Center For Research In Indo

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রাজনৈতিক নানা পালাবদল এবং বাংলাদেশ—ভারত সম্পর্ক

বিভুরঞ্জন সরকারঃ বাংলাদেশের সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

(সেন্টার ফর রিসার্চ ইন ইন্দো-বাংলাদেশ রিলেশনস্ কলকাতা কর্তৃক ২০১0 সালে আয়োজিত সেমিনারে পঠিত)

এক আজ আমরা দুটি পৃথক স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের নাগরিক হলেও মাত্র ছয় দশক আগেও অর্থাৎ গত শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত আমরা একই দেশের অধিবাসী ছিলাম। ১৯৪৭ সালে কোন প্রেক্ষাপটে, কীভাবে দেশভাগ হয়েছিল, সে ইতিহাস এখানে নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনাপর্বটা ছিল ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে ভারতবাসীর ঐক্যবদ্ধ চেতনার বহিঃপ্রকাশ। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মতের এবং পথের ভিন্নতা ছিল কিন্তু ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে দেশভাগের ধারণাটা যোগ হয়েছে একেবারে শেষ দিকে। যুক্ত বাংলাসহ গোটা ভারতবর্ষেই হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের সঙ্গে বসবাস করেছে। এক সঙ্গে রাজনীতি করতে তখন দুই সম্প্রদায়ের মানুষদের তেমন সমস্যা হয়নি। যুক্ত বাংলার হিন্দু সম্প্রদায় শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক কিংবা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে নেতা মেনে নিতে দ্বিধা করেননি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর এই সুসম্পর্ক বজায় থাকেনি। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা হয়েছে। স্বজন-সম্পদহারা হয়েছে দুই সম্প্রদায়ের অসংখ্য মানুষ। নানা প্রচার-অপপ্রচার-কূটকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছে যে হিন্দু এবং মুসলমান এক দেশে এক সাথে বসবাস করতে পারবে না। বৃটিশ শাসকদের ‘ভাগ করো এবং শাসন করো’ নীতি এবং কোন কোন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংকীর্ণতা, অদূরদর্শিতা ও নীতিহীনতার কারণে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষ পর্যায়ে দু’টি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে অনিবার্য করে তুলেছিল। ওই বিভক্তির ফলে বর্তমান বাংলাদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান ছিল বস্তুত একটি কৃএিম রাষ্ট্র। ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন দুটি অংশের আলাদা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অনুসারী মানুষদের কেবলমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করে এক রাষ্ট্রের নাগরিক বানানো হয়েছিল। মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের জীবনে আর কোন সমস্যা থাকবে না, সবাই রাজার হালে থাকবে – পাকিস্তান আন্দোলনের নেতাদের এমন প্রতারণাপূর্ণ প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই পাকিস্তানের পক্ষে এক ধরণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দিয়েছিলেন। যারা এই প্রতারণার বিষয়টি কিছুটা আঁচ-অনুমান করতে পেরেছিলেন, তারাও পরিস্থিতির চাপে বা অন্য যে কারণেই হোক না কেন পাকিস্তানবিরোধী জোরালো অবস্থান গ্রহণ করেননি। দু’একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু সাধারণ স্রোতটা ছিল পাকিস্তানের অনুকূলেই। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর রাজনীতির প্রধান উপজীব্য ছিল হিন্দু এবং ভারতবিরোধিতা। কিন্তু শাসকদের এ ধরণের সাম্প্রদায়িক ও একদেশদর্শী মনোভাব শুরু থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে শাসন-সঙ্কটের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। আর সে জন্যই বাঙালি মুসলমানদের মোহভঙ্গ হতে বেশি সময় লাগেনি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই ‘রাষ্ট্রভাষা’ প্রশ্নে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর প্রকৃত চেহারা বাঙালিদের সামনে উন্মোচিত হতে থাকে। জনসংখ্যার দিক থেকে বাঙালিরা ছিল পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু। সে হিসেবে বাংলাই হওয়া উচিৎ ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বলা হল উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা অর্থাৎ বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতেও তারা কুণ্ঠিত ছিল। উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বেশির ভাগই ছিলেন উর্দুভাষী। সে জন্য শাসকগোষ্ঠীর মুখের ভাষাকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়। আর এ থেকেই বাঙালিরা বুঝতে শুরু করে যে, ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা রাষ্ট্র কায়েম হলেও সে রাষ্ট্রে বাঙালিদের অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে টিকে থাকা সম্ভব হবে না। মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়ার বিষয়টিকে বাঙালিরা একেবারেই ভালো চোখে দেখেনি। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকার রাজপথে অকাতরে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে বাঙালি এক নতুন ইতিহাস রচনা করেছিল। ভাষা আন্দোলনকে ভারতীয় অনুচরদের ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করেও মানুষকে বিভ্রান্ত করা যায়নি। ভাষা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের প্রতি বাঙালির মনে যে ঘৃণার জন্ম নিয়েছিল, তা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ঘটনায় কেবল বেড়েছে। একের পর এক আন্দোলন-সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানের বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীকে অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি, ষাটের দশকে রবীন্দ্রবিরোধিতা তথা বাঙালির ভাষা- সংস্কৃতির ওপর আঘাত, শোষণ-বৈষম্য, পশ্চিম অংশের উন্নয়ন এবং পূর্ব অংশের প্রতি ক্রমাগত বঞ্চনা চলতে থাকায় বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভ- অসন্তোষ ধুমায়িত হতে থাকে। পাকিস্তানে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে তারা সবাই ছিল প্রতিক্রিয়াশীল ধ্যানধারণার অধিকারী, গণবিরোধী ও উচ্চাভিলাষী। গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি তাদের সামান্য শ্রদ্ধাবোধ ছিল না। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় অর্থাৎ পাকিস্তানের পূর্ব অংশে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিদার সংগঠন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ভরাডুবি এবং আওয়ামি লিগের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের অভূতপূর্ব বিজয় রাজনীতিতে নতুন বাতাবরণ সৃষ্টি করে। নির্যাতনের ফলাফল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে শঙ্কিত করে তুলেছিল। বাঙালির ন্যায়সঙ্গত দাবি-দাওয়া সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা না করে শাসকগোষ্ঠী ভুল পথ অনুসরণ করেছিল। ক্রমাগত, সাম্প্রদায়িক প্রচারণা, উগ্র ভারতবিরোধিতা, গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে যারা কথা বলে তাদের ঢালাওভাবে ভারতের দালাল হিসেবে প্রচার করা- এগুলোই ছিল পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর আত্মরক্ষার ঢাল এবং হাতিয়ার। অথচ অতি ব্যবহারে এই হাতিয়ার এক সময় ভোঁতা হয়ে যায় বা কার্যকারিতা হারায়। বাঙালি জাতি ভয়কে জয় করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। দুই ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর হঠাৎ আক্রমণ শুরু করার পরই বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং শুরু হয় এক অসম ও রক্তাক্ত যুদ্ধ। যুদ্ধটা বাঙালির ওপর আকস্মিকভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল সত্য, কিন্তু পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসন-শোষণ, অত্যাচার-নির্যাতনের কারণে এটা ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখা এক পর্যায়ে অসম্ভব হয়েই পড়বে। ভাঙনটা কবে, কীভাবে ঘটবে সেটাই ছিল দেখার বিষয়। পাকিস্তানি শাসকরাই বাঙালিকে স্বাধীনতার দিকে ঠেলে দিয়েছে, প্রতিরোধে বাধ্য করেছে। ধাপে ধাপে আন্দোলনের উত্তরণ ঘটেছে। নতুন নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। আর এসব আন্দোলনের সব পর্যায়েই শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতি ও সক্রিয় ভূমিকা ছিল। তাই বলা যায়, শেখ মুজিবুর রহমান রাতারাতি নেতা হননি। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করতে গিয়ে তিনি ধারাবাহিকভাবে জেল-জুলুম-অত্যাচার সহ্য করেছেন। পাকিস্তানের ২৪ বছরের ১২ বছর কেটেছে তাঁর কারাগারে। তিনি গোড়াতেই এটা উপলব্ধি করেছিলেন যে, পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্য থেকে বাঙালি তার অধিকার পাবে না। এ জন্য পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই। ষাটের দশকের প্রথম দিকেই তিনি আত্মগোপনে থাকা কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আলোচনা শুরু করেছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূল না থাকায় তখনই প্রকাশ্যে এ ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। অপেক্ষা করা হচ্ছিল উপযুক্ত সময় ও সুযোগের। শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সংবলিত ৬ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করার পর পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট, মিলিটারি ডিক্টেটর আইয়ুব খান এবং তার মন্ত্রণাদাতাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে শেখ মুজিব কোন পথে হাঁটছেন, কোথায় তাঁর গন্তব্য। শেখ মুজিবকে ঘায়েল করার জন্য তাঁকে প্রধান আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। আইয়ুব খান ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা ভেবেছিলেন এই ষড়যন্ত্রমূলক রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারা সম্ভব হবে। ভারতের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তান ভাঙার কাহিনী মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠলে শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা শূন্যে নেমে আসবে এবং সেই সুযোগে বিচারের নামে তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলান সহজ হবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটে উল্টো ঘটনা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফলে শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা দ্রুত বেড়ে যায়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ ও অসন্তোষ তীব্র হয়ে ওঠে। শেখ মুজিব কার্যত জাতীয় বীরে পরিণত হয়। শুরু হয় আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রবল ছাত্রগণআন্দোলন। ১৯৬৯ সালের ২৪শে জানুয়ারি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। আইয়ুব খানের ক্ষমতার মসনদ কেঁপে ওঠে। আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করা হয়। শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়। শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় দেশবাসীর পক্ষ থেকে। আইয়ুবের পতন ঘটে। পাকিস্তানে দ্বিতীয়বার সামরিক শাসন জারি হয়। নতুনভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন সেনা প্রধান ইয়াহিয়া খান। জনমতের চাপে ইয়াহিয়া পাকিস্তানে প্রথমবারের মতো এক ব্যক্তি এক ভোট ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দিতে বাধ্য হন। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের পার্লামেন্ট নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামি লিগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্জন করে। শেখ মুজিবের প্রতি বাঙালি জাতের অকুণ্ঠ সমর্থন পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীকে বিচলিত করে তোলে। শুরু হয় নতুন ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত। ইয়াহিয়ার সঙ্গে হাত মেলান পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়া পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল সব রাজনৈতিক শক্তি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে পূর্ব বাংলার মানুষ বিক্ষোভ-আন্দোলনে সামিল হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার এক বিশাল সমাবেশে শেখ মুজিব ঘোষণা করেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো – বাংলার মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো-ইনশাল্লাহ।’ তিনি আরও ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ জুলফিকার আলী ভুট্টোর পরামর্শে ইয়াহিয়া খান আলোচনার নামে কালক্ষেপণের কৌশল গ্রহণ করেন এবং পূর্ব বাংলায় গোপনে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে অসহায় বাঙালি জাতিকে চিরদিনের জন্য দাবিয়ে রাখার লক্ষ্য থেকে শুরু করা হয় নৃশংস হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ। পাকিস্তানিদের সামরিক অভিযানের জবাবে শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। পাকিস্তানের মৃত্যুঘন্টা বেজে ওঠে। সংক্ষেপে এই হল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি। তিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান এক কথায় অতুলনীয়। একথা ঠিক যে, বাংলাদেশের মানুষের অভূতপূর্ব ঐক্য এবং জীবনের বিনিময়ে হলেও স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার দৃঢ়তাই বাংলাদেশকে পাকিস্তানের দখলদার মুক্ত করতে প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে। তারপরও সত্য যে, সেই চরম দুর্দিনে ভারত যদি সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে পাশে না দাঁড়াত তাহলে বাঙালির যুদ্ধজয়টা এত সহজ হতো না। নয় মাসে যে বিজয় অর্জিত হয়েছে, সেটা অর্জনের জন্য হয়ত আরও দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হতো। আরও বেশি জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হতো। সে সময় বাংলাদেশ থেকে ভিটেমাটি সহায়-সম্বল ফেলে প্রায় এক কোটি মানুষকে ভারত আশ্রয় দিয়েছে, খাওয়া-পরার সংস্থান করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং গ্রহণের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া হয়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে সর্বতোভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে মুক্তিযুদ্ধকে সফল পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগী হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে নিরলস পরিশ্রম করেছেন। নিজের এবং ভারতের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়েই তিনি এসব করেছেন। আবার ভারতের সাধারণ মানুষও মানবিকতা ও উদারতার পরিচয় দিয়ে, নিজেরা সব ধরণের কষ্ট-দুর্ভোগ সহ্য করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেছেন। অনেক জায়গায় স্থানীয় অধিবাসীদের চেয়ে শরণার্থীর সংখ্যা ছিল বেশি। এই প্রবল জনচাপে স্থানীয়ভাবে যেসব সমস্যার উদ্ভব হয়েছিল, সেগুলো ভারতবাসী হাসিমুখে মেনে না নিলে সরকারও হয়ত বিপাকে পড়ত। বলা যায়, ভারতের সরকার এবং জনগণ ‘একমন এক প্রাণ’ হয়েই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি ভারতীয় সেনাবাহিনীও সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন এবং কমপক্ষে ১৮ হাজার সৈন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। এটা অবশ্যই একটি অসাধারণ ঘটনা। চার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতির বীরত্বপূর্ণ লড়াই এবং ভারতের নিঃশর্ত সমর্থনের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় উপমহাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। নতুন রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য শেখ মুজিবের সরকার জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র – এই চারটি মূল নীতিকে গ্রহণ করায় বাংলাদেশের এক সম্ভাবনাময় যাত্রা শুরু হয়েছিল। সাম্প্রদায়িকতা ও ভারতবিরোধিতার অবসান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক ও উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কারণ সাম্প্রদায়িক ও অগণতান্ত্রিক নীতি-মানসিকতার ধারক-বাহকদের প্রত্যক্ষ যুদ্ধে পরাজিত করেই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল। বাংলাদেশে আবার সাম্প্রদায়িক ও বিভেদকামী শক্তি মাথা তুলতে পারবে, সেটা নবজাত বাংলাদেশে কষ্টকল্পনার বিষয় ছিল। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় যে, নতুন স্বপ্ন, উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের যাত্রাটা একেবারে নিষ্কন্টক হয়নি। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত রাজনৈতিক শক্তি প্রকাশ্য তৎপরতার অধিকার হারিয়ে গোপনে সংগঠিত হয়ে প্রতিশোধ গ্রহণের পথ খুঁজতে থাকে। পরাজিত পাকিস্তান প্রতিশোধ স্পৃহা থেকে তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে থাকে। মসজিদ ও মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হওয়া এই অপশক্তি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এবং সাহায্যকারী মিত্র শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে নানা ধরণের অপপ্রচার চালাতে শুরু করে। পাকিস্তানিরা পরাজয়ের আগে বাংলাদেশকে মূলত ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। নয় মাসের যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি ছিল ব্যাপক। ত্রিশ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছে, দুই লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছে, কোটি কোটি মানুষ ভিটেমাটি হারা হয়েছে। সম্পদ ধ্বংস হয়েছে অজস্র। এই ধ্বংসযজ্ঞের ভিতর থেকে দেশকে পুনর্গঠন করে মানুষের জীবনকে আলোকিত করার কাজটি সহজ ছিল না। এই অবস্থায় স্বাধীন দেশের নতুন সরকার পরিবর্তিত রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক জটিলতাকে গুরুত্ব দিয়ে উপলব্ধি করার বদলে, যুক্তির চেয়ে আবেগনির্ভর হয়ে চলায় সমস্যা বাড়তে থাকে। সে সময় ক্ষমতাসীনরা মনে করেছিলেন, পাকিস্তানিদের যেহেতু পরাজিত করা গেছে, সেহেতু এখন আর কোনকিছুই বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। ফলে সব কিছু হাল্কাভাবে দেখা হয়েছে। এছাড়া বিজয়ী রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে ছিল বিভেদ-বিভ্রান্তি। শত্রুর বিরুদ্ধে যে ধরণের লাগাতার ও ঐক্যবদ্ধ আদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনার প্রয়োজন ছিল সেটা চালানো হয়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আওয়ামি লিগ নেতৃত্বের দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা, ক্ষেত্রবিশেষে দোদুল্যমানতা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছিল। দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। কিছুটা বেসামাল হয়েই যেন সঙ্কট মুক্তির পথ হিসেবে জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একদলীয় শাসন প্রবর্তন করেন। এতে তাঁর দীর্ঘদিনের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তিনি যেন কিছুটা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এই অবস্থায় ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে যারা সহজভাবে মেনে নেয়নি, স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব যাদের পীড়িত করেছে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সৌহার্দের সম্পর্ক যারা ভালোভাবে দেখেনি, তারাই যে এই হতযাকাণ্ড ঘটিয়েছে সেটা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির উল্টো যাত্রা শুরু হয়। হত্যা ও অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা বদলের পাকিস্তানি ধারার সঙ্গে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও ভারতবিরোধিতার নীতি আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে যা কিছু খারাপ তার জন্য ভারতকে দায়ী করার পুরনো প্রবণতা নতুন করে মাথাচাড়া দেয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রধান সুবিধাভোগী, সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান সংবিধান সংশোধন করে ধর্ম নিরপেক্ষতার নীতি বাদ দেন। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করার জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আশির দশকে আরেক সামরিক ডিক্টেটর এইচ এম এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে দেশের অমুসলিম জনগোষ্ঠীকে কার্যত দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করেন। ‘ধর্ম যার যার – রাষ্ট্র সবার’ এই নীতির চরম ব্যত্যয় ঘটে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হয়। সরকারিভাবে রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার ফলেই এক পর্যায়ে বাংলাদেশে উগ্র জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে। জঙ্গীবাদ যে সভ্যতার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ও ভয়ঙ্কর এক মতবাদ—এটা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। পাঁচ তবে আশার কথা এটাই যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যেমন প্রবল জনমত রয়েছে, তেমনি নানা উত্থান-পতন সত্ত্বেও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষাও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মধ্যেই রয়েছে। অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক শাসনের পক্ষে মানুষের অবস্থানের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। ওই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ‘মহাজোট’ বিপুল বিজয় অর্জন করেছে। মহাজোট সরকার আবার দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে নেবে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ এবং অগণতান্ত্রিক শাসনের পথ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, এটাই এখন বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা। আশাবাদী হয়ে ওঠার মতো কিছু কিছু উপাদান এখনই দেখা যাচ্ছে। দেশে আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে শেখ হাসিনার সরকার। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হয়েছে এবং বিচারের রায়ও কার্যকর করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত পাঁচ খুনিকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। বিদেশে পলাতক অন্য খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের রায় কার্যকর করতেও সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এছাড়া ইতিমধ্যেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হিসেবে প্রত্যক্ষভাবে বিরোধিতা করেছে, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট-অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে তাদের বিচারের উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে। এটা একটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করতে পারলে রাজনীতিতে অনেক স্বচ্ছতা ফিরে আসবে বলে আশা করা যায়। এই বিচার কাজ সম্পন্ন হলে বাংলাদেশ দায় ও গ্লানিমুক্ত হবে। যে স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করা হয়েছিল, তা পূরণের পথে অগ্রসর হওয়ার সম্ভাবনা আবার নতুন করে দেখা যাবে। ছয় সবশেষে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে দু’একটি কথা। এটা স্বীকার না করে উপায় নেই যে, একাত্তরে রক্তের অক্ষরে দুই দেশের মধ্যে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রচিত হয়েছিল তা পরবর্তী সময় একই মাত্রায় বহাল থাকেনি। রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাত দুই দেশের সম্পর্কের ওপরও প্রভাব ফেলেছে। একাত্তরে ভারতীয় ট্যাঙ্ক ও সৈন্যবাহিনী যখন শ্ত্রুমুক্ত করতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিল, তখন সাধারণ মানুয়ষ তাদের হর্ষধব্বনি করে, ফুল দিয়ে বরণ করেছিল, স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ভারতের ব্যাপারে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে এই স্বতঃস্ফূর্ত উৎসাহ আর থাকেনি।এর পিছনে অনেক রাজনৈতিক কারণ নিশ্চয়ই আছে। বাংলাদেশের ভিতরে ভারতবিরোধী শক্তির অবস্থান ও অপতৎপরতা এবং পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পরবর্তী সরকারসমূহের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য যেমন এ ক্ষেত্রে কাজ করছে, তেমনি বড় দেশ হিসেবে ভারতের বাংলাদেশের প্রতি অনুদার মনোভাবের দায়ও হয়তো একেবারে কম নয়। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আন্তরিকতা দেখিয়েছে ভারত সেরক্ম দেখায়নি — এমন সমালোচনা বাংলাদেশের আছে। এ সমালোচনা অমূলক নয়। ফারাক্কার জলবণ্টন, সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি, ছিটমহল সমস্যার সমাধানে ভারতের অবস্থান বাংলাদেশের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। আবার এটাও সত্য যে, মুজিব-পরবর্তী বাংলাদেশের সরকারগুলোও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার তাগিদ অনুভব করেনি। উলটে ন্যায্য-অন্যায্য সব ক্ষেত্রেই ভারতবিরোধিতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে, এমনকি ভারতকে শত্রু রাষ্ট্র গণ্য করে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে বাংলাদেশে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে, যা স্বভাবতই ভারতকে বিরক্ত করেছে। দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তার প্রভাব লক্ষ করা গেছে। সাত শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে নতুনমাত্রায় উন্নত করতে আগ্রহী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এই সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানকে যেমন খাটো করে দেখে না, তেমনি দুই দেশের ক্ষেত্রে যেসব জটিলতা গণবিরোধী অনির্বাচিত কিম্বা নির্বাচিত প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তৈরি করা হয়েছিল তা দূর করতেও সমান আন্তরিক। বর্তমান সময়ে বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটও অনেক বদলে গেছে। এক সময় যেসব দেশ ছিল পরস্পরের শত্রু, তারাও এখন বৈরিতা পরিহার করে সম্প্রীতি ও সমঝোতার দিকে ঝুঁকছে। এক সময় দেওয়াল তুলে এক দেশকে দুইভাগ করা হয়েছিল, অথচ এখন সে দেয়ালও ভেঙে ফেলা হয়েছে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াতের অবাধ সুযোগ এখন এক সাধারণ ঘটনা। আমাদেরও দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। একে অপরকে দোষারোপ করার ভেদনীতি পরিহার করে পারস্পরিক সমঝোতা বা বোঝাপড়ার ঐক্যসূত্র খুঁজে বের করতে হবে। সব পক্ষকেই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। বাংলাদেশের বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ ভারত। ভারত বর্তমান সময়ে বিশ্বের উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি। অকারণ ভারত বিরোধিতার বিলাসিতা বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়, এটা বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই বোঝেন। ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক না থাকলে বাংলাদেশের পক্ষে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জন করে সামনে এগিয়ে যাওয়া কঠিন। তবে এক্ষেত্রে বড় দেশ হিসেবে ভারতেরও দায়িত্ব আছে। ছোট দেশ বলে বাংলাদেশকে উপেক্ষা করা উচিত নয়। বাংলাদেশের আস্থা অর্জন করা, বাংলাদেশের মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকাই সবচেয়ে অধিক। (সংক্ষেপিত)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *