Center For Research In Indo

একুশের চেতনার অবক্ষয়

Dr. Kakoli Sarkar

 ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটি বাংলাদেশের শহীদ দিবস, ভারতবর্ষে তথা সমগ্র বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্কুল, কলেজে, এমনকি ক্লাবগুলিতেও উৎসাহ–উদ্দীপনা চোখে পড়ার মতো। এ কথা ঠিক যে, উৎসাহ–উদ্দীপনা হবারই কথা কারণ, পশ্চিমবঙ্গের জনগণেরও মাতৃভাষা বাংলা। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ভারতবর্ষের ত্রিপুরা রাজ্যে, আসামের দক্ষিণাঞ্চলে এবং আন্দামান–নিকোবার দ্বীপপুঞ্জে অধিকাংশ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। কিন্তু ওইসব অঞ্চলে ২১শে ফেব্রুয়ারি উদযাপন নিয়ে উৎসাহ–উদ্দীপনা পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় অনেক কম। বিগত ৪/৫ বছর ব্যাপি পশ্চিমবঙ্গে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন নিয়ে আতিশয্য চোখে পড়ার মতো। আমি একথা বলছি না যে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পশ্চিমবঙ্গে পালন করার প্রয়োজন নেই। আমি জানি বিশ্বের প্রতিটি জাতির মাতৃভাষার মর্যাদা ও স্বাধিকার রক্ষা করার অধিকার আছে। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে যে বিষয়টি আমি লক্ষ্য করেছি, তা হল– পশ্চিমবঙ্গে ২১ শে ফেব্রুয়ারি উদযাপন করতে গিয়ে অনেকেই ভুলে যাচ্ছেন আমরা বাঙালি হলেও ভারতীয়। তাদের কাছে ভারতীয় হয়ে ওঠাটা যেন এক কষ্টকর বিষয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি পালন করতে গিয়ে তারা বাংলাদেশের অনুকরণে শহীদ দিবস পালন করছেন। বাংলা ভাগ নিয়ে তারা বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করছেন। প্রশ্ন উত্থাপন করাটা দোষের কিছু নয়, কিন্তু কেউ যদি মনে করে আমাদের এক ভাষা তাই আমাদের এক রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়াটা উচিত, তাহলে সেটা নিশ্চয়ই দোষের। বিগত বছরে ২১শে ফেব্রুয়ারি উদযাপন উপলক্ষে আমি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার নিকটবর্তী একটি স্থানে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিই। সেখানে কিছু বক্তা যা বললেন তার সারাংশ হল এই, “বাংলা ভাষাকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে তাচ্ছিল্য করা হয় এবং বাঙালীদের হেয় প্রতিপন্ন করা হয়, সে কারণে আমাদের উচিত হিন্দি ভাষা পরিত্যাগ করা। আমরা কেন হিন্দি শিখবো, ইত্যাদি ইত্যাদি।” আমি সেই অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, “আপনি জাতীয় সংহতি নষ্ট করছেন”। আমার বক্তব্য ঠিক এখানে। পশ্চিমবঙ্গের জনগণ কেবল বাঙালিই নয়, তারা ভারতীয়ও বটে। তাদের বাঙালিত্ব কেউ কেড়ে নিচ্ছে না। নিজেরা তাদের অন্তরে বাংলা ভাষা তথা মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা রাখুন। তাই বলে জাতীয় সংহতি আপনি নষ্ট করতে পারেন না। মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধার আতিশয্য দেখাতে গিয়ে বাংলাদেশের সংস্কৃতি পশ্চিমবঙ্গে নিয়ে আসছে ( বিভিন্ন স্থানে বৃহৎ আকারের শহীদ মিনার তৈরি করার ধুম পড়ে গেছে)। কেউ অবশ্য বলতে পারে, বাংলাদেশের এবং পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিগত মিল আছে, পার্থক্য নেই। কিন্তু তা সঠিক নয়। পশ্চিমবঙ্গের সাথে বাংলাদেশের সংস্কৃতিগত কিছু মিল থাকলেও পার্থক্য আছে। সরস্বতী পুজোতে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের শাড়ি পড়ে ঘুরে বেড়ানো পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, বাংলাদেশের নয়। সামনে দোল। দোলের আগে বুড়ির ঘর পোড়ানো পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতি, বাংলাদেশের নয়। বর্তমানকালে বাংলাদেশে ইসলামী মৌলবাদের প্রসারের ফলে সংস্কৃতিগত অনেক পার্থক্য এসেছে। ১৯৯২–৯৩ সালে আমি বাংলাদেশের রাজবাড়ী সরকারি কলেজে একজন মাত্র মেয়েকে বোরকা পড়ে যেতে দেখেছি, কোন হিজাব পরা মেয়ে দেখিনি। কিন্তু বর্তমানে ঐ কলেজে ৯০% মেয়ে বোরকা অথবা হিজাব পরে কলেজে যায়। বিগত দুই দশকে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে বহু পরিবর্তন হয়েছে। সেই পরিবর্তনগুলি থেকে আমরা বাঁচতে পেরেছি কি? উত্তর হল, না। কিছুটা পরিবর্তন পশ্চিমবঙ্গেও হয়েছে এবং হচ্ছে। বাংলাদেশে ইসলামী মৌলবাদ যেমন নারী সমাজকে প্রায় অবরুদ্ধ করে ফেলেছে, পশ্চিমবঙ্গেও তেমনি নারী সমাজ অবরুদ্ধ হতে শুরু করেছে। বর্তমানকালে বাংলাদেশের পরিচয় দেবার সময় বাংলাদেশের বহু নেতা উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ ৯০% মুসলমানের দেশ, কিন্তু অন্য ধর্মাবলম্বীরাও সুরক্ষিত থাকবে। কিন্তু প্রশ্ন হল, ৯০% মুসলমানের দেশ বলে কোনো দেশের পরিচয় দেওয়া যায় কি? তারা তো কেউ এই কথা বলে না যে, বাংলাদেশ ৫০% নারীরও দেশ, বহু লোক দারিদ্র সীমার নিচে বাস করে–বাংলাদেশে এইরকম একটি দেশ। এ কথা ঠিক যে, পশ্চিমবঙ্গের এবং বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান পূর্ব থেকেই হয়ে আসছে। বর্তমানকালে যেটা দেখা যাচ্ছে তা হল আমরা না বুঝেই বাংলাদেশের সংস্কৃতি কেবল নিতে ব্যস্ত। করোনা কালে আমি লক্ষ্য করলাম, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ওয়েবনার গুলি আয়োজন করা হয়েছিল, তার মধ্যে বহু ওয়েবনারে স্পিকার হিসাবে ছিলেন বাংলাদেশের বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। যদি প্রশ্ন করি, বাংলাদেশে যে সব ওয়েবনার হয়েছে তার মধ্যে আমরা পশ্চিমবঙ্গের কজন শিক্ষক স্পিকার হিসেবে আমন্ত্রণ পেয়েছি? তাহলে তার উত্তর পাওয়া কঠিন। আমাকে খুঁজে দেখতে হবে কজন আমন্ত্রণ পেয়েছেন। বাংলাদেশের শিল্পী সাহিত্যিক অবশ্যই আমাদের কাছে আদরণীয়। আমরা তাদের আমন্ত্রণ করি এবং করবো। কিন্তু প্রশ্ন হল, তারা আমাদের কতজনকে আমন্ত্রণ করছে। কেবল বাংলাদেশের বইয়ের জন্য পৃথক বইমেলার আয়োজন করা হয়। গত বছর ডিসেম্বরে কলকাতার কলেজ স্কয়ারে ২ থেকে ১১ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশের বইমেলা উদযাপিত হলো। সেখানে ৬৮ টি স্টল ছিল, যেখানে বাংলাদেশের ৭৫টি প্রকাশনা সংস্থা অংশ নেয়। আমরা সকলে উৎসাহের সঙ্গে বাংলাদেশের বই কিনেছি। এটা অবশ্যই ভালো ব্যাপার। কিন্তু প্রশ্ন হল, বাংলাদেশে কবার ভারতের বইমেলা হয়। ভারতবর্ষে কি বড় চিন্তক নেই, ভালো সাহিত্যিক নেই, নাকি ভালো বই নেই। তবে কেন তারা আমাদের বই কেনার জন্য ডাকে না? এই প্রশ্নগুলি খুব স্বাভাবিক। 

২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য গৌরব–গাঁথা। সেদিন বাংলাদেশে  (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) বাঙালিরা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। জীবনের বিনিময়ে তারা বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছে। এই ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশ অধিক তাৎপর্যপূর্ণ এই জন্য যে, এই গণআন্দোলনের মধ্যে দিয়ে এক গণজাগরণ এবং চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল। সেই চেতনা ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চেতনা। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যখন দেশভাগ হয় তখন পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) যে চেতনা ছিল তা নিশ্চয়ই ধর্মভিত্তিক চেতনা। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগের মাসে অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ জিয়াউদ্দিন আহমেদ প্রস্তাবিত পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে উর্দুর পক্ষে দারুণভাবে ওকালতি করেন। তিনি বলেন, “ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সংহতি বজায় রাখার জন্য যেমন হিন্দি ভাষাকে সেই দেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেবার বিষয়টি একরকমভাবে চূড়ান্ত হয়ে গেছে, ঠিক তেমনিভাবে প্রস্তাবিত পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার লক্ষ্যে উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার বিষয়টিও চূড়ান্ত করা অপরিহার্য”।১  

সেই তখন থেকেই অর্থাৎ দেশভাগের পূর্ব থেকেই এই বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। তখন থেকেই বাঙালিরা এর বিরোধিতা করে আসছিল। তবুও দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হলো এবং তারা (বাংলাদেশীরা) ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পাকিস্তানের সাথে ঐক্যবদ্ধ হলেন। কিন্তু দেশভাগের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করতে পারলেন ধর্মীয় চেতনা প্রধান হতে পারে না। ধর্মীয় চেতনার ধাক্কায় তারা নির্যাতিত, নিপীড়িত। তাদের মধ্যে তখন অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ ঘটে। ফলে ভাষা আন্দোলনে তা প্রকট হয়ে ওঠে এবং সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণাও বটে। ১৯৭১ সালে জন্ম নিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের। সেই জন্য বাংলাদেশের কাছে ভাষা আন্দোলনের চেতনা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যারা পশ্চিমবঙ্গের জনগণ আমাদের মধ্যে এই চেতনার দ্বন্দ্ব কোনদিন ছিল না, থাকার কথা নয়। ভাষা শহীদই যদি মূল আলোচ্য বিষয় হয় তাহলে ১৯৬১ সালে আসাম রাজ্যে যেসব বাঙালি বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিল আমরা পশ্চিমবঙ্গের জনগণ কজন তাদের কথা স্মরণ করি, বর্তমান প্রজন্মে জানেই বা কজন। বাংলাদেশ যদি সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধরে রাখতে পারতো তাহলে পশ্চিমবঙ্গের সাথে সংস্কৃতিগত এত পার্থক্য তৈরি হতো না, আর এই লেখার অবতারণা করারও প্রয়োজন পড়তো না। ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির সাথে ধর্ম সাপেক্ষ সংস্কৃতির পার্থক্য অবশ্যই আছে– একথা স্বীকার করতে হবে এবং উপলব্ধি করতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ তৈরি হয়েছিল– একথা ঠিক, তাই বাঙালি বাদেও বাংলাদেশে ৫০ টি জনজাতি মনে করেছিল তারা স্বাধীন দেশ পেলো। সেই ৫০ টি জনজাতির ভাষা সংস্কৃতির উপর বর্তমানে যে আঘাত এসেছে তার খবর আমরা কজন রাখি। পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা জনজাতির উপর আঘাত নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশে হিন্দুদের যেমন আশ্রয়স্থল ভারত, বৌদ্ধ–খ্রিস্টান বা চাকমাদেরও আশ্রয়স্থল সেই ভারত।

 আমাদের সমস্যার গোড়ায় যেতে হবে। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ১৯৭৪ সালেই যারা বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে দেন এবং দেশ গঠনের কাজে আহ্বান জানান। সাংঘাতিক অপরাধে অভিযুক্তরা যখন বিচার ব্যতিরেকে সহজেই মুক্তি পেয়ে যায়– তখন যে সমাজে কোন শৃঙ্খলা থাকে না, আদর্শের বিচ্যুতি ঘটে যায়, রাষ্ট্র ব্যবস্থা নড়বড়ে হয়ে পড়ে, শেখ মুজিব যদি তা বুঝতে পারতেন তাহলে আজকের বাংলাদেশে আমরা ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের অস্তিত্ব খুঁজে পেতাম । মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বা ইতিহাস নিয়ে এত বিতর্ক তৈরি হতো না, বাঙালি জাতীয়তাবাদের মাথায় ইসলামী উম্মার নিশান পতপত করে উড়তো না, ভাষা আন্দোলন শুধু আচার অনুষ্ঠানে পর্যবসিত হতো না। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *