Center For Research In Indo

ডলারের পরিবর্তে বাংলাদেশ – ভারতের টাকা ও রুপিতে বৈদেশিক বাণিজ্য

শঙ্কর সরকার, বাংলাদেশ

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের একটি যুগান্তকারী অধ্যায় শুরু হয়েছে দুই দেশের মধ্যে ডলারের পাশাপাশি টাকা ও রুপি দিয়ে বাণিজ্যিক লেনদেন পদ্ধতি শুরু করার মাধ্যমে। বাংলাদেশ যদি কোনো পণ্য অন্য যে কোন দেশ থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলে (লেটার অব ক্রেডিট) আমদানি করতে চায় তাহলে ডলার দিয়ে কিনতে হবে এবং পাশাপাশি বাংলাদেশ যদি কোন পণ্য যে কোন দেশে রফতানি করতে চায় তাহলে ডলারের মধ্যমে কেনা-বেচা করতে হবে। অর্থাৎ বৈদেশিক বাণিজ্য করতে আমেরিকান ডলার একটি অতি অপরিহার্য মুদ্রা। এই ডলার যদি বাজারে কম থাকে তাহলে সকল দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ক্ষতি হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে মার্কিন ডলারের বিকল্প যদি আমদানি ও রপ্তানিকারক দেশ দুটি নিজস্ব মুদ্রার মাধ্যমে আমদানি রফতানি বাণিজ্য করতে পারে তাহলে সেটা উভয় দেশের জন্য মঙ্গলজনক। তাতে ডলারের উপরে নির্ভরশীলতা অনেকটা কমে যাবে। ব্যতিক্রম ছাড়া বিশ্বের সব দেশের সাথে বাংলাদেশ এতদিন ডলারেই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য করে আসছে। ব্যতিক্রমের মধ্যে যেমন চীনা মুদ্রা ইউয়ানে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা এলসি খুলতে পারেন। ভারত অবশ্য ডলারের পাশাপাশি নিজস্ব মুদ্রা রুপিতে অনেক দেশের সাথে বাণিজ্য শুরু করেছে অনেক আগেই। তবে দেশটি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের সাথে শুরু করেছে রুপিতে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য। ভারত ২০২৩ সালের জুলাই মাস থেকেই রুপিতে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য করার কার্যক্রম উদ্বোধনের মাধ্যমে শুরু করেছে। বাংলাদেশ ও ভারতের উভয় সরকারের পক্ষ থেকে আপাতত ভারতীয় মুদ্রা রুপিতে এলসি খোলার মাধ্যমে বানিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। পরে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকা দিয়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে। তবে মার্কিন ডলারে বাণিজ্য কার্যক্রম চলার বিষয়টি আগের মতোই উন্মুক্ত থাকবে। ভারতের বিশ্ববিখ্যাত টাটা মোটরসের বাংলাদেশী এজেন্ট মেসার্স নিটল মটরস্ রুপিতে এলসি খোলার মাধ্যমে ভারতীয় গাড়ির প্রথম চালান বাংলাদেশে আমদানী করে এই যুগান্তকারী বাণিজ্যিক কার্যক্রমের শুভ সূচনা করেন। ভারতের সঙ্গে কারেন্সি সোয়াপ ব্যবস্থা বা নিজস্ব মুদ্রা বিনিময়ের মাধ্যমে উভয় দেশের আমদানি রফতানি বাণিজ্য করার আলাপ আলোচনা চলছে এক যুগ ধরে। তবে কোভিড শুরু এবং রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অনেক দেশের মত বাংলাদেশেও ডলার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি সামলাতে বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এ অবস্থায় ভারতের রাজধানী দিল্লিতে গত বছরের ডিসেম্বরে যখন দুই দেশের বাণিজ্য মন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক হয় তখন ভারতের পক্ষ থেকে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের মাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশী মুদ্রা টাকা ও ভারতীয় মুদ্রা রুপি ব্যবহাররের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে প্রস্তাব নেওয়া হয়। এরপর ভারতের বেঙ্গালুরুতে গত ২৪-২৫শে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জি ২০ ভুক্ত দেশগুলোর অর্থমন্ত্রী ও গভর্নরদের সম্মেলনের এক ফাঁকে দুই দেশের গভর্নরদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উভয় গভর্নর এই কাজটি দ্রুত গতিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে একমত হন। ডলার বা অন্য কোন মুদ্রা এড়িয়ে দুই দেশ যখন নিজেদের মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্যিক কাজকর্ম পরিচালনা করাকে আর্থিক পরিভাষায় বলে কারেন্সি সোয়াপ ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় অর্থাৎ ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য করতে বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাঙ্ক ভারতের ষ্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (এস বি আই) এবং আই সি আই সি আই ব্যাংক কিছু দিন আগে হিসেব খোলার অনুমতি দিয়েছে। এ হিসেবের নাম নষ্টর হিসাব। নষ্টর হিসাব খোলা নিয়ে বাংলাদেশের ও ভারতের চার ব্যাঙ্কের মধ্যে চিঠি চালাচালি এখনো চলছে বলে জানা গেছে। এক দেশের এক ব্যাঙ্ক অন্য দেশের কোন ব্যাঙ্কে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের হিসেব খুললে সেই হিসেবকে নষ্টের হিসেব বলা হয়। অনুরূপভাবে বিদেশের কোন ব্যাঙ্ক যদি বাংলাদেশের কোন ব্যাঙ্কে একই উদ্দেশ্য হিসেব খুলে থাকে তাকে বলা হয়েছে ভষ্ট্র হিসেব। বাংলাদেশ ইস্টার্ন ব্যাঙ্ক ও সোনালী ব্যাঙ্কের মাধ্যমে আপাতত রুপিতে এলসির মাধ্যমে ভারতের সাথে বাংলাদেশ বৈদেশিক বাণিজ্যে আমদানি রপ্তানি চলবে পরে অন্যান্য সিডিউলড ব্যাংকের মাধ্যমেও রুপিতে ভারতের সাথে আমদানি রফতানি বাণিজ্য বাংলাদেশের সাথে ভারতের চলবে। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থাৎ রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া (আরবিআই ) ইতিমধ্যে বাংলাদেশের ইস্টার্ন ব্যাংকের নষ্টর হিসাব খোলার অনুমতি দিয়েছে। ঠিক একইভাবে হিসাব খুলতে সোনালী ব্যাংক আরবিআইয়ের অনুমতি পেতে পারে দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে। আপাতত ভষ্ট্র হিসেব খোলার দিকটি বিবেচনায় থাকছে না বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূএগুলি জানায়। রুপির পাশাপাশি বাংলাদেশের মুদ্রা টাকাও যখন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে তখন ভষ্ট্র হিসেব খোলার বিষয়টি আসবে। কার্যক্রমটি ঢাকাতে উদ্বোধন করেন উভয় দেশের গভর্নরগন। সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেছেন বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশ পরস্পরের সঙ্গে আলাপ আলোচনা, পরীক্ষা নিরীক্ষা, এবং সুবিধা অসুবিধা যাচাই করে রুপিতে এলসি খুলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য শুরু হল এক নতুন পদ্ধতিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী 2021-22 অর্থবছরে বাংলাদেশ মোট আট হাজার নয়শ ষোল কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করে, এর মধ্যে এক হাজার তিনশ ঊনসত্তর কোটি ডলারের পণ্যের আমদানি করে ভারত থেকে। একই অর্থ বছরে বাংলাদেশ ভারতে রফতানি করে দুইশ কোটি ডলারের পণ্য। আমদানি রফতানি মিলিয়ে উভয় দেশের মধ্যে ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয় ওই অর্থ বছরে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থ বছরেও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের একই প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ ভারত চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি ও ইফাদ গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান তাসকিন আহমেদ এ নিয়ে বলেন, ডলারের বিকল্প ভাবনা করা ছাড়া আমাদের উপায় নেই। ভারতে আমরা যে ২০০ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করি সেটা রুপি দিয়ে করা যাবে। তবে খাদ্য পণ্যসহ অতি প্রয়োজনীয় পণ্যকে রুপিতে আমদানি করতে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। অবশ্য ডলারের সঙ্গে রুপির বিনিময়ে হার কত হবে, সেটা কি বাজার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে, তা এখনও ঠিক হয়নি বলে জানা গেছে। আন্তর্জাতিকভাবে অর্থনৈতিক লেনদেনের জন্য বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃত নয় ভারতীয় রুপি, আবার বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রয়েছে বড় ধরণের বাণিজ্যিক ঘাটতি। ফলে রুপিতে লেনদেন করতে বাংলাদেশ কোন ধরণের ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে কি না এমন প্রশ্নও রয়েছে। তাছাড়া এই পদ্ধতিতে বাণিজ্যিক কাজকর্ম যেহেতু শুরু হয়েছে তাই এই পদ্ধতি শুধু পণ্য বাণিজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। ভ্রমণ, চিকিৎসা, শিক্ষা, ইত্যাদি বিষয়ে ব্যবহার হবে। বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের প্রায় কেন্দ্রস্থলে। বাংলাদেশ সরকার তার বিশ্ব বাণিজ্য অত্যন্ত শক্তিশালী করতে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের পাশাপাশি চালনা ও পায়রা বন্দর আরও বেশি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ও দ্রুত গতিশীল বন্দর তৈরি করতে কাজ করে যাচ্ছে। তাছাড়া স্থল ও বিমান বন্দরগুলোর সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন করার জন্য কাজ করছে। বাংলাদেশ আয়তন অনুযায়ী একটি ছোট দেশ হলেও জনসংখ্যা ১৫, ২০ টি মধ্যপ্রাচ্যের অথবা ইউরোপীয় দেশগুলোর সমান। তাই স্বাভাবিক ভাবেই বাংলাদেশের একটি বড় বৈদেশিক বাণিজ্য থাকবে সবসময়। এখন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ভারতের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের গভর্নর গত ১৯শে জুন দেশের মুদ্রানীতি প্রণয়নের সময় বলেছেন টাকার পাশাপাশি রুপিতে ব্যবহার করা যাবে, পে কার্ড নামে এমন একটি ডেবিট কার্ড নিয়ে আসছে বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক। বাংলাদেশিরা ভারতের যে কোন স্থানে ঘুরতে গেলে এ কার্ড দিয়ে লেনদেন করবেন এবং কার্ডটি চালু হলে বাংলাদেশের জনগণের জন্য ডলার খরচ কমবে। গভর্নরের মতে কেউ ভারতে ভ্রমণের জন্য গেলে ভ্রমণকারীদের ১২ হাজার ডলারের যে ভ্রমণ কোটা আছে সে পরিমাণ অর্থ তিনি রুপিতে কেনাকাটা করতে পারবেন। সেনটার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন ভারত একটি বড় অর্থনীতির দেশ। এত বড় অর্থনীতির দেশের সাথে রুপিতে বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে ঝুঁকির বিষয়টা বিবেচনায় রাখতে হবে। তবে এটা ঠিক ২০০ কোটি ডলার রফতানির সমপরিমাণ ভারতীয় রুপির বাণিজ্য শুরু হতেই পারে। কী নিয়ে সতর্কতা জরুরি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন এক কথায় মুদ্রা বিনিময় হার নিয়ে।এ দিক থেকে বাংলাদেশ যেন ক্ষতির ভাগীদার না হয়। তিনি বলেন এদিক থেকে ইতিবাচক যে রুপিতে লেনদেন শুরুর মাধ্যমে বৈদেশিক বাণিজ্যে বাংলাদেশে এক পরিবর্তন আসছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *