Center For Research In Indo

দ্রুতগতির দুনিয়ায় বাংলাদেশ মেট্রোরেলের বিভিন্ন দিক ও বাস্তবতা

সুদীপ কুমার আচার্য্য

বর্তমান বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামি লিগ সরকার জন উন্নয়নের স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মেট্রোরেল প্রকল্পের একটি অংশের সম্প্রতি কাজ সমাপ্ত করলেন এবং জনগণের জন্য MRT 6  নামক লাইনটিকে (উত্তরা – আগারগাঁও) উদ্বোধন করা হল গত ২৮ শে ডিসেম্বর ২০২২। বর্তমানে এটিকে সর্বসাধারণের জন্যে খুলে দেওয়া হয়েছে। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন ভাড়া যথাক্রমে ৬০ ও ২০ টাকা।  স্বাধীনতা দিবসে অর্থাৎ  ২০২৩ এর ২৬শে মার্চ উত্তরা – আগারগাঁও রুটে পূর্ণাঙ্গভাবে মেট্রোরেল পরিষেবা শুরু হয়ে যাবে। রাজধানী ঢাকার রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম ও ভিড়ভাট্টার ভয়ঙ্কর অবস্থা চলে আসছে বছরের পর বছর। ঢাকা মহানগরীতে প্রায় ২ কোটি মানুষ বাস করেন। মুঘল আমলে ঢাকার নাম ছিল জাহাঙ্গীরনগর, সপ্তদশ শতক থেকেই ঢাকা একটি বাণিজ্য কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়। পরবর্তীতে ব্রিটিশ যুগ থেকেই ঢাকা ছিল এক বর্ধিষ্ণু নগরী।  কালের পট পরিবর্তনে তার উপর চাপ আরও বেড়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু যানজটের বিভীষিকায় নাকাল হন সাধারণ মানুষ থেকে, অফিসযাত্রী, মুমূর্ষু রোগী থেকে পর্যটনে আসা বিদেশী নাগরিক। সুতরাং এই মেগা প্রকল্পটি নেওয়ার অন্যতম লক্ষ্য ঢাকাকে পরিচ্ছন্নভাবে, সুষ্ঠুভাবে এবং সুন্দর করে তোলা। যানজট থেকে মুক্তি  এবং মানুষের দুদর্শা লাঘব করা। এই প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছিল ২০১৩ সালে। ২০১৬ সালের ২৬শে জুন প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। MRT 6 লাইনটির স্টেশন নির্মাণ সংখ্যা সংশোধিত হয়ে ১৭টি (কমলাপুর পর্যন্ত) হয়। মেট্রো ৬ এর আংশিক উদ্বোধন উপলক্ষে দিয়াবাড়ীতে যে সমাবেশের আয়োজন করা  হয়েছিল তা নিয়ে উৎসাহের অন্ত নেই। এই উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়েছে  (পঞ্চাশ টাকার স্মারক নোট)। উন্নয়নের মুকুটে অবশ্যই এটি একটি নতুন পালক সংযোজন। ২০৩০ সালের মধ্যে মেট্রোরেল নেটওয়ার্ক  পুরোপুরি সম্পন্ন হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। মতিঝিল পর্যন্ত MRT 6 লাইনের কাজ আংশিকভাবে সমাপ্ত হয়েছে (৮৬%)। বাংলাদেশের প্রযুক্তিবিদরা MRT 6  লাইনে চার পাঁচবার পরিবর্তন করেছেন।  মেট্রো প্রকল্পে আসল ঋণ ১৬,৫৯৫ কোটি টাকা, ২.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা মেট্রোরেল প্রকল্পে সর্বমোট বাজেট। মেট্রোরেল প্রকল্পে যে পরিমাণ শক্তি বা বিদ্যুৎ ব্যয় হবে তা প্রতি ঘণ্টায় ১৩.৪৭  মেগাওয়াট। এর জন্য ৫টি Power supply station  তৈরী করা হয়েছে। অর্থাৎ কোন একটি লাইনে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলে মেট্রো পরিষেবা ব্যাহত হবে না। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে হোটেল সোনারগাঁও থেকে বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক পর্যন্ত দূরত্ব ৪.৪০ কিলোমিটার, তৃ্তীয়  ক্ষেত্রে পল্লবী থেকে উত্তরা লাইনটির দূরত্ব হবে ৪.৭ কিলোমিটার। পুরোটাই মাটির ওপর  ওভারব্রিজের ওপর দিয়ে যাবে। মাটি থেকে উচ্চতা রাখা হয়েছে ১৩ মিটার  যাতে নীচ দিয়ে গাড়ি, ঘোড়া, সাধারণ মানুষও সমানতালে চলতে পারে। উত্তরা থেকে সোনারগাঁও ২১.২৬ কিলোমিটার প্রায় ৩৮ মিনিটে যাওয়া যাবে। পূর্বে আধঘণ্টার পথ যেতে এক ঘণ্টার অধিক সময় লাগত, ক্ষতি হত অর্থনীতির, নষ্ট হত মূল্যবান সময়। মনে করা হচ্ছে যে এবার তা থেকে মুক্তি মিলবে ।  এই প্রকল্পে মোট খরচ ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৫৯ লক্ষ টাকা। যার মধ্যে জাইকা নামক জাপানি উন্নয়ন সংস্থা ব্যয় করেছে ৭৫ শতাংশ (১৭ হাজার কোটি) বাকী টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। এর ফলে ব্যবসা বাণিজ্যে গতি আসতে চলেছে। সময় সংক্ষেপের ফলে উপকৃত হবে অনেক মানুষ। উত্তরা থেকে মতিঝিল সাত জোড়া ট্রেন চলবে। প্রত্যেক ট্রেনে অন্তত ২৩০০ যাত্রী চলাচল করতে পারবে। গতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার। টিকিট একমুখী কাটা যাবে। ডেইলি প্যাসেঞ্জাররা স্মার্ট কার্ড ও পরে রিচার্জের মাধ্যমে  কাজ চালাতে পারবে।  মেট্রোর এই প্রকল্প নিয়ে  ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ও জাপান সরকারের  পক্ষ থেকে সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষর সম্পাদিত হয়েছে।

 

DMRTC নামক সরকারি প্রতিষ্ঠান এই প্রকল্পটির তদারকি  শুরু করেছে। পূর্বেই মিরপুর স্টেশন থেকে ২০২১ এর ২৯ নভেম্বর এবং আগারগাঁও থেকে ২০২১ এর ১লা ডিসেম্বর পরীক্ষামূলকভাবে যাত্রা শুরু করেছিল।  এর যাত্রী পরিবহণ ক্ষমতা হবে প্রত্যেক দিন প্রায় ১ লক্ষ। তবে বাস্তবে কতটা কার্যকারী হবে তা পূর্ণভাবে ট্রেন চলাচল শুরু নাহলে বলা যাবে না। মেট্রোরেলে ৬টি বগি থাকছে। দিয়াবাড়ি (উত্তরা নর্থ)  থেকে আগারগাঁওয়ের ভাড়া ৬০ টাকা। জীবনযাত্রার মান এতে হবে উন্নত। গতিময়তার যুগে এর যে বিশেষ প্রয়োজন ছিল তা বলাই বাহুল্য।  মরিয়ম আফিজা মেট্রোরেলের প্রথম চালিকা ছিলেন এবং গত বুধবার ২৮শে ডিসেম্বর তার ট্রেনে প্রথম যাত্রীর নাম জননেত্রী শেখ হাসিনা। যাঁরা মেট্রোরেল চালাবেন তাঁদের ট্রেনিং সম্পন্ন হয়েছে। আফিজা ছাড়াও ছয়জন মহিলা চালক আছে।  জাপানের মিতসুবিশি-কাওয়াসাকি কোম্পানির এক্সপার্টরা কারিগরি প্রশিক্ষণ যেমন  দিয়েছেন তেমনই দেশীয় প্রযুক্তি ও অপারেটিং সিস্টেমের ট্রেনিংও কর্তৃপক্ষ চালকদের দিয়েছেন। কিছুদিন আগেই জাপান থেকে ব্যাংকক হয়ে একটি জাহাজ মেট্রোরেলের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, কোচ ইত্যাদি নিয়ে বাংলাদেশের মংলা বন্দরে আসে। এরপর এগুলিকে workshop এ নিয়ে এসে ফিটিংস করা  হয়। মেট্রো কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে প্রায় ৫২ জন প্রযুক্তিবিদ নিয়োগ করেছেন মেট্রোর ষোলটি বিভাগে। পাশাপাশি ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড প্রায় ৩৩০ জন অভিজ্ঞ কর্মচারী নিয়োগ করছেন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে।

 ঢাকা মেট্রোর পরিকাঠামো অত্যাধুনিক। তিনতলা স্টেশন। রেলকোচের ভিতরে দিব্যাঙ্গ (Physically challenged), বয়স্ক নাগরিক (Senior Citizen) এবং অন্তঃসত্ত্বা মা  (Pregnant Mother) যাত্রীদের জন্য আসন সংরক্ষণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঘোষণা করেছেন যে মুক্তিযোদ্ধা ও তার পরিবারের সদস্যরা মেট্রোয় যাতায়াতে আংশিক ছাড় পাবেন। আপতকালীন ব্যবস্থাও করা হয়েছে। সকাল ৮টা  থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত আপাতত মেট্রো পরিবহণ শুরু হয়েছে। কিন্তু দিন ও রাতের পূর্ণাঙ্গ পরিষেবা পেতে আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে।  একটির নির্মাণ চলছে আরও পাঁচটির নির্মাণ হবে। পরিকল্পনা করা হয়েছে ১০৪টি স্টেশন বানানোর যেখানে ভুগর্ভস্থ ৫৩টি ও উড়ালপুল হয়ে যাবে ৫১টি। (মোট ১২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ বানানোর  পরিকল্পনা রয়েছে) অন্যান্য লাইনগুলি  হলঃ MRT 1   (বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর ) MRT 1   পূর্বাচল যাত্রাপথ ( নতুন বাজার থেকে তিলগঞ্জ, MRT2 গাবতলী চট্টগ্রাম রোড। MRT5          (উত্তর যাত্রাপথ)  (হেমায়েতপুর – ভাটরা), MRT5 (দক্ষিণ যাত্রাপথ) গাবতলি কল্যাণপুর শ্যামলী সোনারগাঁও হাতিরঝিল আফতাবনগর হয়ে দাশেরকান্দি)।  ২০৩০ সালের মধ্যে সমস্ত প্রকল্প সমাপ্ত করবার চেষ্টা চলছে। সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য এর ফলে নিশ্চিতভাবেই আসবে। নতুন এক আর্থিক দিশা পাবেন বাংলাদেশের মানুষ। কিন্তু পাতালরেল অর্থনীতির  সমীকরণে মূলত উপকার হবে উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত বা অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন এক শ্রেনীর বিত্তশালীর, সরকারী আয় বাড়বে, দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। কিন্তু প্রায় ৭০ শতাংশ নিম্নবিত্ত ও গ্রামীণ জনসাধারণের  জীবনযাত্রার বিশেষ রকমফের ঘটবে বলে মনে হয় না।

 

সমীক্ষা অনুসারে ঢাকায় যে ৩ লক্ষের অধিক রিকশাচালক আছেন তাদের রুটিরুজি পথ চলতি মানুষের যাতায়াতের ভাড়ার ওপর নির্ভর করে যা সামাজিকভাবে একটি শ্রেণিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। রিকশা অর্থনীতি মেট্রোর এই গতিময়তার যুগে খুব একটা প্রভাবিত হবে বলে মনে করা হচ্ছে না। যারা আংশিক দূরত্ব অতিক্রম করবেন তাদের জন্য  মেট্রোর উপযোগিতা কম। কারণ ঢাকা ছাড়াও আরও  নানান অফিস ও বাণিজ্যকেন্দ্র এবং গুরুত্বপূর্ণ  শহরগুলির ভিতরে এখনো মেট্রো পোঁছায়নি। সাধারণ মানুষের  ধরাছোঁয়ার মধ্যে টিকিটের দাম না আনতে পারলে সাধারণ মানুষও বিশেষ উপকৃত হবে না। সর্বশেষে বলি একবার জনৈক  সাংবাদিক চিনের চেয়ারম্যান মাও-সে-তুং কে  জিজ্ঞাসা করেছিলেন সমাজে ফরাসী বিপ্লবের কী উপযোগিতা বা প্রভাব দেখা যায়?  মাও বলেন  `It is too early to say’. একইভাবে সম্প্রতি মেট্রো প্রকল্পের যে অঙ্কুরোদগম হল এখনই তার সুদূরপ্রসারী ফলাফল নিয়ে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলার সময় আসেনি।  

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *