Center For Research In Indo

ধর্মীয় সন্ত্রাস ও ইসলামের শিক্ষা

বিমল প্রামাণিক

 

বিগত কয়েক দশক আমাদের সামনে বহুল আলোচিত ও ঘটনাবহুল একটি বিষয় বিদ্যমান রয়েছে – যা হল অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ। বিশেষভাবে বলতে গেলে ধর্মীয় সন্ত্রাস। আর এইসব সন্ত্রাসের প্রধান অঞ্চল বা দেশসমূহ – যেখানে মুসলমান জনগোষ্ঠীর বসবাস। অর্থাৎ যেখানে ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটেছে। এই প্রবন্ধ মূলতঃ ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ ভূখণ্ডের  মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

ইসলাম ধর্ম কোন জাতিসত্তায়  বিশ্বাস করেনা, তাদের ধারণায় মুসলমান একটি  জাতি।  ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের  পিছনেও মুসলমানরা ‘দ্বিজাতি তত্ত্বের’ একটি অসার যুক্তি দাঁড় করিয়েছিল।  তখন থেকেই মুসলমানরা পাকিস্তান কায়েমের দাবীতে  হিন্দু তথা ভারতবর্ষের  প্রতি প্রবল বৈরী আচরণ এমনকি কলকাতা, নোয়াখালির ব্যাপক গণহত্যা সংঘটিত করেও বাঙালি মুসলমান বাংলা ভাগ না করে ছাড়ে নাই। কিন্তু মাত্র পঁচিশ বছর সময় কালেই সেই যুক্তি আস্তাকুঁড়ে  ফেলে দিয়ে বাঙালি মুসলমান, বাঙালি জাতিসত্তা আঁকড়ে ধরার একটা চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। অনেকে বলে  থাকেন এটা বাঙালি মুসলমানের সাময়িক বিভ্রম বা বিভ্রান্তি। তা না হলে এরপর  প্রায় পাঁচ দশক রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে একটি ইসলামি গোঁজামিলতন্ত্র নীতির  অবতারণা করা হয়েছিল যা ক্রমান্বয়ে  দেশকে কট্টর  ইসলামিতন্ত্রের  দিকে ঠেলে দেয়।

অন্যদিকে পাকিস্তান রাষ্ট্রটির গোড়াপত্তনের  ভিত তৈরি হয়েছিল কট্টর  ইসলামিতন্ত্রের আদলে। যা একসময় পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানগণ মনেপ্রাণে  বিশ্বাস করতো  যার ফলে তারা  দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগকে সমর্থন করেছিল।  

বাঙালি মুসলমান যে কখনও বাঙালি জাতিসত্তা আঁকড়ে ধরতে পারে নাই তার প্রধান কারণ ‘ইসলাম ধর্ম’। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও অধ্যাপক আহমদ শরীফের বিশ্লেষণ নিম্নরূপঃ “আমাদের জাতিপরিচয় সমস্যার মত এমন অদ্ভূত দুঃসাধ্য সমস্যা পৃথিবীর কোন দেশের বা ভাষার মানুষের আছে কিনা জানিনা। যে চেতনা থেকে মানুষ প্রাণরস আহরণ করে,  সত্তার স্বরূপ অনুভব উপলব্ধি করে, সে চেতনাটিই আমাদের এখনও অস্পষ্ট ও অপূর্ণ। এখনও অনির্ণীত  ছায়া, নিরবয়ব অনুভূতি মাত্র। ব্যক্তি মানুষেরও আশৈশব সুনির্দিষ্ট তিনটি পরিচিতি থাকে – এগুলো তিনটি প্রশ্নের আবশ্যিক ও জরুরী উত্তর। কি নাম, কোথায় নিবাস এবং কি বৃত্তি – এ তিনটির উত্তরই ব্যক্তি মানুষের  পরিচিতির আবশ্যিক ভিত্তি এবং আত্ম পরিচয়ের এ তিনটি ভিত্তি সবারই  দৃঢ়। ব্যতিক্রম বিপর্জয়-জাত মাত্র।

দৈশিক-ভাষিক-জাতিক রাষ্ট্রিক জীবনেও তেমনই একটি অভিন্ন সত্তা  চেতনায় ঐক্য ও একাত্মতা অনুভব না করলে একটা দৈশিক-ভাষিক-রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক  জাতি-চেতনা দানা বাঁধতে পারে না।  এ অভিন্ন সত্তা-চেতনা বা জাতি চেতনা থেকেই অভিন্ন উদ্দেশ্যে এবং সিদ্ধি-সাফল্যের লক্ষ্যে রাষ্ট্রিক জীবনে ভাব-কর্ম-আচরণ নিরূপিত, নিয়মিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়, একটা জাতি গড়ে ওঠে। আমাদের বেলায় তা আজও হয়ে ওঠেনি।“ …

মুসলমান সমাজে বাঙালি জাতিসত্তাবোধ গভীরে প্রবেশ না করায় বাঙালি জাতিরাষ্ট্র গঠনে যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, ১৯৭২ সালেই সামনে এসেছিল, ১৯৭৫ এর পটপরিবর্তন তা চিরতরে অবসান ঘটিয়েছে বললেও অত্যুক্তি হবে না। ভারতবর্ষে  মুসলিম আগ্রাসনের ইতিহাস মুসলমানরা স্বীকার করে না। হাজার হাজার হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন মন্দির মুসলমানদের দ্বারা ধ্বংস হয়েছে, লুন্ঠিত হয়েছে, লক্ষ লক্ষ অমুসলিমদের হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, নারী-শিশু  লুণ্ঠিত হয়েছে, প্রাণভয়ে বাধ্য হয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ ধর্মান্তরিত  হয়ে মুসলমান হতে বাধ্য হয়েছে –  এ  ইতিহাস পাকিস্তান-বাংলাদেশে পড়ানো হয়না। তারা শুধু  বোঝে ভারতে মুসলমান আক্রমণকারীগণ বীর, মহান, উদার, দয়াশীল।  তাদের শাসনকালে শান্তি আর সমৃদ্ধি অন্তহীন। তারা ভাবতে পারে না,  ভারতে এখন আর ইসলামি শাসন নাই। ইসলামি আমলের দুষ্কর্মের প্রতিবিধান করা ভারতবাসীর নৈতিক এবং সামাজিক অধিকার। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মতো বর্বর শাসন এবং সমাজব্যবস্থা ১৯৪৭ সালের পরে ভারতে গেড়ে বসতে পারে নাই।  এদেশে মুসলমানরাও নাগরিক অধিকার নিয়ে এখনও বসবাস করছে। স্বাধীনতা উত্তর (দেশ বিভাগোত্তর) পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে মুসলমানদের মনে এবং মননে হিন্দু-বিদ্বেষ ও ভারত-বিদ্বেষের যে বীজ প্রতিনিয়ত বপন করা হয়েছে – তার ফল হয়েছে বিষময়। তা দূর করা মোটেই সহজ নয়। যতদিন না পঠন-পাঠনে, গবেষণায় এবং জীবন-চর্চায়  ভারতে আটশত বছরের মুসলমান (আরব) সাম্রাজ্যবাদী শাসনের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরা হচ্ছে – ততদিন বাংলাদেশে ভারত-বিদ্বেষের অবসান সম্ভব নয়। ভারতের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অধিকাংশ মুসলমান  নিজেদেরকে ভারতীয় বলে গর্ববোধ করলেও – একটা বড় সংখ্যক মুসলমান জনগোষ্ঠী আটশত বছরের ইসলামি  শাসনের অতীত গর্ব এখনও ভুলতে পারে নাই বা বলা যায় ভুলতে দেওয়া হচ্ছে না। তারা ভারতকে ‘দারুল হার্ব’ বা যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করে এবং বিশ্বাস করে একদিন তারা বিজয়ী হবে – এটাই জিহাদ, কোরাণ-সুন্নাহ-শরীয়ার নির্দেশ। এটাই প্রকৃ্ত ইসলাম! আর বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে তো সকল মুসলমানেরা এটাই মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে। ভারত সরকার মুসলমানদের দলবদ্ধ জিহাদের ভিত নড়িয়ে দিয়েছে তাই নানা পন্থায় ব্যক্তিগত জিহাদ চলছে। কিন্তু বাংলাদেশে দলবদ্ধ জিহাদ বারে বারে ঘটে চলেছে।  

বাংলাদেশের মুসলমান বুদ্ধিজীবীরা বড় অসহায়। তারা না দাঁড়াতে পারেন কোন নির্বাচিত সরকারের দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে  ঋজু হয়ে, না করতে পারেন ইসলামের নামে জনগণের অপকর্মের কোন সুরাহা। কারণ তারাও তো ইসলামের বাইরে নয়। কুরান-সুন্নাহ তো  তাদের না মানলে চলে না। জনমতের বাইরে যাওয়ার মত শিরদাঁড়া সোজা রাখতে কজনই বা পারেন। ১৯৪৬ এর নোয়াখালির গণহত্যা, পাকিস্তানের ১৯৪৯-৫০ সনের  গণহত্যা, ১৯৬২, ১৯৬৪ এর দাঙ্গা ও গণহত্যা এবং ১৯৭১ এর ব্যাপক দাঙ্গা এবং গণহত্যার ইতিহাস থেকে এটাই আমাদের অভিজ্ঞতা। স্বাধীন বাংলাদেশেও একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। স্বাধীন বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকারের আমলে ১৯৯০, ১৯৯২, ২০০১—২০০৪, হিন্দু বিরোধী দাঙ্গায় বুদ্ধিজীবীরা বারবার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন – নির্বাচিত সরকারগুলির উপর তার কি কোন  প্রভাব পড়েছে ? বুদ্ধিজীবীদের কোন পরামর্শ বা প্রস্তাবে কোন সরকার কি দাঙ্গা প্রতিরোধে  স্থায়ী ব্যবস্থা নিয়েছে?  অপরাধীদের গ্রেফতার বা বিচারের কাঠগড়ায়  হাজির করা সম্ভব হয়েছে? এক কথায় না। এটাই হল পাকিস্তান বা বাংলাদেশের ঐতিহ্য। অমুসলমানদের উপর সংঘটিত কোন অপরাধের বিচার হয় না। এক্ষেত্রে  নির্বাচিত বা অনির্বাচিত  সরকারের সঙ্গে কোন তফাৎ নাই। ২০২৪-২৫ সালের ভয়াবহ সংখ্যালঘু নির্যাতন, গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, বাড়িঘর, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, লুট তো বর্তমান সরকার স্বীকারই  করতে চায় না। এটাই হল ইসলামের শিক্ষা। কুরান-সুন্নাহর  সারকথা। অমুসলমানদের নির্যাতন কর, হত্যা কর, ইসলামে ধর্মান্তর  হতে বাধ্য কর। এটাই চৌদ্দশ বছরের  ইসলামি ইতিহাসের শিক্ষা। ভারতবর্ষের ইসলামি শাসনের ইতিহাসও এর বাইরে কিছু নয়। সাম্প্রতিক কাশ্মীরের গণহত্যা তো এই ইসলামি ইতিহাসেরই  পরম্পরা।

 

 



Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo.

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *