Center For Research In Indo

নানামুখী প্রতিবন্ধকতায় বাংলাদেশের প্রিন্ট মিডিয়া

Dr. Kakoli Sarkar

 

 যে কোনো রাষ্ট্রের জনমত গঠনের ক্ষেত্রে গণমাধ্যম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে বর্তমানে যে মৌলবাদী বাড়বাড়ন্ত তার পিছনে সে দেশের গণমাধ্যমের অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের মধ্যে কেবলমাত্র প্রিন্ট মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে আমি অতি সংক্ষেপে দু চার কথা বলতে চাই।

বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর তখন বাংলাদেশে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ছিল দশটি, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দৈনিক আজাদ, ইত্তেফাক, পূর্বদেশ, দৈনিক অবজারভার, দৈনিক বাংলা। তবে বাংলাদেশে প্রথম দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় বিজয়ের দুদিন পরে, অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর। সেই দিন বাংলাদেশের সকল পত্রিকায় ফুটে উঠেছে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বিজয়ের আনন্দ আর শহীদ পরিবারগুলোর অশ্রুবেদনাগাঁথা। সেই সময় বাঙালি জাতীয়তাবাদী ঝড়ের কাছে ইসলামপন্থী পত্রিকাগুলির আত্মগোপন করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। তবে জামায়াতে ইসলামী দলের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম তখনও প্রকাশিত হতো। জামায়াতে ইসলামী দলের মুখপত্র এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হতে শুরু করে ১৭ই জানুয়ারি ১৯৭০ থেকে। ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই পত্রিকাটি বিভিন্নভাবে স্বাধীনতাকামী মানুষের বিপক্ষে, রাজাকার ও পাকিস্তানিদের পক্ষে, মিথ্যা, বানোয়াট ও বিভ্রান্তিমূলক খবর ছেপে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিল। তবে এই পত্রিকার পাঠক সংখ্যা ছিল হাতে গোনা অর্থাৎ খুবই অল্প। কেবলমাত্র জামাত–শিবিরের কর্মীদের মধ্যেই এই পত্রিকাটি সীমাবদ্ধ ছিল।

বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইন জারির মাধ্যমে সংবাদপত্রের নিয়ন্ত্রণে সরকারকে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়। ১৯৯০ এর পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে পত্রপত্রিকাগুলির বিশেষ কোন স্বাধীনতা লক্ষ্য করা যায় না, সরকার দ্বারা তাদের গন্ডি সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৬ই জুন বাংলাদেশ সরকার দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, দ্য বাংলাদেশ অবজারভার ও দ্য বাংলাদেশ টাইমস্ এই চারটি পত্রিকা ছাড়া বাকি সব পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। তবে ওই বন্ধ পত্রিকাগুলির কর্মীরা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন পেতেন। ১৯৭৬ সাল থেকে পুরানো পত্রিকাগুলি আবার ধীরে ধীরে প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত বাংলাদেশে সংবাদপত্র স্বৈরশাসকের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সরকারের সমালোচনামূলক খবর ছাপানোর অভিযোগে যখন তখন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হতো। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ সরকারের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিশেষ ক্ষমতা আইনের মাধ্যমে ১৬-১৭ এবং ১৮ নং ধারা অবলুপ্ত করলে সেন্সরশিপ ও প্রকাশনা নিষিদ্ধ সংক্রান্ত আইনের বিলুপ্তি ঘটে। ১৯৯০ এর পর থেকে পত্রপত্রিকার প্রকাশনার সংখ্যাটা বিশেষভাবে বেড়ে যায়। ফলে ১৯৭৫ সালের পর থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত বাংলাদেশে পত্রিকার জগতে যে ইসলামী মৌলবাদের প্রবেশ তা সরকারের প্রত্যক্ষ মদতেই ঘটেছিল। বাংলাদেশের সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং হোসেন মোহাম্মদ  এরশাদ উভয়ই ইসলামী মৌলবাদের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এই সময় কালের (১৯৭৫–৯০) মধ্যে বাংলাদেশে ইসলামী মৌলবাদ প্রচারে যে পত্রিকাটি সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সেটি হল ইনকিলাব। ইনকিলাব যেন বাংলাদেশের বুকে এক গভীর চক্রান্ত। আমরা জানি জামাতে ইসলামী দলের মুখপত্র হিসাবে দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকাটি ছিল এবং যেটি অবশ্যই ইসলামী মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষক ও পাকিস্তানপন্থী। কিন্তু ইনকিলাব এর সাথে দৈনিক সংগ্রামের পার্থক্য হল, দৈনিক সংগ্রামের পাঠক ছিল কেবলমাত্র জামাত শিবিরের সদস্যরা, কিন্তু ইনকিলাব একটি ব্যাপক অংশের পাঠক হাতে নিয়েই যাত্রা শুরু করে। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের একটি অংশকে পুঁজি করেই এই পত্রিকাটি শুরু হয়। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সংগঠনের নাম ‘জমিয়াতুল মোদারেসিন’ । এই জমিয়াতুলের অনুরোধেই দৈনিক ইনকিলাবের প্রকাশ বলে জানা যায়। ১৯৮৬ সালে মাওলানা আব্দুল মান্নানের উদ্যোগে এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। মাওলানা আব্দুল মান্নান আবার জমিয়াতুলের প্রধানও ছিলেন। মাওলানা আব্দুল মান্নানের পরিচয় হলো তিনি একজন রাজাকার, স্বাধীনতা বিরোধী। ১৯৭১ সালে এই আব্দুল মান্নান ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করে ডক্টর আলিম চৌধুরীর হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাকে ‘নর পিশাচ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবাদের অপরাধী হিসেবে সে কিছুদিন জেল খাটে। তারপর জেনারেল এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতায় জেল থেকে বেরিয়ে এসে সে  এরশাদের মন্ত্রিসভায় প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে। এখানে আব্দুল মান্নান ইনকিলাব পত্রিকা প্রকাশের পূর্বেই প্রতিটি কামিল মাদ্রাসাকে ১২ কপি করে পত্রিকার গ্রাহক হবার নির্দেশ দেয়। ফলে পত্রিকা প্রচারের আগেই এর প্রচার সংখ্যা দাঁড়ায়  ১ লক্ষ ২৮ হাজার আর তার আয় দাঁড়ায় ৭ কোটি ৬৮ লক্ষ। বিভিন্নভাবে মৌলবাদের বিষ মাদ্রাসাগুলিতে ছড়ানো এবং এরশাদ সরকারের গুণ কীর্তন করা– এটাই ছিল তার পত্রিকার উদ্দেশ্য। বিভিন্ন রকম গুজব ছড়ানোতে এই পত্রিকার জুড়ি মেলা ভার। তসলিমা নাসরিন থেকে শুরু করে বাবরী মসজিদ ধ্বংস, কোনো কিছুতেই এই পত্রিকা গুজব ছড়াতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেনি। ‘রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম’ প্রচারের পক্ষে এই পত্রিকাটি এরশাদের পাশে  থেকে সহযোগী হিসেবে ব্যাপকভাবে প্রচারকার্য চালিয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, ইনকিলাবের টাকার কাছে বহু বিশিষ্টজন বিক্রি হয়ে গেলেন, তাই তারা মুখ বন্ধ করে থাকলেন।

বর্তমানে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে নষ্ট রাজনীতিকদের মিডিয়া মালিক হওয়া রোধ করা যাবে না। তাই বর্তমানে  বাংলাদেশ সরকার ইচ্ছা করলেও আর মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। বাংলাদেশের অর্থনীতির অনেকখানি  অংশ জুড়ে বসে আছে তৎকালীন রাজাকার, আলবদর বা পাকিস্তানপন্থী গোষ্ঠী, যারা ইসলামী মৌলবাদের প্রচারক। তাদের শিকড় এখন অনেক গভীরে, বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। বর্তমান সময়ে গণমাধ্যম পরিচালনাও একটি ব্যবসা। এই ব্যবসাটির অনেকখানি অংশ দখল করে আছে পাকিস্তানপন্থী ইসলামী মৌলবাদী গোষ্ঠী। এই সবকিছুর মধ্যেই কিছু পত্রিকা আছে যারা সাংবাদিকতার নৈতিকতাকে মনে রেখে চলতে চেষ্টা করেন। এখনো বাংলাদেশে কিছু প্রণম্য সাংবাদিক আছেন যাঁরা বোঝেন গণমাধ্যম পরিচালনার ব্যবসা অন্য ব্যবসা থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। তাই এখনো সংবাদপত্রেই দাবি ওঠে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসবে ছুটি প্রদানের। কেননা বাংলাদেশে সংবাদিকদের এগারো দিন ছুটি ঘোষিত আছে, এর মধ্যে নয় দিনই ইসলাম ধর্মকেন্দ্রিক ছুটি, একদিন পয়লা বৈশাখের ছুটি, আর একদিন মে দিবসের ছুটি। এর বাইরে জাতীয় তিন দিবসে তিনটি সরকারি ছুটি, তবে ওই ৩ দিন বিশেষ ব্যবস্থায় পত্রিকা বের হয়। অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসবে কোনরকম ছুটি নেই। যাই হোক, অর্থনীতিকে বাদ দিয়ে কোন কিছুই হতে পারে না। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনীতির যারা নিয়ন্ত্রক শক্তি হবে তারা গণমাধ্যমকেও নিয়ন্ত্রণ করবে। এখন সেটাই দেখার অপেক্ষা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *