বিমল প্রামাণিক
বড় দেশের পাশাপাশি ছোট দেশ থাকলেই যে পারস্পরিক সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকবে না ইতিহাসে এমন কোন স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম দেখা যায় না। আবার পড়শি দেশের সঙ্গে বৈরি সম্পর্কের দৃষ্টান্তও পৃথিবীতে বিরল নয়। যেমন ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক। দেশভাগের কারণে সৃষ্ট দুটি দেশ জন্মলগ্ন থেকেই শত্রুভাবাপন্ন হওয়ার প্রধান কারণ ধর্মীয় ভিন্নতা, তিক্ততা। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পঁচাত্তর বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনও কি শত্রুতার পারদ কিছুমাত্র নীচে নেমেছে? এবিষয়টি নিয়ে নানা বিশ্লেষণ, তথ্য এবং ইতিহাস আমাদের দেশের নাগরিকদের জানা থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ইতিহাস সরল রেখায় চলে না। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল বিচ্ছিন্ন হয়ে যে নতুন দেশ গঠিত হল – সে দেশ পাকিস্তান আন্দোলনের মূল ভাবনা দ্বিজাতিতত্ত্বই শুধু অস্বীকার করলো না, বাঙালি জাতীয়তাবাদকেই আঁকড়ে ধরল। পাকিস্তান আন্দোলনের প্রাক্কালে বাঙালি মুসলমান নেতৃত্ব ইসলামি রাষ্ট্রের মোহে মুসলমানকে বাঙালি জাতিসত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করেই শুধু ভাবতে শুরু করলো না, বাঙালি হিন্দুদের পূর্ব-পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত করা তাদের অন্যতম প্রধান কাজ বলে মনে করতে লাগলো। সরকারিভাবে হিন্দু বাঙ্গালিরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়ে গেল। ভারতবর্ষকে প্রধান শত্রুতে পরিণত করে ফেলতেও ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানের চিন্তা চেতনায় আটকাল না। অথচ বিরাট সংখ্যক মুসলমান বাঙ্গালি-সহ ভারতে থেকে গেল ভারতের অন্যান্য নাগরিকের সমঅধিকার নিয়ে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও তাদের নাগরিক অধিকার খর্ব হল না।
এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে স্বাধীন বাংলাদেশের মুসলমান নেতৃবৃন্দ এবং জনগণ বাঙালি জাতিসত্ত্বা-ভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ কতটুকু মেনে নিতে পেরেছিলেন? মাত্র চারবছরেরও কম সময়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ঘোষণা ও পরিচালনাকারী মূল নেতৃবৃন্দকে কীভাবে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব হল? যারা ক্ষমতা দখল করলো তারাও তো বাঙালি মুসলমান! জাতীয়তাবাদী ভাবধারা থেকে রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা ইসলামি ভাবধারা প্রতিষ্ঠা করল, অনেকে বলেন পাকিস্তানিকরণ – তারাও তো বাঙালি মুসলমানই! তবে কি বাঙালি জাতিসত্তাভিত্তিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানের সমর্থন ছিল না ? না কি তারা পাকিস্তানপন্থী মুসলমানদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন? মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে একটি বড় সংখ্যক বাঙালি মুসলমান যে পাকিস্তানি সেনা শাসন ও অত্যাচারের সহযোগী হিসাবে পূর্ব-পাকিস্তানকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিল – আমরা তার প্রত্যক্ষদর্শী। তারা মোটেই কম শক্তিশালী ছিল না। হেন গর্হিত অপরাধ নেই যা তারা করেনি। স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পরে বাংলাদেশ সরকার ঐ সকল পাকিস্তানি দালাল ও ঘোরতর যুদ্ধাপরাধীদেরকে হাতে ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিচার করতে ব্যর্থ হল কেন? সেই সব যুদ্ধাপরাধীর তালিকাই বা জনসমক্ষে আনা হল না কেন? সেইসব পাকিস্তানি বাঙালি সেনা, পুলিশ, রাজাকার, আলবদর প্রভৃতি ও নয়মাস পাকিস্তান সরকারের চাকরিতে রত দালালগণ, মুক্তিযুদ্ধের যারা প্রধান শত্রু ছিল – তাদের বিচার-বিবেচনা ব্যতিরেকে সাধারণ ক্ষমতার আওতায় এনে নতুন স্বাধীন দেশের সমাজ-সংস্কৃতি–প্রশাসন এবং সর্বোপরি নীতি-আদর্শকে কি রক্ষা করা সম্ভব ছিল? না, তা যে কত বড় ভুল ছিল ১৯৭৫ সালের মধ্যেই নেতৃবৃন্দের সমূলে উৎপাটন ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পাকিস্তানি ভাবাদর্শে পুনরায় প্রতিষ্ঠাকরণ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও কি বাঙালি তা থেকে শিক্ষা নিতে পেরেছে? আজকে অর্ধ-শতাব্দি পেরিয়ে এসেও আমরা কি দেখছি – তা বলার প্রয়োজন আছে বলেই মনে করি।
“Frequent failure of living with a multicultural ethos has jeopardized communal harmony, and defaced the secular fabric of the society. Islamization has always been, historically a `power concept’. When a secular forces come forward to protect social harmony on the basis of a dominant culture with a highly powerful assimilating forces, forces of Islamization might claim their due and finally crave for a division of the same, assertive secular society.” …
After the assassination of Sheikh Mujib in 1975, the relevance of the very Bangladesh concept of 1971 was lost, and Bangladesh became a state tilting towards Islamization. All this shows that the emergent idea of a secular Bangladesh, partially apparent in 1971, was not only missing but was probably mistaken.”1
মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশে যে আদর্শের দোদুল্যমানতা, অর্ধশতক অতিক্রম করেও তার অবসান তো ঘটলোই না – বলা যায় আরও জটিলতা বেড়েছে। নানা স্বার্থবাদী রাজনৈতিক শক্তি, যারা মুক্তিযুদ্ধের ঘোরতর শত্রুতা করেই ক্ষান্ত হয়নি বরঞ্চ অতি দ্রুত বাংলাদেশকে পাকিস্তানিকরণের স্বপ্নে বিভোর ছিল, তারাই আজকে গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রামে অবতীর্ণ । গণতন্ত্র হত্যার দায় যারা কোন যুক্তিতেই এড়িয়ে যেতে পারে না – তাদের দ্বারা নাগরিক এবং মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বিশ্বাসযোগ্য হবে কেন? তাদের পূর্বসূরি, যারা বাংলাদেশের মানুষের নিকট অপরিচিত নয়, তাদের দুষ্কর্মের ইতিহাস — বাঙালিদের স্মৃতিশক্তি যতই ক্ষণস্থায়ী হোক –- তা এত অল্প সময়ে মুছে ফেলা যাবে কি? জনগণের গণতন্ত্র চর্চার দাবির মান্যতা যদি তৎকালীন পাকিস্তানে স্বীকৃতি পেত, তবে উপমহাদেশের মানচিত্র ভিন্নতর হতে পারতো। বর্তমানের শাসক সম্প্রদায় একথা অনুধাবন করে বলেই বাংলাদেশের মানুষের এখনও সরকারের প্রতি বিশ্বাস রয়েছে। যেহেতু জনগণই গণতন্ত্রে ক্ষমতার চাবিকাঠি, তাই তাদের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে। বর্তমান আওয়ামি লিগ সরকার বার বার একথা উচ্চারণ করায় জনগণের আস্থা অটুট থাকবে একথা আশা করা অমূলক নয়।
পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আজকে জোরগলায় একথা বলছেন যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পূর্ব-পাকিস্তানে বর্বর গণহত্যা চালিয়ে পাকিস্তানের ইতিহাস কলঙ্কিত করেছিল। যদিও ইমরান খান বাহান্ন বছর পর একথা বলেছেন ব্যক্তিগত স্বার্থে। পাকিস্তানি মুসলমান নেতৃবৃন্দ একথা কখনও স্বীকার করেনা। এটা মুসলমান আক্রমণকারীদের জেহাদের অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের অঙ্গ। আজ যারা বাংলাদেশে তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রবক্তা সেজে মঞ্চে নাচনকোঁদন করছে তারাই তো উনিশশো একাত্তরের পাকিস্তানি কোলাবরেটরদের উত্তরসূরি। ইতিহাস থেকে একথা কি মুছে ফেলা হয়েছে না মানুষকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে ?
‘পাকিস্তানি প্রত্যয় এখনও সজীব’ প্রবন্ধে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, “১৯৪৭ থেকে ১৯৫৪ মুসলিম লীগই দেশ শাসন করেছে এবং এ প্রত্যয়টি বাঙালির মানসিকতায় প্রোথিত করেছে। মুসলিম লীগের অবসান হয়েছে, তারা আর ফিরে আসেনি কিন্তু এ প্রত্যয়টির প্রভাব বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে যথাযথভাবে আছে। বঙ্গবন্ধু এ প্রত্যয় থেকে বেরুবার চেষ্টা করেছেন, জয়লাভও করেছেন। কিন্তু তাকে হত্যার পর যখন বামপন্থী, আওয়ামি লিগার, মুক্তিযোদ্ধারা জিয়ার দলে ভিড়লেন তখন বোঝা গেলো, ১৯৭১ সালও বাঙালিকে এ প্রত্যয় থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে পারেনি।’’২
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তার লেখায় যেসব জায়গায় ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের বাঙালি হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন, তখন কি তারা দ্বিজাতিতত্ত্বের উপর প্রত্যয় হারিয়ে ফেলেছিলেন ? এমনকি শেখ মুজিবসহ মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নেতৃবৃন্দ নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া সত্ত্বেও যখন দল-মত নির্বিশেষে এমন কি যারা বাংলাদেশ মুক্ত করার জন্য লড়াই পর্যন্ত করেছিলেন তারাও বাংলাদেশের প্রতি প্রত্যয় দেখাতে ব্যর্থ হলেন কেন? এবিষয়ে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘জীবনের স্মৃতিদীপে’ গ্রন্থে অনেক প্রণিধানযোগ্য মন্তব্য করেছেন, তা থেকে একটি উদ্ধৃতি করা হলঃ “তাঁর (বিপ্লবী ত্রৈলক্যনাথ চক্রবর্তী) গ্রন্থে (জীবনস্মৃতি) তিনি হিন্দুদের প্রতি মুসলমান সরকার ও সম্প্রদায়ের যে অত্যাচারের বিবরণ দিয়েছেন – তারজন্য পূর্ববঙ্গের মুসলমানরাই যে দায়ী এ সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। পশ্চিম পাকিস্তানের সরকার এবিষয়ে হয়ত উদাসীন ছিলেন, এবং তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায় যে এবিষয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের পরোক্ষ সহানুভূতি ছিল তথাপি মূলতঃ যে পূর্বপাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশের মুসলমানরাই এবিষয়ে যথার্থ অপরাধী তা অস্বীকার করার উপায় নেই। যে কারণে তারা তখন হিন্দুদের দূর করে দিতে ব্যস্ত ছিল সেকারণ আজও বর্তমান আছে এবং বহুদিন পর্যন্ত থাকবে। সেটা হল ব্যক্তিগত এবং সম্প্রদায়গত স্বার্থ ।”৩
১। তথ্যসূত্রঃ Bimal Pramanik, Endangered Demography, Kolkata, 2005, pp.13-14.
২। মুনতাসীর মামুন, ‘পাকিস্তান প্রত্যয় এখনও সজীব,’ জাগো নিউজ ২৪.কম, ৭ মে, ২০২৩)।
৩। রমেশচন্দ্র মজুমদার, ‘জীবনের স্মৃতিদীপে’, পারুল প্রকাশনী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১লা জানুয়ারী, ২০১৮, পৃঃ ১৯০।