Center For Research In Indo

বাংলাদেশি সমাজে ইসলামীকরণের প্রারম্ভিক কালপর্ব

পূর্ণিমা নস্কর

বাংলাদেশের সমাজে ইসলামের ভিত পাকা করতে বাংলাদেশি সকল শাসকরাই তাঁদের মতো করে উদ্যোগ নিয়েছে। পাকিস্তান আমলের যে অভিজ্ঞতা পূর্ব পাকিস্তানি সমাজের কট্টর ইসলামি নেতৃবৃন্দের সঞ্চয় হয়েছিল – তা ইসলামি সমাজ গড়ার পক্ষে তেমন সহায়ক হয়েছে বলে তাঁরা মনে করতে পারেননি। এবিষয়ে তাঁরা স্পষ্টভাবেই মতামত দিয়েছেন যে, পাকিস্তান ইসলামি রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব  পাকিস্তানে ইসলামের যথাযথ বিকাশ  না হওয়ায় ইসলাম এবং পাকিস্তান বিরোধী নানা আন্দোলন গড়ে উঠতে পেরেছিল। উদাহরণস্বরূপ, ভাষা আন্দোলন, উদার বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার আন্দোলন এবং সর্বোপরি, বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তানের) স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা বলা যায়। শেষ পর্যন্ত একটি রক্তক্ষয়ী  যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ড পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের চরিত্র প্রদান করার উদ্যোগ নিল।  

আর এই সমস্ত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই পূর্ব পাকিস্তানের ইসলামি পণ্ডিত, মৌলানা মৌলবিগণ ও তাঁদের বিদেশী মুরুব্বীগ্ণ প্রথম থেকেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল যে, বাংলাদেশের সমাজের অন্দরে ইসলামি প্রভাবের একটি বাতাবরণ তৈরি করতে হলে স্থায়ীভাবে এমন একটি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা দরকার, যা বাংলাদেশি সমাজকে ইসলামি ধ্যান ধারণায় পুষ্ট করতে পারে এবং এই মনোভাবকে আশ্রয় করেই স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনা থেকেই মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার উপরে গুরুত্ব আরোপ করা শুরু হয়েছিল।

বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ প্রক্রিয়াকে নির্মূল করে ধর্মভিত্তিক প্রতিক্রিয়াশীলতাকে প্রাতিষ্ঠানিক  রূপ দিতে হলে দেশে একটি শক্তিশালী ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি বা সরকারের প্রয়োজন – তাও তাঁরা অনুভব  করেছিল। কিন্তু, তা করার জন্য শুধু সংবিধানে ইসলামিকরণই যথেষ্ট ছিল না; রাজনীতিতে ও সমাজে প্রয়োজন ছিল ধর্মান্ধ মানবসম্পদের  সুনিশ্চিত জোগান। ঠিক এইরূপ একটা পটভূমিতে আমরা বাংলাদেশে মাদ্রাসা ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার শ্রীবৃদ্ধি ও স্বাধীনতা বিরোধী ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলির প্রত্যাবর্তন এবং পুনর্বাসন দেখতে পাই। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে মাদ্রাসা শিক্ষা ও ইসলামি মৌলবাদী দলগুলির যুগপৎ শ্রীবৃদ্ধির ঘটনা এদেশের   বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সমাজ-রাজনীতির চরিত্র ও গতিপ্রকৃতি বুঝতে আমাদের অনেকটাই সাহায্য করবে ।

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ও  তার কয়েকদিনের মধ্যে শেখ মুজিবসহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রধান ভূমিকা গ্রহণকারীদের হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার পরবর্তীকালে  রাষ্ট্রীয় নীতিতে ইসলামি তথা পাকিস্তানি ভাবধারার স্পষ্ট প্রতিফলন  দেখা যেতে লাগল এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে  তার প্রয়োগও ঘটতে থাকল।  মাদ্রাসা শিক্ষাকে বিচ্ছিন্ন রেখে যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রশাসনের ধর্মান্ধ জনশক্তির সরবরাহ ও চলাচল  সুনিশ্চিত  করা যাবে না; তা বুঝতে বাংলাদেশের তদানীন্তন  শাসকদের বিন্দুমাত্র সময় লাগেনি। তাই মাদ্রাসা হতে মূল শিক্ষা ব্যবস্থায় চলাচল সুনিশ্চিত করতে সত্তর দশকের শেষার্ধে মূল ধারার সাথে সাথে মাদ্রাসা শিক্ষার পাঠ্য বিষয়াবলীর সংযোগ ও  সমন্বয় এমনভাবে করা হয়; যা কিনা মাদ্রাসায় শিক্ষিত ছাত্রদের সহজেই মূল ধারায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ করে দেয়।

সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের ইসলামিকরণ রাজনীতির প্রতিষ্ঠা শুরু হয়েছিল। ১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলের পরপরই পাকিস্তানপন্থী ধর্মীয় মৌলবাদী নেতাদেরকে  সমাজে পুনর্বাসিত করার সাথে সাথে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য  দরগা, পীর এবং মাদ্রাসা পরিদর্শনের প্রক্রিয়া, সংবিধান হতে ধর্মনিরপেক্ষতার উচ্ছেদ ঘটানো, সরকারি নীতিমালায় মাদ্রাসা  শিক্ষাখাতে অস্বাভাবিক  ব্যয় বরাদ্দ ও তার পৃষ্ঠপোষকতাদানের ন্যায় ঘটনাবলীর নেপথ্যে ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য।

ধর্মকে  রাজনৈতিক বর্ম হিসাবে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে এরশাদ তাঁর পূর্বসূরীদের তুলনায় একধাপ বেশি এগিয়ে ছিলেন। প্রেসিডেন্ট এরশাদের সময়কালে মসজিদ ভিত্তিক শিক্ষাকে সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে মসজিদের ইমামদের বেতন – ভাতা  বৃদ্ধি করা হয়। শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য এরশাদকে সভাপতি ও মওলানা আব্দুল মান্নানকে সাধারণ সম্পাদক করে বাংলাদেশের শিক্ষক ফেডারেশনের  কলেবর বৃদ্ধি করা হয়।  উল্লেখ্য যে, প্রায় সকল ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলই সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছিল । তবে বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে আমরা জাতীয় পার্টি ও বি. এন. পি.-র কথা জানি, যারা আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিরোধীতা না করলেও বা এখনও পর্যন্ত তা করা সম্ভব না হলেও জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি এদের অনীহা প্রকাশিত হয়ে পড়ে।

 

 বাংলাদেশের সমাজে ইসলামি মৌলবাদী শক্তি, ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি এবং মাদ্রাসা শিক্ষার দ্রুত বিকাশের একটি যোগসূত্র  রয়েছে। ১৯৭৫ সালের পরবর্তীকালে জামাতে-ই-ইসলামীসহ অপরাপর ইসলামপন্থী ও দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক শক্তিসমূহ প্রকাশ্যে আনুষ্ঠানিক রাজনীতি করার এবং দল গঠন করার সুযোগ লাভ করে । ১৯৭৬ সালের ২৮ শে জুলাই জিয়াউর রহমানের সামরিক প্রশাসন ঘোষিত “রাজনৈতিক দল নিয়ন্ত্রণ বিধি”র মাধ্যমে এরা বাংলাদেশের মাটিতে সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিক বৈধতা পায়। জিয়াউর রহমানের সক্রিয় সহায়তায় এইসব মৌলবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহ বাংলাদেশের মাটিতে দ্রুত প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। এপ্রসঙ্গে বলা যায় যে, ১৯৭৯ সালের নির্বাচনের  প্রাক্কালে খুলনায় অনুষ্ঠিত এক নির্বাচনী সেমিনারে তদানিন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী  লেফটন্যান্ট কর্নেল মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘নতুন জাতীয় সংসদের প্রথম ও প্রধান করণীয় হবে, কোরান ও সুন্নাহভিত্তিক আইন প্রণয়ন করা ।’ ঐ সেমিনারটির উদ্বোধক ছিলেন বাংলাদেশে নিয়োজিত সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় যে, ১৯৭৬ সাল হতেই সৌদি আরব, ইরান, লিবিয়া, প্রভৃতি পশ্চিমী অর্থবান ইসলামি রাষ্ট্রসমূহ বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করতে থাকে এবং বিভিন্ন মৌলবাদী কর্মকান্ডে আর্থিক সহায়তাও দিতে  থাকে। আর এইসব মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের থেকে প্রাপ্ত বিপুল আর্থিক সাহায্য মাদ্রাসা শিক্ষাখাতে ব্যয়িত হওয়ার ফলে বাংলাদেশের সমাজে ইসলামিকরণের ধারাটি দ্রুততার সাথে এগিয়ে যায়।

এদেশের ধর্মানুরাগী সামাজিক জনগণ জনপ্রিয় সামাজিক প্রতিষ্ঠানরূপে মসজিদকে অচিরেই গুরুত্ব দিতে থাকে। এর কারণ ১৯৭৯ সালে প্রথমবারের মতো স্বনামে আবির্ভূত হতে পেরেই ‘জামাত’ মসজিদ ও ছাত্রদেরকে তাদের রণকৌশলের মুখ্য ক্ষেত্র হিসাবে বিবেচনা করে । এমনকি, জামাতের কথা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে মসজিদকেই  কর্মতৎপরতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা হয় । নিয়মিতভাবে তাফসীর মাহফিল,  শুক্রবারের নামাজের পর খুৎবার বাংলা তর্জমা, ইসলামি লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা,  ফোরকানীয়া মাদ্রাসা ব্যবস্থাপনা এবং ইসলামি দিবসসমূহের উদযাপনার্থে  উক্ত কর্মসূচীর বাস্তবায়নের জন্যই মসজিদ ভিত্তিক প্রচারণা কর্মসূচী সম্পাদন করা হতে থাকে।

বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার দ্রুততর বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজে ইসলামি ছাত্রশিবির এবং ধর্মান্ধ মৌলবাদী দলের প্রসার ঘটে চলেছে। মাদ্রাসা সৃষ্ট বিশাল জনশক্তি ইতিমধ্যেই দেশ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রবেশ করতে শুরু করেছে ।  উদার  ও শিক্ষিত সমাজে সাম্প্রদায়িকতার  প্রসার ও এর সহনশীলতা এই সকল  কর্মকান্ডেরই ফল একথা এখন  আর অস্বীকার করা যাবে না ।     

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *