বিমল প্রামাণিক
পাকিস্তানের তেইশ বছরের রাজনীতির ইতিহাসের বড় সময়কালই ব্যয়িত হয়েছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। সাধারণ মানুষের বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল নির্বাচনই গণতন্ত্রের আসল কথা। গণতন্ত্রের অন্যান্য উপাদান নিয়ে তারা ভাবিত ছিল না। পাকিস্তান মুসলিম লিগ দীর্ঘকাল সামরিক শাসনের সুযোগ সমাজে জেঁকে বসেছিল, ক্ষমতাও তারাই ভোগ করতো। আওয়ামি লিগের দীর্ঘ লাগাতার সংগ্রামে সামরিক শাসনের ফাঁস সমাজে আলগা হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এটা ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ। কিন্তু সামরিক সরকার অঙ্কুরেই গণতন্ত্রের পিঠে ছুরি মেরে দেশকে অরাজকতার দিকে ঠেলে দিয়ে জাঁকিয়ে বসতে চেষ্টা করলো। পরবর্তী ইতিহাস সবারই জানা আছে।
শুরু হল স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা। মানুষ আশান্বিত হল, এবার স্বাধীন দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে। প্রত্যাশামত ১৯৭৩ সালে সাধারণ নির্বাচন হল, কিন্তু ১৯৭৪ সালে একদলীয় শাসন এবং ১৯৭৫ সালে এল মহাসঙ্কটময় কাল। গণতন্ত্রের স্বপ্ন তছনছ হয়ে গেল।
বাংলাদেশেও পাকিস্তানের ধারায় একাধিক সামরিক স্বৈরতন্ত্রের অধীনে তথাকথিত বেসামরিক নির্বাচিত সরকার আমরা দেখলাম ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। এটাও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের আর এক রূপ বলে অনেকে মেনে নিয়েছেন। যেমন জেনারেল এইচ এম এরশাদের আমলে দেখেছি।
১৯৯১ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চার উপর আলোকপাত করা যাক।
বাংলাদেশের জনগণের বদ্ধমূল ধারণা গণতন্ত্র সাধারণ নির্বাচন ছাড়া সফল হয় না, পাকিস্তানের আমলেও এই সংগ্রামের ঐতিহ্য পূর্ববঙ্গের মানুষের রয়েছে। কিন্তু আরও একটি বিষয় গণতন্ত্রে অপরিহার্য তা হল সহনশীল সমাজ ব্যবস্থা। সেখানে প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হতে হবে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে। যা পাকিস্তানের আমলে দেখা যায়নি। কারণ ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানে গণতন্ত্রের ভিতই গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশেও ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ছয়টি সাধারণ নির্বাচন হয়েছে। সেখানেও কি ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত ছিল? সেই সকল সরকারের আমলে কি সাম্প্রদায়িক নির্যাতন হয়নি? সেখানে কি পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ সরকারি মদতে দাঙ্গাকারীগণ উৎসাহিত হয়নি? সরকারি ও প্রশাসনিক চরম নির্লিপ্ততা দেখা যায়নি? ১৯৯০ সালেও সরকারি মদতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও লুটপাট দেখা গিয়েছিল অর্থাৎ বাংলাদেশে গত পাঁচ দশকেও কোন স্থিতিশীল ও স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা সচেতন বাংলাদেশি নাগরিক প্রত্যক্ষ করেনি। তারা নিজ স্বার্থ ব্যতিরেকে রা কাড়ে না। সাধারণ মানুষের কাছে এসকল নির্বাচন ও শাসন ব্যবস্থাই মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেজন্য তারা নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচন পরবর্তীতে গণতন্ত্র ধর্ষিত হলেও সাতপাঁচ ভেবে এড়িয়ে যায়। বলা যায় এই ‘গণতন্ত্র’ তাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। কেন পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্রের এই সঙ্কট আমরা দেশ বিভাগের পর থেকেই দেখে আসছি? অথচ এই সঙ্কট ভারতে দেখা যাচ্ছে না কেন? পাকিস্তান ইসলামি রাষ্ট্র বিধায় গণতন্ত্র চর্চার বিষয়ে নানা মতভেদ পাকিস্তানি সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করতে সহায়ক হল না । এর পরিণামে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম। নতুন বাংলাদেশেও গণতন্ত্রের সঙ্কট কাটলো না। এই সঙ্কটের স্বরূপ ইতিহাস থেকে দেখা যাক।
ভারত বিভক্তির মূল ভিত্তি ছিল দ্বিজাতিতত্ত্ব। মুসলমান সম্প্রদায় নিজেদের ধর্মভিত্তিক জাতি ঘোষণা করে জাতিগত পরিচয় মুছে ফেলে পাকিস্তান দাবি করল, এবং এতোই বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়া হল যে শত শত বছরের স্বজাতি প্রীতি ধর্ম ভিন্ন হওয়ার কারণে স্বজাতি শত্রু বলে গণ্য হতে থাকল। তখন মুসলমানদের মূল উদ্দেশ্যই হয়ে দাঁড়ালো পাকিস্তানি ভূখণ্ড থেকে অন্য ধর্মের মানুষকে (শত্রু) বিতাড়িত করা এবং তাদের সহায় সম্পদ দখল করে নেওয়া। যা ছিল ভারতে মুসলমান আক্রমণকারীদের ইতিহাস।
নব্য বাংলাদেশকে যাঁরা বাঙালি জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় নিয়ে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ ঘোষণা করেছিলেন অঙ্কুরেই সে প্রচেষ্টা বিনষ্ট হয়েছে। বর্তমানে পাকিস্তান যেমন ইসলামি প্রজাতন্ত্র, বাংলাদেশ বকলমে ‘গণপ্রজাতন্ত্র’ হলেও অঘোষিত ইসলামি প্রজাতন্ত্র। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতৃবৃন্দ দ্বিজাতিতত্ত্বের বাইরে কেমন করে বেড়িয়ে আসবেন – তাদের পূর্বসূরীগণই তো পাকিস্তান আন্দোলনের প্রধান হোতা ছিলেন। ইতিহাস অস্বীকার করলে সাধারণ বাঙালি মুসলমান মেনে নেবে কেন? অধ্যাপক- ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের একটি প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘পাকিস্তান প্রত্যয় এখনও সজীব’। এই প্রবন্ধে তাঁর মতামত প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন, “একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি অনেকদিন, কিন্তু এখনও তেমন সদুত্তর পাইনি। সেটি পাকিস্তান সম্পর্কিত। আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে পাকিস্তান একটি দেশ শুধু নয় একটি প্রত্যয়। এ প্রত্যয়ের অন্তর্গত, সামরিকায়ন ও আমলাতন্ত্রের শাসন, ‘গণতন্ত্র’ পরিচালিত হবে তাদের নির্দেশে, ব্যাপক দুর্নীতি ও সম্পদ ভোগ করবে সামরিক আমলারা, ধর্মকে শুধু রাজনীতি নয়, মানুষ দমনে ব্যবহৃত হবে, জঙ্গিবাদ প্রাধান্য পাবে। এখানে যারা বসবাস করে তাদের মানসজগৎ এসব উপাদান দ্বারা প্রভাবিত। এরা নির্দয় ও হিংস্র, হাসতে হাসতে মানুষ খুন করে ও ধর্ষণ করে যেমন করেছিল ১৯৭১ সালে এবং সে সব খুনের বিচার হয় না। একজন মুসলমান সমান দু’জন হিন্দু। বাঙালিরাও হিন্দু। এই হল তাদের মানসজগৎ। পাকিস্তান প্রত্যয় যদি প্রাধান্য বিস্তার করে তাহলে সে দেশ ব্যর্থ হতে বাধ্য। ১৯৪৭ সালের আগে থেকে মুসলিম লিগ এই প্রত্যয় নির্মাণে সচেষ্ট থেকেছে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৪ মুসলিম লিগই দেশ শাসন করেছে এবং এই প্রত্যয়টি বাঙালির মানসিকতায় প্রোথিত করেছে। মুসলিম লিগের অবসান হয়েছে, তারা ফিরে আসেনি কিন্তু এ প্রত্যয়টির প্রভাব বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে যথাযথভাবে আছে। বঙ্গবন্ধু এ প্রত্যয় থেকে বেরুবার চেষ্টা করেছেন, জয়লাভও করেছেন। কিন্তু তাঁকে হত্যার পর যখন বামপন্থী, আওয়ামি লিগার, মুক্তিযোদ্ধারা জিয়ার দলে ভিড়লেন তখন বোঝা গেলো, ১৯৭১ সালও বাঙালিকে এ প্রত্যয় থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে পারেনি। গত কয়েক দশকে প্রমাণিত হয়েছে এরা অনেক শক্তিশালী। এবং গণতন্ত্রের নামে এরা প্রতিনিধিত্ব করছে বিএনপি, জামাত ও জাতীয় পার্টিতে।”১
অধ্যাপক মামুন গত পাঁচ দশকের রাজনীতির বাস্তব পরিস্থিতির যে বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন – তা কি বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিকাশের সহায়ক হতে পারে? নীতি-নৈতিকতা বর্জিত রাজনৈতিক শক্তি মধ্যযুগীয় অন্ধ বিশ্বাস লালন করে জীর্ণ পাকিস্তানি লেবাসের আড়ালে দেশকে কোথায় নিয়ে যেতে চায় তা তো আমাদের অজানা নয়। গণতন্ত্রের কুৎসিত রূপ ২০০১—এ নির্বাচিত সরকারের আমলে বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। সুষ্ঠু গণতন্ত্র বিকাশের পথ কণ্টকাকীর্ণ তো বটেই।
সুত্রঃ ১। Jagonews24.com, 27 May, 2023.