Center For Research In Indo

বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের নবজাগরণের অগ্রদূত বনভন্তে

ড. আনন্দ বিকাশ চাকমা, সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের পার্বত্য অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী বসবাস করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে একজন অসামান্য মহাপুরুষের নাম শ্রীমৎ সাধনানন্দ মহাস্থবির বনভন্তে। তিনি 1976 থেকে 2012 খ্রী. পর্যন্ত ছিলেন রাঙ্গামাটি রাজবন বিহারের অধ্যক্ষ। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রকৃত থেরবাদী বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনে তাঁর অবদান অনতিক্রম্য। তাঁর ধর্মপ্রচারের সময়কাল বিশ শতকের  সত্তরের দশক থেকে একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের গোড়া অর্থাৎ 2012 খ্রী. পর্যন্ত প্রায় 42 বছর। 1962 সালে উপসম্পদা বা ভিক্ষুত্ব গ্রহণ থেকে হিসাব করলে এই সময়সীমা আরও 8 বছর বেড়ে হয় 50 বছর বা অর্ধশতাব্দী। সুতরাং সুদীর্ঘ 50 বছর যাবৎ বনভন্তে পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ ধর্ম ও বৌদ্ধ সংস্কৃতিমুখী সমাজ বিনির্মাণে নিরলসভাবে ধর্মোপদেশ দেশনা করে গেছেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ আচার-অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতিতে নতুন ধারা প্রবর্তন করেন। 24 ঘণ্টার মধ্যে সুতা কেটে ভিক্ষুদের পরিধেয় চীবর তৈরি করে কঠিন চীবর দানের প্রবর্তন, উপগুপ্ত বুদ্ধের পূজা, ছিমিতং পূজা বা স্বর্গঘর তৈরি করে স্বর্গের সোপানগুলোর ধারণা প্রদান, কার্তিক মাসের চাঁদদেখা থেকে মাসব্যাপী আকাশ প্রদীপ প্রজ্জ্বলন, সারারাত ব্যাপী মঙ্গলসূত্র পাঠ বা পরিত্রাণ শ্রবণ, বিপুল সংখ্যক ভিক্ষু সমাবেশে মহাসংঘদান, একইসাথে শত কূলপুত্রকে শ্রামণ্যধর্মে দীক্ষা বা প্রব্রজ্যাদান, সমগ্র ত্রিপিটক বঙ্গানুবাদ করে প্রকাশের নিদের্শন প্রদান, রাজবন পালি কলেজ প্রতিষ্ঠা, বুদ্ধগয়ার আদলে রাঙ্গামাটি রাজবন বিহারে একটি দৃষ্টিনন্দন বিশ্বশান্তি প্যাগোডা নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ, তিন পার্বত্য জেলায় এমনকি ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে শাখা বনবিহার প্রতিষ্ঠা করে একই নীতি আদর্শের শিষ্যসংঘ প্রেরণ করে ধর্মপ্রচার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।  

বনভন্তের নির্দেশিত এসব দানকর্ম, উৎসব অনুষ্ঠান, পূর্জা-পার্বণ ও প্রতিষ্ঠান গড়ার উদ্যোগ সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং পার্বত্য অঞ্চলে বৌদ্ধ সমাজ গঠনে অতুলনীয় অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে।ফলশ্রুতিতে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামব্যাপী গড়ে ওঠে একটি সুশৃঙ্খল বৌদ্ধ ধর্মীয় অনুশাসন। চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, বড়ুয়া সকল সম্প্রদায়ের মনে ধর্মচেতনা জাগ্রত করে এবং ত্রিরত্ন তথা বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ এবং বৌদ্ধ বিহারের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও অনুরাগের জোয়ার সৃষ্টি হয়। বুদ্ধ বলেছেন সংসার অনিত্য। বনভন্তেও বাংলাদেশের আপামর বৌদ্ধদের মনে ধর্মবোধ সৃষ্টি করে 2012 সালের 30 জানুয়ারি দেহত্যাগ করে পরিনির্বাণ লাভ করেন। তবে তাঁর পবিত্র দেহধাতু প্রায় একযুগ ধরে রাজবন বিহারে  পেটিকাবদ্ধ অবস্থায় ভক্তদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। এ প্রবন্ধে পার্বত্য অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের পুনর্জাগরণে এই মহাপুরুষের কৃতিত্ব সম্বন্ধে আলোকপাত করা হয়েছে।

1920 সালের 8 জানুয়ারি পূজ্য বনভন্তে ধরাধামে আবির্ভূত হন। তৎকালীন প্রতাপশালী মৌজাপ্রধান হেডম্যান শ্রী ত্রিলোচন দেওয়ান-শাসিত মৌজার অন্তর্গত একটি গ্রাম ছিল মোরঘোনা। সেই গ্রামেই হারুমোহন চাকমা ও বীরপুদি চাকমার সংসারে জন্ম গ্রহণ করেন রথীন্দ্রলাল চাকমা যিনি নিজের সাধনা ও কর্মের ফলে কাল পরিক্রমায় লোকমুখে বনভন্তে নামে সমধিক পরিচিত ও পূজিত হন। বনভন্তের পবিত্র জন্মস্থান মোরঘোনা ও ধ্যানস্থান ধনপাতা পরিণত হয়েছে পবিত্র তীর্থস্থানে।কাপ্তাই হ্রদের জলে গ্রামটি নিমজ্জিত হলেও বর্তমানে হ্রদের মাঝখানেই নির্মিত হয়েছে বনভন্তের সুদৃশ্য স্মৃতিস্তম্ভ।

শ্রদ্ধেয় বনভন্তে গৃহী জীবনে তৎকালীন রাঙামাটি শহরে ধনাঢ্য বিরাজমোহন দেওয়ান বাবুর দোকানে চাকরি নিয়েছিলেন। রাঙামাটি শহরে অবস্থান করার সুবাদে তিনি অবসর সময়ে প্রচুর গ্রন্থ পাঠের সুযোগ লাভ করেন। বনভন্তের জন্মস্থান মোরঘোনা ছিল রাঙ্গামাটির চাকমা রাজবাড়ি ও বড়াদমের দেওয়ান পরিবারের কাছাকাছি।  চাকমা রাজবাড়ি এলাকায় ছিল বিশাল বৌদ্ধ বিহার এবং বড়াদমেও ছিল পার্বত্য চট্টল ধাতুচৈত্য বৌদ্ধ বিহার। ফলশ্রুতিতে রথীন্দ্র ছোটবেলা থেকেই বৌদ্ধ ধর্মীয় সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়ার ও একান্ত সান্নিধ্যে আসার সুযোগ লাভ করেন। বনভন্তের নিজগ্রাম মোরঘোনাতেও একটি বৌদ্ধ বিহার ছিল। সেদিক দিয়ে বনভন্তে শৈশবে বৌদ্ধ মন্দির, বুদ্ধমূর্তি, বৌদ্ধ ভিক্ষু ও বৌদ্ধ ধর্মানুষ্ঠান স্বচক্ষে দেখার অপার সুযোগ লাভ করেন যা তাঁর বাল্যকালের কোমল কচি চিত্তে বৈরাগ্যের চিন্তার ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়।

বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সংসার জীবনের চেয়ে বুদ্ধের নির্দেশিত প্রব্রজ্যা জীবনকেই শ্রেয়তর বলে মনস্থির করতে সক্ষম হন। এর ধারাবাহিকতায় 1949 সালের মার্চ মাসে চট্টগ্রাম নন্দনকানন বৌদ্ধ বিহারে গুরুভন্তে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান মহাস্থবিরের নিকট গৃহীজীবন পরিত্যাগ করে প্রব্রজ্জিত হন। তিনি শুরুতে রথীন্দ্র শ্রমণ নাম  প্রাপ্ত হন। পরে পারমার্থিক জ্ঞানের সন্ধানে বারোটি বছর অরণ্যজঙ্গলে ধ্যানসাধনারত অবস্থায় তিনি ভক্ত- পূজারী ও সাধারণ মানুষের নিকট বনশ্রমণ নামে পরিচিত হন।

পূজ্য বনভন্তে শ্রমণ থাকা অবস্থায় কাপ্তাই বাঁধের ফলে সৃষ্ট হ্রদের পানি তাঁর সাধনাস্থান ধনপাতা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে দীঘিনালায় চলে আসেন। ওই অবস্থায় তিনি তৎকালীন গুরুস্থানীয় সাংঘিক ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে 1962 সালে উপসম্পদা তথা ভিক্ষুত্ব গ্রহণে সম্মত হন।বনশ্রমণ নিরন্তর সাধনায় নিমগ্ন থাকতে পছন্দ করেন বলে উপসম্পদার পর তাঁর নাম রাখা হয় সাধনানন্দ ভিক্ষু। আর সর্বসাধারণের নিকট বনভন্তে নামেই সম্বোধিত ও পূজিত হতে থাকেন। অতঃপর শুরু হয় তাঁর ধর্মপ্রচার কাজ।    

রাঙামাটি পার্বত্য জেলার একটি উপজেলা হলো লংগদু। দীঘিনালা থেকে কাছে। গভীর অরণ্য আচ্ছাদিত এলাকা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেখানে তিনটিলা নামক স্থানে অবস্থান করেন।  তখন তাঁর সাধকজীবন, আধ্যাত্মিক শক্তি, প্রজ্ঞাবল, ঋদ্ধিবল ও বিশুদ্ধ ত্যাগময় সরল সাধাসিধে জীবনযাপন লোকমুখে জানাজানি হতে থাকে।

1973 সালে তাঁর নির্দেশনায় ও উপদেশে লংগদুস্থ তিনটিলা বনবিহারে প্রথমবারের মতো বুদ্ধযুগের মহাউপসিকা বিশাখা প্রবর্তিত নিয়মে দানোত্তম কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠিত হয় । 24 ঘণ্টার মধ্যে সুতা কেটে, রঙে ভিজিয়ে. আগুনের তাপে শুকিয়ে, টানা দিয়ে. কোমর তাঁতে কাপড়/চীবর বুনে ও সেলাই করে সংশ্লিষ্ট বিহারের অধ্যক্ষকে দান করা হলো কঠিন চীবর দান। এমন অভূতপূর্ব দানপ্রক্রিয়া দেখে এবং চাকমাদের প্রথাগত ঐতিহ্যবাহী বেইনবুননের সাথে সামঞ্জস্য দেখে সকলেই অভিভূত হন।এরপর বনভন্তের খ্যাতি দ্রুত   অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর খ্যাতির কথা লংগদু থেকে রাঙামাটির রাজপরিবার পর্যন্ত পৌছঁতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। পরম্পরাগতভাবে সৎ ধর্মানুরাগী, সমাজহিতৈষী, প্রজাবৎসল চাকমা রাজপরিবার শ্রদ্ধেয় বনভন্তেকে সশিষ্যে রাঙামাটির রাজবাড়ির পার্শ্ববর্তী বনে বিহার স্থাপন করে স্থায়ীভাবে বসবাসের আমন্ত্রণ জানায়। বনভন্তের সেই ফাং বা আমন্ত্রণ গ্রহণ ছিল একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত । অতঃপর রাজবাড়ির  উত্তরপাশে সবুজশ্যামল ছায়া সুনিবিড় বনে স্থাপিত হয় রাঙ্গামাটি রাজবন বিহার যা এখন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র। লংগদু থেকে রাঙামাটি অবস্থানগত, যোগাযোগ ও দায়কদায়িকাদের অবস্থা বিবেচনায় সুবিধাজনক জায়গায় অবস্থিত। বনভন্তে কর্তৃক রাজপরিবারের আমন্ত্রণে সাড়া প্রদান ও রাঙামাটিতে অবস্থানের সিদ্ধান্তগ্রহণ নিঃসন্দেহে বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারের ক্ষেত্রে মাইলফলক রচনা করে।

রাজনৈতিক নানা উত্থান পতনের সময়েও কঠিন পরিবেশে শ্রদ্ধেয় বনভন্তে অভয় ও অবিচল চিত্তে ধর্মপ্রচার করেছেন।  বুদ্ধের দেশিত অহিংসা, করুণা, মুদিতা, উপেক্ষা, কৃতজ্ঞতাও পরোপকারিতার কথা সহজ সরল উপমা দিয়ে দেশনা করে গেছেন। ব্যাখ্যা করেছেন দানের মাহাত্ম্য, শীল পালন ও নৈতিকতার গুরুত্ব, ভাবনার প্রয়োজনীয়তা। সমালোচনা ও প্রতিবন্ধকতা এসেছিল।কিন্তু তিনি তাঁর নীতি থেকে একচুলও চ্যুত হননি।  তাঁর  ঋদ্ধিবলম আধ্যাত্মিক শক্তি, প্রজ্ঞাতেজের সামনে আসলে নিন্দুক, সমালোচক ও শক্তিধররা আপনিই নতজানু হয়েছেন। করজোড়ে বন্দনা নিবেদন করেছেন।

এ সময়কালে আশির দশকে রাঙামাটি শহর এলাকা এবং সদর উপজেলার প্রায় প্রত্যেকটি ইউনিয়ন বনভন্তের  ধর্মপ্রচারের আওতায় চলে আসে। বনভন্তের রচিত ও শ্রুত বৌদ্ধ ধর্মীয় সংগীত, কীর্তন, বন্দুকভাঙ্গা, তৈমিদং, বালুখালি, মগবান, জীবতলি কুতুকছড়ির বৌদ্ধ জনপদ, গৃহ ও বিহারগুলিতে বাজতে শুনা যেতো। বনভন্তের জীবনের শেষ পনেরো বছর ছিল(1997-2012) খ্যাতি ও সাফল্যের স্বর্ণালী অধ্যায়। এসময় বাংলাদেশে ধর্মপ্রচারের অনুকুল পরিবেশ বিরাজমান থাকায় তাঁর ধর্মবাণী ও ধর্মোপদেশের কথা অগণিত মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। তিনি স্বশরীরে বিভিন্ন বিহারে গিয়ে ধর্মপ্রচার করে, মানুষকে সচেতন করেন। বৌদ্ধ ধর্মপালনে উদ্বুদ্ধ করেন। শুধু দেশের সমতল ও পাহাড়ের  মানুষ নন বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে তাঁর গুণমাহাত্ম্যর কথা। ফলে দেশ বিদেশের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ যেমন রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধান, রাষ্ট্রদূত, সেনাপ্রধান, বৌদ্ধ পণ্ডিত বনভন্তের সন্দর্শনে এসে নিজেদের ধন্য করেন। বার্মা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ভারত, শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে বনভন্তে সমাদৃত হন। প্রতিবছর থাইল্যান্ড থেকে ভিক্ষু এসে রাজবন বিহারে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে শামিল হন।

বনভন্তে বনসাধক থেকে আন্তর্জাতিক ধর্মগুরুর মর্যাদায় আসীন হন। অগণিত ভক্ত, পূজারির চিত্তলোকে স্থান করে নেন বনভন্তে। ধর্মপ্রচারের ক্ষেত্রে  অনুকূল রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি যে কতবড় সহায়ক এটা তার সাক্ষ্য দেয়। 1997-2012 সময়কালে কয়েকটি দৃষ্টান্তস্থাপনকারী ঘটনা ধর্মপ্রচারের অনুকূল ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়।

বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে 1996 সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে।

উল্লেখ্য যে, 1997 সালের 2 ডিসেম্বরে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি ছিল সেই পার্বত্য পরিস্থিতির উন্নতির মূলে প্রধান অনুঘটক। এতে করে পার্বত্য মানুষের মন থেকে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা কিছুটা হলেও দূরীভূত হয়। গ্রাম থেকে গ্রামে, শহর থেকে শহরে মানুষের চলাচল অবাধ ও সহজ হয়। এতে করে ধর্মানুরাগী মানুষের সাধ ও সাধ্যমত দান-দক্ষিণা করার সুযোগ অবারিত হয়। রাজবন বিহারে এসময়কালে সর্বাধিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও বৃহৎ জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানগুলো অনুষ্ঠিত হয়। প্রত্যেকটি অবকাঠামো নির্মাণ, দানানুষ্ঠান সম্পাদন ও তিথি পার্বণে ধর্মীয় অনুষ্ঠান সাফল্যমণ্ডিত করার পিছনে শুধুমাত্র বনভন্তে ও বনবিহারের নামে সাধারণ মানুষের অসীম শ্রদ্ধায় শ্রদ্ধাদান প্রদানের অবদান প্রশংসনীয়। মানুষ ধর্মের উদ্দেশে ত্যাগ করতে শেখে। ত্রিরত্ন তথা বুদ্ধ ধর্ম  সংঘ, বনভন্তে ও তাঁর শিষ্যসংঘের প্রতি বাড়ে ভক্তিশ্রদ্ধা। পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ ধর্ম অনন্য উচ্চতায় উন্নীত হয়। সুতরাং বনভন্তের প্রতি জনমানুষের এমন ঐকান্তিক ভক্তি শ্রদ্ধা ছিল তাঁর কঠোর সাধনাজীবনের পরম সামাজিক স্বীকৃতি।

এ সময় কী গ্রামে কী শহর-বন্দরে ধনী গরিব স্তর বিশেষে সকল ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ আদিযুগের অবৌদ্ধসুলভ সামাজিক কুপ্রথা ও কুসংস্কার দূরীভূত করে বুদ্ধ, বনভন্তের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে  গৃহে গৃহে মঙ্গলসূত্র বা পরিত্রাণ শ্রবণসহ দানক্রিয়া সম্পাদন করে আত্মমুক্তি ও আত্মোন্নতির চেষ্টা করেছে।  বিপদে আপদে বনভন্তের শরণ নিয়েছে। তাঁর সমীপে, নামে মানত করেছে। ব্যক্তির বৈষয়িক উন্নতি, পরিবারের সুখ ও সমৃদ্ধি, ছেলেমেয়েদের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার মানসে বনভন্তের বনবিহারে ছুটে এসেছে দূরদূরান্ত থেকে। উদ্দেশ্য বনভন্তের আশীর্বাদ প্রাপ্তি। সুযোগ ও সুবিধাজনক সময়ে সশরীরে, সপরিবারে, সবান্ধবে, আত্মীয় পরিজন, পাড়াপ্রতিবেশীকে সাথে নিয়ে বনভন্তের সমূখে এসে দান-দক্ষিণা উৎসর্গ করেছে। মানুষের মনে এমন ধর্মচেতনার জাগরণ নিঃসন্দেহে বনভন্তের পঞ্চাশ বছরের ধর্মপ্রচারের সুফল।

পরিশেষে বলা যায় শ্রদ্ধেয় বনভন্তে বারো বছরের কঠোর সাধনা, জ্ঞান ও গুণের ফলে সাধারণ মানুষের নিকট দেবতুল্য মনীষায় পরিণত হয়েছেন।বহুমুখী ছিল তাঁর প্রতিভা। বস্তুত বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারই তাঁর প্রধান ব্রত হলেও তিনি ছিলেন একাধারে লেখক, কবি, গীতিকার, ধর্ম-সমাজ সংস্কারক ও ধর্মীয় পথ প্রদর্শক।সর্বোপরি তিনি পরিণত হন পরমপূজ্য প্রধান ধর্মগুরুতে। তার শিষ্য ও ভক্তরা তাঁকে শ্রাবকবুদ্ধ হিসেবে গণ্য করেন। 2012 সালে 30 জানুয়ারি তিনি তাঁর অসংখ্য ভক্তপূজারিকে শোক সাগরে ভাসিয়ে ঢাকায় দেহ ত্যাগ করেন। তাঁর তিরোধানের পর তাঁকে একনজর দেখতে ঢাকা ও রাঙামাটিতে লক্ষ লক্ষ পূণ্যার্থীর ঢল নামে। কয়েকশত মণ পুষ্পাঞ্জলিতে ভরে ওঠে তাঁর শবাধার। এমন আবেগঘন বিদায় পার্বত্যবাসী কখনও প্র্ত্যক্ষ করেনি।এমন আরাধ্য মহাপুরুষ পরম কল্যাণমিত্রের বিকল্প বা সদগুণ সম্পন্ন কোনো সাধক মনীষী আমাদের ত্রিভূবনে আবির্ভূত হবেন কিনা তা দূর ভবিষ্যতে জানা যাবে। কিন্তু বর্তমান পূঁজিবাদী, ভোগবাদী ও আত্মকেন্দ্রিক দুনিয়ার  নিকট ভবিষ্যতে সে-সম্ভাবনা অতীব ক্ষীণ বলেই প্রতীয়মান হয়। তবে সাধনানন্দ মহাস্থবির বনভন্তে 1920- 2012) আমাদের মাঝে যে নির্মল ধর্মবোধ ও চেতনার প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছেন আসুন আমরা সেই আলোকশিখা অনির্বাণ রাখি।তাঁকে সকৃতজ্ঞ ও সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করি ও তাঁর হিতোপদেশ মেনে জীবন গড়ি। যে-জীবন হবে হিংসা, বিদ্বেষহীন, সংঘাতমুক্ত এবং পারস্পরিক বিশ্বাস ও মৈত্রীর বন্ধনে মোড়া।

সূত্র নির্দেশ :

  1. ডা. অরবিন্দ বড়ুয়া (সংকলিত), বনভন্তের দেশনা (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড)(তাইওয়ান: কর্পোরেট বডি অব দ্য বুদ্ধা এডুকেশনাল ফাউন্ডেশন, 2537 বুদ্ধাব্দ, 1ম সং 1993)
  2. ভদন্ত ইন্দ্রগুপ্ত ভিক্ষু, আর্যশ্রাবক বনভন্তের ধর্মদেশনা সম্ভার-1 (রাঙামাটি: বনভন্তে প্রকাশীত, 2014)
  3. ভদন্ত ইন্দ্রগুপ্ত ভিক্ষু, শ্রাবকবু্দ্ধ বনভন্তে (রাঙামাটি: দীপাল চন্দ্র বড়ুয়া, 2014)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *