Center For Research In Indo

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধঃ বাঙালি মুসলমানদের মনে সাদরে স্বীকৃতি পেল না কেন?

বিমল প্রামাণিক

 

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হওয়ার অব্যবহিত পর থেকেই হিন্দু জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনে দারুনভাবে প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে, সাথে সাথে মেয়েদের নিরাপত্তাও। দাঙ্গা-হাঙ্গামা, লুটপাট এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণে বহুসংখ্যক মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিল। আমার জানা মতে একটি মুসলমান পরিবারও পাইনি যারা হিন্দুদের পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছেন বা আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। সুদীর্ঘকাল  একই সাথে একই গ্রামে বসবাস করে যাদের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল, সে সকল মুসলমান পরিবারও যেন কেমন হয়ে গেল পূর্ববঙ্গ  স্বাধীন ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানের অঙ্গীভূত হওয়ায়। বঙ্গ বিভাজন করে ইসলামি রাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তান তাদের মোহগ্রস্ত ও আত্মহারা করে ফেলেছিল। তাদের কাছে অন্য আর কিছুর অগ্রাধিকার ছিল না। তা না হলে দেশভাগের মাত্র পাঁচ  বছরের মধ্যেই এক কোটিরও অধিক হিন্দু জনগোষ্ঠী উদ্বাস্তু হয়ে কিভাবে ভারতে আশ্রয়  নিতে বাধ্য হল ?

পাকিস্তানের জন্ম থেকেই পূর্ববঙ্গের মুসলমান জনগোষ্ঠী এবং সরকার ইসলামি ভ্রাতৃত্ববোধের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিল। সমস্ত ইসলামি দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল এবং ভারতকে শত্রু-রাষ্ট্র হিসেবে শুধু জ্ঞান করাই নয়,  চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক শাসনের যাঁতাকলে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক আন্দোলন মাথাচাড়া দেয়। শেখ মুজিব এই রাজনীতিকেই আঁকড়ে ধরেন এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মোড়কে জনগণের সম্মুখে রেখে এমন একটা মোহসৃষ্টি করতে সক্ষম হন,  যা ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে তার দলের ব্যাপক সাফল্য এনে দেয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালে সপরিবারে নৃশংস মুজিব হত্যার পরবর্তী বাংলাদেশে মুসলমান জনগোষ্ঠীর যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহের প্রকাশ আমরা দেখলাম তা তো বাঙালি জাতীয়তাবাদী চরিত্র নয়, সেটা হল উগ্র ইসলামি জাতীয়তাবাদী বৈশিষ্ট্যের ছাপ যা পাকিস্তান আমলের চেয়েও কট্টর ইসলামি, কুরুচিকর সাম্প্রদায়িকতায় জর্জরিত।

পাকিস্তানের ইতিহাসে কখনও  বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রভাব দেখা যায়নি, কারণ পাকিস্তানের রাজনীতির ভিত্তিই ছিল দ্বিজাতিতত্ত্ব এবং বঙ্গ বিভাগও সেই দ্বিজাতিতত্ত্ব মেনেই হয়েছে।

১৯৬৬ থেকে ১৯৭০ পর্বের পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ইতিহাসে দেখা যায়,  ধীর এবং নিশ্চিত পদক্ষেপে শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে অবদমিত, শোষিত বাঙালি মুসলমানের মধ্যে একটা নবচেতনার উত্থান ঘটে যায়, যার ফলে  তিনি পাকিস্তানি ক্ষমতাকেন্দ্রে শুধু  নাড়াই দেননি, দিয়েছিলেন ক্ষমতা ভাগের  বিকল্পের      সন্ধান। কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী এবং সামরিক জান্তা এই বিষয়টিকে  একেবারেই মেনে নিতে পারেননি  তারা মগ্ন  ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান দ্বারা  শাসিত এক অঙ্গরাজ্য হিসাবে দমিয়ে রাখার  ক্ষুদ্র এবং স্বার্থপর চিন্তায়। আর সেকারণেই শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয়ে যায় পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের  বিরুদ্ধে লাগাতার এক গণসংগ্রাম।

শেখ মুজিব জানতেন তার দল আওয়ামি লিগের মিনার গড়ে উঠেছে মুসলিম লিগের ভিতের উপর যার আদর্শগত ভিত্তি দ্বিজাতিতত্ত্ব। এই দলকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আদর্শে উত্তরণ ঘটানো অসম্ভব কাজ। তাই তিনি সেপথে যাননি। তিনি ছাত্র সমাজের উপর ভরসা রাখলেন। কিন্তু দেশের যে জনতা মুজিবকে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করলেন তাদের মূল উদ্দেশ্যই ছিল শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর আসনে দেখতে চাওয়া। তারা আওয়ামি লিগের ‘ছয়–দফা’ দাবির মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন ও অধিকারের স্বপ্ন দেখেছিল। তারা পাকিস্তান খন্ডিত হওয়া বা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার  স্বপ্ন দেখেনি। আর স্বাধীন বাংলাদেশ তাদের কল্পনায়ও ছিল না।

১৯৭০ সালের নির্বাচন পরবর্তী  ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ গণহত্যার পূর্ব পর্যন্ত  এই প্রথম পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাঙ্গন ও গ্রামে-গঞ্জে  বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একটা ধারণা নিয়ে প্রধানত ছাত্র-যুবকদের মধ্যে  একটা উন্মাদনা লক্ষ করা গেল। সবটাই পাকিস্তান-বিরোধী বাঙালি জাতীয়তাবাদের উচ্ছ্বাসে ভরা। বাঙালি সংস্কৃতি- নির্ভরশীলতার  ভিত দুর্বল থাকায় পাকিস্তান-বিরোধী মানসিকতাই এখানে প্রাধান্য পেল। ফলে পাকিস্তানি মানসিকতা থেকে বাঙালি চেতনায়  প্রকৃত উত্তরণ ঘটল না।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণা অচিরেই  উবে গেল যখন ১৯৭১ এর ২৫ শে মার্চ থেকে পাকিস্তানি সেনার গণহত্যা দ্রুত সারা পূর্ব পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়লো। আমি তখন রাজশাহী- বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এস.সি. (গণিত) ক্লাসের ছাত্র। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় ঠুনকো বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারণার পরিণতি নিম্নরূপঃ বাঙালি মুসলমানরা আওয়ামি লিগকে ভোটবাক্সে আশাতীত সাফল্য পেতে এগিয়ে এসেছিল এই ভেবে যে তারা ন্যায্য অধিকার পাবে – যা আওয়ামি লিগ স্বপ্ন দেখিয়েছিল। তারা পাকিস্তান ভেঙ্গে ফেলার জন্য ভোট দেয়নি। ফলে পাক-বাহিনীর আক্রমণ শুরু হলে তারাও এক বড় অংশ পাকিস্তানের সমর্থনে দাঁড়িয়ে গেল। শুধু মুসলিম লিগ জামাতে ইসলামি নয়, আওয়ামি লিগ সমর্থকরাও অনেকেই সামিল হয়ে গেল পাকিস্তান বাঁচাতে। এটা পাকিস্তানের তেইশ বছর বাঙালি মুসলমানদের মগজ ধোলাই-এর ফল যা বিভিন্ন দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সম্পত্তি দখল ও লুটপাট ও হিন্দু-বিতাড়নের ঘটনার মধ্য দিয়ে এতদিন প্রকাশ পেয়েছে। এটা ছিল পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হওয়ার আক্রোশের বহিঃপ্রকাশও। হিন্দু-মুসলমানের  দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব, সুসম্পর্ক এবং পড়শি বা একই গ্রামের অধিবাসী বংশ পরম্পরায় পরিচিত সম্পর্ককে কী অনায়াসে রাতারাতি ভেঙ্গে ফেলা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ না এলে এটা হয়ত কোনদিনই আমার অভিজ্ঞতায় আসত না। সমাজতত্ত্বের গবেষক বিশিষ্ট পণ্ডিতজন হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে কিছু মতামত ব্যক্ত করলেও দ্বিজাতিতত্ত্বের মত যে বিষধর চিন্তা বাঙালি মুসলমানের  রক্ত-মজ্জায় মিশে আছে তা পরিশ্রুত হওয়া মোটেই সহজ ব্যাপার নয়।

বিশিষ্ট চিন্তক ও প্রাবন্ধিক আহমদ ছফার প্রণিধানযোগ্য মতামত নিম্নে উদ্ধৃত হলঃ

        “ইতিহাসে  বিশ-ত্রিশ বছর কোন দীর্ঘ সময় নয়। বাঙালি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্রযন্ত্রটি প্রতিষ্ঠা করেছে সে রাষ্ট্রের সংকটের অন্ত নেই, কোথায়ও কোন দিক নির্দেশনার চিহ্ন পরিদৃশ্যমান নয়। সামাজিক সভ্য এবং ধর্মীয় কুসংস্কার সাম্প্রতিক কালে এমন প্রচন্ড আকার  নিয়ে দেখা দিয়েছে, অনেক সময় মনে হয়, এই জাতি মেরুদণ্ডের উপর থিতু হয়ে কোনদিন দাঁড়াতে পারবে না। মধ্যযুগীয় ভূত এই জাতিকে এমনভাবে আষ্টে-পৃষ্টে বেঁধে রেখেছে তার নাগপাশ কখন কিভাবে ছাড়াতে পারবে একথা এখন একরকম চিন্তা করাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

        বর্তমান অস্থিরতা এবং মধ্যযুগীয় ধর্মীয়  বদ্ধ মতের পুনরুত্থানের একটি কারণ আমি নির্দেশ করতে চাই। শুরু থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নেতৃত্বে যে দলটি গিয়েছিল তার আদর্শিক বৃত্তটি বিশ্লেষণ করলেই সেটা ধরা পড়বে। আওয়ামি লিগ বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে। অন্যান্য দলও স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করেছে। কিন্তু আওয়ামি লিগের ভূমিকাটি যে প্রধান তাতে সন্দেহ  নেই। কিন্তু এই আওয়ামি লিগের কী পরিচয় ? আওয়ামি লিগের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা ভাসানী ছিলেন আসাম মুসলিম লিগের প্রেসিডেন্ট। হোসেন সহীদ সোহরাওয়ার্দী নিখিলবঙ্গ মুসলিম লিগের প্রেসিডেন্ট এবং শেখ মুজিবর রহমান নিখিলবঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সম্পাদক। সুতরাং একথা বলা একটুও অযৌক্তিক হবে না যে, মূলত  আওয়ামি লিগ মুসলিম লিগের একটা অংশ। পাকিস্তানের সঙ্গে বাস করে তাদের ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারছিল না বলে আওয়ামি লিগকে শেষ পর্যন্ত বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সূচনা করতে হয়েছিল।

        একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন তাৎপর্যের দিক দিয়ে দুটি এক জিনিস নয়। এই আওয়ামি লিগের আন্দোলন যতই বেগ এবং আবেগ সঞ্চয় করেছে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের নেতৃত্ব  কবুল করে নিয়েছিল। কিন্তু সমাজের ভিতরে তারা কোন নতুন মূল্যচিন্তার জন্ম দিতে পারেনি; নতুন সংস্কৃতি নির্মাণ করতে পারেনি। তারা সেক্যুলারিজমের নীতি শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল।”

এই প্রবন্ধের বিষয়বস্তু উপযোগী বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সমাজতাত্ত্বিক অধ্যাপক আবুল বারকাত-এর বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও সামাজিক রূপান্তরের একটা পরিষ্কার (স্বচ্ছ) ধারণা পেতে সাহায্য করবে। তিনি মনে করেন,  “১. ১৯৪৭-এ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি।  ২. … পাকিস্তান রাষ্ট্রের পুরো সময়টা (১৯৪৭-১৯৭১) রাষ্ট্র-পরিচালন এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক জীবনে ধর্ম-ভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতাকে পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। যে কোন রাজনৈতিক-সামাজিক সঙ্কট  উত্তরণে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে – বিপদাপন্ন  হলেই বলা হয়েছে “ইসলাম বিপন্ন” (ইসলাম খতরে মে হ্যায়ঃ মিলিটারি শাসন এবং স্বৈরাচার  বলবৎ রাখতে প্রায় সব সময়ই ইসলামের বিপন্নতা ছিল একমাত্র শ্লোগান।  … এদেশে ইসলাম ধর্মের বড়মাপের পশ্চাৎমুখী রূপান্তর (regressive transformation)  ঘটে তিন দফায়। প্রথমটি ঘটে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বৃটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়ে যখন ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন হল তখন (অর্থাৎ ১৯৪০ এর দশকে শুরু হয়ে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় পর্যন্ত),  আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় পশ্চাৎমুখী বিপর্যয় ঘটে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে, যখন আমরা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দলকে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের জন্য শাস্তি দিতে ব্যর্থ হলাম এবং প্রায় একই সময়ে বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অর্জন দেশ-সমাজ-রাষ্ট্র বিনির্মাণে অন্যতম গণ-আকাঙ্ক্ষা “ধর্ম-নিরপেক্ষতা” (যা ছিল আমাদের প্রথম সংবিধান – ১৯৭২-এর  সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি) কে সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে চুড়ান্তভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। … আর বলা যায়, ইসলাম ধর্মের পশ্চাৎমুখী রূপান্তরে “হেফাজত ইসলাম” হল তৃতীয় কালপর্বের মোটামুটি চুড়ান্ত রূপের অন্যতম বহিঃপ্রকাশ মাত্র।” 

বাঙালি জাতিসত্তা, সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিষয়ে স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার বিষয়ে আলোকপাত করেছেন বিশিষ্ট পণ্ডিত ও রবীন্দ্র আলোচক অধ্যাপক আহমদ রফিক। তাঁর প্রণিধানযোগ্য মতামত এইরূপঃ “কিন্তু জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীর দল এবিষয়ে সচেতন হবার প্রয়োজন অনুভব করেনি। তারাও রাজনীতিকদের মতো কিম্বা তাদের চেয়েও বেশি বাঙালি জাতীয়তার আবেগ-উচ্ছাসে ভেসেছে। এতো গেল ১৯৭৫ সালের আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পূর্বেকার অবস্থা। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসকদের হাতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রকাশ, এমনকি হোসেন মুহম্মদ এরশাদের হাতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবার পরও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অঙ্গন থেকে কোন প্রতিবাদী আন্দোলন সংগঠিত হয়নি। আশ্চর্যের বিষয় যে, বুদ্ধিবৃত্তির বলয় থেকে, বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গন থেকে এই সাম্প্রদায়িক চেতনার বিরুদ্ধে বড়সড় প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়নি, কি লেখায়, কি বক্তৃতায়, কিম্বা সংগঠিত আন্দোলনে। কিন্তু কেন ?  কিভাবে তারা বাঙালি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামোয় মুসলিম বাংলার আরোপ মেনে নিলেন?  তাহলে কি বুঝতে হবে যে বাঙালি জাতীয়তা নিয়ে উচ্ছ্বাসটা নিতান্তই মেকি ছিল? তার কোন রাজনৈতিক-সামাজিক ভিত্তি ছিল না তাদের চেতনায়। এমনকি এরশাদ-শাসনের স্বৈরতন্ত্র নিয়ে যখন প্রতিবাদী আন্দোলন সংঘটিত করা হচ্ছে সেখানেও ধর্ম ইসলাম বা স্বৈররাজনীতির  সাম্প্রদায়িক চরিত্রের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ উচ্চারিত হচ্ছে না; কি লেখায়, কি সমাবেশের বক্তৃতায়! বুদ্ধিজীবীরা তখন কি ধরে নিয়েছিলেন যে জিয়া কিম্বা এরশাদ প্রবর্তিত সম্প্রদায়গত রাজনীতির একটা স্থায়ী ব্যবস্থা, এর পরিবর্তন ঘটানো যাবে না! নাকি এসম্পর্কে নীরবতার মাধ্যমে তারা তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছেন মুসলিম বাংলা তথা সংখ্যাগরিষ্ঠের  ধর্মচেতনার  রাজনীতির প্রতি! 

ভাবতে অবাক লাগে, স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সেমিনার, সমাবেশ বা লেখা-জোখায় স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে প্রগলভ হওয়া সত্ত্বেও সংবিধান পরিবর্তন বা জাতীয়তাবাদে সাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতিফলন সম্পর্কে কোন প্রতিবাদ বা সমালোচনা উচ্চারিত হল না।  সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত সাম্প্রদায়িকতার ধারায় পরিবর্তন দূরে থাক বেগম খালেদা জিয়ার ‘বিসমিল্লাহ’র  রাজনীতির বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার কাছে ‘বিসমিল্লাহ’র রাজনীতিই আচরণযোগ্য  বলে বিবেচিত হল। এবং তা সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বাতন্ত্র্যবাদী  বৈশিষ্ট্য হিসাবে রাজনীতিতে সংস্কৃতিতে স্বীকৃতি পেল। আওয়ামি লিগের অসমর্থক বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদেরও কিছু বলতে দেখা গেল না।

বুদ্ধিজীবীর মননশীলতা কি অনুধাবন করেনি যে এতে করে সম্প্রদায়বাদী রাজনীতিকেই মেনে নেওয়া হল  বিভাগপূর্বকালীন দ্বিজাতিতত্ত্বের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পরিশ্রুত  রূপ হিসাবে? এতে যদি জাতির সামাজিক- সাংস্কৃতিক বৈশিষ্টকে মেনে নেওয়ার যুক্তি উত্থাপিত হয় তাহলে বলি, বাংলাদেশে  বাঙালি জাতি বলতে শুধু মুসলমান অধিবাসীদেরই বোঝাবে, মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান বাঙ্গালিকে নয়। তাতে বাঙালি জাতিসত্তার খণ্ডিত রূপই, শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের জোরে, বাঙালি জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। এতে কি গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষা পাবে !” ৩   

সদ্য স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বাঙালি মুসলমান রাজনীতিক এবং বুদ্ধিজীবী সমাজ আত্মগরিমায় বাহ্যজ্ঞান একেবারে হারিয়ে না ফেললেও তারা এবিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন বলে মনে হয়না যে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অঙ্গনে জাতি পরিচয়  ছাপিয়ে ধর্মীয় পরিচয় বাঙালি মুসলমান সমাজকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে যে পূর্ব পাকিস্তানের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ করে দিলেই তাদের দৈনন্দিন জীবনে এবং মননে বাঙালি জাতিসত্তার চেতনা ও স্বরূপ উপলব্ধি হবে না।

আবুল মনসুর আহমদ বাহাত্তরেই লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশ আসলে পাকিস্তানেরই সত্যতর রূপায়ণ’।

 

 

তথ্যসূত্রঃ

১   আহমদ ছফা, বাঙালি মুসলমানের মন, খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ঢাকা, পৃষ্ঠা ১৭।

২   আবুল বারকাত, বাংলাদেশে মৌলবাদ, অধ্যায় ৬, ‘উদারনৈতিক ইসলাম’ থেকে ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ঃ সমকালীন পশ্চাৎমুখী রূপান্তর, পৃষ্ঠাঃ ৯৭-১০৮; মুক্তবুদ্ধি, ঢাকা, ২০১৮।

৩   আহমদ রফিক, সাতচল্লিশের ভারত-বিভাগ ও বাংলাদেশের বর্তমান  বুদ্ধিবৃত্তিক পরিস্থিতি, বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিঃ ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতার সঙ্কট, জাতীয়-গ্রন্থ প্রকাশন, ঢাকা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠাঃ ৫০-৫১।

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo.

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *