বিমল প্রামাণিক
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন সংবিধানে (১৯৭২) যে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইঙ্গিত মিলেছিল অচিরেই তা দ্রুত মুছে যেতে লাগল। “একটি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারা জাতীয় জীবনের বহুধাবিভক্ত স্রোতকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করে। বিদ্যমান অবস্থার একটি বড় প্রভাবসৃষ্টিকারী উপাদান হল এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিচয় বুঝতে হলে আমাদের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা মানতে হবে। পাকিস্তান সৃষ্টির কারণের মধ্যেই উগ্র সাম্প্রদায়িকতা বিদ্যমান থাকায় পাকিস্তানের পুরো আমলে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক প্রভাব এক জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে বাঙ্গালিত্বকে ছাড়িয়ে মুসলমানত্ব মুখ্য হয় এবং সযত্নে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্নতা আনয়নের দুর্বার চেষ্টা চালানো হয়। শাসকশ্রেনী রাজনীতি ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানদের ধর্মীয় পরিচয়কে সরকারিভাবে সামনে নিয়ে আসে এবং তা বাস্তবায়নে বহু উপাদানের সমাবেশ ঘটায় যাদের অন্যতম হলে ভারত বিরোধিতা ও হিন্দু বিরোধিতা।”১
স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষ যারা পাকিস্তান বাহিনীর দোসর লক্ষ লক্ষ বাঙালির গণহত্যাকারী, সম্পদ লুণ্ঠনকারী তাদের বিচারের আওতায় না এনে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে দিলেন শেখ মুজিবের সরকার। সাধারণ ক্ষমার আওতায় কারা ছিলেন? তারাই তো মুক্তিযুদ্ধের প্রধান শত্রু। মুসলিম লিগ, জামাতে-ইসলাম, নেজানে ইসলাম, শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ এরা সবাই গর্হিত অপরাধে অপরাধী। এটা বলা সমীচীন যে, “মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির দৃশ্যত পার্থক্য ও মালিকানাবোধ এবং সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ে উগ্রতার পরিমিতিবোধ পার্থক্যের প্রশ্ন ব্যতীত এসব শাসকদল সমলক্ষ্য ও সমউদ্দেশ্য অভিসারী পরস্পর কোন্দলরত এক গোষ্ঠীভূক্ত রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক জোট”।২ বর্তমান বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির রাজনৈতিক সংস্কৃতির উত্তরাধিকারকে প্রমাণিত করার জন্য জাতীয় জীবনের কিছু বিষয়কে উপস্থাপন করা হল। ‘ (১) আন্তর্জাতিক ইসলামি ঐক্যজোট (O.I.C. = Organisation of Islamic Conference) গঠন এবং এতে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি, (২) মুসলিম উম্মার স্বার্থ সংরক্ষণ, (৩) দেশে ক্রমবর্ধমান হারে সরকারি অর্থানুকূল্যে মসজিদ এবং মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা, (৪) ইসলামি শিক্ষা প্রসারে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, (৫) সংবিধানে পঞ্চম এবং অষ্টম সংশোধনী আনয়ন ও সংরক্ষণ বিষয়ে সমর্থনদান বা উদ্দেশ্যমূলক নীরবতা ও বাতিল বিষয়ে উদ্যোগহীনতা, (৬) সেকুলারিজম্ বিষয়ে বিরোধিতা বা কপটতাপূর্ণ বক্তব্য প্রদান, (৭) ধর্মীয় সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতির প্রতিফলন, (৮) সরকারি প্রচারমাধ্যমগুলিতে ধর্ম প্রচার, (৯) হজ পালনে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, (১০) জাতীয় বাজেটে নও মুসলিম পুনর্বাসন কর্মসূচি, (১১) ধর্ম বিষয়ে রাষ্ট্রনীতির বৈষম্যমূলক অবস্থান, (১২) ১৯৯০ ও ১৯৯২ সালে ভারতের বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশে অমুসলমানদের (হিন্দুদের) কয়েক হাজার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ভাঙ্গাসহ অন্যান্য নির্যাতনে সরকার ও রাজনৈতিক দলসমূহের নেতিবাচক ভূমিকা, (১৩) ১৯৭২ সালে একই দিনে সারা দেশব্যাপী দুর্গা প্রতিমা ভাঙচুর, (১৪) হজরত বাল চুরির ঘটনায় ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক উদ্বেগজনক পরিস্থিতি (দাঙ্গা), (১৫) ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের সময় সাদ্দাম মাতম, (১৬) শত্রু সম্পত্তি আইন, (১৭) ভারত-পাকিস্তান কার্গিল যুদ্ধকালীন (সাম্প্রদায়িক) অসহিষ্ণুতা, (১৮) আফগানিস্তানে তালেবান সরকার কর্তৃক প্রাচীন বৌদ্ধমূর্তির ধ্বংসসাধন (বাংলাদেশে উল্লাস), (১৯) ২০০১ সালের ১লা অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বাপর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত সাম্প্রদায়িক নির্যাতন। একটা নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ইতরবিশেষ পার্থক্যসহ বড় বড় সব রাজনৈতিক দলের অবস্থান হল এ বিষয়সমূহের পক্ষে।”৩ এমনকি বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামি লিগের শাসন আমলেও ২০১২ সালে চট্টগ্রামের পটিয়া, ফটিকছড়িসহ নানা জায়গায় এবং ২০২১ সালে কুমিল্লাসহ পঁচিশটি জেলায় সাম্প্রদায়িক নির্যাতন ও প্রতিমাসহ ধর্মস্থানগুলির ধ্বংসসাধন সরকার প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হল। ‘সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি বলতে বর্তমানে কি বুঝায় তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, আন্তর্জাতিক যে কোন বিষয়ে ভারতের অবস্থানের উপর নির্ভর করে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুদের নিরাপত্তার মাত্রা। অর্থাৎ কিনা ভারত এবং হিন্দুদের সমার্থকভাবে বিবেচনার পাকিস্তানি মনোভাব এখনও অটুট এবং এটা অত্যন্ত প্রভাবশালী। অবিশ্বাস্য হলেও এরূপ সমার্থক দৃষ্টিভঙ্গি মুক্তিযুদ্ধের মূল দলের শীর্ষস্থানেও অবস্থানের পরিচয় মেলে। সুতরাং আজকের বাংলাদেশের সাথে সেদিনের পাকিস্তানের লক্ষ্যনীয় বিশেষ কোন পার্থক্য নেই’।৪
বাংলাদেশের শুরু থেকেই রাজনীতিতে আদর্শ ও সমাজে নৈতিকতায় যে ঘুন ধরেছিল, গত পাঁচ দশকের সমাজ ও রাজনীতিতে তার প্রতিফলন স্পষ্ট। মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য ছিল পূর্ব-পাকিস্তানকে পাকিস্তানি শাসন থেকে মুক্ত করে বাঙালিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন। আন্দোলনরত জনগণ তাকে ‘বাংলাদেশ’ বলে অভিহিত করে। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে সাধারণ নির্বাচনের পরেও ‘বাংলাদেশের’ প্রশ্ন জনমনে দেখা দেয় নাই। মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণ, সেখানেও কোন স্বাধীন বাংলাদেশের রূপরেখা ঘোষিত হয়নি বা ঘোষণা করার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। এর পরেই ২৫শে মার্চ রাত থেকেই পাকিস্তানি গণহত্যা শুরু হয়ে গেল। ৭ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলনের ডামাডোলে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের’ বক্তব্য কোন কোন ছাত্রনেতার মুখে শোনা গেলেও জনসাধারণের উপর তার কোন প্রভাব দেখা যায়নি। অর্থাৎ পাকিস্তানি আদর্শ ও রাষ্ট্র তখনও জনমনে বদ্ধমূল। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে পূর্ব-পাকিস্তানের মুসলমান জনতা আরও কট্টর ভারত বিরোধি ও পাকিস্তানী মানসিকতায় পরিপুষ্ট হয়। এবিষয়টি আমি প্রত্যক্ষ করেছি। শেখ মুজিবের ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণার পিছনে এটি একটি বড় কারণ। ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে কোন আদর্শগত দৃঢ়তা লক্ষ করা যায়না। গত পাঁচ দশকের রাজনীতির ইতিহাসে যে সকল দল রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয় ছিল বা এখনও রয়েছে, প্রত্যেকটি দলই শুধু ক্ষমতা দখলের জন্য দলীয় নীতি-নৈতিকতা ও জনস্বার্থ বিসর্জন দিতে এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করেনি। যেহেতু ‘মুক্তিযুদ্ধ’ সমাজে ও রাজনীতিতে কোন নীতি-নৈতিকতা বা আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি বা সে সুযোগ পায়নি, ফলে দেখা যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধকারী আর মুক্তিযুদ্ধের শত্রুর সহাবস্থান একই সঙ্গে চলেছে। কারণ তারা একই পাকিস্তানি আদর্শে দীক্ষিত।
আজকের বাংলাদেশে নয়, অতীতের সব সরকারই (গণতন্ত্রী- স্বৈরতন্ত্রী, প্রগতিশীল-প্রতিক্রিয়াশীল, মুক্তিযুদ্ধপন্থী- মুক্তিযুদ্ধবিরোধী) তাদের কর্মকাণ্ড, চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রগুলিতে একটি বিষয়ে একমত, বা ঐকমত্য পোষণ করে, তা হল ক্রমহ্রাসমান সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে। বিভিন্ন দলের বক্তব্যের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। যেমন, (১) সরকার ‘সংখ্যালঘু- সংখ্যাগুরু’ তত্ত্বে বিশ্বাস করে না। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খৃস্টান নির্বিশেষে সবাই বাঙালি বা বাংলাদেশী। তবে সংবিধানটিকে সংখ্যাগুরুর পক্ষে করা হল কেন ? (২) বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। কিন্তু সংখ্যালঘুরা ধারাবাহিকভাবে নির্যাতন ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার। এটা অস্বীকার করা মিথ্যাচারের সামিল। (৩) ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, এদেশে হয় না। কিন্তু ১৯৪৭ থেকে এ পর্যন্ত যত সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস হয়েছে এবং তা একপক্ষীয় ও ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়। (৪) ইসলাম শান্তির ধর্ম । অর্থাৎ অন্যান্য ধর্ম অশান্ত, তাই তারা দাঙ্গাবাজ, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য তারাই দায়ী। এটাই কি ‘শান্তির ধর্মের’ লক্ষ্য? (৫) এদেশ থেকে কোন নাগরিক ভারতে যায়নি। মিথ্যাবাদী এবং পাগল ব্যতীত সারা দেশের সব মানুষ জানে প্রতিনিয়ত সংখ্যালঘু জনগণ ভারতে চলে যাচ্ছে, দেশত্যাগ করছে চিরতরে। (৬) দুষ্কৃতিদের কোন দল বা সম্প্রদায় নেই। সত্য কথা হল, সন্ত্রাসীরা সবাই চিহ্নিত রাজনৈতিক দলের ক্যাডার। রাজনৈতিক দলগুলির এসব বক্তব্য দিতে কখনও লজ্জাবোধ করতে দেখা যায়নি।
গলাবাজির রাজনীতির চোরাগলিতে হারিয়ে গেছে বাংলাদেশ, হারিয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধ।
তথ্যসূত্রঃ
১। নির্যাতিত সংখ্যালঘু বিপন্ন জাতি, দেওয়ান বাজার, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ, ২০০২। পৃষ্ঠা ১৭৫।
২। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৭৬।
৩। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৭৬।
৪। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৭৭।