Dr. Kakoli Sarkar
যে কোন দেশের মনোজগতে আধিপত্য বিস্তার করার সর্বোৎকৃষ্ট কৌশল হল তার শিক্ষা জগৎ দখল করা। সেই কারণে স্কুল-কলেজের পাঠক্রম তৈরি করার বিষয়টি অতি স্পর্শকাতর একটি বিষয় রুপে বিবেচনা করা হয়। আমরা দেখি বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে রাষ্ট্রগত আদর্শকে সামনে রেখে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের দ্বারা পাঠক্রম তৈরি করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এই বিষয়টি অত্যন্ত বিশৃংখল ভাবে ঘটে থাকে। বিশৃংখল বলছি এই কারণে যে, সেখানে যে রাজনৈতিক দল যখন ক্ষমতা দখল করে তখন তারা তাদের মতো করে পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন সাধন করে। তাদের জাতিগত আদর্শ কিছু মাত্র উপলব্ধি হয় না। এখানে আমি পাকিস্তানের কথা বলতে পারি। পাকিস্তানে শিক্ষার ক্ষেত্রে নির্লজ্জভাবে ইসলামিকরণ করা হয় এবং ভারতবিদ্বেষ ছড়ানো হয়। আমার মনে হয় সেক্ষেত্রে তবুও একটা অবস্থান পরিষ্কার আছে যে, পাকিস্তানের শিক্ষানীতির মূলে হল ইসলামী চেতনা এবং সেটা তাদের স্বাধীনতার চেতনাও বটে। সে কারণে তারা সেটা প্রকাশ্যেই করে। তার ফলও অবশ্য তারা পাচ্ছে এবং পাবে। যেমন আমরা দেখেছি পেশোয়ারের সামরিক স্কুলে জঙ্গিদের বোমা হামলায় শতাধিক মৃত্যু এবং এইরকম বহু ঘটনা। এখানে পাকিস্তান আমার আলোচ্য নয়। বাংলাদেশে বিষয়টি কিন্তু তেমন নয়। বাংলাদেশে পাঠক্রম তৈরির ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যার বিষয় হলো তাদের জাতিগত চেতনা। তারা যদি তাদের স্বাধীনতার চেতনাকে সামনে রাখে তাহলে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে প্রাধান্য দিতে হয় এবং পূর্ব পাকিস্তান থাকাকালীন তাদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বরচিত অত্যাচারের কথা বলতে হয়। স্বাধীনতার ইতিহাস বলতে গেলে ৩০ লক্ষ শহীদের কথা বলতে হবে, অসংখ্য নারী ধর্ষণের কথা বলতে হবে। আর এই সবই করেছিল তাদের একই ধর্মাবলম্বী পশ্চিম পাকিস্তান। যখন ধর্মভিত্তিক ইসলামিক দল বা পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দল ক্ষমতা দখল করে তখন তাদের বড় সমস্যা হয় স্বাধীনতার ইতিহাস বিষয়টিকে ঘিরে। কিন্তু বাংলাদেশ কখন স্বাধীন হলো, কেন এবং কিভাবে স্বাধীন হলো সে ইতিহাস তো বলতেই হবে। এদিকে আবার পাকসেনার বর্বরোচিত অত্যাচারের কথা বলা যাবে না, ভারতের সাহায্যের কথা বলা যাবে না। ভারতের সাহায্যের কথা তারা নাই বলতে পারে, কিন্তু প্রশ্ন ওঠে পাক সেনার আত্মসমর্পণের বিষয়টিকে নিয়ে। পাক সেনা কখন, কার কাছে আত্মসমর্পণ করল অর্থাৎ কখন বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেল?– এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে তো ভারতের সাহায্যের কথা বলতেই হবে, কিন্তু বাংলাদেশের ইসলাম পন্থী দলগুলির ঘোষিত নীতি হলো ভারত ও হিন্দু বিদ্বেষ। তাদের কাছে বাঙালি জাতীয়তার থেকে বড় আদর্শ ইসলামী চেতনা। সেই কারণে পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করতে গিয়ে তারা জটিল সমস্যার সম্মুখীন হয়। আর সেজন্য তারা সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে তা করতেও পারে না। সত্যকে চাপা দেবার অপচেষ্টা করতে গিয়ে পাঠ্যপুস্তকে বিভিন্ন জায়গাতে জগাখিচুড়ি একটা কিছু তৈরি করে।
আমার স্কুল জীবনের একটা অংশ কেটেছে বাংলাদেশে সামরিক শাসকের সময়ে। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ বাংলাদেশে পাকিস্তানি মডেল অনুসরণ করেছিলেন। আমি ছোটবেলায় বইতে পড়েছি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান। তিনি ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। আমাদের বইতে শেখ মুজিবের কোন ছবি এবং নাম ছিল না। বাস্তবতা এবং পাঠ্যবই এই দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান না করার জন্য আমার মত ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা বিভ্রান্ত হয়েছে। ১৯৭৫ সাল থেকে হিন্দু লেখকদের লেখা পাঠ্য বই থেকে বাদ পড়তে থাকে। বাংলাদেশের নবম শ্রেণী থেকে মানবিক, বিজ্ঞান এবং বাণিজ্য শাখাতে ভাগ করে দেওয়া হয়। আবশ্যিক বিষয়গুলির মধ্যে আমার সময় (১৯৯০–৯২) ছিল বাংলা ২০০ নম্বরের, ইংরেজি ২০০ নম্বরের, সাধারণ গণিত ১০০ নম্বর, ভূগোল ১00 নম্বর এবং ধর্ম শিক্ষা ১০০ নম্বরের। বিজ্ঞান এবং বাণিজ্য বিভাগে বিশেষ সমস্যা ছিল না, সমস্যা হতো মানবিক শাখাতে। মানবিক শাখাতে ইতিহাসের বদলে পড়ানো হতো ইসলামের ইতিহাস। তখন একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণী কলেজে পড়ানো হতো। আমাদের রাজবাড়ি সরকারি কলেজে ইতিহাস পড়ানো হতো না, তার বদলে ইসলামের ইতিহাস পড়ানো হতো, যার ১০০ নম্বর আরবের ইতিহাস এবং আর ১00 নম্বর বাংলায় মুসলমানদের ইতিহাস। স্কুলে আবশ্যিক বিষয়গুলির মধ্যে মুসলমানরা পড়তো ইসলাম ধর্ম শিক্ষা আর আমরা হিন্দুরা পড়তাম হিন্দু ধর্ম শিক্ষা। সম্ভবত ১৯৮৯ সালে আমার বোনের হিন্দুধর্ম শিক্ষা বইটির রানিং টাইটেলে লেখা ছিল মালায়ন ধর্ম শিক্ষা, অবশ্যই তা ছাপার অক্ষরে লেখা ছিল। এর থেকে অনুমান করা যায় বাংলাদেশে পাঠ্য পুস্তক নির্মাণে সমস্যা কোন স্তরে পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশে সব থেকে বড় সমস্যা ইতিহাস পড়ানো নিয়ে। কারণ ইতিহাস পড়লে সত্য জানতে পারবে। আমার স্কুল জীবনে দেখেছি অধিকাংশ স্কুল-কলেজে ইতিহাসের বদলে ইসলামের ইতিহাস পড়ানো হতো, কেননা সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস আসবেনা। আমি ২০১৬ সালের একটা পরিসংখ্যান দিতে পারি যেখানে ৮ টি জেলার ৩০ টি সরকারি কলেজে ইতিহাস বিভাগ নেই। কোনো সরকারি মাদ্রাসায় ইতিহাস পড়ানো হয় না। বাংলাদেশের ৪৭৫৭ টি বেসরকারি কলেজ ও মাদ্রাসায় ইতিহাস পড়ানো হয় না (অবশ্য মাদ্রাসা শিক্ষা আমি এখানে আলোচনা করছি না) । বাংলাদেশে ১০০–এর উপরে বিশ্ববিদ্যালয় আছে। ইতিহাস বিভাগ আছে, এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা পাঁচ এর বেশি হবে না। এর অর্থ হল এই, শিশু অবস্থা থেকেই জোর দেওয়া হচ্ছে ধর্ম শিক্ষা, ইসলাম শিক্ষা ও ইসলামের ইতিহাসের উপর। সেখানে অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ কি করে তৈরি হবে। যদিও বাংলাদেশ তৈরীর ভিত হিসেবে কাজ করেছিল ধর্মনিরপেক্ষতা বা অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ। সেই কারণে আমি প্রথমেই বলেছি বাংলাদেশের স্কুল কলেজে কোন্ আদর্শকে সামনে রেখে পাঠক্রম তৈরি করা হয় তা আমার বোধগম্য হয় না। বলতে বাধা নেই ১৯৭১ সালের পর যে প্রজন্ম বাংলাদেশে গড়ে উঠছে তাদের মনোজগৎ অধিকার করে আছে ধর্ম, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, প্রতিক্রিয়াশীলতা ইত্যাদি।
এবার বাংলাদেশে পাঠ্য বইয়ে যে বিবর্তন হয়েছে সে সম্পর্কে দু একটি তথ্য উপস্থাপন করব। তবে বাংলাদেশে পাঠ্য বইয়ের বিবর্তন কিভাবে হয়েছে সে সম্পর্কে তথ্য পাওয়া খুবই দুরূহ। বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষা ক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে এ সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। আরো আশ্চর্যের বিষয় হল, এ যাবত যে সব বই প্রকাশিত হয়েছে তার সংগ্রহও বোর্ডে নেই। ১৯৮০র দশকে পঞ্চম শ্রেণীর বইতে আমরা পড়েছি ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ আমলে ওই মিথ্যা ইতিহাস সংশোধন করা হয়। ১৯৯৬ সালে পঞ্চম শ্রেণীর আমার বই এ “বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল” রচনাটি সংশোধন করে করা হলো এইরকম – “ গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।”
২০০১ সালে খালেদা– নিজামী সংস্করণে ওই জায়গাতে বলা হলো, “ ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ মধ্যরাতে তারা অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। শুরু হলো হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ।” এখানে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা বাদ।
তৃতীয় শ্রেণীর বইতে একটি রচনা ছিল “ আমাদের জাতীয় পতাকা”। ১৯৯৬ সালে হাসিনা সরকার সেটি সংস্করণ করে এইরকম করলেন, “ ১৯৭০ সালে সারা পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন হয়। এ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বেশি আসন লাভ করে। কিন্তু জনগণের রায়কে অস্বীকার করে পাকিস্তানের সরকার আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে দিল না। বরং বাঙ্গালীদের কঠোরভাবে দমন করার পথ বেছে নিল।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানী সৈন্যরা নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তখন বঙ্গবন্ধু মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। পাক বাহিনী সেই রাতেই তাঁকে গ্রেফতার করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বাধীনতার ঘোষণা দেশবাসীকে জানানোর জন্য ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে সেটি প্রচার করেন। ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট অস্থায়ী বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার আরেকটি ঘোষণা প্রচার করেন। এজন্য ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস।”
২০০১ সালে খালেদা–নিজামী সংস্করণ এইরকম, “ ১৯৭০ সালে সারা পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন হয়। এ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে বাঙালিরা বেশি আসন লাভ করে। কিন্তু জনগণের রায়কে অস্বীকার করে তাদেরকে সরকার গঠন করতে দেওয়া হলো না। তাদেরকে কঠোরভাবে দমন করার পথ বেছে নেওয়া হলো।
১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাতে পাকিস্তানী সৈন্যরা নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা হাজার হাজার নিরীহ বাঙালি কে হত্যা করে। এতে সারা দেশ ক্ষোভ ও ঘৃণায় ফেটে পড়ে। পরের দিন অর্থাৎ ২৬ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তারপর থেকে শুরু হয় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ। এজন্য ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস।”
এইভাবে কেবলমাত্র স্বাধীনতার ইতিহাসই যে বারবার পরিবর্তিত হচ্ছে তা নয়, প্রগতিবাদী লেখকদের লেখাও বারবার পরিবর্তিত হচ্ছে। হিন্দু লেখকদের বহু লেখা ধীরে ধীরে তুলে দেওয়া হয়েছে। যে যখন ক্ষমতায় আসে তার মত করে পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তন সাধন করে। আওয়ামী লীগ সরকার এবং বিএনপি–জামাত সরকারের মধ্যে প্রধান সমস্যার জায়গাটা হল স্বাধীনতার চেতনা এবং ইতিহাস। কিন্তু বাংলাদেশে এর থেকেও একটি বড় সমস্যা তৈরি হয়েছে পাঠক্রমকে কেন্দ্র করে। এখন যারা পাঠক্রম তৈরীর কমিটিতে আছেন তাদের বেশির ভাগই আশির দশকের শিক্ষায় শিক্ষিত। ফলে সরকার যদি অসাম্প্রদায়িক পাঠক্রম তৈরি করতে ইচ্ছা পোষণ করে থাকেন তাও তাদের পক্ষে করা সম্ভব হচ্ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিবাদী এক শিক্ষকের বক্তব্য দিয়ে শেষ করি। তিনি বলেন, “অচিরেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক ধরনের মাদ্রাসায় পরিণত হয়ে যাবে”।