বিমল প্রামাণিক
‘পাকিস্তানি বাধা অতিক্রম করে মধ্যবিত্তের বিকাশের পথ যখন উন্মুক্ত হল তখন তার সামনে সমস্যা দেখা দিল আরেকটি। ভারত বড় প্রতিবেশী। শুধু আয়তনে নয়, অর্থনীতিসহ সব দিক দিয়েই বাংলাদেশের তুলনায় ভারত অগ্রসর। আর ভয় সেখানেই। এভয় হল ক্ষুদ্র প্রতিবেশীর বৃহৎ সম্পর্ক-ভীতি। তার উপর দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সাথে অবিশ্বাস বা বিদ্বেষের যে পটভূমিতে উপমহাদেশ বিভক্ত হয়েছিল মাঝের গণতান্ত্রিক আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় তা দূরীভূত হয়েছে এটা মনে করার কোন কারণ নেই। ফলে স্বাধীনতার পরে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত সম্পর্কে সন্দেহের ভাব যখন দেখা দিল মধ্যবিত্তের মনে, তখন স্বাভাবিকভাবে সম্প্রদায়গত বিভেদের ইতিহাসও সামনে এসে দাঁড়াল। আর এদের সাথে একাংশের ভিতর পাকিস্তানের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বদলে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তারও অস্বাভাবিক মনে হল না। আর ভারতের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে শীতলতা যত বেড়েছে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক তত ঘনিষ্ঠতর হয়েছে। বস্তুত বাঙালি মধ্যবিত্তের মাঝে একদিকে মুক্তিযুদ্ধ বা তার আগের অভিজ্ঞতা, অন্যদিকে ভারত সম্পর্কে সন্দেহ-অবিশ্বাস (যা অতীত সম্প্রদায়গত বিভেদের অভিজ্ঞতা দ্বারা পরিপোষিত) – এই দু’য়ের টানাপোড়েন বিদ্যমান। আর এই টানাপোড়েনেই বাঙালি না মুসলমান, না মুসলমান বাঙালি, না বাঙালি মুসলমান এই দোলাচলে অভিব্যক্ত।’ ১
আজকের বাংলাদেশের মুসলমান সমাজে ভারত বিদ্বেষের যে প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে তা কোন নতুন বিষয় নয়। এর শিকড় দ্বিজাতিতত্ত্বের গভীরে নিহিত ছিল। এর প্রকট প্রকাশ ধরা পরে হিন্দু বিদ্বেষের ঘটনাবলীর ধারাবাহিকতায়। পাকিস্তানের ‘যোগাযোগ মন্ত্রী’ শ্রী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ১৯৫০ সালেই তার সুদীর্ঘ ইস্তফাপত্রে পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সরকারের হিন্দু-বিতাড়নের নীতি ও কার্যকলাপের যে বিস্তারিত বিবরণ লিখে গেছেন তা থেকে কিঞ্চিৎ এখানে উদ্ধৃত করা হলঃ
“Pakistan `Accursed’ for Hindus
- Now this being in brief the overall picture of Pakistan so far as the Hindus are concerned, I shall not be unjustified in stating that Hindus of Pakistan have to all intents and purposes been rendered “stateless” in their own houses. They have no other fault than that they profess Hindu religion. Declarations are being repeatedly made by Muslim League leaders that Pakistan is and shall be an Islamic State. Islam is being offered as the sovereign remedy for all earthly evils. In the ruthless dialectics of capitalism and socialism you present the exhilarating democratic synthesis of Islamic equality and fraternity. In that grand setting of the Shariat Muslims alone are rulers while Hindus and other minorities are jimmies who are entitled to protection at a price, and you know more than anybody else, Mr. Prime Minister, what that price is. After anxious and prolonged thought I have come to the conclusion that Pakistan is no place for Hindus to live in and that their future is darkened by the ominous shadow of conversion or liquidation. The bulk of the upper class Hindus and politically conscious scheduled castes have left East Bengal. These Hindus who will continue to stay in the accursed province and for that matter in Pakistan will, I am afraid, by gradual stages and in a planned manner be either converted to Islam or completely exterminated. It is really amazing that a man of your education, culture and experience should be an exponent of a doctrine fraught with so great a danger to humanity and subversive of all principles of equity and good sense.
I may tell you and your fellow workers that Hindus will never allow themselves, whatever the thereat or temptation, to be treated as jimmies in the land of their birth. Today they may, as indeed many of them have already done, abandon their hearths and homes in sorrow but in panic. Tomorrow they will strive for their rightful place in the economy of life.
Who knows what the womb of the future is? When I am convinced that my continuance in office in the Pakistan Central Government is not of any help to Hindus I should not, with a clear conscience, create the false impression in the minds of the Hindus of Pakistan and peoples abroad that Hindus can live there with honour and with a sense of security in respect of their life, property and religion. This is about Hindus.”2
পাকিস্তান সরকারের যে ভারত তথা হিন্দু বিদ্বেষী নীতি ও কার্যকলাপ এবং তার বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই ভারতের বিরুদ্ধে মাত্র চব্বিশ বছরের (১৯৪৭-১৯৭১) মধ্যেই তিনবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েই ক্ষান্ত হয়নি, লাগাতার হিন্দু বিরোধী দাঙ্গা ও কালা কানুন ( Enemy Property ordinances and laws উল্লেখযোগ্য) জারী করে হিন্দু নিশ্চিহ্নকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখায় পাকিস্তানের মুসলমান সম্প্রদায় ভারতকে তাদের প্রধান শত্রু হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। এর প্রধান সুবিধাভোগী ছিল উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও ক্ষমতাশালী মুসলমান সম্প্রদায়। ফলে পূর্ব পাকিস্তান ও পরবর্তীকালে বাংলাদেশে যারা শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন বা করছেন তারা ভারত বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হবেন কী করে ! ভারত বিদ্বেষের মধ্যেই যাদের জন্ম এবং বংশ পরম্পরায় বেড়ে ওঠা সেই পাকিস্তানি সংস্কৃতির আবহে, তা থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রকে উত্তরণ ঘটানোর জন্য যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গঠনের উদ্যোগ প্রয়োজন ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রারম্ভেই তার একটা চেষ্টার অঙ্কুর দেখা গেলেও অচিরেই তা রুদ্ধ হয়ে যায়। আর ১৯৭৫-এর কালান্তক ঘটনার পর বাংলাদেশের শরীরে পাকিস্তানের প্রেতাত্মা জাঁকিয়ে বসতে কাল বিলম্ব করেনি।
বিশিষ্ট গবেষক নুহু-উল-আলম লেনিন ‘সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ’ সমকালীন বাংলা সাহিত্যে যে থাবা বিস্তার করেছে, তার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লিখেছেন, “সাম্প্রদায়িক উন্মাদনায় সৃষ্ট পাকিস্তানের সমকালীন কবি- সাহিত্যিকরা অনেকেই তাই সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদকে উপেক্ষা করতে পারেননি। তাঁদের কবিতা, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, নাটক সবকিছুতেই এর ছাপ পড়েছে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সমাজ-রাষ্ট্র কাঠামোতে নানা পরিবর্তন সাধিত হলেও সাম্প্রদায়িক চেতনার সাহিত্যিকেরা ধর্মীয় ও পশ্চাদপদ রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে আসতে পারানি। … কিন্তু ১৯৭৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদী চেতনার প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়।” …
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান কবি “আল মাহমুদ পুরোপুরি সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা সবকিছু মূল্যায়ণ করেছেন। বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের সশস্ত্র সংগ্রামকে তিনি যেমন সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক মনোভাবের দ্বারা সমর্থন করেছেন, তেমনি সংস্কৃতি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার উর্দ্ধে উঠতে পারেননি। বাংলাদেশের মানুষের সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্মকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি সব কিছুতে ইসলাম আর মুসলমান লেবেল এঁটে দিয়েছেনঃ বাংলাদেশ মূলত একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। এখানে সাড়ে এগারো কোটি নর-নারীর মধ্যে দেড় কোটি হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃস্টান বাদে আর সকলেই ইসলাম ধর্মাবলম্বী । ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক ইসলামের বিধিনিষেধ সমূহ এখানকার জনজীবনে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিপালিত হচ্ছে। এমনকি অন্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও। এখানকার আদব-কায়দা, প্রাত্যহিক সামাজিক বিনিময়ে, পোশাক-আশাকে, খাদ্য রুচিতে এবং সর্বোপরি সাধারণ সামাজিক সম্মিলনের ক্ষেত্রগুলোতেও অচেতনভাবে হলেও ইসলামের হালাল-হারাম পাত্তা পেয়ে আসছে। পারস্পরিক সাক্ষাৎ মুহুর্তে আমরা যেমন ধর্ম বা সম্প্রদায় নির্বিশেষে ইসলামী কায়দায় সালাম বিনিময় করি, তেমনি ভাষার ক্ষেত্রে তৃষ্ণার্ত হলে একজন হিন্দু বা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের যুবকের মুখ থেকেও ‘পানি’ শব্দটি ছিটকে পড়ে।
ধর্মকে তিনি আমাদের সমাজ সংস্কৃতির প্রধান স্তম্ভ বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু আমাদের সমাজ সংস্কৃতির মূল প্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কোনকালেই ধর্ম আমাদের সমাজ সংস্কৃতির প্রধান স্তম্ভ ছিল না, ছিল অন্যতম স্তম্ভ। বিভিন্ন ধর্ম বিভিন্ন সময় প্রভাব বিস্তার করলেও তা আমাদের সমাজ সংস্কৃতির মূল প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। অথচ আল মাহমুদ ধর্মকেই সমাজ সংস্কৃতির প্রধান স্তম্ভ বলে আত্মতৃপ্তি লাভ করেছেন।” …
“আদতে আল মাহমুদ শেষ জীবনে হয়ে পড়েছেন একজন প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির মুখপাত্র,। … আমাদের দেশের সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর বড় অস্ত্র ভারত বিরোধীতা। সুযোগ পেলেই তারা ভারত বিদ্বেষী বক্তৃতা দেয়। ভারতীয় আগ্রাসনের জুজুর ভয় দেখিয়ে তারা বিভিন্ন সময় এদেশের জনগণকে ধোঁকা দিয়ে ফায়দা হাসিল করে। শুধু তাই নয়, পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতিমান কবি সাহিত্যিকদের জীবন ও সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে বিষোদ্গার করতেও ছাড়ে না। এদের মুখপাত্র হিসেবে আল মাহমুদ এসব বিষয়ে সব সময় সরব থেকেছেন। তিনিও সব কিছুর মধ্যে খোঁজেন ভারতীয় আগ্রাসন, ভারতীয় খ্যাতিমান লেখকদের সাহিত্যকর্মের করেন বিরূপ সমালোচনা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব-পশ্চিম’ উপন্যাসের সমালোচনায় তিনি যা বলেছেন, তা তাঁর সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী চেতনারই বহিঃপ্রকাশঃ ‘পূর্ব-পশ্চিম’ মনে হয় এক অসম্ভব রূপকথা মাত্র। মনে হয় হিন্দু-মুসলমানের সামাজিক সৌহার্দ্যের যে চিত্র সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এঁকেছেন তা কোনকালে কখনও ঘটেনি। তার রচনার অবাস্তবতা ও অসংলগ্নতার কারণেই একটি সত্য মুক্তিযুদ্ধকেও অলীক বানোয়াট কাহিনী বলে মনে হয়। মনে হয় বইটি একজন অতিশয় চতুর হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদীরই সুচতুর রচনা। যিনি হিন্দু-মুসলমানের মিলন-প্রয়াসের ছদ্মবেশের নীচে ভারতীয় আধিপত্যবাদের ষড়যন্ত্র জালটি সুকৌশলে লুকিয়ে রেখেছেন”। …
সামগ্রিক মূল্যায়নে বলা যায় ১৯৪৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতার স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে নানা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ ও পাকিস্তান আন্দোলনের উন্মাদনায় অনেক কবি সাহিত্যিক সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী চেতনাকে তাঁদের সাহিত্যের প্রধান বিষয়বস্তু করেছেন। একদিকে নিজেদের মৌলিক সৃষ্টিকর্মে, অন্যদিকে অন্য সাহিত্যিকদের বিশ্লেষণ ও উপলব্ধির ক্ষেত্রে তাঁরা এ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। ভাষা আন্দোলনের পর ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসার ঘটতে থাকলেও এক শ্রেনির লেখক পাকিস্তান সরকারের তল্পিবাহকরূপে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদী চেতনার আলোকে সাহিত্যচর্চা করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশেও অনেক লেখক ধর্মের ধুয়া তুলে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বাণীমূর্তি নির্মাণ করেছেন।”৩
মুসলিম লিগের দ্বিজাতিতত্ত্ব-ভিত্তিক পাকিস্তান আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বঙ্গে বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমানদের চিন্তা-চেতনায় পাকিস্তানি সংস্কৃতির যে উদ্রেক দেখতে পাওয়া গেল, বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট পণ্ডিত অধ্যাপক বদরুদ্দিন উমরের ভাষায় “…পাকিস্তান আন্দোলনের সময় মুসলমানদের ‘তাহজীব’ ‘তমদ্দুন’ ইত্যাদি অনেক দোহাই দেওয়া হলেও এসবের সত্যিকারের চেহারা সম্পর্কে নিদারুণ অজ্ঞতা ছিল সর্বস্তরে বিদ্যমান। ‘তাহজীব’ ‘তমদ্দুন’ ইত্যাদি সম্পর্কে কোন নিশ্চিত ধারণার অবর্তমানে কেউ এসবের দ্বারা মনে করল কোর্মা, পোলাও, কোপ্তা, আর গরু খাওয়ার স্বাধীনতা। কেউবা আবার মনে করল ভাষায় যথেচ্ছভাবে আরবী, ফারসী শব্দের আমদানির স্বাধীনতা। কেউ ভাবল মরুভূমির উপর কবিতা লেখার স্বাধীনতা। কারো কাছে বা মুসলমানদের সাংস্কৃতিক আত্মনিয়ন্ত্রণ মানে বোঝানো মসজিদের সামনে হিন্দুদের বাদ্যবাদনের পরিবর্তে মুসলমানদের সেই কাজে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা। কারও কাছে এর অর্থ হল বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করে তার স্থানে আলাওল, গরীবুল্লা এবং কায়কোবাদকে অভিষিক্ত করা। অনেকের বিশেষ করে মুসলিম লিগের দক্ষিণপন্থীদের মনে এসবগুলি মিলিয়ে একটা অপরিচ্ছন্ন ধারণা ‘তাহজীব’ ‘তমদ্দুন’ রক্ষার নামে জাগ্রত রইল। এদিক দিয়ে মুসলিম লিগের অল্প শিক্ষিত এবং উচ্চ শিক্ষিত সমর্থকদের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না এবং পরবর্তীকালেও সে পার্থক্যের কোন চিহ্ন এদের চিন্তার মধ্যে দেখা যায়নি। … হিন্দু দেব-দেবী অথবা প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির কোন চিহ্ন যে সকল শব্দের বা বইপত্রের মধ্যে আছে সেগুলি ব্যবহার এবং পাঠ করা তাদের বিবেচনায় ইসলামী ‘তাহজীব’ ‘তমদ্দুনের’ পক্ষে মারাত্মক এবং ক্ষতিকর। কাজেই তাঁদের প্রচেষ্টা সংস্কৃতি-উদ্ভূত শব্দ এবং বাংলা ভাষার হিন্দু লেখকদের বইপত্র-এ দুইকেই বিষবৎ বর্জন করে দুর্বোধ্য আরবী-ফারসী শব্দ জর্জরিত ভাষায় ‘মরু সাইমুম’ এবং ‘হাতেম তাই’ এর উপর লেখা কাব্যরসের দ্বারা পাকিস্তানী ‘মুমিনদের’ অন্তরকে সিক্ত করা। এই রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দুরভিসন্ধিমূলক প্রচেষ্টা দ্বারা বাংলা ভাষার বিকাশ এবং তার সাথে আমাদের দেশের মানুষের, বিশেষতঃ অল্পবয়স্ক ছেলে-মেয়েদের মনের কিভাবে রুদ্ধ হচ্ছে, তার নিখুঁত পরিমাপ করা সম্ভব না হলেও তার পরিচয় আমাদের শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক জীবনে সহজেই লক্ষণীয়।
স্কুলের নিম্নতম শ্রেনী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চতম পর্যায় পর্যন্ত বাংলা বইপত্র পাঠের হিসাব নিলে দেখা যাবে যে সেখানে রীতিমত এক নৈরাজ্য বিরাজ করছে। বাংলা সাহিত্যের মধ্যে যে সব উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের আবির্ভাব ঘটেছে তাদের সাথা এদের পরিচয়ের বিশেষ সুযোগ নেই। কারণ সামান্য দুই এক ক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রম হলেও সন্তোষজনকভাবে তাঁদের লেখা তাদের পাঠ্য তালিকায় অন্তর্গত নয়। কিন্তু পাঠ্য তালিকাতে না থাকলেও তারা হয়ত অন্য কোন স্থান থেকেও সংগ্রহ করে সেগুলি পড়তে পারে। এই সুযোগ থেকেও যাতে তারা বঞ্চিত হয়ে ইসলামিক ‘তমদ্দুনের’ উন্নতিতে আগ্রহশীল হয় তার জন্যে প্রভাবশালী মহল থেকে ভারতীয় কোন লেখকের বই পাঠ অথবা আমদানি কমানো এবং বন্ধ করার প্রতিও অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে। এর ফলে যে সব বই পত্র তাদের স্কুল কলেজের পাঠ্য তালিকাভূক্ত হচ্ছে সেগুলির প্রভাবে তাদের মনের বিকাশ না ঘটে তাদের চিত্ত হচ্ছে সঙ্কুচিত এবং চিন্তা হচ্ছে বিকৃত।”৪
অধ্যাপক বদরুদ্দিন উমর ‘একুশে ফেব্রুয়ারী ও সাংস্কৃতিক আত্মনিয়ন্ত্রণ’ প্রবন্ধে যে উপলব্ধি ব্যক্ত করেছিলেন পাকিস্তানের শেষ লগ্নে এসে; বাংলাদেশের বয়ঃক্রম অর্ধশতাব্দী হলেও সমাজ চেতনা ও শিক্ষা সচেতনতায় পাকিস্তানি আমল থেকে বাংলাদেশী শাসনকালে তেমন কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। কিন্তু গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের আর্থিক অগ্রগতির স্থায়ী উপাদান ব্যতিরেকেও যে সামাজিক অগ্রগতি দৃশ্যমান তার প্রভাব সমাজ এবং শিক্ষাক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে। তদুপরি গত কয়েক দশকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যায় দ্রুত অগ্রগমনের ফলে সামাজিক-ব্যবহারিক ক্ষেত্রগুলিতে জনগণের মধ্যে যে ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে, এটি সমাজের গতিশীতলতার লক্ষ্মণ মনে হলেও ধর্মীয় উন্মাদনা ও চিন্তন এবং ভারতের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, বাঙালি মুসলমান সমাজে পাকিস্তানি আমলের চেয়ে উন্নতি ঘটেছে বলে পরিলক্ষিত হয় না।
প্রাক দেশবিভাগ থেকেই বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের সঙ্কট দেখা যাক। “১৯৪০ থেকে বাঙালি মুসলমান সজ্ঞানে সচেতনে হিন্দুকে ত্যাগ করতে আরম্ভ করে। বাঙালিত্বের প্রায় সব কিছুকেই হিন্দু জ্ঞানে পরিত্যাগ করা আরম্ভ করে – ধুতি ছেড়ে পাজামা লুংগি, কাঁসা ছেড়ে কাঁচ, পিদিম-চেরাগ ছেড়ে মোমবাতি, শাড়ি ছেড়ে সালোয়ার- কামিজ। জল ছেড়ে পানি ঠিক নয়, হিন্দি পানি শব্দ উর্দুর হাত ধরে আশরাফ মুসলিমের প্রভাবসুত্রে আম- মুসলমান চাষী তাঁতির বাংলা শব্দ হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। এবারে আরম্ভ হল পানিবন্ধী, পানিবিদ্যুৎ। আদাব চিরবিদায় নিল। আসসালাম আলাইকু্ম সর্বাচরণীয় হল, আমদানি হল পশ্চিমা মুসলিম সাম্প্রদায়িক খোদা হাফিজ। থালাবাটি এমনকি বাসন পর্যন্ত বিদায় হয়ে কাপ প্লেট ঢুকল। প্রদীপ-পিদিম এমনকি হিন্দি উর্দু চেরাগ পর্যন্ত হিন্দু বলে সেই ফেলে আসা পূর্ববঙ্গে যে-কোন অনুষ্ঠান-আরম্ভে মাঙ্গলিক প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করলে ইসলাম গেল বলে তুমুল হৈ চৈ পড়ে যায়। সম্ভবত তাই পনরই ডিসেম্বর রাতে লক্ষ লক্ষ তরুণ তরুণী শহীদ স্মরণে মোমবাতি জ্বেলে শহীদ মিনারে স্থাপন করে।” …
আর বাঙ্গালিত্বকে ঘোষণা দিয়ে ত্যাজ্য করে তার বিরুদ্ধে লড়াই করেই তো পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম বাঙালি কেবলই পাকিস্তানি এবং কেবলই মুসলমান হবার জন্যে বঙ্গ বিভাগকে কাজে লাগালেন। কতই যে সুবিধা এতে, কতই যে লাভের ব্যবসা এ। বাল থ্যাকারেকে পঞ্চাশ বছর আগেই পিছনে ফেলে তাঁরা ভেবেছেন বলেছেন করেছেন একটি নীতি – এটা মুসলমানদের দেশ বানিয়েছি, হিন্দুরা হিন্দুদের দেশ হিন্দুস্থানে চলে যায় না কেন? তারপরও যখন যায় না, জমির দখল ছাড়ে না, বাড়ি ছাড়ে না, পরীক্ষায় উচ্চস্থান ত্যাগ করে না, চাকরিতে ব্যবসায়ে ভাগ বসায় তখন থেকে থেকেই ধাক্কা দিতে হয় – মরণ ধাক্কা, পঞ্চাশে, চৌষট্টিতে, বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পরে। সাকুল্যে দাঁড়াল এই, বাঙালিত্বের এখন কোন ঘর নেই আর। এ কোন জাতিসত্তা নয়, যদিও দুই হাজার বছর ধরে অপরে তাকে বাঙ্গালি বলে স্বতন্ত্র সত্ত্বার স্বীকৃতি দিয়েছে।”৫
“প্রথম প্রকাশ বাহাত্তরেরই শরতে। হালে তখন শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং তাও ঘটে যায় অভাবিত ঘটনা। স্বাধীন বাংলার নানা জায়গায় ভাঙ্গা হয় দুর্গা প্রতিমা, পুজাকালেই। সিগন্যাল কি কিছু পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু? হয়ত পেয়েও গ্রাহ্য করেননি কিম্বা হয়ত তার করবার তেমন কিছুই ছিল না। কিম্বা হয়ত সাম্প্রদায়িকতার ঘোড়া বেসামাল হবার আগে তাকে বাগে আনবার জন্যেই দুইটি অপ্রত্যাশিত কাজ করলেন। ইসলামি রাষ্ট্রসংঘের বৈঠকে তড়িঘড়ি যোগ দিলেন। যে মাদ্রাসা শিক্ষা সাধারণ আধুনিক সর্বজনীন শিক্ষার সমান্তরালে উঠে এসে বাংলাদেশের বিভীষণ শত্রু সংখ্যা লাখে লাখে বাড়তে থাকবে, তার পত্তন করলেন তিনি।” … মুক্তিযুদ্ধের ফলে যে দেশ পাওয়া গেল, আবুল মনসুর বললেন এ সেই হারিয়ে যাওয়া পাকিস্তান-মুসলিমদের আবাসভূমি। বাংলাদেশ হয়ে দেশটি হয়ে গেল কিনা পাকিস্তানই, বললেন বাঙালি মুসলমানের ঐ বিশিষ্ট চিন্তানায়ক। তেইশ বছরের লাগাতার সংগ্রাম, নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ – তার বিনিময়ে আবার একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। এরকমটা ভাবা গেল! আবুল মনসুর নির্বোধ ছিলেন না। তীক্ষ্ণধী বুদ্ধিজীবী রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি বাংলাদেশকে ঐ চোখে দেখলেন মানে বাঙালি মুসলিমের শিক্ষিত অগ্রসর অংশের, এবং আওয়ামী লীগেরও, — এক বিরাট অংশই ঐ একই চোখে দেখেছে বাঙালি হিন্দু-মুসলিমের মিলিত রক্তস্রোত ও ভারতের বিরাট সহযোগিতায় গড়ে ওঠা এদেশকে।
… বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঊষালগ্নেই, বাহাত্তরেই রাষ্ট্রে মূলভিত্তি, যা কিনা তার গণমানবস্বার্থ- ভিত্তিক যৌতিকতা ও কার্যকারিতা, নড়বড়ে হয়ে গিয়ে রাষ্ট্র এবং সমাজ পাকিস্তানি তথা সাম্প্রদায়িক অমানবিকতা, অগণতান্ত্রিকতা ও শোষণের দিকে দ্রুত ছুটতে আরম্ভ করেছে।”৬
ওয়াহিদুল হক ও তার স্ত্রী সনজিদা খাতুন বাংলাদেশে রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা ও প্রসারে পথিকৃৎ এবং বাঙালি জাতীয়তা ও সংস্কৃতি আন্দোলনে অন্যতম ভাবুক হিসেবেই পরিচিত। উল্লেখিত প্রবন্ধে তাঁর মোহমুক্ত চিন্তন বিশ্লেষণ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসের এবং সমাজের যে বেদনাদায়ক এবং অভাবিত দিকগুলিতে আলোকপাত করেছেন, বর্তমান বাংলাদেশকে বুঝতে তা সাহায্য করবে।
শুধু বাংলাদেশী বা মুসলমান বাঙালি পরিচয়ই যথেষ্ট ছিল না ‘ধর্মনিরপেক্ষ প্রক্রিয়াকে নির্মূল করে ধর্মভিত্তিক প্রতিক্রিয়াশীলতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি বা সরকারের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু, তা করার জন্য শুধু সংবিধানের ইসলামীকরণই যথেষ্ঠ ছিল না, রাজনীতিতে এবং সরকারে ধর্মান্ধ মানবসম্পদের যোগানটাই সুনিশ্চিত করা ছিল জরুরী। ঠিক এরূপ একটা পটভূমিতে আমরা এদেশে মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার শ্রীবৃদ্ধি ও স্বাধীনতা-বিরোধী ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন দেখতে পাই।’ বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাদ্রাসা শিক্ষা ও ইসলামি মৌলবাদী দলগুলোর যুগপৎ শ্রীবৃদ্ধির ঘটনা এবং সরকারের এ বিষয়ে নীতি ও কর্মকাণ্ড এদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনীতির চরিত্র ও গতি প্রকৃ্তি অনুধাবন করতে সাহায্য করবে।
১৯৭৫ এর পনরই আগস্ট পরবর্তীকালে রাষ্ট্রীয় নীতিকে ইসলামী তথা পাকিস্তানি ভাবধারায় স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যায় এবং শিক্ষাক্ষেত্রে তার প্রয়োগ ঘটতে থাকে। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামি রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিকিকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলের পরপরই পাকিস্তানপন্থী ধর্মীয় মৌলবাদী নেতাদেরকে বিভিন্ন পথে পুনর্বাসিত করা হয়। ১৯৯১ এর সাধারণ নির্বাচনে এ বাস্তবতাই প্রমাণিত হয় যে, এদেশের রাজনীতিতে ধর্মান্ধ বা স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি সত্যিকার ভাবেই প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। এদেশে ইসলামী-মৌলবাদী এবং ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি এবং মাদ্রাসা শিক্ষার দ্রুত বিকাশের একটি যোগসুত্র আছে।
‘বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার দ্রুততর বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্র শিবির, প্রভৃতি ছাত্র সংগঠন এবং ধর্মান্ধ ও মৌলবাদী রাজনৈতিক দলের প্রসার বিবেচনায় এনেই এদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির বিশ্লেষণ করতে হবে। মাদ্রাসাসৃষ্ট বিশাল জনশক্তি ইতিমধ্যেই দেশ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। শিক্ষিত সমাজে সাম্প্রদায়িকতার প্রসার এই আলামতই বহন করে। মাদ্রাসা-সৃষ্ট বিশাল জনশক্তি দ্বারাই ছাত্র শিবির, ছাত্রদল, জাতীয় ছাত্র-সমাজ, জামাতে ইসলামী, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মত দলগুলি যে পুষ্ট হচ্ছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই জনশক্তি আজকে অন্যদের মত, যেমন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক, ম্যাজিস্ট্রেট, এম পি এমনকি কবি সাহিত্যিকদের মত জনপ্রিয় পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবিতে পরিণত হলেও নারী ও সংখ্যালঘুদের প্রতি উদার দৃষ্টিভঙ্গির যথেষ্ট অভাব রয়েছে এদের মধ্যে।’৭ …
আমরা বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের তিন মেয়াদের কালে ‘ইসলামের খেদমতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান’ এর প্রতি একবার দৃষ্টিপাত করতে পারি। বাংলাদেশে ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে যে সকল গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প তিনি সম্পন্ন করেছেন এবং যা চলমান সেসম্পর্কে কিছু তথ্য উপস্থাপন করা হল।
সারাদেশে ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, উপজেলা পর্যায়ে একটি করে মসজিদ ও একটি করে মক্তব সরকারীকরণ প্রকল্প। মসজিদ ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম। মসজিদে পাঠাগার স্থাপন। ১৮টি ইসলামি মিশন কেন্দ্র স্থাপন। ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতি ও ঐ মাদ্রাসার ডিগ্রীকে সাধারণ শিক্ষার ডিগ্রীর সমমানে উন্নীত করা। স্বতন্ত্র মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর স্থাপন। দুই লাখ বার জন ইমামকে ইসলামি বুনিয়াদী শিক্ষা প্রশিক্ষণ। একাশি হাজার একশ সাতচল্লিশ জন আলেম-ওলামাকে দীনি দাওয়াত ভিত্তিক কর্ম সংস্থানের সুবিধা। ইমাম-মুয়াজ্জিন কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন। এক হাজার দশটি এবতেদায়ী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা সহ মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়ন ও ব্যাপক প্রসারে সরকার নানাবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে বা পুরণ করেছে।
অন্যদিকে, ‘হেফাজত ইসলামে’র দাবি মোতাবেক স্কুল পাঠক্রমে পাঠ্য নির্ঘণ্টের পরিবর্তন হয়েছে। এবিষয়ে সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি নিম্নরূপঃ ‘বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী আওয়ামি লিগ সরকার যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছে, তাকে কোনভাবেই সময়োপযোগী, সাম্প্রদায়িকতা-মুক্ত কিম্বা বিজ্ঞানমনস্ক বলা যাবে না। বিদ্যালয়ের শিশু কিশোরেরা কি পড়বে কি পড়বে না, সেটি এখন ঠিক করে দিচ্ছে কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। তারা মাদ্রাসা নিয়ে তাদের দাবি সীমিত রাখেনি; সাধারণ শিক্ষার বিষয়েও খবরদারি করছে। শিক্ষা দপ্তরের উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, “যাদের পিছনে বেশি রাজনৈতিক শক্তি কাজ করে, সরকার তাদের কথা আমলে নিতে বাধ্য। সরকার এখন যা করছে, তা কৌশলগত এবং দীর্ঘ মেয়াদে গিয়ে এ গোষ্ঠী পরাজিত হবে।” …
হেফাজতের সুপারিশে পাঠ্যবই থেকে হিন্দু কবি-প্রাবন্ধিক ও প্রগতিশীল মুসলিম লেখকদের কবিতা ও প্রবন্ধ বাদ দেওয়া হয়েছে। কোন গণতান্ত্রিক দেশে কি এভাবে পাঠ্যবই অদলবদল হতে পারে? ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের সঙ্গে যে সব শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবী যুক্ত ছিলেন, তাঁরা সরকারের এই সিদ্ধান্তের পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু কী কারণে সরকার তাঁদের দাবি উপেক্ষা করেছে এবং হেফাজতের দাবি আমলে নিয়েছে, তার একটি ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে শিক্ষা উপমন্ত্রীর বক্তব্যে।”৮
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার শাসনকালে ইসলামের সেবায় তিনি যে সকল উদ্যোগ নিয়েছেন এবং যা কিছু বাস্তবায়িত হয়েছে তার কিছু দৃষ্টান্ত উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা স্মরণ করতে পারি, সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বিধস্ত বাংলাদেশের প্রথম সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশী সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে সকল সুদুর প্রসারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন, সে সকল সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগকেও মোটেই নগণ্য বলা যায় না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুই প্রথম আইন করে, মদ, জুয়া, হাওজি ও অসামাজিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করে শাস্তির বিধান জারী করেন। সোনার বাংলা গড়ার জন্য তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের এদেশে ইসলামের সঠিক মূল্যবোধ কায়েম করতে চেয়েছেন। মানুষকে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষায় আলোকিত করতে চেয়েছেন যাতে শান্তিপূর্ণ মানবিক সমাজ গড়ে ওঠে। তবে তিনি তার শাসনামলে বাংলাদেশের জনমানসে ইসলাম প্রচার ও প্রসারে অসামান্য অবদান রেখেছেন। অনেকে মনে করেন, সমকালীন মুসলিম বিশ্বেও এর দৃষ্টান্ত বিরল।
শেখ মুজিব ইসলামের জন্য কি কি করেছেনঃ
- বাংলাদেশে প্রথম হজ্জ যাত্রীদের জন্য সরকারি তহবিল থেকে অনুদানের ব্যবস্থা। এ সুবিধা ভারতবর্ষ বা পাকিস্তানের আমলেও ছিল না।
- বঙ্গবন্ধু প্রথম মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডকে স্বায়ত্বশাসন দিয়ে এর নাম রাখেন ‘বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড’, ইসলামি আকিদাভিত্তিক জীবন গঠন ও ইসলামি শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড পুনর্গঠন করেন।
- তবলীগ জামাত একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। ইসলামের পথে দাওয়াত দেওয়াই হচ্ছে এ সংগঠনের একমাত্র কাজ। বঙ্গবন্ধু তবলীগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমার জন্য টঙ্গীতে সুবিশাল জায়গা বরাদ্দ করেন। বিশ্ব ইজতেমার জন্য টঙ্গীতে এ জায়গা বরাদ্দ করেছিলেন বলেই আজ সারা দুনিয়া থেকে লক্ষ লক্ষ মুসলিম এখানে এসে সমবেত হয়ে দুনিয়ায় ইসলাম ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
১৯৭৫ এর ২৮ মার্চ বঙ্গবন্ধু ‘ইসলামি ফাউণ্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করেন।
এই ইসলামিক ফাউণ্ডেশন থেকে যেসব প্রকাশনা সারাদেশে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কাজ করছে তা হলঃ এই প্রতিষ্ঠান থেকে এ পর্যন্ত পবিত্র কুরানের বাংলা তর্জমা, তাফসির হাদিস গ্রন্থের অনুবাদ, রসুল (সাঃ) এর জীবন ও কর্মের উপর রচিত ও অনুদিত গ্রন্থ, ইসলামের ইতিহাস, ইসলামের আইন ও দর্শন, ইসলামি অর্থনীতি, সমাজনীতি, সাহাবি ও মনীষীদের জীবনী ইত্যাদি নানা বিষয়ে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠান ঢাকায় প্রধান কার্যালয়সহ সারাদেশের ৬৪টি জেলা কার্যালয়, আর্ত মানবতার সেবায় ২৮টি ইসলামিক মিশন, সাতটি প্রশিক্ষণ একাডেমীর মাধ্যমে নানামুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে। বৃহত্তম কলেবরে ২৮ খণ্ডে ইসলামী বিশ্বকোষ, ১২ খণ্ডে সিরাত বিশ্বকোষ প্রকাশ করে জ্ঞানের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছে। আলেম-ওলামাদের সঠিক নির্দেশনা দিয়ে জনগণের সামনে ইসলামকে তুলে ধরার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকায় সিরাত মজলিস নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। সিরাত মজলিস ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে রবিউল আওয়াল নামে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বৃহত্তর আঙ্গিকে ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ) মাহফিল উদযাপনের কর্মসূচী গ্রহণ করে। সরকার প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু বায়তুল মোকারম মসজিদ চত্বরে মাহফিলের উদ্বোধন করেন। একজন সরকার প্রধান হিসেবে জাতীয়ভাবে মিলাদুন্নবী মাহফিলের উদ্বোধন উপমহাদেশের ইতিহাসে প্রথম দৃষ্টান্ত। এমনকি ইসলামের ধর্মীয় দিবসগুলো যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু প্রথম বাংলাদেশে ঈদে মিলাদুন্নবী(সাঃ), শব-ই-কদর, শব-ই-বরাত উপলক্ষ্যে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। ৯
উপরের আলোচ্য বিষয়সমূহের নির্যাস থেকে যে ফলাফল বা পরিণতির ছাপ ও তার প্রভাব আজকের বাংলাদেশের সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং রাজনীতিতে থাকবে তা বলাই বাহুল্য। ভারত তথা হিন্দু বিদ্বেষ – যা দ্বিজাতিতত্ত্বের মধ্যেই নিহিত ছিল, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের পটভূমিতে যে সামাজিক অগ্রগতি আমরা দেখতে পাচ্ছি সেখানে দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রভাব মোটেই নগণ্য নয়। আজকের বাংলাদেশে যে ভারত বিদ্বেষ বা ভারত বিরোধীতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি এবং রাজনীতিতে আকস্মিক কোন ঘটনা নয়। তদুপরি, সামরিক/ স্বৈরাচারী সরকারগুলির আমলে বাংলাদেশের সংবিধানের ইসলামিকরণ ও সমাজে পাকিস্তানিকরণের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল পরবর্তী গণতান্ত্রিক (তথাকথিত) সরকারগুলির শাসনকালেও সে প্রক্রিয়া রদ করার কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি, বরঞ্চ, সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রগুলিতে সংকীর্ণতা ক্রমবর্ধমান ।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সমাজতত্ত্ব বিশ্লেষক আবুল বারকাতের মন্তব্য বর্তমান বাংলাদেশের বিরাজমান অবস্থায় যথেষ্ঠই প্রণিধানযোগ্যঃ
“একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা চেয়েছিলাম, আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম – ‘জয় বাংলা’ চেতনায় সিক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ হবে সোনার বাংলা, যে বাংলায় বিনির্মিত হবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শোষনহীন-বঞ্চনাহীন-বৈষম্যহীন এক রাষ্ট্রব্যবস্থা; যে বাংলায় সৃষ্টি হবে অসাম্প্রদায়িক মানস কাঠামোর বিজ্ঞানমনস্ক আলোকিত মানুষের সমৃদ্ধ সমাজ; যে বাংলায় ধর্ম হবে যার যার রাষ্ট্র হবে সবার এবং এ বিনির্মাণ প্রক্রিয়ায় ১৯৭২-এর মূল সংবিধানের চার মূল স্তম্ভ – জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা হবে আমাদের প্রগতির প্রধান দর্শনগত ভিত্তি। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৫ বছর পেরিয়ে গেল – এসব তো হল না। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হল। আর তারই প্রতিফল হিসেবে ফুলে ফেঁপে উঠল রেন্টসিকার নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির দূর্বৃত্তায়ন, রাজনীতর দূর্বৃত্তায়ন, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মভিত্তিক মৌলবাদ ও সংশ্লিষ্ট জঙ্গিবাদ, বিচারহীনতার সংস্কৃতি; আর একই সাথে ব্যাপক জনমানুষের ক্রমবর্ধমান বঞ্চনা-বৈষম্য –অসমতা। এসবকিছুই আমাদের সুদীর্ঘ মুক্তিসংগ্রামের এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী, ওই চেতনার সাথে সম্পুর্ণ বিপরীতধর্মী, সম্পুর্ণ উল্টো, পুর্ণমাত্রায় সাংঘর্ষিক।” ১০
ইসলামপন্থীদের রাজনৈতিক বৈধতা ও সামাজিক প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলনের পর। ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পরেই আওয়ামি লিগ পরিষ্কার করে দেয় যে শাহবাগ-কেন্দ্রিক সেকিউলারদের চেয়ে মিত্র হিসেবে ইসলামপন্থীরা বেশি দরকারি। ২০১৪ এর মার্চে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন, যে মদিনা সনদ অনুযায়ী দেশ চলবে। ২০১৭ সালে টেক্সট বইয়ে পরিবর্তন এনে অমুসলিম লেখকদের রচনা সরিয়ে ফেলে ও সুপ্রিমকোর্টের প্রাঙ্গণ থেকে লেডিজাস্টিসের মুর্তি অপসারণ করে। ২০১৭ সালেই সরকার দেশব্যাপী ৫৬০টি মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। সবটাই করা হয়েছে হেফাজত ইসলামকে খুশী রাখার জন্য।
গত ৫০ বছরে প্রধান দল এবং সরকারগুলি যতই বৈধতার সঙ্কটে নিপতিত হয়েছে, যতই গণতন্ত্রের পথ থেকে সরে গেছে, ততই ধর্ম এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উপর নির্ভরশীল হয়েছে। ১১
একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, পূর্ববঙ্গে তথা পূর্বপাকিস্তানে চব্বিশ বছরের শাসনকালে পাকিস্তান যে সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত বিদ্বেষের মহীরুহ সার-জল দিয়ে সারা দেশে পুষ্ট করে তুলেছিল – সেই প্রজন্মের মুসলমান বাঙ্গালিরাই স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল। আর আজকে ক্ষমতা ও রাজনীতির মল্লভূমিতে রয়েছে তাদেরই দ্বিতীয় প্রজন্ম। সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতির ক্ষেত্রে তাদের মননশীলতা ও দৃষ্টিভঙ্গি বিবিধ কারণে উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত পাকিস্তান আমলের চেয়ে তরলীকরণ হবে এটা স্বাভাবিক – নিরসন হওয়া সম্ভব কি? ভারত বিরোধীতার আরও একটি গুরুত্বপুর্ণ কারণ যা ইতিহাস এবং মনস্তত্ত্বঘটিত। নব্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্ম থেকেই মুক্তিযুদ্ধের যে ইতিহাস ও ভারত সরকার ও ভারতের জনগণ বাংলাদেশের সংকটকালীন সময়ে যেভাবে দুস্থ মানবতার সেবায় ও পাকিস্তানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের প্রবাসী সরকার ও মুক্তিফৌজকে সর্বতোভাবে সাহায্য–সহযোগিতার মাধ্যমে সামরিক ও প্রতিরোধ শক্তিতে বলীয়ান করে তুলেছিল – তা জানার সুযোগ পায়নি বা তাদের সামনে পরিকল্পিতভাবেই তুলে ধরা হয়নি। এর পিছনে রয়েছে পাকিস্তানি মনস্তত্ত্ব – যার ফলে ইতিহাস বিকৃত। ফলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভারত বিদ্বেষের মনস্তত্ত্ব — যা ছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের মূল ভিত্তি – তা থেকে মুক্ত হয়ে নিকট প্রতিবেশী ভারতের সহৃদয় মনুষ্যত্বপূর্ণ আচরণ ও ব্যবহার খোলা মনে গ্রহণ করতে পারছে না। ফলে এরা পাকিস্তানি বশংবদদের অপপ্রচারের শিকার হয়ে যায়। আমরা আশা রাখি, পরিবর্তিত বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে যে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সম্পর্কের নতুন বিন্যাস দেখতে পাওয়া যাচ্ছে – তা ভারত এবং বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। ধর্ম, ভাষা ও সংকীর্ণ সাংস্কৃতিক ভাবনা – অর্থনৈতিক ও মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে একেবারেই গৌণ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। দ্বিজাতিতত্ত্বের অসারতা বার বার প্রমাণিত হয়েছে। মধ্য প্রাচ্যের কট্টর ইসলামী দেশগুলি পর্যন্ত ধর্মীয় কট্টরতা ও সংকীর্ণতা পিছনে ফেলে অর্থনীতি ও মানব উন্নয়নে পরধর্ম সহিষ্ণুতা ও উদার সংস্কৃতির দ্বার খুলে দিতে বাধ্য হয়েছে।
পাকিস্তানের গত পঁচাত্তর বছরের ভারত বিদ্বেষের কঠিন রোগ সেনা সমর্থিত ও সেনা নিয়ন্ত্রিত তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলির কুশীলবদের দ্বারা নিরাময়যোগ্য নয়। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার, বাংলাদেশ ভারত পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ক স্বচ্ছ নীতি গ্রহণ করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যৎ বিপর্যয় রোধ করা কঠিন হবে।
তথ্যসূত্রঃ
১ অজয় রায়, বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তি ধর্ম সাম্প্রদায়িকতার সঙ্কট, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ঢাকা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৬৩-৬৪।
২ Muhammad Ghulam Kabir, Minority Politics in Bangladesh, Nawroze Kitabistan, Dhaka, 1980, pp.150-151.
৩ নূহ-উল-আলম লেনিন, বাঙালি সমাজ ও সাহিত্যে সাম্প্র্দায়িকতা এবং মৌলবাদ, প্রকাশক ডঃ জালাল আহমেদ, পরিচালক (বিক্রয়) বাংলা একাডেমী, ২০১৫, পৃঃ ২৫৭, ২৬৪, ২৬৫, ২৬৯।
৪ বদরুদ্দিন উমর, একুশের সংকলন, বাংলা একাডেমীর পক্ষে প্রকাশনাধ্যক্ষ ফজলে রাব্বি, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১, পৃঃ ৫৯-৬০, ৬২।
৫ ওয়াহিদুল হক, পূর্বপশ্চিম, বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিঃ ধর্ম সাম্প্রদায়িকতার সঙ্কট, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ঢাকা, ১৯৯৯, পৃঃ ৭৪-৭৫।
৬ ওয়াহিদুল হক, পূর্বপশ্চিম, বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিঃ ধর্ম সাম্প্রদায়িকতার সঙ্কট, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ঢাকা, ১৯৯৯, পৃঃ ৭৪, ১০১-১০৩।
৭ নজরুল প্রামাণিক, ‘মাদ্রাসা-মানবসম্পদ ও ধর্ম নিরপেক্ষতার ভবিষ্যৎ’, বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিঃ ধর্ম সাম্প্রদায়িকতার সঙ্কট, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ঢাকা, ১৯৯৯, পৃঃ ২৮৪।
৮ সোহরাব হাসান, হেফাজতের শক্তি ও সরকারের অসহায়ত্ব, প্রথম আলো, ২ আগস্ট, ২০১৯।
৯ মুরাদ হাসান, বাংলাদেশে ইসলাম ও বঙ্গবন্ধু, মতামত, ২৬ আগস্ট, ২০২১, bdnews24.com/bangla.
১০ আবুল বারাকাত, বাংলাদেশে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতির অন্দর বাহির, মুক্তবুদ্ধি প্রকাশনা, ঢাকা, ২০১৮, পৃঃ ২১৯, ২২০।
১১ আলী রিয়াজ, সাইমুম পারভেজ, রাজনীতিতে ধর্মের ফিরে আসা, প্রথম আলো, ২২।৩।২০২১।
Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo.
Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo.