Center For Research In Indo

বাংলাদেশে হিন্দুদের সমস্যা এবং সমাধান শিতাংশু গুহ, নিউইয়র্ক

বাংলাদেশে হিন্দুদের সমস্যা এবং সমাধান-১

ছবিটি দু’টি সাপের। একটি বিশালাকায় অজগর এবং অপরটি কিং-কোবরা। এরা জীবন বাজি রেখে মারামারি  করছে। কোবরা কামড় দিয়েছিল অজগরকে। অজগর তাই চেপে ধরে কোবরা-কে। পরিণতি দু’জনের মৃত্যু। অজগর মরে কোবরার বিষে; আর কোবরা মরে অজগরের প্রচন্ড চাপে। অথচ এরা স্বজাতি। সমাজে প্রতিনিয়ত এমন ঘটনা ঘটছে। বন্ধু-বন্ধুতে, পরিবারে, ধর্মে, ভাইয়ে-ভাইয়ে, সর্বত্র। কারণ, ঈর্ষা, ইগো, কে কত বড়, নেতৃত্ব, রাজনীতি, সর্বত্র। কুৎসা, চরিত্রহনন, দালাল, চামচা আখ্যায়িত করা, টাকা মেরে দেয়া, গুজব, মিথ্যাচার- এসব চলতে থাকে। শেষমেষ উভয়পক্ষ হেরে যায়?

 

বাংলাদেশের হিন্দু কমিউনিটি’র দিকে তাকালে কথাটি পরিষ্কার বোঝা যায়। অন্য কমিউনিটি’র কথা বলবো না, এক্ষণে শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের কথা বলবো। দেশে ও প্রবাসে একই চিত্র। সামাজিক মাধ্যমে প্রশংসা নেই, শুধু চরিত্রহনন। প্রত্যেকটি মানুষের কিছু ভাল গুণ থাকে, থাকে কিছু বদভ্যাস। ভালমন্দ নিয়েই মনুষ্য চরিত্র গঠিত হয়? যার মধ্যে শুধুই ভাল বিদ্যমান, তিনি মানুষ নন, দেবতা, বা সাধু-সন্ন্যাসী। সাধু-সন্ন্যাসীরা সমাজের কাজে লাগেনা, তাঁরা নিজেদের স্বর্গলাভের জন্যে কাজ করেন। এটি হিন্দু সমাজের দুর্ভাগ্য। 

 

ভারতে যত সাধু সন্ন্যাসী আছেন, এঁরা রাস্তায় নেমে এলে সব-সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো। বাংলাদেশে হিন্দু’র ওপর এত অত্যাচার হচ্ছে, সাধু-সন্ন্যাসী-পুরোহিতরা কি মাঠে নামেন? তাঁরা নামেন না, মন্দিরগুলো ভক্তদের বোঝায় ওসব রাজনীতি, বাজে কাজ, সময় নষ্ট, ধর্মে মনোনিবেশ করা এর চেয়ে ঢের বেশি জরুরী!  অথচ রাষ্ট্র না থাকলে ধর্ম টেকানো দায়। সৌদি আরবে গিয়ে আপনি ইচ্ছে করলেই পুজা করতে পারবেন না? ওআইসি দেশগুলোতে অন্য ধর্মের ক্ষেত্রে হাজারো বিধিনিষেধ। মক্কা-মদিনায় আপনার ঢোকার অনুমতি নেই! 

 

অথচ মধ্যপ্রাচ্যে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠার অনুমতি পেলে আপনি ‘বিজয়’ অনুভব করেন। ইউরোপ-আমেরিকায় আপনি মহাসমারোহে ‘কীর্তন’ করেন, রাস্তায় বিশাল মিছিল করেন, এটুকু বুঝতে চাননা যে, প্রশাসন না চাইলে আপনি তা করতে পারবেন না? ঢাকা-চট্টগ্রামে জন্মাষ্টমীর মিছিলে যত মানুষ হয়, সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধে সেই মানুষগুলো রাস্তায় নামলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বন্ধ হয়ে যাবে। ২০২১-র অক্টোবরে কুমিল্লার ঘটনায় ‘ইসকন’ মাঠে নেমেছিল, কারণ তাদের ওপর হামলা হয়েছিল। তখন যদি মতুয়া, অনুকূল ঠাকুর, রামকৃষ্ণ মিশন, বা অন্যরা মাঠে নামতো? না, তাঁরা নামেনি। 

 

নিজের ওপর হামলা না হলে কেউ মাঠে নামেনা। এক হিন্দুর বাড়ী পুড়লে অন্য হিন্দু ভাবে, আমার কি, আমারটা তো পুড়েনি। এক হিন্দুর মেয়ে উঠিয়ে নিয়ে গেলে অন্য হিন্দু ওই মেয়ের দোষ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পরে? নিজের মেয়েটা হারিয়ে গেলে কপাল চাপড়িয়ে মরে। গুরুকে খুশি করতে গিয়ে হিন্দু প্রতিবেশী হিন্দু’র সুখে সাথী হতে ভুলে যায়। ঘরে আগুন লাগলে প্রতিবেশীই যে প্রথম এগিয়ে আসবে তা বেমালুম ভুলে থাকে। হিন্দু চায়, তার সমস্যা সমাধানে ভারত এগিয়ে আসুক। এতকাল পরেও হিন্দু বুঝলো না যে, ভারত এগিয়ে আসেনি, আসবে না, নিজেদের সমস্যা নিজেদের সমাধান করতে হবে।

বাংলাদেশে হিন্দুদের সমস্যা এবং সমাধান-২

বাংলাদেশে এ সময় দু’জন হিন্দু ভদ্রলোক বেশ সোচ্চার। একজন হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, এবং অপরজন হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব এডভোকেট গোবিন্দ  প্রামাণিক। সামাজিক মাধ্যমে সবাই এদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার হতে দেখেছেন। এদের পক্ষে খুব বেশি কথাবার্তা কি চোখে পড়ে? এঁরা দু’জন আবার একে অপরের চক্ষুশূল, অনেকটা অজগর ও কোবরা’র মত! এই দুইটি মানুষ কি খুব খারাপ? কতটা খারাপ? আপনার চেয়েও খারাপ? ভাবুন, জীবনে কি কখনো এ দু’টো মানুষের প্রশংসা করেছেন? তাঁরা কি কোন ভাল কাজ করেননি? 

 

রানা দাশগুপ্তের কথা উঠলেই বলা হয়, সরকারের দালাল। প্রসিকিউটর থেকে সরকারের সকল সুবিধা নেয়, তাঁর পক্ষে সরকারের বিরোধিতা করা সম্ভব নয়, সবই লোক দেখানো! গোবিন্দ প্রামাণিকের কথার শুরুতেই  বলা হয়, উনি ডিজিএফআই’র লোক, বিশ্বহিন্দু পরিষদের লোক। বুঝলাম, আপনি তাঁর সমালোচনা করছেন, আপনি কি ওনার মত সাহস করে কথা বলতে পারছেন? আপনি কেন বিশ্বহিন্দু পরিষদ বা ডিজিএফআই’র লোক হন’না? রানা দাশগুপ্তের মত সরকারি দালাল হয়ে আপনিও কিছু কথাবার্তা বলুন, কিছু কাজ করুন। আপনার কোন সমালোচনা নাই, কারণ আপনি কাজ করেন না, শুধু সমালোচনা করেন! যিনি কাজ করেন তিনি সমালোচিত হন, এটিই স্বাভাবিক। 

রানা দাশগুপ্তকে চিনি ৪৫ বছর। ১৯৭৮ সালে ঢাকায় ‘শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তি আইন পরিষদ গঠিত হয়, এর সভাপতি ছিলেন বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্য্য এবং সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আমিনুল হক, যিনি সার্জেন্ট জহুরুল হকের ভাই, এবং পরে এটর্নি জেনারেল হয়েছিলেন। রানা দাশগুপ্ত, সুব্রত চৌধুরী, প্রফেসর নিম ভৌমিকের নেতা ছিলেন, আমি ছিলাম দপ্তর সম্পাদক। রাশেদ খান মেনন, এমপি’র ওয়ার্কার্স পাটির পল্টন বিল্ডিং-এ এর একটি অফিস ছিল। যে লোকটি সেই তখন থেকে দেশের জন্যে কাজ করে যাচ্ছে, আপনি ‘দুই দিনের বৈরাগী’ তুড়ি বাজিয়ে তাঁকে উড়িয়ে দেবেন, তা তো হয়না। তাঁর কাজের গঠনমূলক সমালোচনা করুন, তিনি বনেদি, সম্ভ্রান্ত পরিবার, তাঁর দুর্নীতি করার প্রয়োজন হয়না। এ সময়ে তাঁর অবস্থান ২১ জন সংখ্যালঘু এমপি, মন্ত্রীর চেয়ে শক্তিশালী। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পর তিনিই এখন বাংলাদেশে হিন্দুদের অলিখিত নেতা, মুখপাত্র। রানা দাশগুপ্ত কি ভুল করেন না? অবশ্যই করেন। যুক্তরাষ্ট্রে এসে তিনি ঐক্য পরিষদকে চারভাগে ভাগ করে দিয়ে গেছেন। বহির্বিশ্বে আমেরিকা ও জেনেভায় গিয়ে তিনি কমিটি করছেন, যাদের বাড়ীতে ছিলেন তাদের নেতা বানিয়েছেন, দু’টি কমিটি ‘অকেজো’। আমরা তাঁর কঠোর সমালোচনা করেছি, এখনো করি। গতবার যাতে তিনি সাধারণ সম্পাদক হতে না পারেন একটি শক্তিশালী গ্রূপ সেই চেষ্টা করেছিল, বলেছিল , আমি অপারগতা জানিয়েছিলাম, সবার সাথে যোগাযোগ করেছিলাম, তিনি নেতা, হিন্দুদের একজন নেতার বড় প্রয়োজন, তাঁর বিরোধিতা ন্য, তাঁকে উপরে উঠতে সাহায্য করুন।

একই কথা এডভোকেট গোবিন্দ প্রামাণিকের জন্যে প্রযোজ্য। গোবিন্দ প্রামাণিক সাহস করে যা বলছেন, তা কি আপনি বলতে পারেন? আমি কি লিখতে পারি? পারিনা, আপনি/আমি যা পারিনা, তা অন্য কেউ করছে, তাতে সমস্যা কি? তাঁর সব কথার সাথে আপনার একমত হতে হবে কেন? আমি তাঁর অনেক নীতির সাথে একমত নই, কিন্তু এজন্যে আমায় তাঁর বিরোধিতা করতে হবে কেন? তিনি আমার আশীর্ব্বাদ থেকে বঞ্চিত হবেন কেন? হিন্দু মহাজোট যখন প্রথমবার ভাঙ্গে তখন এর এক নেতাকে আমি বলেছিলাম, ‘আপনারা একসাথে থাকুন’, গোবিন্দ প্রামাণিক মাঠে আছে, তাঁর সাথে পারবেন না। তাঁরা আমার কথা শোনেনি, তাঁরা হারিয়ে গেছেন। কিছুদিন আগে যখন কিছু লোক বেরিয়ে গেলেন, তাঁদের একজনকে একই কথা বলেছিলাম, তারাও শোনেনি, তারাও হয়তো হারিয়ে যাবে। এরমানে এই নয় যে, যারা বেরিয়ে গেছেন, তাঁরা অযোগ্য? শুধুমাত্র একত্রে কাজ করতে না পারার জন্যে আমাদের অনেক নেতা হারিয়ে যাচ্ছেন। গোবিন্দ প্রামাণিক ঈশ্বরের বরপুত্র নন, তারও অনেক দোষগুণ আছে, কিন্তু সাহস নিয়ে সত্যকথা বলার কারণে তিনি সামনের সারিতে আছেন, এবং তাঁর পিছনে অনেক মানুষ আছে। যা বলছিলাম, হিন্দুদের একজন নেতা দরকার, কে নেতা হবেন কেউ জানেনা, যাঁরা আছেন, তাঁদের টেনে নীচে না নামিয়ে ওপরে উঠতে সাহায্য করুন।   

বাংলাদেশে হিন্দুদের সমস্যা এবং সমাধান-৩

প্রিয় হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু ভাইবোনেরা, উঠে দাঁড়াবার সময় এখনই। জেগে উঠুন, নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ান। দীর্ঘদিন ধরেই ভাবছি, শুনছি, জানতে চেষ্টা করছি যে, বাংলাদেশে আমার হিন্দু ভাইবোনেরা  একজন চৌকষ, সাহসী, দৃঢ়চেতা নেতা চান। কিন্তু কেউ দায়িত্ব নিয়ে নিজে নেতা হতে চাননা, অথবা এজন্য কিছু করতে চাননা? বিপদ এলে তাঁরা দ্রুত অন্যকে দোষারোপ করেন, তাঁরা সরকার, আওয়ামী লীগ, হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান ঐক্য পরিষদ, হিন্দু মহাজোট বা এমনতর সংগঠনের সমালোচনা করেন। দায়িত্ব এড়িয়ে যান।   অবশ্যই সরকার, দল বা ঐসব সংগঠনের দায়িত্ব আছে, কেননা তাঁরা সংখ্যালঘু সুরক্ষার কথা বলে। কিন্তু ওহে, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান, আদিবাসী বা অন্য যেকোন নির্যাতীত ধর্মীয় জনগোষ্ঠী, আপনাদের কি কোন দায়িত্ব  নেই? 

 

আপনি কি আপনার কর্মের দায়িত্ব নিয়েছেন? মৌলবাদী-সন্ত্রাসীরা যখন আপনার বাড়ী আক্রমণ করে তখন কি আপনি রুখে দাঁড়িয়েছেন? আপনার বাড়ী রক্ষা করার প্রথম দায়িত্ব কি আপনার নয়? আপনার নাবালিকা বোনকে যখন দুর্বৃত্ত জোর করে উঠিয়ে নিয়ে যায়, ভাই হিসাবে তাঁকে রক্ষা করা কি আপনার কর্তব্য নয়? আপনি কি তা করেন? আপনার আরাধ্য মূর্তি যখন ভাঙ্গা হয়, আপনার দেবালয় যখন আক্রান্ত হয়, ভক্ত হিসাবে তা ঠেকানো বা প্রতিরোধ করা কি আপনার দায়িত্ব নয়? ইলনোর রুজভেল্ট বলেছেন, ‘আপনার সম্মতি ব্যতীত কেউ আপনাকে ‘ছোট’/ভীত বা ‘নিকৃষ্ট’ করতে পারেনা’। আপনি বুঝতে পারছেন না যে, আপনি প্রতিবাদী হচ্ছেন না বলেই আপনার প্রতিবেশী বা মৌলবাদী শক্তি আপনার ঘরে প্রবেশ করার সুযোগ পেয়ে আপনার জীবনকে  বিষিয়ে দিচ্ছে।

আমি জানি, আপনি ভয় পাচ্ছেন। আপনার মূল্যবান জীবন হারানো’র ভয়ে আপনি ভীত। আপনি চান অন্য কেউ এসে আপনার বাড়ী রক্ষা করুক, আপনার ব্যবসা বাঁচাক, আপনার পরিবারের সন্মান রক্ষা করুক। আপনি পালিয়ে গেলেন, আপনার বাড়ী ভস্মীভূত হলো, ধনসম্পদ লুট হলো, পরদিন সকালে ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে আপনি ‘অসহায়’-ভাবে আক্ষেপ করছেন, বিলাপ করছেন, অথচ এমনও হতে পারতো যে, আগের দিন আপনি একটু সাহসী হলে আপনার সবকিছু রক্ষা পেতে পারতো? বাংলাদেশ রাষ্ট্র, বা সমাজ ‘কল্যাণমুখী’ নয়, তা আপনি জানেন, এরপরও আপনি কিভাবে বুঝতে অক্ষম যে, এটি প্রথমে আপনার সমস্যা,  আপনি রুখে দাঁড়ালেই কেবল অন্যরা উৎসাহী হয়ে আপনার পাশে দাঁড়াবে। হ্যাঁ, যা দরকার তা হচ্ছে, একটু সাহস এবং সামান্য আত্মত্যাগ। এখানে আত্মত্যাগ হচ্ছে, সামান্য বিপদ দেখলেই পালিয়ে যাওয়ার মানসিকতা ত্যাগ করা! আপনি কি এজন্যে তৈরী? আপনি তৈরী না হলে ভাববেন না যে, অন্য্ কেউ এসে আপনার জন্যে আত্মত্যাগ করবে, তা হয়না! অতীতে হয়নি, ভবিষ্যতেও হবেনা। 

 

এজন্যে আমি সর্বদা বলি, আপনার দায়িত্বটুকু আপনি পালন করুন। সমালোচনা করুন, কিন্তু আপনার ‘উঠে দাঁড়াবার’ ব্যর্থতার দায়ে অন্যদের দায়ী করবেন না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের হিন্দুদের ক্ষেত্রে এটিই ঘটছে। প্রত্যেকে একে অন্যকে দোষ দিচ্ছে, কেউ দায়িত্ব নিয়ে কিছু করছে না। আমি কি জ্ঞান দিচ্ছি? না, আমি আমার জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলছি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো দু’জন ভদ্রলোক বা নেতার পরামর্শ শোনার। তাঁরা আমায় স্পষ্টত: বলেছেন, ‘নিশ্চয় তুমি ছাত্রলীগ করতে পারো, কিন্তু একই সাথে তোমার উচিত ধর্মীয় সংখ্যালঘুর স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করা’। আমি আজো তাই করছি, ওই দুই নেতার পরামর্শ মেনে চলছি। 

আমি কি কিছু করতে পেরেছি? বলা শক্ত বা এটি মানুষ বলবে, কিন্তু তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পারিনি বলে কি আমি থেমে যাবো? না, আমি থামছি না, থামার কোন কারণ নেই? যেমন শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন, ‘কর্মেই তোমার অধিকার, কর্মফলে নয়’। আমিও তাই কাজ করে যাচ্ছি, লাভের আশায় নয় ফলের চিন্তা না করে সযত্নে লক্ষ্য রাখছি, আমার কর্ম যেন বাংলাদেশের হিন্দুদের পক্ষে যায়, মানুষের পক্ষে থাকে। আমি তিনজন নেতাকে সম্মান করি, দৃষ্টান্ত দিই, অনুসরণ করি। এঁরা হচ্ছেন, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, ছত্রপতি শিবাজী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। প্রথম দু’জন আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন, তৃতীয় জন সফলতা-ব্যর্থতার সাক্ষ্য বহন করেন। প্রথম দু’জন উৎসাহ উদ্দীপনা যোগায়, তৃতীয় জন আশা জাগানিয়া। মানুষ আশা নিয়েই বাঁচে, আমিও আশা নিয়েই বেঁচে আছি যে, একদিন আমার স্বপ্ন সফল হবে।

কি সেই স্বপ্ন? মার্টিন লুথার কিং বলেছেন, ‘আই হ্যাভ এ ড্রীম’। তাঁর স্বপ্ন ছিলো, তাঁর চার সন্তান এমন এক সমাজে বসবাস করবে যেখানে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে তারা সমাজে বিবেচিত হবে, তাদের ‘গায়ের রং’ দিয়ে নয়। আমারো স্বপ্ন তাই, বাংলাদেশের হিন্দু বা অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা তাঁদের যোগ্যতা দিয়ে এমন এক সুরক্ষিত সমাজে বসবাস করবে, যেখানে তাঁরা ধর্ম দিয়ে চিহ্নিত হবেনা বরং শিক্ষাদীক্ষা চরিত্র দিয়ে গণ্য বা বিচার্য হবে। এমন স্বপ্ন দেখা মন্দ নয়! কেউ হয়তো বলবেন মুসলিম সমাজে এরূপ সমাজে স্বপ্ন অবাস্তব। তারপরও বলা যায় ‘স্বপন যদি মধুর এমন হোক না সে কল্পনা–’।  সুন্দর স্বপ্ন দেখা ভালো। বাংলাদেশের হিন্দু সুন্দর স্বপ্ন দেখতে অভ্যস্ত হও, সাহসী হও সবল সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে সুস্থ হয়ে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াও, বলঃ এদেশ আমার। এ মাটি আমার চৌদ্দ পুরুষের। ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সুচাগ্র মেদিনী’। ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন। 

 বাংলাদেশে হিন্দুদের সমস্যা এবং সমাধান-৪

বাংলাদেশে মূর্তিভাঙ্গা, মন্দির আক্রমন একটি নিত্যনৈমত্যিক ঘটনা। যারা এগুলো করে তারা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস থেকেই তা করে। প্রশাসন বিচার করেনা, কারণ তারা এটিকে ‘অপরাধ’ মনে করেনা। পুলিশ এদের একাজকে ‘পাগল’ আখ্যায়িত করে ছেড়ে দেয়। এসব কারণে বাংলাদেশে হাজার হাজার মূর্তিভাঙ্গা বা মন্দির আক্রমণ হলেও আজ পর্যন্ত এ অপরাধে কারো বিচার হয়নি, বা কেউ শাস্তি পায়নি। বাংলাদেশে এমন কোন একটি প্রতিষ্ঠিত মন্দির পাওয়া যাবেনা, যা কখনো না কখনো আক্রান্ত হয়নি? 

 

তাহলে মূর্তিভাঙ্গা বন্ধ হবে কিভাবে? মন্দির আক্রমন ঠেকানো যাবে কিভাবে? যেহেতু প্রশাসন বা সরকারের সদিচ্ছার অভাব আছে, তাই হিন্দুদের অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। প্রথম কথা হচ্ছে, হিন্দু যদি তার আরাধ্য মূর্তি বা মন্দির রক্ষা করতে না পারে, তাহলে পুজা করা বা মন্দিরে যাওয়ার অধিকার থাকে কি? মূর্তি বা মন্দির রক্ষার প্রথম দায়িত্ব তো ভক্তের বা হিন্দুর। হিন্দু কি কখনো মন্দির রক্ষায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছেন? ভবিষ্যতে দাঁড়াবেন এমন চিন্তা কি মাথায় আছে? 

 

মন্দিরে প্রচুর চাঁদা ওঠে। এই চাঁদার কিছু অংশ মন্দির রক্ষায় ব্যয় হয়কি? মন্দিরে প্রহরী রাখা হয়না কেন? বর্তমান যুগে সিসি ক্যামেরা সহজলভ্য, ক’টি মন্দিরে সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে? নাই কেন? চাঁদার সামান্য অংশ দিয়েই তো এটি সম্ভব। তদুপরি মন্দির কর্তৃপক্ষ আবেদন করলে একাজে দান করতে ভক্তের অভাব হবার কথা নয়? 

প্রায় সকল মন্দিরে বা পূজামণ্ডপে একটি পরিচালনা পরিষদ বা কমিটি থাকে। এই কমিটি’র অন্যতম ‘লক্ষ্য ও কর্ম’ হওয়া উচিত মূর্তিভাঙ্গা প্রতিরোধ এবং মন্দির রক্ষা। দুর্ঘটনা ঘটলে দেখা যায় মন্দির কমিটি’র প্রেসিডেন্ট/ সেক্রেটারি মিডিয়ায় কথা বলেন, দুস্কৃতিকারীদের ওপর দোষ দেন, বিচার চান; কিন্তু দুর্ঘটনা রোধে তারা কি ব্যবস্থা নিয়েছেন তা বলতে পারেন না? এর কারণ হচ্ছে, তারা কোন ব্যবস্থা নেননি? হরদম মূর্তিভাঙ্গা বা মন্দির আক্রমনের ঘটনা ঘটলেও তাঁরা কেন কোন আগাম ব্যবস্থা নেননা, এর কারণ কি? 

 

কোন মন্দির আক্রান্ত হলে প্রথমেই উচিত প্রতিরোধ করা। আগাম ব্যবস্থা নেয়া না হলে বা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হলে, প্রথমেই মন্দির কমিটি’র সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক বা পুরো কমিটি’র পদত্যাগ করা। ভক্তদের উচিত তাদের পদত্যাগে বাধ্য করা। কমিটি’র উচিত মামলা করা। স্থানীয় থানা মামলা না নিলে উচ্চতর আদালতে মামলা করা উচিত। থানার সামনে, বা ডিসি, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করা। এগুলো কমিটি’র কাজ, কমিটি এর দায়িত্ব পালন করলে মন্দিরে হামলা বা মূর্তিভাঙ্গা অনেকাংশে বন্ধ হবে। 

 

শুধু প্রশাসন, সরকার বা মৌলবাদীদের দিকে আঙ্গুল তুলে লাভ নেই? আপনার মন্দির আপনাকেই রক্ষা করতে হবে। মন্দিরগুলো রক্ষণাবেক্ষণ  করুন, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করুন, সাহসী, যোগ্য লোক নিয়ে মন্দির কমিটি গঠন করুন। শাঁখারী বাজারে পাকিস্তান আমলে কখনো রায়ট বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি, এর কারণ শাঁখা কাটার ‘করাত’। আগে হিন্দুর বাড়িতে একটি রামদা থাকতো, এখন থাকেনা। হিন্দুর সকল দেবদেবী যোদ্ধা কিন্তু হিন্দু সকল সমরাস্ত্র দেবতার হাতে দিয়ে নিজে নিরস্ত্র হয়ে বসে আছে। আত্মরক্ষার জন্যে কখনো কখনো যুদ্ধ করতে হয় বৈকি, হিন্দু ভুলে গেছে যে ‘সারভাইবেল অফ দি ফিটেস্ট’ কথাটি সত্য।

বাংলাদেশে হিন্দুদের সমস্যা এবং সমাধান-৫

আসুন আমরা নিন্দা বাদ দিয়ে সবার প্রশংসা শুরু করি। সমালোচনা করে তো কিছু হচ্ছেনা, প্রশংসা করে দেখা যাক? আপনার সদিচ্ছা আছে, আপনি একজন যোগ্য নেতা চান, প্রশংসা করুন। প্রশংসা করতে পয়সা লাগেনা, ফ্রি, দেদার প্রশংসা করুন। আপনার প্রশংসা অন্যদের কাজে উৎসাহ জোগাতে পারে? এতে আপনি নিজেও লাভবান হবেন, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আপনার জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আপনি/আমি প্রশংসা করলেই কেউ নেতা হয়ে যাবেনা, যিনি নেতা হ’ন, তিনি আপন  গুণেই  নেতা হবেন। দেখবেন, অনেকে অভিযোগ করছে যে, সিনিয়ররা সরছেন না বলেই তাঁরা নেতা হতে পারছেন না? বারাক ওবামা সিনিয়রদের  ধাক্কা মেরে নয়, সিনিয়রদের সাথে নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হ’ন। ঋষি সুনক যোগ্যতা দিয়ে সিনিয়রদের ডিঙ্গিয়ে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। 

 

অযোগ্য, অকর্মন্য লোকই অন্যের সমালোচনা করে, যোগ্যরা কাজ করে এগিয়ে যায়। সমালোচনা হবে, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের সমালোচনা আছে, আপনি/আমি তো কোন ছাড়! জানি, আপনার সদিচ্ছা আছে, আপনি চান আপনার পছন্দমত একজন যোগ্য নেতা? দশটি শেয়ালের নেতা যদি একটি সিংহ হয়, তখন শিয়ালগুলো সিংহের মত আচরণ করে? আপনি বাঘের মত গর্জে উঠুন, দেখবেন আপনার নেতাও সিংহের মত ঝাঁপিয়ে পড়বে। আপনি নেতিবাচক ভূমিকা পালন করলে আপনার নেতাও ‘শিয়াল’-র মতোই হবে, তাই না? হিন্দু অন্য হিন্দু’র সমস্যা দেখলে পাশ কাটিয়ে যায়, অর্থাৎ নিজেকে হিন্দু হিসাবে পরিচয় দিতে চায়না, অথচ তিনি নিজে বিপদে পড়লে হিন্দু হিসাবেই সাহায্য চান! এমন ঘটনার অজস্র দৃষ্টান্ত আছে। রামু থেকে নাসিরনগর হয়ে কুমিল্লা ঘটনায় প্রমাণ হয়েছে অন্যদের কাছে আপনার আর্তি মূল্যহীন, তাই আপনাকে নিজস্ব সম্প্রদায়ের সাথেই মিলে মিশে থাকতে হবে, মরলে হিন্দু হিসাবেই মরতে হবে, বাঁচলে হিন্দু হয়েই বাঁচতে হবে।  

 

বাংলাদেশের হিন্দু ভাবতে ভুলে গেছে তাঁরা ‘সূর্য সেনের ভাই, প্রীতিলতা তাঁদের বোন, ক্ষুদিরাম, বিনয় -বাদল-দীনেশের উত্তরসূরী। হিন্দুর সব আছে, বিদ্যা আছে, বুদ্ধি আছে, অর্থবিত্ত আছে; বাংলার হিন্দু কাপুরুষ নয়, তাদের গৌরবময় ইতিহাস ছিল, আছে। হাজার বছরের পরাধীনতার গ্লানি ধুয়ে-মুছে আবারও জেগে উঠতে হবে, গাইতে হবে ‘বিজয়ের গান’। কেউ হয়তো হিন্দুদের মধ্যে জাতপাত বিভক্তির কথা বলবে, বিভক্তি নেই কোথায়? বৈচিত্রের মাঝেই ঐক্য খুঁজে বের করতে হবে। হিন্দু এক গ্রূপ গিয়ে অন্য গ্রূপের ওপর বোমা মারেনা। ভাই-ভাই বিবাদ থাকে, হিন্দু বললেই যখন দুইভাই এক কাতারে দাঁড়িয়ে যাবে, তখন সমস্যা থাকবে না। 

 

সবাই বলেন, হিন্দুরা ঐক্যবদ্ধ হলে সকল সমস্যার সমাধান সম্ভব। কথাটা সত্য। কিন্তু ঐক্য কোথায় আছে? বেশিরভাগ মানুষ যখন একই সুরে কথা বলে, তখন ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়, সমস্যার সমাধান হয়। কাজেই ঐক্যের অজুহাত না দিয়ে ‘আপনার কাজটি আপনি করুন’, দেখবেন সমস্যা উড়ে গেছে। প্রসঙ্গ বাংলাদেশ, বাংলাদেশের হিন্দু’র কথাই বলছি। ভারত ভাগে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ বাঙ্গালী হিন্দু। বিশেষত: পূর্ব-বাংলার হিন্দু। বাংলাদেশের হিন্দু। পাঞ্জাবের মত বাংলায় ‘জনসংখ্যা বিনিময়’ হলে বাঙ্গালী হিন্দু বেঁচে যেতো। হয়নি, তাই পশ্চিমবাংলা এখন ভুগছে। বাংলাদেশের হিন্দু ভুগছে। জনসংখ্যা বিনিময় হলে হয়তো বাঙ্গালী মুসলমানও ভালো থাকতো। যা হয়নি, তা নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই, বাস্তবতার নিরিখে বাংলাদেশের হিন্দু’র ভাল থাকার উপায় কি? 

 

উপায় একটাই, উঠে দাঁড়াতে হবে। শিশু যে মাটিতে আছাড় খায়, সেই মাটি ধরেই উঠে দাঁড়ায়। হিন্দুকেও ভারতের দিকে তাকিয়ে না থেকে বাংলাদেশের মাটি ধরেই উঠে দাঁড়াতে হবে। বীরভোগ্য বসুন্ধরা, শ্রীকৃষ্ণ দুর্বলকে সাহায্য করেনা, অর্জুনের মত যোদ্ধাকে সাহায্য করে জিতিয়ে দেয়। ‘য পলায়তি স জীবতি’ ভুলে যান, ‘চামচিকার’ মত বেঁচে লাভ কি? বাঁচতে হয় ‘হাতির’ মত! বলা হয়, দুর্বল বারবার মরে, বীর একবারই মরে। ‘জন্মিলে মরিতে হইবে’, আসুন হাতির মত বাঁচি অথবা বীরের মত মরি! মনে রাখা দরকার, খরগোশ ঘুমিয়ে পড়েছিল বলেই কচ্ছপ জিতেছিল, হিন্দু জাগলে এখন যেগুলো সমস্যা মনে হয়, তখন তা সমাধান হয়ে যাবে। ‘সারভাইভাল অফ দি ফিটেষ্ট’ থিওরী সত্য। (শেষ) #  

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *