Center For Research In Indo

বাংলাদেশ কেন স্থিতিশীল ভূখণ্ড নয় ?

বিমল প্রামাণিক

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বয়স বর্তমানে পাঁচ দশক অতিক্রান্ত। পূর্বে এই ভূখণ্ডটি পাকিস্তানের অধীনে ছিল চব্বিশ বছর  অর্থাৎ ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। তারও পূর্বে এটি ছিল বৃটিশ শাসনের অধীনে প্রায় দু’শ বছর। বৃটিশ সরকারের শাসনের শুরুতেই বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অধীনে আসে অবিভক্ত বাংলা, আসাম, বিহার, মেঘালয়, উড়িষ্যা, ত্রিপুরা। ১৭৬৫ সালের পরে আরও যুক্ত হয় ঝাড়খণ্ড। ১৮৭৭ সালের পর অর্থাৎ উনবিংশ শতকে ইংরেজ রাজত্বে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির আয়তন সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছয়। তখন আফগানিস্তানের নিকটস্থ খাইবার পাস থেকে শুরু করে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত বিস্তার ঘটে। পরে অবিভক্ত বাংলা তথা বেঙ্গল প্রভিন্স বা বঙ্গপ্রদেশ হিসেবে ১৯৪৭ সালে বিভক্ত হয়ে গঠিত হয় পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গ। যদিও ১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে একটি প্রদেশ গঠিত হলেও ১৯১১ সালে সেটা বাতিল হয়ে যায়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগকালীন  পূর্ববঙ্গের সঙ্গে সিলেটের কয়েকটি অঞ্চলকে যুক্ত করা হয়। অবশিষ্টাংশ আসাম প্রদেশের সঙ্গে থেকে যায়। এরপরএকটি প্রদেশ হিসেবে পাকিস্তানের যুক্ত হয় আর পশ্চিমবঙ্গ ভারতের প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এরপরপূর্ববঙ্গ ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে এবং বাংলাদেশ নামে একটি দেশ গঠিত হয়। অর্থাৎ বিভিন্ন শাসন আমলে বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডটির আকার অখণ্ড থাকেনি। সংক্ষেপে এটিই হলবর্তমান বাংলাদেশের পরিচিতি। প্রবন্ধের কলেবর বৃদ্ধি না করার প্রয়োজনে মুঘল ও দেশীয় রাজাদের ইতিহাস আলোচনায় অন্তর্ভূক্ত করা হল না।

বৃটিশ আমল থেকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি এবং পরে বঙ্গপ্রদেশের বিবর্তনের ইতিহাস, বেঙ্গলি রেনেসাঁ ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গদেশের ভূমিকা ও বাঙ্গালিদের আত্মত্যাগের ইতিহাস, দেশ-বিভাগের ফলে বাঙালি হিন্দুদের ব্যাপকহারে পূর্ববঙ্গ ত্যাগের ইতিহাস, মুসলমানদের আংশিক পশ্চিমবঙ্গ ত্যাগ করে পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব- পাকিস্তানে গমনের ইতিহাস, ১৯৫০, ১৯৬৪ সালে পূর্ববঙ্গ ও পূর্ব-পাকিস্তানে ভয়াবহ হিন্দু নিধনের ইতিহাস,১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস—ভারতবর্ষের অবদান, গণহত্যার ইতিহাস, পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বাঙালি দালাল ও সহযোগীদের ইতিহাস এসব জানা আজকের প্রজন্মের জন্য জরুরী। যার নামে এবং আহ্বানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা—সপরিবারে সেই শেখ মুজিবুর রহমান সহ প্রবাসী সরকারের প্রধান চার নেতা স্বাধীনতার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে নৃশংসভাবে নিহত হন। আজকের বাংলাদেশী মুসলমানরা তো এদেরই উত্তরসূরি। এসব ইতিহাস আজকের বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীগণ না পড়লে, না জানলে তারা বাঙালি জাতির শিকড়ে পৌঁছুবে কেমন করে? বর্তমান এবং আগামী প্রজন্ম বাঙালির শৌর্য-বীর্য, গর্ব, বীরত্ব, আত্মত্যাগের ও বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস না জানলে, তাদের শিকড় বাংলার মাটির গভীরে প্রবেশ করতে পারবে না। তারা শিকড়হীন জাতিতে পরিণত হবে। তারা হয়ে যাবে ভাসমান বাঙালি।

আজকের বাংলাদেশে স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ানো হয় শুধু ইসলামের ইতিহাস, ভারতের মধ্যযুগের মুঘলদের ইতিহাস, উদ্দেশ্য ছাত্র সমাজকে ইসলামি শাসন, ইসলামি ঐতিহ্য মন-মানসিকতায় গেঁথে দেওয়া। ইংরেজ শাসনে বাংলায় কোন স্বতন্ত্রভাবে স্বাধিকার আন্দোলন গড়ে না উঠলেও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালি হিন্দুদের বড় ভূমিকা রয়েছে, যদিও বাঙালি মুসলমান বৃটিশকে সহযোগিতা করাই শ্রেয় মনে করেছিল। তারা বাঙালি ঐতিহ্যের  কোন ধার ধারে নাই। বাঙালির বীরত্বে গর্বিত হয় না। তারা নিজেদের মুসলিম বলতে পছন্দ করে, বাঙালি বলতে হিন্দুদের বোঝায় – যাদের তারা ঘৃণা করতে পছন্দ করে। এই পাকিস্তানি ভাবধারা তাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গেড়ে বসতে বসতে, নিজেদের বাঙালি পরিচয় থেকে বহু দূরে সরে যাচ্ছে। এ বিষয়ে অধ্যাপক মুনতাশীর মামুন লিখেছেন, “এরাই নিয়ত বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা,  আওয়ামি লিগকে সব সময় দোষারোপ করে। খালেদা জিয়া, বিএনপি বা জিয়াউর রহমান ও এরশাদকে নয়, এরা ধর্মাশ্রয়ী দলকে সমর্থন করে বলে যে তারা আদর্শবাদী দল, মুক্তিবাহিনীর  বিচার চায় তারা পাকিস্তানি বা পাকিস্তানপন্থীদের ১৯৭১ সালে হত্যা করেছে বলে। এরা শিক্ষায়তনগুলোতে শিক্ষক হিসেবে পাকিস্তানতত্ত্ব সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে  সমর্থন  জোগায়। এখন দেখছি স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধ যারা সমর্থন করে তাদের অনেকেও এই পাকিস্তান প্রত্যয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন।  আজ ৭৫ বছর কেন এই তত্ত্ব বাঙালিদের প্রভাবিত করছে তার উত্তর খুঁজছি।”

ধর্মীয় রাষ্ট্র কাঠামোয় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রকৃত অর্থেই কোন বিশেষ মূল্য পায় না। দেশবিভাগ পরবর্তীপাকিস্তানেরচব্বিশবছরেরশাসনেপূর্ববঙ্গেরঅধিবাসীবৃন্দমর্মেমর্মেএটাউপলব্ধিকরেছিল।পূর্ববঙ্গতথাবাংলাদেশেরাষ্ট্রীয়ওসামাজিকঅঙ্গনেজাতিপরিচয়ছাপিয়েধর্মীয়পরিচয়বাঙালিমুসলমানসমাজকেএমনভাবেআষ্টেপৃষ্টেবেঁধেফেলেছেযেতারাআরতাথেকেবেরিয়েআসতেপারছেনা।এবিষয়েবিশিষ্টবুদ্ধিজীবীঅধ্যাপকআহমদশরীফেরমতামতনিম্নরূপঃ

“আমাদেরজাতিপরিচয়সমস্যারমতোএমনঅদ্ভূতদুঃসাধ্যসমস্যাপৃথিবীরকোনদেশেরবাভাষারমানুষেরআছেকিনাজানিনা।যেচেতনাথেকেমানুষপ্রাণরসআহরণকরে, সত্তারস্বরূপঅনুভব-উপলব্ধিকরে, সেচেতনাটিইআমাদেরএখনওঅস্পষ্টওঅপূর্ণ।এখনওঅনির্ণীতছায়া, নিরবয়বঅনুভূতিমাত্র।ব্যক্তিমানুষেরওআশৈশবসুনির্দিষ্টতিনটিপরিচিতিথাকে—এগুলোতিনটিপ্রশ্নেরআবশ্যকওজরুরীউত্তর।কিনাম, কোথায়নিবাস, এবংকিবৃত্তি–এতিনটিরউত্তরইব্যক্তিমানুষেরপরিচিতিরআবশ্যিকভিত্তিএবংআত্মপরিচয়েরএতিনটিভিত্তিসবারইদৃঢ়।ব্যতিক্রমবিপর্যয়জাতমাত্র।

দৈশিক-ভাষিক-জাতিক-রাষ্ট্রিক জীবনেও তেমনি একটি অভিন্ন সত্তা চেতনায় ঐক্য ও একাত্ম অনুভব না করলে একটা দৈশিক-ভাষিক-রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক জাতি চেতনা দানা বাঁধতে পারে না।  এ অভিন্ন সত্তা-চেতনা বা জাতি-চেতনা থেকেই অভিন্ন উদ্দেশ্যে এবং সিদ্ধ-সাফল্যের লক্ষ্যে রাষ্ট্রিক জীবনে ভাব-চিন্তা-কর্ম-আচরণ নিরূপিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়, একটা জাতি গড়ে ওঠে। আমাদের বেলায় তা আজও হয়ে ওঠেনি।

মুসলমান সমাজে বাঙালি জাতিসত্তাবোধ গভীরে প্রবেশ না করায় বাঙালি জাতি রাষ্ট্র গঠনে যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ১৯৭২ সালেই সামনে এসেছিল, ১৯৭৫ সালে এর পট পরিবর্তন তা চিরতরে অবসান ঘটিয়েছে বললেও অত্যুক্তি হবে না।

আবুল মনসুর আহমদ  বাহাত্তরেই লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশ আসলে পাকিস্তানেরই সত্যতর রূপায়ণ’!’ অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালি মুসলমানের জাতিসত্তা বা বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তার প্রধান অন্তরায় ‘ইসলাম’। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভূত – যা পাকিস্তানের জন্ম ও ভারত-বিভক্তির প্রধান ভূমিকায় দেখা গেল, আজ দেশ বিভাগোত্তর পঁচাত্তরবছরপেরিয়েএসেসেইভূতবাঙালিমুসলমানদেরকাঁধেআবারওচেপেবসেছে।কোরাণ, সুন্নতওশরিয়ারবাঁধনশিথিলনাহলেবাঙালিজাতিসত্তারবিকাশকখনওসম্ভবনয়।‘ইসলাম’এবং ‘জাতিসত্তা’ পরস্পর সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশের আধুনিক গণতন্ত্রকামী গবেষকগণ হিন্দু-মুসলমান  সম্পর্ক বিষয়ক যে মতামত ব্যক্ত করেছেন এবং বাঙালি মুসলমান সমাজ বাঙালি হিন্দুদের প্রতি যে ধরণের আচরণে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে তার নমুনা নীচে উদ্ধৃত করা হলঃ

“The attitude of Muslims towards the minorities is fully influenced by the tenets of Islam.  The tenets and practices of other religious are compared with that of Islam, and in the process, it is established how Islam as a religion is superior to other religions.  The superiority is rationalized on the assessment that the Quran is infallible. Secondly, experience of Muslims in their encounter with the minority communities in the past is transmitted through socialization”…

 উল্লেখিত বিশিষ্ট পণ্ডিত জনের মতামত প্রণিধানযোগ্য। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ‘পাকিস্তানি প্রত্যয়’ এখনও সজীব কেন তার প্রধানতম কারণ বাঙালি জাতিসত্তারধারণা বাংলাদেশের মুসলমান সমাজে শিকড় বিস্তার করতে পারেনি। নামে ‘বাংলাদেশ’ হলেও দ্বিজাতিতত্ত্বের  শিকড় রয়েছে সমাজের গভীরে। জাতিসত্তা বা জাতীয়তাবাদের শিকড় গভীরে প্রবেশ করার সুযোগ না পেলে কোনো জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র আজকের দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমন কোন নজির নাই।  একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, যখন কোন জনগোষ্ঠী স্বজাতি- স্বধর্ম ত্যাগ করে ধর্মান্তরিত  হতে বাধ্য হয় বা স্বেচ্ছায় অন্য ধর্ম গ্রহণ করে, তখন নব্য ধর্মান্তরিত জনগোষ্ঠীর নতুন ধর্মের গুণগান করে মহিমান্বিত করার সবরকম চেষ্টা করার বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়ে যায়। নতুন ধর্মে তার বিশ্বাস-যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পূর্বেই তাকে পুরাতন ধর্মের অসারতা প্রমাণ করা আবশ্যিক হয়ে পড়ে। এই কর্মে প্রয়োজনে তার পুরানো ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈরী আচরণ করতেও দ্বিধাবোধ করে না বা ন্যায্যতা অন্যায্যতা তার বিবেচনায় আসে না। এখানে কোন জাতিসত্তা-বোধ কাজ করে না। গত দুইশত বছরের বাঙালি মুসলমানের ইতিহাস ঘাঁটলে এমন অনেক নজির দেখতে পাওয়া যাবে। সে কারণেই অধ্যাপক  আদমদ শরীফ বাঙালি মুসলমানের জাতিসত্তা-বোধ সম্পর্কে বলেছেন, “আমাদের জাতিপরিচয় সমস্যার মতো এমন অদ্ভূত দুঃসাধ্য সমস্যা পৃথিবীর কোন দেশের বা ভাষার মানুষের আছে কিনা জানি না। যে চেতনা থেকে মানুষ প্রাণরস আহরণ করে, সত্তার স্বরূপ অনুভব-উপলব্ধি  করে, সে চেতনাটিই আমাদের এখনও অস্পষ্ট ও অপূর্ণ।” …

ইসলামি দেশ বা অত্যধিক-সংখ্যক মুসলিম-গরিষ্ঠ দেশে ইসলামি আইন-কানুন থাকা অস্বাভাবিক নয়। সেখানে বসবাসকারী অমুসলমানদের অবস্থা পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের অবস্থা থেকে বোঝা যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের লেবাস ভারতীয় হিন্দু বাঙালিদের সামনে যে মোহজাল তৈরি করে ফেলেছিল, তা অতিক্রম করে ইসলামি ঐতিহ্য ও পরম্পরা বুঝতে আরও সময় লাগবে! ভাষা ও জাতিগত বন্ধন যদি এতই দৃঢ় হতো তাহলে, গত পঁচাত্তর বছরে হিন্দু বাঙালির সংখ্যা এত দ্রুত হারে হ্রাস পেতো না – যা এখন অকিঞ্চিৎকরের দিকেই এগিয়ে চলেছে। আমরা মুসলিম দেশগুলোর ইতিহাস থেকে কি আদৌ শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করেছি?

 

তথ্যসূত্রঃ

১  ‘পাকিস্তানি প্রত্যয় এখনও সজীব’, Jagonews24.com,  7 May 2023.

বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক বৈষম্যঃ তথ্য ও দলিল, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান ঐক্য পরিষদ, ঢাকা, ২০ মে, ১৯৯৩, পৃষ্ঠা-১৯৫।

 Mohammad Rafi, Can We Get Along, An account of Communal Relationship in Bangladesh, Dhaka, Panjeree Publications Ltd., 2008, p.145.