Center For Research In Indo

বাঙালি ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের লড়াই

বিমল প্রামাণিক

বাংলাদেশের রাজনীতিতে মতাদর্শগত তফাৎ কখনই বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি। বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পূর্ব প্রজন্ম পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছিলেন দ্বিজাতি তত্ত্বে বিশ্বাস রেখে। “পাকিস্তান নিছক একটি ভৌগলিক অঞ্চল নয়। এটা একটা আদর্শ, একটা মনস্তত্ত্ব, একটা বিশ্বাস। আমাদের বুঝতে হবে, option থাকা সত্ত্বেও অগ্রসরমান ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমান যুবকরা তিরিশ এবং চল্লিশের দশকে কলকাতা গিয়ে মুসলিম লিগের পতাকাতলে সমবেত হয়েছিলেন। সন্দ্বীপের মুজাফফর আহমদ, ফরিদপুরের হুমায়ুন কবীর কিম্বা দিনাজপুরের মোহাম্মদ দানেশরা ছিলেন সংখ্যায় নগণ্য। কাজী নজরুল ইসলাম কিম্বা মুজতবা আলীদের হাতের আঙ্গুলে গোনা যেত। নাজিমুদ্দিন, ভাসানী, আতাউর রহমান খান, ফজলুল কাদের চৌধুরী, শেখ মুজিবুর রহমান, সবুর খান, খন্দকার মোস্তাক আহমেদ, আবুল মনসুর আহমদ এবং শাহ আজিজুর রহমানরা সংখ্যায় ছিলেন অনেক বেশি। তারা যদি সেদিন মুসলিম লিগ না করতেন, তা হলে এদেশের ইতিহাসটাই অন্যরকম হতো।”১
যদি আমরা পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাই, “তবে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা ও ইসলামি মৌলবাদ শক্তিশালী হয়ে ওঠার জন্য শুধু বি.এন.পি. ও জাতীয় পার্টির মুসলিম লীগীয় রাজনীতিই দায়ী নয়, এর পিছনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতির প্রবক্তা আওয়ামি লিগের ভূমিকাও রয়েছে। ১৯৪৮-১৯৭১ পর্বে আওয়ামি লিগ পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরই পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমানের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবীদার ছিল। ঐসময় আওয়ামি লিগ বাঙালির অভিন্ন সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারে বিশ্বাসী ছিল না।”২
১৯৭২ সালে বদরুদ্দিন উমর সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের ভিত্তি’। এর একটা বাংলা অনুবাদও ঐ সময় আরেকটি বাংলা সাপ্তাহিকে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রবন্ধটিতে লেখক জোরালো যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের ভিত্তি আসলেই ‘বাঙালি মুসলিম জাতীয়তা’।” ৩
উপরের আলোচনা থেকে এবিষয়টি স্পষ্ট যে, বাঙালি মুসলমান কখনও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আঁকড়ে ধরতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি – তা বিভাগ-পূর্ব ভারতে বা পাকিস্তানের তেইশ বছর কিম্বা বর্তমান বাংলাদেশের পাঁচ দশকের অধিককাল। তারা কখনও দ্বিজাতিতত্ত্ব, কখনও অধিকারের দর-কষাকষির আন্দোলনে মুসলিম বাঙালিদের জন্য স্বায়ত্তশাসন বা বর্তমান বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বকলমে বাঙালি ইসলামি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠাকরণের উদ্যোগের চেষ্টা। এ বিষয়টি কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের উপর নির্ভরশীল নয় – বা বিশেষ সরকারের উপরও এর দায় বর্তায় না। এটা হচ্ছে সমগ্র বাঙালি মুসলমান সমাজের মতামতের প্রতিফলন।
এর ফলস্বরূপ আমরা দেখতে পাচ্ছি, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত সরকারের দ্বারাই বাংলাদেশের প্রধান শত্রু যুদ্ধাপরাধী, যারা জঘন্যতম অপরাধে অপরাধী তাদেরকে সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন। কেন এই বিচারহীনতা? আর এর পিছনের কারণ এবং উদ্দেশ্যই বা কি ? একথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এরাতো পূর্বপাকিস্তানেরই বাঙালি মুসলমান, যারা ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিব তথা আওয়ামি লিগকে বিপুল সংখ্যক ভোটে জয়যুক্ত করে পাকিস্তানের ক্ষমতার আসনে বসতে সুযোগ করে দিয়েছিল। পাকিস্তানের ক্ষমতা না পেলেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী/প্রেসিডেন্ট হয়েও তিনি অপরাধীদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় তুলতে ব্যর্থ হলেন। এটা কি সাধারণ ঘটনা ! বাংলাদেশে তো এর বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ, বিক্ষোভ দেখা গেল না, এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও ! যারা যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দিলেন, তাদের আত্মীয়স্বজনরাও নিশ্চুপ থাকলেন।
এটাই পাকিস্তানি ম্যাজিক, মুসলিম জাতীয়তাবাদ। কোন রাজনৈতিক মতাদর্শ, বিবেচনাবোধ দিয়ে এটা মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। আজকের পাকিস্তানি ও বাংলাদেশী সমাজের দিকে ফিরে তাকালে এটা বুঝতে কোন অসুবিধা হয়না।
বর্তমান বাংলাদেশে রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং ক্ষমতার রাজনীতির মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নেই। ক্ষমতা দখলের জন্য রাজনৈতিক জোট গঠন গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে দেশে বিদেশে সব সময়ই আমরা দেখতে পাই। এমনকি নীতি আদর্শগত বিভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও অনেক দেশেই জোট সরকার চলছে। বাংলাদেশেও এর নজির রয়েছে। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে সম্ভবত জোট গঠন চুড়ান্ত পর্যায়ে এখনও পৌঁছেনি। মুক্তিযুদ্ধ বা কোন মতাদর্শগত ঐক্যের চেয়ে দেশের আর্থিক ও পরিকাঠামোগত প্রধান ইস্যু হলেও বিরোধী দলের ইস্যু ভিন্ন। তারা চাইছে ‘free and fair’ নির্বাচন, সরকার অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাহলে সমস্যা কোথায় ?
বাংলাদেশে অবাধ বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নির্ভর করে রাজনৈতিক দলগুলির উপর, এখানে স্বতন্ত্র নির্বাচন কমিশনের দুর্বলতা সর্বজনবিদিত। এর প্রমাণ রয়েছে ১৯৭৩ সালের নির্বাচন থেকেই। তদুপরি বর্তমান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির নেতৃ্ত্ব উত্তরাধিকারসুত্রে প্রাপ্ত। দলগুলির মধ্যে গণতন্ত্রের অপ্রতুলতা। সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক অঙ্গনে এর প্রতিফলন স্পষ্ট। গণতান্ত্রিক দেশ বা সমাজে বড় ঘটনা হল নির্বাচনী প্রক্রিয়া, সেটাও এই প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। এটা মাথায় রেখেই বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়টি ভাবতে হবে। কোন দেশের সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
যে ‘বাঙালি মুসলমান জাতীয়তা’ দিয়ে প্রবন্ধটি শুরু হয়েছিল তার ফলাফল দিয়েই শেষ হচ্ছে। “অবশেষে ১৯৮৮ সালের ৭ই জুন এরশাদ রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতাকে চুড়ান্তভাবে সংবিধানে সন্নিবেশিত করে বাংলাদেশকে মিনি পাকিস্তানে পরিণত করার জন্যে তার উপর ন্যস্ত দায়িত্বটি পূর্ণ করলেন। অর্থাৎ বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে অষ্টম সংশোধনী গৃহীত হল এবং তাতে বলা হল, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হচ্ছে ইসলাম’, তবে প্রজাতন্ত্রে শান্তি ও সম্প্রতির সঙ্গে অন্যান্য ধর্মও অনুশীলন করা যাবে।’৪ স্বাধীনতার সতের বছর পর একজন স্বৈরশাসক একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে দ্বিতীয়ও নয়, আরও নিম্নশ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করেন। সেসময় শেখ হাসিনা বলেছিলেনঃ ‘রাষ্ট্রধর্ম বিল সর্বস্তরের জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। স্বৈরাচারের ক্ষমতার মসনদ রক্ষার কূটকৌশল হিসাবে পবিত্র ধর্মকে ব্যবহারের চক্রান্ত চলছে।’ আর খালেদা জিয়ার বক্তব্যঃ ‘রাষ্ট্রধর্ম সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধনী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত, এবং ধর্মের নামে জাতিকে বিভক্ত করে অনৈক্য সৃষ্টি ও জনগণকে ধোকা দেওয়ার অপচেষ্টা মাত্র।’৫
অর্থাৎ, দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধানই একটা ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছিলেন যে, রাষ্ট্রধর্ম সংবিধানে সন্নিবেশিত করার মাধ্যমে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে, এবং এটা জাতিকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র। খালেদা জিয়া পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিলেন আর হাসিনা ছিলেন বিরোধী দলীয় নেত্রী। দু’জন সিদ্ধান্ত নিয়ে রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতার এই বিষবৃক্ষটি সংবিধান থেকে কি উৎপাটন করতে পারতেন না? কিন্তু করেননি। এখন শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী, এবং খালেদা জিয়া বিরোধী দলনেত্রী। এখনও এই কাজটি করা যায়। কিন্তু কেউই উদ্যোগ নিচ্ছেন না।”৬
এটাই বাঙালি মুসলিম জাতীয়তা। জিয়া, এরশাদ, বেগম খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা তারা কেউ কি মুসলিম জাতীয়তার বাইরে? শেখ মুজিবই যখন বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হলেন – যার ডাকে এবং নামে মুক্তিযুদ্ধ, সে যুদ্ধে মতাদর্শের কোন সুস্পষ্টতা ছিল না। মূল লক্ষ্য ছিল দখলদার মুলশত্রু পাকিস্তানকে পরাস্ত করা। আমরাও সেই লক্ষ্য নিয়েই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। কোন জাতীয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম আমাদের সামনে ছিল না। কোন জাতিরাষ্ট্র কি জাতীয়তাবাদ ছাড়া প্রতিষ্ঠা পায়? বাংলাদেশ একটি বাঙালি মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র। অর্থাৎ একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র। যেমন পাকিস্তান। এটা যারা অস্বীকার করতে চান, তারা ভাবের ঘরে চুরি করেন।

 

তথ্যসূত্রঃ
১ মহিউদ্দিন আহমেদ, জাতিরাষ্ট্র ভাবনা এবং বুদ্ধিজীবী মানস, বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিঃ ধর্ম- সাম্প্রদায়িকতার সঙ্কট, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ঢাকা, বাংলাদেশ, ১৯৯৯, পৃঃ ২৬৪।
২ ইবনে আজাদ, বাংলাদেশে সেকুলার বুদ্ধিজীবীদের সমস্যা, … পৃঃ ২৫৫।
৩ মহিউদ্দিন আহমেদ, ঐ, পৃঃ ২৬৬।
৪ আবেদ খান, বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতা, ঐ, পৃঃ ২৫০।
৫ দৈনিক সংবাদ, ঢাকা, বাংলাদেশ, ৮.৬.১৯৮৮।
৬ ইত্তেফাক, ঢাকা, বাংলাদেশ, ৮.৬.১৯৮৮।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *