বিমল প্রামাণিক
ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে যে বিষয়টি বারবার মনে বাজে তা হল জাতিসত্তা বা জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদের শক্তি এমনই যে পৃথিবীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী অনেক বৃহৎ শক্তির সঙ্গে অসম লড়াই সত্বেও শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এর যেমন নজির রয়েছে, সাম্প্রতিক অতীতে ভিয়েতনাম যুদ্ধ বা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তো এখনও আমাদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। ধর্মকে জাতিসত্তার বিকল্প হিসাবে দাঁড় করানোর চেষ্টা বার বার ব্যর্থ হয়েছে। ধর্মযুদ্ধ আজকের পৃথিবীতে শুধু রক্তক্ষয় আর ধ্বংসের ইতিহাস। বর্বরতার ইতিহাস বললে কম বলা হয়। তা বলে কি ধর্মীয় রাষ্ট্রের ধারণা বা রাষ্ট্র পৃথিবী থেকে লোপ পেয়ে গেছে – তা তো নয় । কিন্তু তারা দূর্বল থেকে দূর্বলতর হচ্ছে। একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের নামে সামরিকতন্ত্র তাদের সঞ্চিত ক্ষমতা-অর্থ-সম্পদের কারণে আরও কিছু বছর টিকে থাকবে বটে, কিন্তু শেষ কথা বলার ক্ষমতা নিয়ে তারা কম্পমান।
জাতিরাষ্ট্র বা বহুজাতি রাষ্ট্রে গণতন্ত্র জনগণের সামনে আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। বহুজাতি রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের অভাব দেখা দিলে যেমন বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা তৈরি হতে পারে, উগ্রজাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিতে পারে এমনকি দেশ খণ্ডিতও হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ তার একটি উদাহরণ। অন্যদিকে, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দেউলিয়াপনার প্রেক্ষিতে ইসলামি সন্ত্রাসবাদ রফতানির ব্যবসা চালু রাখা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। ভারতীয় উপমহাদেশে উগ্র ইসলামি মৌলবাদ বা ইসলামি সন্ত্রাসবাদের প্রবণতা নতুন করে মাথাচাড়া দেওয়ার সম্ভাবনাও মোটেই উজ্জ্বল নয়। বিশেষকরে ভারত-পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে বাম মৌলবাদী চেতনার যে ব্যাপক ধ্বস নেমেছে ফলে বাম সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের কোন ভবিষ্যৎ নাই বলেই প্রতিপন্ন হচ্ছে। ফলে বাঙালি জাতিয়তাবাদী গণতান্ত্রিক শক্তির পায়ের নীচের মাটি ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। এটা আশার কথা বৈকি!
মুজিব হত্যার পর পরই বাঙালি জাতিয়তাবাদের উচ্ছ্বাস হ্রাস পেতে শুরু করে। তারপর প্রায় চার দশক বাঙালি জাতিয়তাবাদ সমাজে তেমন সমাদৃত হতে দেখা যায়নি। পাকিস্তানে দ্বিজাতিতত্ত্বের জৌলুস ফিকে হয়ে যাওয়া, আর্থিক দুরবস্থা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক ইসলামি দেশের পাকিস্তান থেকে দূরে সরে যাওয়া ও তাদের ভারতের প্রতি পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি বাঙালি মুসলমান মনে জাতিসত্তা নিয়ে নতুন ভাবনার উদ্রেক দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশি মুসলমানের সামনে বিশ্ব-দুয়ার খুলে যাওয়ায় বিরাট সংখ্যক মানুষ প্রায়শই দেশের বাইরে কাজকর্মসহ নানা কারণে ভ্রমণকালে স্ব-পরিচিতির ক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশি বাঙ্গালি’ সামনে চলে আসে। ধর্মীয় পরিচয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গৌণ হয়ে যায়। বাঙালি জাতীয়তা বড় হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতি যেভাবে ইতিহাস বা সংস্কৃতি চর্চা অতীতকাল থেকে করে চলেছে তা কখনও ধর্মের নিগড়ে বাঁধা পড়েনি। আজকে যারা বাঙালীকে মুসলমান পরিচয় দিয়ে বাঁধতে চায় তারা শুধু অজ্ঞই নয়, অজ্ঞাত কুলশীল। এখানেই বাঙালি জাতিসত্তার বিজয় এবং ভবিষ্যৎ। যা কোন নিছক রাজনৈতিক শাসক বা ধর্মান্ধ জনগোষ্ঠীর উপর নির্ভরশীল নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সেটা প্রমাণ করেছে। আজ বাংলাদেশে দ্বিজাতিতত্ত্বের কদর কোথায়?
বালুচ, সিন্ধ্রিসহ প্রভৃতি আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। গেরিলা সশস্ত্র লড়াইয়ের ময়দানে ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানের মূল ভিতে আঘাত হেনে চলেছে। যা ১৯৭১ সালে বাঙালিরা মোকাবিলা করেছিল। কিন্তু একথা ভুললে চলবে না যে, চল্লিশের দশকে দ্বিজাতিতত্ত্ব এবং পাকিস্তান দাবির মোড়কে কট্টর ভারত তথা হিন্দু- বিরোধিতা সাধারণ মুসলমান জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করতে যেমন কার্যকার হয়েছিল, সেই অবস্থার সম্পূর্ণ অবসান হয় নাই। ইসলাম ধর্ম মুসলমান জনগোষ্ঠীকে দেশে দেশে তাদের স্ব স্ব জাতিসত্তাকে যেভাবে অধিকতর তরলীকৃত করে কট্টর ইসলামি নিগড়ে সমন্বয় করতে চায় – সে চেষ্টায় এখনও ভাটা পড়ে নাই। জাতিসত্তা বা জাতি পরিচয়কে ইসলামে ভাল চোখে দেখা হয়না বলেই ১৯৭১ সালে বাঙালিদের উপর গণহত্যা চালাতে না ধর্মে, না মানবতায় পাকিস্তানি ও বাঙালি কট্টর মুসলমানদের বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
আজকের পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়লেও ধর্মীয় কট্টরতার বাইরে এখনও বেরিয়ে আসতে পারেনি। প্রধান কারণ ইসলামের নামে শোষণ, শাসন, নির্যাতন পাকিস্তানের ইতিহাসের অঙ্গ ।
একটা বিষয় পরিষ্কার করে বলা দরকার বলে মনে করি । বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোন স্বাধীনতা সংগ্রাম করেনি । ১৯৭১-এ ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙ্গালীদের মুক্তি আন্দোলন, যা সাধারণত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নামে খ্যাত । যে কোন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পিছনে থাকে দীর্ঘ ইতিহাস যার মধ্য দিয়ে একটা আদর্শবাদিতা এবং ঐকমত্য গড়ে ওঠে। সেটা বিদেশী শাসকের ক্ষেত্রে যেমন হয়, স্বদেশী রাজতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্রের ক্ষেত্রেও ভিন্নতর কিছু হয় না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে কোন ভূখণ্ডকে মুক্ত করাই হয় প্রধান লক্ষ্য। সেখানে আদর্শগত বা ঐকমত্য সবসময় প্রধান বিচার্য বিষয় নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রেও এটা সত্য । এক্ষেত্রে বাস্তবতা ছিল, একটি বড় সংখ্যক জনসংখ্যা আদর্শগতভাবে ধর্মীয় ঐক্য রক্ষায় পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। অন্যদিকে, ধর্মীয় ভিন্নতা না থাকা সত্বেও একটি বড় সংখ্যক মানুষ মতাদর্শগতভাবে পাকিস্তানি শাসনমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। যার মূলে কাজ করেছিল বাঙালি জাতিসত্তার ভিত্তি।
আজকের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা পাকিস্তান থেকে ভিন্নতর। এখানে গত চৌদ্দ বছর কমবেশি একটি স্থিতিশীল সরকার থাকায় অর্থনৈতিক ভিত যেমন শক্তিশালী হয়েছে, সামাজিক অস্থিরতাও হাতের নাগালের বাইরে চলে যায়নি। সমাজে ইসলামি মৌলবাদ শক্তি সঞ্চয় করলেও সরকারি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে, যেটা পাকিস্তানের সাথে তুলনা করা চলে না। বাংলাভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি যেহেতু এখনও ধর্মের নিগড়ে বাধা পড়ে যায় নাই, দেশ বিভাগোওর কালে পাকিস্তানি শাসনে বাঙালি জাতিসত্তাকেও তরলীকৃত করে পাকিস্তানিকরণও সম্ভব হয়নি। এটা আমরা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণের প্রেক্ষিতে বাংলাভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন ও পূর্ববঙ্গে ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার মধ্যে দেখতে পাই। যখন বাঙালি জাত্যাভিমানের উপর বড় আঘাত এলো, জাতিসত্তাই সংকটের মুখে পড়ে গেল তখন বাঙ্গালির সুপ্ত জাতীয়তাবাদ ফেটে পড়তে দেখা গেল, ধর্ম গৌণ হয়ে গেল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসে এর একটা বড় উদাহরণ ।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের পূর্ণ বিজয় আজ ইতিহাসের দাবি। “আত্মঘাতী বাঙ্গালির” অপবাদ তো বাঙালি মুসলমানদেরই মোচন করতে হবে।