Center For Research In Indo

বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের ক্রমাবনতির কার্য-কারণ সম্পর্ক

বিমল প্রামাণিক

Director, Centre for Research in Indo-Bangladesh Relations

বাঙালি মুসলমানের চিন্তার সঙ্কট বিংশ শতকের প্রারম্ভেই শুরু হয়েছিল যখন পূর্ববঙ্গ ও আসামকে আলাদা প্রদেশ তৈরি করে বঙ্গ বিভাগ করা হয়েছিল।  পূর্ববঙ্গের মুসলমান নেতৃবৃন্দের দাবি মেনে বৃটিশ সরকার বঙ্গকে ভাগ করেছিল,  ঢাকা হয়েছিল তার রাজধানী। এর পিছনে ছিল বৃটিশ শাসকের  দীর্ঘমেয়াদী  একটা শাসন কায়েম রাখার সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা।

তখন সারা বঙ্গদেশব্যাপী বৃটিশ ঔপনিবেশিক  শাসন বিরোধী  আন্দোলনের যে ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল তা মোকাবিলা করতে শাসক সম্প্রদায় নানা ব্যবস্থা নিলেও মুসলিম তোষণ খোলা চোখেই ধরা পড়েছিল। সশস্ত্র (সন্ত্রাসবাদী)  আন্দোলনের শিকড় ক্রমশই শক্তিশালী হওয়ায় বৃটিশরাজের কাছে বঙ্গবিভাগ জরুরী মনে হলেও হিন্দু শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বাঙালি জাতিসত্তা ভিত্তিক প্রবল আন্দোলনে সাময়িকভাবে বঙ্গবিভাগ থেকে বৃটিশ-রাজ পিছিয়ে আসে। কিন্তু ইসলাম ধর্মের শক্ত ভিতে বাঙালি জাতিসত্তার আন্দোলন যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তা স্পষ্ট হল যখন তৎকালীন  মুসলিম নেতৃবৃন্দ নিজেদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে বঙ্গবিভাগ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তারা বুঝলেন, ইসলামে যেহেতু জাতিসত্তা গুরুত্বহীন, “পূর্ববঙ্গ ও আসাম” একটি প্রদেশ হলে সেটা হবে মুসলমান প্রধান।  পূর্ববঙ্গের মুসলমান কৃষকরা অবিভক্ত আসামের উর্বর বিরাট ভূখণ্ডে ছড়িয়ে পড়তে পারবে, দক্ষিণাঞ্চলের সামুদ্রিক দুর্যোগ ও হিন্দু জমিদারদের প্রভাব কাটিয়ে ভবিষ্যতে হিন্দু আধিপত্য খর্ব করা যাবে।   ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে বঙ্গে দুর্বল করতে হলে “মুসলমানদের বৃটিশ সহযোগিতা একটি আশীর্বাদ হবে।” ফলে বঙ্গের মুসলমানরা বৃটিশ সহযোগিতা অব্যাহত রাখলেন। মুসলিম লিগ গঠিত হলো ১৯০৬ সালে।   মুসলিম নেতৃবৃন্দ মুসলিম লিগের পতাকাতলে সমবেত হতে থাকলো।  শুধু জাতিসত্তাই ভাগ হলো না, রাজনীতিও আলাদা হয়ে গেল, সংস্কৃতি-সাহিত্যচর্চা-ভাষা প্রভৃতি ক্ষেত্রগুলিতে ক্রমেই মুসলমানিকরণ হতে থাকল। এরপর দেশভাগ, এলো ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তান। চব্বিশ বছর পর এলো ১৯৭১ সালের মহাসঙ্কট। যারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হিন্দু বাঙালিকে প্রধান শত্রু হিসেবে এতদিন বিবেচনা করে এসেছিল তাদেরই একটি অংশ বাঙালি জাতিসত্তা রক্ষার লড়াইয়ে ভারতের সাহায্যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে বসলেন। শেষ পর্যন্ত পাহাড় প্রমাণ ত্যাগের বিনিময়ে সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশ নামক একটি দেশের জন্ম পৃথিবীর মানুষ দেখতে পেল। কিন্তু অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে  বাঙালি মুসলমানের আবার পদস্খলন হলো। বাঙালি জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার প্রধান নেতৃত্ব নৃ্সংশভাবে নিহত হলেন।  পুনরায় বাংলাদেশের সংবিধানের খতনাকরণ বাঙালি মুসলমানদের ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ সামনে এনে দিল। আর এই সুযোগ গ্রহণ করতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বা বিপক্ষে কোন দল বা শক্তিই আর পিছিয়ে থাকলো না। তারা যে কত সাচ্চা মুসলমান সেটা প্রমাণ করতে  কোন কসুর রাখলো না।

আজকের বাংলাদেশের স্কুলগুলিতে আধুনিক বাংলা হরফের জনক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাম কেউ জানেনা, কোন হিন্দু কবি-লেখকের লেখা পড়ানো হয়না, এমন কি উদার বাঙালি মুসলমান লেখকগণও স্কুলপাঠ্যে  ব্রাত্য। আবহমান  উদার বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার বা বিনোদনের আগ্রহ মুসলমান সমাজ হারিয়ে ফেলছে। হাতে গোনা দু’চার জন মানুষ, বাঙালি সংস্কৃতি চর্চায় নিবেদিত প্রাণ, এখনও কাজ করে চলেছেন, যদিও সমাজে তাদের কাজের কোন  প্রভাব লক্ষ্য করা যায় না। সরকারের ভূমিকা কিছু পদক বিলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে।

গত ১২৫ বছর সময়কালের মধ্যে বাঙালি মুসলমানের প্রধান ধারা কখনও বাঙালি জাতিসত্তা-ভিত্তিক চিন্তায় প্রভাবিত হয়নি। ভারতে মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের যে দাবি ভারতীয় মুসলমান নেতৃবৃন্দ উত্থাপন করেছিল, বাঙালি মুসলমান তাকে সর্বতোভাবে সমর্থন করেই ক্ষান্ত হয়নি, কলকাতা ও নোয়াখালিতে দাঙ্গা ও গণহত্যায়  সরাসরি অংশগ্রহণ করে দ্বিজাতিতত্ত্বের সারবত্তা বারবার প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে । অতঃপর পূর্ব-পাকিস্তানের তেইশ বছরের বাঙালি মুসলমান শাসকদের ভূমিকা বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশে কখনও সহায়ক  ভূমিকা পালন করেনি। আর ১৯৭১ সালের আকস্মিক মুক্তিযুদ্ধে ভারতের বাঙালি হিন্দুরা উদগ্র বাসনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে এগিয়ে এলেও পূর্ব-পাকিস্তানের মুসলমানদের মধ্যে কত অংশের সমর্থন ছিল তার প্রমাণ পাওয়া গেল মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে শেখ মুজিবসহ মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নেতৃবৃন্দের নৃশংস  খুনের মধ্য দিয়ে। নব্যগঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ পুনরায় পাকিস্তানি ইসলামি ধারায় মিশে গেল। এথেকে একথা বলা একান্তই সঙ্গত যে, বাঙালি মুসলমানদের প্রধান ধারা বরাবরই দ্বিজাতিতত্ত্বের আবর্তের মধ্যেই আটকে থেকেছে। কখনও বাঙালি জাতিসত্তার  দিকে ঝুঁকে পড়েনি। পাকিস্তান আমলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের তিক্ততা এমন মাত্রায় পোঁছায় যে চারবার দুটি দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানের ইতিহাসে ভারত তাদের এক নম্বর শত্রু একথাই এতকাল মুসলমানরা জেনে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে ভারতকে কিভাবে দেখা হয় ? ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী ও সাহায্যকারী দেশ একথা বাংলাদেশের ইতিহাসে পড়ানো হয় বটে। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে পাকিস্তানের সহযোগী ও কোলাবরেটর হিসেবে ভূমিকা রেখেছিল, এমনকি গণহত্যায়ও সামিল হয়েছিল – একথা অস্বীকার করা যায় না। তাদের বা তাদের বংশধরদের মানসিকতা ও চরিত্র মাত্র পঞ্চাশ বছরেই পাল্টে যাবে এতটা আশাবাদী হওয়া উচিৎ নয়। যেখানে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই মুক্ত বাংলাদেশের বুকে চূড়ান্ত আঘাত হানতে তাদের এতটুকু অনুতাপ আমরা দেখিনি। বরঞ্চ দেশটিকে পাকিস্তানিকরণের চেষ্টা প্রথম থেকেই শুরু হয়েছিল।  পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান নীতি ছিল দেশ থেকে হিন্দু নিশ্চিহ্নকরণ। বাংলাদেশেও যে নীতি বলবত রয়েছে। ১৯৬১ সালে বাংলাদেশে ১৮.৫% হিন্দু থাকলেও ১৯৭৪ সালে তা নেমে দাঁড়ায় ১৩.৫%, আর ২০২১ সালে হিন্দু জনসংখ্যা নেমে দাঁড়িয়েছে আট শতাংশের নীচে। এটা বলা অসঙ্গত হবে না যে, আর এক বা দুই দশকেই হিন্দুর পরিণতি বর্তমান পাকিস্তানের মতোই দাঁড়াবে।

এরপর দেখা গেল ভারতের অন্যতম প্রধান  শত্রু দেশ চিনের সঙ্গে দহরম-মহরম। অর্থনৈতিক ও উন্নয়নের  প্রধান সহযোগী দেশ হিসাবে চিন বাংলাদেশের কাছে বর্তমানে ভারতের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। সামরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও চিন বড় সহযোগী। এ থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, বাঙালি মুসলমানের প্রধান পরিচালিকা শক্তি যখনই সুযোগ পেয়েছে, তারা ভারতের বিরুদ্ধে দাঁত-নখ বের করতে কসুর করেনি। বাংলাদেশের গত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসেও এর প্রমাণ পাওয়া যাবে।  বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট চিন্তক ইবনে আজাদের মতামত প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন, “বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি হচ্ছে ১৯৪৭-এ তার দেহ বিভাজন। এ ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা বাঙালিকে একটি পূর্ণাঙ্গ জাতি হিসেবে তার সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হওয়ার সব সম্ভাবনা নষ্ট করে দিয়েছে। সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও অর্জনের কথা বাদ দিলেও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হওয়ার ভিত্তিটিও দেশবিভাগ ধ্বংস করে দিয়েছে। কিন্তু এগুলো নিয়ে বাঙালি মুসলমান রাষ্ট্র নেতারা চিন্তিত নন। বাঙালি মুসলমান বিদ্বান, পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবীরাও উদ্বিগ্ন নন।  এসব কারণ  আমাদের মনোজগতে ঐ অপূরণীয় ক্ষতি  সম্পর্কে বিস্মরণ, ইতিহাস ও জাতি চেতনার অনুপস্থিতি ও হীন স্বার্থপরতা কার্যকর রয়েছে। তসলিমাও যে এসব বিষয়ে খুব সচেতন বা তার ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতটি খুব স্বচ্ছ ও সঠিক তা নয়। কিন্তু এক দুর্লভ মানবতাবোধ সংক্রামিত হয়ে তিনি বাঙালি হিন্দুকে স্বজাতি  বলে গণ্য করেছেন, তার উপর অন্যায় উৎপীড়নের প্রতিবাদ করেছেন আর সবচেয়ে বড় কথা হলো মধ্যশ্রেনীর বাঙালি মুসলমানের অসাম্প্রদায়িক হওয়ার ভণ্ডামিটা তুলে ধরেছেন। এটিই তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার মতো অপরাধে অভিযুক্ত করেছে”। ১

ইতিহাস আর সরকারি নীতিমালা এক নয়। এই লেখায় ইতিহাসের কয়েকটি পৃষ্ঠায় আলোকপাত  করা হয়েছে মাত্র।

 

তথ্যসূত্রঃ ১। বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিঃ ধর্ম সাম্প্রদায়িকতার সঙ্কট, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ঢাকা, ১৯৯৯, পৃঃ ২৫২-২৫৩।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *