Center For Research In Indo

ভারতীয় উপমহাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশ ও তার পথে অন্তরায়

বিমল প্রামাণিক

Director, Centre for Research in Indo-Bangladesh Relations

বাংলাদেশের  হাল আমলের অনেক বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিক শাসনের গতিমুখ স্বৈরতান্ত্রিক। এর প্রতিফলন রাজনীতি ও প্রশাসনে পরিলক্ষিত হচ্ছে। রাহুল গান্ধীর সাংসদপদ বাতিল, দিল্লি দাঙ্গার বিচার প্রক্রিয়া এবং উত্তর প্রদেশে শাসন ব্যবস্থা ও প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে বলে উল্লেখিত হয়েছে। তাঁদের মতে, এর ফলে বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পাবে। তাঁরা এটাও মনে করেন, পৃথিবীতে অন্যতম বৃহৎ শক্তি হিসেবে ভারতের প্রতিষ্ঠা পাওয়া, বহুজাতিরাষ্ট্রে  বহুদলীয় গণতন্ত্রে  বিজেপি’র মতো  একটি হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন হওয়ায় স্বৈরতন্ত্রের প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি বিবিসি’র তরফে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিরোধী উদ্দেশ্য প্রণোদিত  অপপ্রচারে ভারতের কড়া পদক্ষেপও তাদের দৃষ্টিতে স্বৈরতান্ত্রিক কাজ মনে হচ্ছে। এখানে বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তি চর্চা নিয়ে কিছু আলোচনা করা যেতে পারে।

১৯৪৭ পরবর্তী পূর্বপাকিস্তানে তথা পূর্ববঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তি চর্চায় প্রায় খোলামেলাভাবেই দ্বিজাতিতত্ত্ব ভিত্তিক রাজনীতি চর্চা ও চিন্তায় বাঙালি বুদ্ধিজীবী মহলে ভিন্নমত দেখা যেতে থাকে। যেমন, ভাষা আন্দোলন ও শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিতর্কে তাঁরা জড়িয়ে পড়েন। গণতন্ত্র, সামরিক শাসনকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ আন্দোলন পরিলক্ষিত হয়। জাতিসত্তা ও গণতন্ত্র নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার পুরোধাগণ  কালের নিয়মেই গত হয়েছেন। যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁরাও বর্তমানে অশীতিপর বৃদ্ধ। স্বাধীন বাংলাদেশে গত পঞ্চাশ বছরে নানা অবাঞ্ছিত ঘটনাবলী বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার পরিসরকে সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর করেছে, সমাজ ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অসহিষ্ণুতা বেড়েছে। পাকিস্তান আমলের চেয়ে অনেকগুণ বেশি ধর্মীয় আগ্রাসী চিন্তায় সমাজ ও রাজনীতি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে।  বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার মৌলিক ধারণা তরলীকৃত হয়ে গেছে। একটি জাতির ইতিহাসের প্রধান স্তম্ভকেই (মুক্তিযুদ্ধ) যদি বিকৃত করে ফেলা যায় তবে তার গৌরবগাথা মুছে যেতে খুব বেশি সময় লাগে না, এটাই ইতিহাসের শিক্ষা ।  আজকের বাংলাদেশ তার জ্বলন্ত প্রমাণ। বুদ্ধিবৃত্তি চর্চায়ও  এর প্রভাব স্পষ্ট।

আর একটি  গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ধর্ম ব্যতিরেকে হিন্দু বাঙ্গালির বুদ্ধিবৃত্তি চর্চায় পশ্চিমি প্রভাব বিশেষভাবে ইংরিজি শিক্ষার প্রভাব বাঙালি মানসের গভীরে বিস্তৃত। তাদের চর্চায় ভারতীয় দর্শন, ইতিহাস এবং সমাজ মোটের উপর উপেক্ষিত। তদুপরি বামপন্থী ইতিহাস চর্চার একপেশে প্রভাবে প্রভাবিত। সেকারণে তাদের চর্চায় ভারতীয়ত্ব, হিন্দুত্ব এসকল বিষয় অচ্ছুৎ বললেও ভুল হয়না। এর ফল ফলেছে, বৃহত্তর  ভারতের শিকড় থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অথচ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের অবদান মোটেই কম ছিল না। তখন  সর্বভারতীয় প্রেক্ষিত নিয়ে তাদের চিন্তায়, চর্চায় এবং ভূমিকায় বাঙ্গালিরা ছিল প্রথম সারিতে। কিন্তু মুসলমান বাঙ্গালির কোন বলিষ্ঠ ভূমিকা তখনই চোখে পড়ে যখন দ্বিজাতিতত্ত্বের নাকাড়া ভারতবর্ষে বেজে ওঠে। তাছাড়া, মুসলমান বাঙালি বৃটিশ শাসকদের প্রতি সহযোগিতার হাতই বাড়িয়ে দিয়েছিল। তারা নিজেদের ভারতীয় বলে পরিচয়ের চাইতে মুসলমান পরিচয়েই অধিকতর গর্ব করতো । এর প্রমাণ অবিভক্ত বাংলায় সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত । বাঙলায় বৃটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জেল-জুলুম অত্যাচারের যেসব দলিল আজও সংরক্ষিত রয়েছে তার চেয়ে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে ! এই যে বাঙালি জাতিসত্তার বিভাজন হয়ে গেল তার বড় কারণ ধর্ম । আর ইসলাম ধর্ম জাতিসত্তার ঘোরতর প্রতিবন্ধক।  আর জাতিসত্তার  বিকাশ ছাড়া গণতন্ত্র সুদূর পরাহত। বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার প্রধান সংকট এখানেই। ভারতের গণতন্ত্রের বিকাশ এবং সংহতকরণ যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হচ্ছে তা ভারতের পড়শি রাষ্ট্রগুলির জন্য মোটেই সুখকরবোধ হচ্ছে না। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত অধিকাংশ মতামত এবং মন্তব্য  এর সাক্ষ্য বহন করে। ২০১৪ সালে বিজেপি সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই এই ধরণের মতামতের বাড়াবাড়ি লক্ষ্য করা যায়। তদুপরি সরকারি নির্লিপ্ততায় ধারাবাহিক সংখ্যালঘু বিশেষভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নানা ধরণের নির্যাতনের যে সকল ঘটনা ঘটে চলেছে – সেসব ক্ষেত্রেই সরকারের ভূমিকা সম্পর্কিত বিষয়ে বুদ্ধিজীবীমহলে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া  লক্ষ্য করা যায় না। এ সম্পর্কে  অনেকেই সরকারের কঠোর প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া আইনের দিকে আঙুল তোলেন। তাছাড়াও ভারতে মুসলমানদের উপর নির্যাতন সংক্রান্ত ঘটনাবলী উল্লেখ করে বাংলাদেশের হিন্দু নির্যাতনে ন্যায্যতা গণ্য করে থাকেন। এই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি বা মানসিকতা মুসলমানদের মধ্যে পাকিস্তানের  আমলে যেমন দেখেছি, বাংলাদেশেও সেই মানসিকতার  কোন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। এর কারণও  সহজেই অনুমেয়। পাকিস্তান বা বাংলাদেশে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির  বাইরে তারা অমুসলমানদের দেখবে একথা তারা ভাবতেই পারেনা – এটাই তাদের ধর্মের সার কথা।  ইসলামে সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের কোন প্রশ্নই আসে না।  জাতীয়তাবাদী মানসিকতার নিরন্তর চর্চা ব্যতিরেকে বাঙালি মুসলমান মুখে বাঙালি পরিচয় দিলেও কখনও বাঙালি হতে পারবেন না। এটাই বাঙালি মুসলমানের বড় সঙ্কট। আর এই সঙ্কট থেকে না বেরিয়ে আসতে পারলে গণতন্ত্র চর্চার কোন সফলতা বাংলাদেশে আসতে পারে না।  নিজেদের দেশে গণতন্ত্রের বিকাশ না হলে ভারতের মতো একটি বহুজাতিক গণতান্ত্রিক প্রশাসন, সমাজ ব্যবস্থার অন্দরে প্রবেশ করে তার জটিল প্রক্রিয়া বুঝতে পারা অতো সহজ ব্যাপার নয়।  কোন একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল দিয়ে গণতন্ত্র বিচার সম্ভব নয়, গণতন্ত্র একটি সার্বিক ব্যবস্থা, দেশের সংবিধান থেকে সাধারণ মানুষের চেতনা – সবটাই সচল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অঙ্গ।  ধর্ম গণতন্ত্রে মুখ্য বিষয় নয়। নাগরিকের অধিকার, দায়িত্ববোধ, যা তৈরি হয় সামাজিক চেতনা থেকে, সেখানেই নীতি, আদর্শ, নৈতিকতার ভাবনা মানুষের মন এবং চিন্তাকে সমৃদ্ধ করে।  বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ তখনই সম্ভব যখন অবাধ গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কোন দেশে বিরাজ করে।  যার প্রকৃ্ত উদাহরণ আমরা ইউরোপের অনেক দেশে দেখতে পাই।

আমাদের মতো দেশে বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার একটি বড় সমস্যা হলো দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি। বুদ্ধিজীবীমহল ভারতে বা বাংলাদেশে রাজনীতি ও দলীয় মতাদর্শের  বাইরে প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু ভারতে গণতন্ত্রের বেগবান ধারা সমাজে সচল থাকায় একপেশে মতামত গ্রহণযোগ্য যেমন হয়না এবং বিকল্প মতামতও উঠে আসে। এরফলে জনমত উপকৃত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে বা পাকিস্তানে গণতন্ত্রের উদারীকরণ না হওয়ার ফলে সমাজে জনমতের সঠিক প্রতিফলন সবসময় দেখা যায় না। বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ বা চর্চার জন্য গণতন্ত্রের উদারীকরণ যেমন প্রয়োজন, শিক্ষা ব্যবস্থাকে সংকীর্ণতা মুক্ত করাও তেমন জরুরী। কিন্তু বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে গত পঁচাত্তর বছরের ইতিহাসে  এমন নজির দেখা যায় না। ফলে বর্তমান বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তি চর্চারও ক্ষেত্রগুলি ক্রমেই সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর হয়ে যাচ্ছে। এক সময়ের বর্জিত পাকিস্তানি চেতনা বাংলাদেশি সমাজে শক্তিশালী হওয়ার  পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ভারতের প্রতিও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে। এর পিছনে শুধু কট্টর ইসলামি শক্তি ও দলগুলিই কাজ করছে না, সরকারি পৃষ্ঠপোষণও রয়েছে।

আজকের পাকিস্তানের পরিণতি থেকে আবারও একথা প্রমাণিত হল যে অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা ও দারিদ্র্য দ্বিজাতিতত্ত্ব ও ধর্মীয়  রাষ্ট্রের অসারতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, ধর্মীয় কারণে পড়শি রাষ্ট্রের সঙ্গে শত্রুতা ও বৈরী মনোভাব  পোষণ করে নিজের দেশের জনগণের মঙ্গল হয় না। পাকিস্তানি বা বাংলাদেশি  সকল জনগণের ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য। বোরখা দিয়ে এ মারাত্মক সমস্যা  ঢেকে রাখা যাবে না, এতে দেশের সঙ্কট তৈরি হওয়া অনিবার্য। আর এই সঙ্কট এক সময় দেশের অস্তিত্বের উপরই আঘাত হানতে পারে।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *