Center For Research In Indo

ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কঃ পর্ব ১

বিমল প্রামাণিক 

 

এ বিষয়টি আলোচনার  শুরুতেই ভারত এবং বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও রাজনৈতিক বিষয়টি যেমন মনে রাখতে হবে, দেশ বিভাগোত্তর কালে দুদেশের গণতন্ত্র চর্চা, দেশ পরিচালন ব্যবস্থা ও শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশ বা গতিপ্রকৃতির দিক-নির্দেশনাও খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে।

স্বাধীনতা-উত্তরপর্বে ভারতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রথম সংবিধান প্রতিষ্ঠা ১৯৫০ সালের পর থেকেই দেশে নিয়মিত নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাজ্য সরকারগুলিরও যথাযথভাবে নিয়মিত নির্বাচনের নজির রয়েছে। এ থেকে ধারণা করা যায়, কেন্দ্রে এবং রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র  চর্চার একটা অভ্যাস জনগণের মধ্যে গড়ে উঠেছে এবং একটি ভিতও শক্তপোক্ত হয়েছে – যা গণতন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের আবশ্যিক শর্ত।

অন্যদিকে, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পর্বের পঁচাত্তর বছরের ইতিহাসে সুষ্ঠু গণতন্ত্র চর্চার ইতিহাস বড়ই এলোমেলো, দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রেও সামরিকতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র বারবারই গণতন্ত্র চর্চার পরিবেশ গঠনে যেমন সহায়ক হয়নি, তেমনই কোন সময়ে  নির্বাচিত সরকার গঠিত হলেও  তা গণতন্ত্রের ভিত শক্তিশালী করতে বা পরিবেশ তৈরি করতে পারেনি। ফলে  আজকের  বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চা  ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমাজে শিকড় গেড়ে বসতে পারেনি। শিক্ষা-সংস্স্কৃতির বিকাশ হয়েছে পশ্চাদমুখী। আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক জনবল তৈরির প্রতিবন্ধকতা যেমন সমাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে, তেমনই ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন মধ্যযুগীয় মতাদর্শ আজকের বাংলাদেশকে অন্ধকারের দিকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে।

পাকিস্তান আন্দোলন পর্বের প্রধান ভিত্তি ছিল দ্বিজাতিতত্ত্ব, যা বাংলাদেশ আন্দোলন পর্বে মোটেই পরিত্যাগ করা হয়নি। প্রবাসী সরকারের ঘোষণাপত্রে যে সকল সর্বজনীন জনকল্যাণমূলক নীতি বিধৃত হয়েছিল, শেখ মুজিব দেশে ফিরে সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর সেসকল নীতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেল। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, পাকিস্তান যে কালা-আইনগুলির  বলে দ্রুত হিন্দু জনগোষ্ঠী  নিশ্চিহ্নকরণ  প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছিল, তার মধ্যে ‘Enemy Property Act’ অন্যতম, মুজিব সরকার এই আইনের একটা ভদ্রগোছের নাম ‘Vested Property Act’ এর মাধ্যমে ‘Enemy Property Act’  এর সকল ধারা বজায়  রেখে সদ্য স্বাধীন দেশ থেকে হিন্দু বিতাড়ণের ব্যবস্থা পাকা করে দিলেন।

এ বিষয়ে অধ্যাপক আবুল বারকাত লিখেছেন, Transformation of Enemy Property into Vested Property: Old Wine in a new bottle.   The proclamation of independence and formation of the Provisional Government of Bangladesh took  place at Mujibnagar on April 10, 1971 and the order named Laws of Continuance Enforcement Order, 1971 was promulgated on the same day purporting to keep in force  all the Pakistani Laws which were in force in the then East Pakistan on or before March 25, 1971.  In other words, Ordinance No.1 of 1969, which does not fit  with the spirit of proclamation of independence of Bangladesh, automatically  remained ineffective in the new state. Bangladesh was not a successor state of Pakistan. On the contrary, Bangladesh established by waging a war of Independence against Pakistan.

Immediately after liberation, the Bangladesh government enforced  on 26th March 1972,  the Bangladesh Vesting of Property and  Assets Order, 1972 (Order 29 of 1972). By this order, as can be seen in Exhibit 9, the properties left behind by the Pakistanis and the erstwhile ‘enemy properties’ were combined to a single category. However, in 1974, the Government passed the Enemy Property (continuance of Emergency Provisions (Repeal) Act, Act XLV of 1974, repealing Ordinance I of 1966 (Exhibit 10).  But despite the fact of repealing Ordinance I of 1969  under Act XLV of 1974, all enemy properties and firms which were vested with the custodian of enemy property in the then East Pakistan renamed Vested  in the Government of Bangladesh under the banner of Vested Property.

At the same time, Government also enacted another law, namely the Vested and Non-resident property (Administration) Act (Act XLV) of 1974.  This act as shown in Exhibit II, was enacted  to provide the  management of certain properties and assets of the  persons who are non-residents of Bangladesh or have acquired  a foreign  nationality.  Though the Principal aim of the Act XLVI of 1974 was to identify and take over the properties of those residents who left Bangladesh during/immediately after liberation war and or took foreign citizenship, in practice this Act XLVI of 1974 was also widely used against Hindu minorities who had no connection with Pakistan for quite valid and obvious reasons.(১)

যেহেতু প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠন এবং পরিচালনা হয়েছিল ভারতের মাটিতে এবং ভারত সরকারের সহায়তায় এমনকি মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাও; যদি আওয়ামি লিগ নেতৃবৃন্দের  মনের কোণে হিন্দুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আইন বলবৎ  রাখার গোপন ইচ্ছাও থাকতো, পরিস্থিতির কারণে সেটা প্রকাশ করা সমীচীনও ছিল না, সম্ভবও ছিল না, যেহেতু আওয়ামি লিগের অনেক বড় বড় নেতাও পাকিস্তানি Enemy Property আইনের সুযোগে হিন্দুদের স্থাবর সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। কিন্তু ‘মুজিবনগর সরকার’ ঢাকায় থিতু হওয়ার মাত্র স্বল্প সময়ের মধ্যেই শেখ মুজিবের নেতৃত্বে  Enemy Property  তার সকল দাঁত-নখ  সহ  Vested Property তে রূপান্তরই শুধু  হল না, মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত শত শত হিন্দু পরিবার শেখ মুজিবের আমলেই স্বাধীন  বাংলাদেশ থেকে  চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে পুনরায় ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হল। মুজিবনগর সরকারের  কোন নেতা বা মন্ত্রীর  এসকল  ঘটনার বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ ধ্বনিত হল না, পাকিস্তান আমলের চেয়েও দ্রুততার সঙ্গে হিন্দু জনগোষ্ঠীর নতুন বাংলাদেশের প্রতি মোহভঙ্গ হতে সময় লাগল না। দেখা গেল ১৯৬১ সালের জনগণনায় হিন্দু ১৮.৫ শতাংশ থাকলেও ১৯৭৪ সালে তা কমে দাঁড়াল ১৩.৫ শতাংশ।   

স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামি লিগ তথা মুসলমান সমাজ যে দ্বিজাতিতত্ত্বের  মানসিকতা পরিত্যাগ করতে পারেনি বার বার নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে তা আরও প্রকট হয়েছে। আজকের সমাজে এই ‘তত্ত্ব’ দগদগে ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। হিন্দু  নিশ্চিহ্নকরণ  হয়ে গেলেও এই ঘা নিরাময় হবে না, যেমন পাকিস্তানে হয়নি। এর প্রধান কারণ হিন্দুদের শিক্ষা-দীক্ষা-সংস্কৃতি-দর্শন  যা ভারতীয় পরম্পরা ও দর্শনের অঙ্গ। হিন্দুরা জাতিসত্ত্বায়  আস্থাশীল – সেকারণেই ভারত একটি বহুজাতিক গণতান্ত্রিক দেশ। মুসলমানরা জাতিসত্তায়  বিশ্বাস করে না, তারা ধর্মকে জাতির ঊর্ধ্বে  স্থান দেয়, যা তাদের জীবন-চর্চায়  চরিত্র ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গঠনে প্রধান অনুষঙ্গ। ফলে বাংলাদেশে বাঙালি  মুসলমানের জাতিসত্তা বা বাঙালি জাতীয়তাবাদের কোন বিকাশ হয়নি।

সবশেষ আমার ছয় দশকের উপলব্ধি ব্যক্ত করা একান্তই প্রয়োজন বলে মনে করি। পাকিস্তান ঘোষিত ইসলামি রাষ্ট্র বিধায় ইসলামি সমাজ সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা শাসকের মূল লক্ষ্য হবে – যা দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তি, তা নতুন করে আলোচনার প্রয়োজন নাই। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারাই বসেছেন, শেখ মুজিবর রহমান থেকে শেখ হাসিনা ওয়াজেদ পর্যন্ত, তাদের কর্মকাণ্ড বিচার বিশ্লেষণ করলে আমরা এটাই দেখতে পাই, সকল শাসকের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশী সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনীতি ইসলামের ভিতের উপর প্রতিষ্ঠা করা। এর পিছনে যে প্রধান উদ্দেশ্য ও মনস্তত্ত্ব কাজ করে তা হল, চারিদিকে বৃহৎ ভারতবর্ষ পরিবৃত এই ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে ভারতীয়  শিক্ষা-সংস্কৃতি দর্শন বাংলাদেশে অবাধে প্রবেশাধিকার বা বিকাশ হওয়ার সুযোগ থাকলে আপামর বাঙালি মুসলমান যে দ্বিজাতিতত্ত্বের  উপর ভিত্তি করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছিল, (তৎকালীন মুসলিম লিগ নেতৃবৃন্দ যার মধ্যে শেখ মুজিব ছিলেন অন্যতম প্রধান নেতা) যার মূল উদ্দেশ্যই ছিল বাঙালি হিন্দুদের প্রভাব বলয় থেকে মুসলমানদের মুক্ত  করা – তা ব্যর্থ হয়ে যায়। ফলে বাংলাদেশী শাসককুল দেশে ইসলামের ভিত শক্ত করা থেকে বিরত থাকতে পারেনি।

 

১। Political Economy of Rural Bangladesh, Abul Barkat et.al, Association of Land Reform and Development (ALRD), Dhaka, 1997.

 

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo.

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *