বাংলাদেশ থেকে হিন্দু বিতাড়ন অব্যাহত
বিমল প্রামাণিক
আমরা বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতার রূপ যদি দেখতে চাই, তাহলে বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকেও দৃষ্টিপাত করতে হবে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিপুল অংশ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল এবং তাদের অবর্তমানে স্থানীয় মুসলমানদের একটি বিশেষ প্রভাবশালী মহল তাদের সম্পত্তি দখল করেছিল। স্বাধীনতার পর ওরা দেশে ফিরে যখন নিজেদের বিষয়-সম্পত্তি ফেরৎ চাইল, তখন একটা প্রচারণা ব্যাপকভাবে চালানো হয় যে, ভারত বিভাগের আগে যারা চলে গিয়েছিল তারাও এসে বাংলাদেশে তাদের সম্পত্তির ভাগ চাইছে। এই প্রচারণার মধ্যে কোন সত্যতা ছিল না। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় ঐসব লুটেরা, যারা একাত্তরের দেশত্যাগী হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করেছিল। ওরাও বাহাত্তরেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সুবিধাবাদী অংশকে হাত করে – যারা ছিল তথাকথিত আওয়ামি লিগ। পাকিস্তান আমলে ভারত-বিদ্বেষ সৃষ্টি করেছিল হিন্দু-বিদ্বেষকে, আর বাংলাদেশ আমলে হিন্দু-বিদ্বেষ থেকে সৃষ্টি হল ভারত-বিদ্বেষ। বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত ছদ্মবেশী আওয়ামি লিগ থাকলেও অবশেষে তারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে পুরো রাষ্টীয় কাঠামোকেই খোলাখুলিভাবে সাম্প্রদায়িক ও পাকিস্তানি করে ফেলল।
পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পরপরই দখলদার রাষ্ট্রপতি খন্দকার মুস্তাক ঘোষণা করেন বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা চলবে না। এদেশ চলবে ইসলামি মূল্যবোধের আলোকে। তিনি বললেন, এদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট, আর ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর অর্জিত হয়েছিল গণতন্ত্রের সংগ্রামের বিজয়। খন্দকার মোস্তাকের এই ঘোষণার ভিতর দিয়ে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতা একটি পরিপুষ্ট ও সতেজ চারাগাছ হিসেবে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হল। বাংলাদেশের পঁচাত্তর পরবর্তী সরকারসমূহ এই চেষ্টাই করেছে এবং রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতাকে বিশাল মহীরুহে পরিণত করেছে ধীরে ধীরে।
১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট সায়েমের মাধ্যমে রাজনৈতিক দন্ডবিধি জারি করে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোকে ময়দানে ছেড়ে দেওয়া হল। ১৯৭৬ এর ৭ই মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামি জলসা’র নামে একাত্তরের ঘাতক আলবদর-রাজাকাররা সমবেত হল এবং সেখানে উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিমান বাহিনী প্রধান এম. জি. তাওয়াব বক্তৃতা দিয়ে বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণার দাবি জানালেন। সেখানেই স্বাধীনতা-বিরোধীদের পক্ষ থেকে ছয় দফা দাবি তোলা হল এবং সেটা গৃহীতও হল। বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করতে হবে, জাতীয় পতাকা পাল্টাতে হবে, নতুন জাতীয় সঙ্গীত চালু করতে হবে, একাত্তরে নিহত রাজকারদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করতে হবে, বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের শহীদমিনারটি ভেঙ্গে ফেলতে হবে। এম. জি.তাওয়াবের এই তৎপরতা থেকে বোঝা গিয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামকে মুছে ফেলার জন্যে বাংলাদেশের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা পাকিস্তানপন্থীরা গোপনে গোপনে কতখানি সংগঠিত হয়ে গিয়েছিল। জিয়াউর রহমান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থাকাকালীনই তার ডেপুটির মাধ্যমে বাংলাদেশকে পাকিস্তানি মার্কা ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গিয়েছিল।
আজ ২০২৪ সালে মুহম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে ও জামাত-হিজবুত তাহরীর সহযোগিতায় বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তানিকরণের চেষ্টা হচ্ছে, যার শুরু হয়েছিল জিয়াউর রহমানের শাসনকালেই তার সক্রিয় উদ্যোগে। ১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করার পরদিনই জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ও দূরদর্শন ভাষণে সংবিধানের কাঠামোই দিলেন পাল্টে। সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন করে পাকিস্তানকে যখন ইসলামি প্রজাতন্ত্রে পরিণত করা হয়, তখন তার মূলনীতিতে বলা হয়েছিলঃ ‘Where in the principles of democracy, freedom, equality, tolerence and social justice as enunciated by Islam shall be fully observed, ‘ ঠিক তেমনভাবে ‘৭৭ এর ২২ এপ্রিল জিয়া বলে ভিলেন, সংবিধানের মূল রাষ্ট্রনীতি হবে সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, সংবিধানের শুরুতে থাকবে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’। জিয়াউর রহমান আসলে পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের সংবিধানকে ইসলামাইজেশনই করলেন।
অন্যদিকে “In November 1976, the Government of Bangladesh repealed previouks Act No. XLVI of 1974 by Ordinance XCII of 1976 (Exhibit 12) and with a restrospective effect from the date of enactment amended the Act XLV of 1974 by Ordinance XCIII of 1976 (Exhibit 13) Ordinance XCIII of 1976 empowered the Govermment not only to administer and manage the Vested Properties, but also to dispose of or transfer the same on long term basis. All the Acts prior to Ordinance XCIII of 1976 (including Ordinance I of 1969) empowered the Government only to become the custodian and to preserve enemy property in contemplation of arrangement to be made in the conclusion of peace with India. But Ordinance XCIII of 1976 made the Government owner of vested properties instead of protector of the same. This the Government encroached the right of ownership, which is a gross violation of the existing laws pertaining to the right to private ownership, These steps undertaken by the military dictator had served dimensions, all related to the strengthening of the political’ base of the vested groups. First, the military rulers wanted to accelerate the process of Pakistanization, and to eliminate the spirit Bengalee Nationalism built-upon secularism that has been developed and enrooted through the war of Independence of 1971. Second, the military dictators wanted to create a panic and insecurity feeling among the 9.7 million Hindus (Census 1974) as they are considered to be the bridge of Bengalee Nationalism, culture and spirit. Third, the nmilitary junta wanted to establish a strong foothold of the ruling government and the power mechanism with the local level power structure by providing them access to acquire vested properties in exchange of collaborations with the government. Fourth, the military rulers wanted to divert the attention of the economically ruling strata of the society from the current6 socio-political development and being engaged in procuring the property of the emigrant Hindus. It is to be mentioned here that in the context of a densely populated country like Bangladesh, it is considered to be a great opportunity to get a chance for further expanding the most scarce recource, the real estate. All the above stated objectives of the military dictator were accompanished to a great extent.
প্রাক্তন মিলিটারী শাসক ও প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত। তার শাসনকাল বিশ্লেষণ করলে যে ইতিহাস উঠে আসে তা হল, বাংলাদেশের অস্তিত্বে তিনি কখনও বিশ্বাস করেননি, মনেপ্রাণে পাকিস্তান চেয়েছিলেন এবং হিন্দু-বিতাড়নে তিনি ছিলেন অন্যান্য পাকিস্তানি ও বাংলাদেশী শাসকের চেয়ে এক কাঠি উপরে। এ থেকে এই কথাই প্রমাণিত হয় যে, উনবিংশ শতকের দ্বিজাতিতত্ত্ব ও সাম্প্রদায়িকতা মুসলমানের মনোজগতে চেতনার গভীরে যেভাবে শিকড় বিস্তার করেছিল – তা আজ মহীরুহ হয়ে ভারত উপমহাদেশের বাঙালি মুসলমান সমাজকে অনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির অশান্ত ছায়া প্রদান করে চলেছে – যা প্রাক দেশ বিভাগোত্তর কাল থেকে নিরন্তর পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু এই মহীরুহের ছায়ার বাইরে যে ক্ষুদ্র জনসংখ্যা বাঙালি জাতিসত্তা নিয়ে নাড়াচাড়া করেন – তাদের বুদ্ধি-বৃত্তির শিকড় বাংলার মুসলমান সমাজে মননে-চিন্তায় একেবারেই দাগ কাটতে পারেনি। তাই আজ আমরা দেখছি বাংলাদেশের জন্ম পাঁচ দশক অতিক্রান্ত হলেও সেই পাকিস্তানি চেতনাই বাঙালি মুসলমানদের আন্দোলিত করে চলেছে – হোক সে শাসকশ্রেণী বা জনসাধারণ।
যেহেতু পাকিস্তান হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে, সেহেতু সেখানে ধর্মকে রাষ্ট্রীয় বিধানে পরিণত করা হয়েছিল, আর যেহেতু বাংলাদেশ একসময় পাকিস্তানের একটা অংশ ছিল, সেহেতু এই কালচারটি বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তান) গভীরে নিহিত ছিল। স্বাধীনতাযুদ্ধ এই বোধকে সাময়িক স্তিমিত করেছিল বটে, কিন্তু নিঃশেষ করতে পারেনি। পঁচাত্তরের পর পাকিস্তানি গুপ্তশক্তি যখন আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল, তখন পুনরুজ্জীবিত হল সেই কালচার। পাকিস্তানে যেহেতু ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করা হয়েছিল, ফলে পাকিস্তান ধর্মরাষ্ট্রে পরিণত হতে বাধা হয়নি। বাংলাদেশে অন্য ধর্মাবলম্বীদের অস্তিত্ব অনেক চেষ্টা করেও নিশ্চিহ্ন করা যায়নি, ফলে বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতার চারণক্ষেত্র। প্রতিটি সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে, সঙ্গে সঙ্গে দেশত্যাগও।
তথ্যসূত্রঃ
১. আবেদ খান, বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতা, বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিঃ ধর্ম সাম্প্রদায়িকতার সঙ্কট, পৃষ্ঠা ২৩৮, ঢাকা, ১৯৯৯।
২. Abul Barakat et.al., Political Economy of the Vested Property Act in Rural Bangladesh, ALRD, Dhaka, 1997.
Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo.
Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo.