Center For Research In Indo

ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্কের অবনতির সূচনা (১৯৭৫–১৯৯০)

Dr. Kakoli Sarkar

আমরা সকলেই জানি যে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। কিন্তু তার দশ দিন পূর্বেই ১৯৭১ সালের ৬ই ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তাছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের যে অবদান তার থেকে আমরা নিঃসন্দেহে একথা অনুমান করতে পারি যে, ভারত আশা করেছিল একটি সৌহার্দ্য মূলক, শান্তিপূর্ণ প্রতিবেশী পাবার। এ কথা মিথ্যা নয় যে, ভারত সেই প্রতিবেশী প্রাথমিকভাবে পায়নি। ভারত বন্ধুত্বপূর্ণ যে প্রতিবেশী আশা করেছিল তা পেয়েছিল তবে খুবই অল্প সময়ের জন্য। কিছুদিনের মধ্যেই ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট মুজিব হত্যার মধ্যে দিয়ে ভারতের সে আশা ভঙ্গ হল। মুজিব হত্যার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হলো পাকিস্তানপন্থী সরকার, আর তা প্রতিষ্ঠিত হলো পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। পরবর্তীকালের ঘটনা পরম্পরায় আমরা তার প্রমাণ পাই।

      ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট মুজিব হত্যার দিন থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনা পরম্পরা অতি দ্রুত ভাবে পরিবর্তিত হতে থাকে। আমি বিস্তৃতভাবে সেই প্রসঙ্গে যাব না, কেবল এইটুকু বলার চেষ্টা করব যে, মেজর জিয়া সামরিকায়নের এবং পাকিস্তায়নের যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তার পেছনে প্রত্যক্ষভাবে পাকিস্তান সক্রিয় ছিল। শাফায়েত জামিলের একটি লেখায় বিষয়টি স্পষ্ট হয়। তিনি লিখেছেন, “৬ নভেম্বর রাতে খালেদ মশাররফ চলে যাওয়ার পরও আমি বঙ্গভবনে থেকে যায় তারই নির্দেশে। খালেদের সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি আমাদের। তারপর তো সিপাহী বিপ্লব ঘটে গেল। রাত তিনটার দিকে জিয়া ফোন করলেন আমাকে। বললেন, ‘Forgive and forget, let’s unite the army’।

      আমি রূঢ়ভাবেই বলি, ‘আপনি বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছেন আর নামতে পারবেন না। যা করার আপনি অফিসারদের নিয়ে করতে পারতেন, সৈনিকদের নিয়ে কেন?’ সেনাবাহিনীর মধ্যে হিংসা ও বিভেদের রাজনীতি ঢোকানো হয়েছে বলেও আমি ক্ষোভ প্রকাশ করি। এই সময় একটি আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে। জিয়ার সঙ্গে আমার কথোপকথন হচ্ছিল ইংরেজি, বাংলা মিশিয়ে। আমাদের সংলাপের যে অংশগুলো বাংলা ছিল তা সঙ্গে সঙ্গে লাইনে থাকা অন্য কেউ ইংরেজিতে ভাষান্তর করে দিচ্ছিল, যেটা আমি পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিলাম। আমার কোন সন্দেহ নেই, বঙ্গভবনে টেলিফোন এক্সচেঞ্জে এমন কেউ অবস্থান করছিল যে আমাদের সংলাপ বিদেশি কোন সূত্রের কাছে ভাষান্তর করে দিচ্ছিল।”[শাফায়েত জামিল, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ: রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রের নভেম্বর, ঢাকা, ১৯৯৮]

     ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট থেকে যখন পাকিস্তানের মদতে পাকিস্তানপন্থী সরকার বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হলো তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। কারণ পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান নীতি হলো, “ভারত এবং হিন্দু পাকিস্তানের শত্রু”। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ব্যাপকভাবে ভারতবিদ্বেষ ছড়াতে থাকে। সামরিক বাহিনী থেকে সাধারণ জনগণ সকলকেই তারা বোঝাতে থাকে– ভারত এবং হিন্দুদের সহযোগিতায় ইসলাম ধর্মকে নষ্ট করা হয়েছে। ইসলাম ধর্মের সম্মান রক্ষা করতে হবে মুসলিম রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে বিশেষ করে পাকিস্তানের সাথে একতাবদ্ধ হয়ে। হাস্যকর হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট থেকে মাঝে মাঝে সাধারণ সৈনিকদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করা হতো– “ভারত আমাদের (বাংলাদেশ)  আক্রমণ করার জন্য সেনাপাঠিয়ে দিয়েছে, আপনারা অস্ত্র নিয়ে তৈরি থাকুন”। সাধারণ সৈনিকেরা তা বিশ্বাসও করত।

       বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরই ১৯৭২ সালে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী বন্ধুত্ব ও নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তাছাড়া যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে ভারত ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক সাহায্য করেছিল। কারণ ভারতের সাথে তৎকালীন বাংলাদেশের একটা আদর্শগত মিল ছিল। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে। বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল অন্যতম বিষয়। ভারত ভেবেছিল মুক্তি সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে গঠিত বাংলাদেশ উগ্র ইসলামী ধর্মান্ধতা থেকে মুক্তি পেয়ে গেল। কিন্তু ভারতের আশাভঙ্গ হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিব OIC(Organisation of Islamic Cooperation) এর সদস্যপদ গ্রহণ করে এবং পাকিস্তান সফরে যায়। বাংলাদেশ যে উগ্র ইসলামী ধর্মান্ধতা থেকে মুক্তি পায়নি এটি হলো তার প্রথম প্রমাণ। শেখ মুজিবের কাছেও আবশ্যিক হয়ে ওঠে দেশবাসীর সামনে নিজেকে মুসলমান প্রমাণ করা। তা সত্ত্বেও শেখ মুজিব চেষ্টা করেছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে ধর্ম এবং পাকিস্তানকে দূরে রাখতে। কিন্তু তার হত্যার মধ্যে দিয়ে শুরু হয়ে গেল পাকিস্তানিকরনের প্রচেষ্টা। পাকিস্তানিকরন করতে গিয়ে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্নভাবে ভারতবিদ্বেষ ছড়াতে লাগলেন। নিজের আধিপত্য বিস্তার করার জন্য তিনি একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসেবে নিজেকে প্রচার করলেন।। এর ফলে দেশবাসী বিভ্রান্ত হলো। কিছু শিক্ষিত উদারচেতা ব্যক্তি ছাড়া সাধারণ জনগণ তা উপলব্ধি করতে পারল না। কিভাবে ভারতবিদ্বেষ ছড়িয়ে নিজেকে সাচ্চা মুসলমান প্রমাণ করা যায়– এই শিক্ষাটি মেজর জিয়ার নিকট থেকে হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ গ্রহণ করেছিলেন খুব ভালোভাবেই। ফলে জিয়া হত্যার পর তিনি যখন ক্ষমতায় এলেন ভারত বিদ্বেষ ছড়াতে তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত ভারত বিদ্বেষ ছড়াতে প্রধান দুটি অস্ত্র ছিল ফারাক্কা বাঁধ এবং তিন বিঘা করিডর।

    আমার ছোটবেলায় দেখেছি, স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চারা পর্যন্ত আলোচনা করত, ভারত কিভাবে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে কৌশলে বাংলাদেশকে একটি শুখা দেশে পরিণত করছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের নদী নালা শুকিয়ে যাচ্ছে, ফসল হচ্ছে না, ভবিষ্যতে আরও ভয়ংকর বিপদ হতে যাচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই প্রচারটি এত বেশি ছিল যে ভূমিষ্ঠ হবার সাথে সাথে নবজাতক বাচ্চা কেও তারা এটি বুঝিয়ে দিত। আমি স্কুলে বহুবার এই কথা শুনেছি যে, ভারতে তোদের হিন্দুরা আমাদের নদীর পানি বেঁধে রেখেছে, আমাদের নদীগুলিকে নষ্ট করে দিচ্ছে, আমাদের পানির কষ্ট দিচ্ছে। ফলত ভারত খুব খারাপ। “ভারত খারাপ” একথা স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।

      আর একটি বিষয় যেটা পূর্বে উল্লেখ করলাম– তিন বিঘা করিডর। আমার ঐ ছোট মাথায় তিন বিঘা করিডরের বিষয়টি বুঝতাম না। তবে এটুকু বুঝতাম যে, তিন বিঘা একটি জমি আছে যেটা বাংলাদেশের সম্পত্তি, কিন্তু ভারত আটকে রেখেছে। জানিনা এই অজ্ঞতা আজও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বহন করে আছেন কিনা। এই বিষয়গুলি ভারত সরকার জানতেন না, তা হতে পারেনা। তাই কূটনৈতিক স্তরে দুদেশের সম্পর্ক থাকলেও ভারত বাংলাদেশকে এড়িয়ে চলতে পছন্দ করেছে। দু দেশের মধ্যে এক প্রকার ঠান্ডা লড়াই চলতে থাকে। ঠান্ডা লড়াই এর ব্যাপারটি ব্যাপক আকার ধারণ করেনি তার কারণ বাংলাদেশ নয়, বরং ভারতের বিদেশ নীতি। ভারত ইচ্ছে করলেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে পারত। কিন্তু ভারত তা করেনি, কারণ তাতে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের উপর প্রভাব পরতো। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ বিপদে পরলে অতীতে যেমন ভারতের শরণাপন্ন হয়েছে, এখনো তাই হয়। ভারত ইচ্ছে করলেই তাদের ত্যাগ করতে পারে না। বাংলাদেশের অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে জঙ্গি কার্যক্রমে বাংলাদেশের  মদতদানের বিষয়টি ভারত বহুবার বলার পরও বাংলাদেশ কিন্তু তা থেকে বিরত থাকেনি। নিরাপত্তা বিষয়ক ভারতের স্বার্থ বিঘ্নিত হবার পরও ভারত বাংলাদেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেনি কেবল এড়িয়ে চলার নীতি গ্রহণ করেছিল। এইসবের মধ্যে ১৯৭৯ সালে গঙ্গার জলবন্টন চুক্তি হয় এবং ১৯৮০ সালে বাণিজ্য চুক্তি হয়। তবে এই দুটি ঘটনাকে সম্পর্কের উন্নতি বলা চলে না, কেননা এই দুটি চুক্তি হয়েছিল কেবলই বাস্তবভিত্তির উপর, কূটনৈতিক স্তরে কোন আদর্শগত জায়গাতে দুই দেশের মধ্যে ঐক্য তৈরি হয়নি। তাই নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়টি একটি তিক্ততার জায়গায় পৌঁছে গেছে। ভারত বাংলাদেশের মধ্যে পাকিস্তানের ছায়া লক্ষ্য করেছে। ফলত, দুদেশের জনগণের মধ্যে তৎকালীন সময়ে অনেক দূরত্ব বেড়েছে। দুদেশের মধ্যে এই অবস্থা চলতে থাকে ১৯৯০ পর্যন্ত অর্থাৎ সামরিক শাসক হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদের পদত্যাগ পর্যন্ত।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *