Center For Research In Indo

ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে কয়েকটি কথা

বিমল প্রামানিক

দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রচলিত যে সকল সংজ্ঞা আমরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেখতে পাই, তা সব সময় পড়শি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে প্রয়োগের সাফল্য আসে না বা দুই দেশের জনগণের উন্নয়নে ও অগ্রগতিতে সহায়ক হয় না৷ তাছাড়া পড়শি দেশগুলির মধ্য স্ব স্ব ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রভৃতি বিষয়গুলিও পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে থাকে।

 

আমরা ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রের দিকে একবার আলোকপাত করতে পারি। পঁচাত্তর বছর পূর্বে ভারতের একটি রাজ্য বঙ্গদেশ বিভক্তির ফলে তার মুসলিম প্রধান পূর্বাংশ পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গঠিত হয় একটি মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান। আর সেই পাকিস্তানেরই পূর্বাংশ (পূর্ব পাকিস্তান) ১৯৭১ সালে একটি সশস্ত্র লড়াই এর মধ্য দিয়ে ভারতের সক্রিয় সহযোগিতা ও সাহায্যে বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত। একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাহলো, গত পঞ্চাশ বছর বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিপথ বড়ই সংঘাতময়, বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ ও রক্তাক্ত। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপরে তার প্রভাব পরিলক্ষিত হওয়াই স্বাভাবিক।

 

পড়শি রাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরিতার নজির আমাদের উপমহাদেশে মোটেই বিরল নয়। এর পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে ভারত বিভাজন। এমনকি জাতিগত বিভাজনও এড়ানো যায়নি। যার জের এখনও আমরা টেনে চলেছি। এর পিছনেও রয়েছে ঐতিহাসিক কারণ। আর এই জাতিগত বিভাজনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্থাবর- অস্থাবর সম্পত্তি গ্রাসের প্রবণতা। এমন প্রবণতা দুনিয়ার অন্যদেশে আছে বলে জানা নেই। এশিয়ার অন্য একটি দেশ কোরিয়া সেখানে জাতিগত বিভাজন হলেও ধর্মীয় বিভাজন না থাকায় এই সমস্যা নেই। কিন্তু পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে এই সমস্যা প্রবল। ‘Islamisation has always been, historically a ‘power concept’. এদিক থেকে দেখতে গেলে ethnic identity বা জাতিগত পরিচয় ধর্মের নিরিখে অনেকটাই গুরুত্বহীন। এটি মৌলবাদী ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী। ভারতীয় উপমহাদেশে এই মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে এসেছে দ্বিজাতি তত্ত্ব — যা ভারতবর্ষকে দ্বিখন্ডিত করেছিল। ইতিহাসের অধ্যায় ভূলে গেলে চলবে না। ইসলামের সামাজিক কেন্দ্রাভিমুখী ধর্মীয় প্রবণতা থেকে উদার গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় উত্তরণ পাকিস্তান বা বাংলাদেশে এখনও সম্ভব হয়নি। ফলে ঐসব দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনসংখ্যা দ্রুত ক্রমহ্রাসমান। এসকল বিষয়ও ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপর ছায়াপাত করছে। এসকল বিষয় মাথায় রেখেই ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও পারস্পরিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলির অগ্রগতিও সমাধানের কথা ভাবতে হবে।

 

তদুপরি রয়েছে দুদেশের সরকারগুলির বিদেশনীতির বৈচিত্র ও সময়ে সময়ে পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে পরিবর্তন। স্বাধীনতা-উত্তর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক একেবারেই মধুর ছিল একথা বলা যায় না। বর্তমান নেতৃত্ব ভারতে ও বাংলাদেশে একটি নিরন্তর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলেছে দু’দেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহের শান্তিপূর্ণ, উভয়দেশের গ্রহণযোগ্য সমাধান উদ্ভাবন ও বাস্তবায়নে। ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে যা দেশ বিভাগের পর থেকে চলে আসছিল, দু’দেশের সীমান্ত নির্ধারণে কোন সমস্যা নেই। ব্যবসা-বানিজ্যের প্রসার ঘটেছে। সীমান্তে অনুপ্রবেশ, চোরাচালান, গরুপাচার প্রভৃতি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে — যা দুই দেশের জনগণের বিশেষভাবে সীমান্ত জনগণের দৈনন্দিন জীবন-যাত্রায় ব্যাপকভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কারণ এই সমস্যাগুলি দুই দেশের সীমান্তে আইন-শৃঙ্খলার সাথে সরাসরি জড়িত। আর একটি বিষয় হচ্ছে, দু’দেশের সংশ্লিষ্ট নদীর জলবন্টন। জল- বন্টন সমস্যার উদ্ভব হয় দেশ বিভাগের ফলে। ভারত ও চিনে উৎপত্তি ছোট বড় অনেকগুলি নদী ভারতের পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ভারত একটি যুক্তরাজ্য। ফলে রাজ্যগুলির অধিকারও গুরুত্বপূর্ণ। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের ঐক্যমত এক্ষেত্রে গুরুত্ব পায়। তাছাড়া, রাজ্যগুলির জল ব্যবহারের উপর কেন্দ্র স্বাধীন মতামত চাপিয়ে দিতে পারে না। এসমস্ত বিষয়গুলি মাথায় রেখেই দু’দেশের মধ্যে জল বন্টনের চুক্তি হয়ে থাকে। দেশ-বিভাগের সময় এসব বিষয় ভেবে দেখার প্রয়োজনীয়তা ও সময় কি নেতাদের হাতে ছিল ! আর একটা বিষয় আমাদের ভেবে দেখতে হবে, তা হলো পড়শি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন শাসন প্রণালী, বাংলাদেশের শুরু থেকেই একটি অঘোষিত/ঘোষিত নীতি সমাজে এবং রাষ্ট্রে কার্যকর রয়েছে যে সংখ্যালঘু নাগরিকদের নিপীড়ন/নির্যাতন/বিতাড়ন। তার ধাক্কা এসে আছড়ে পড়ছে ভারতের সমাজে এবং অর্থনীতিতে। ফলে বাংলাদেশের সংলগ্ন ভারতের রাজ্যগুলিতে নানা সমস্যা ও প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে এর ঢেউ লাগছে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজনীতিতে। এর ফলে দুই প্রতিবেশী দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রভাব পড়ছে। ব্যক্তি গন্ডির বাইরে রাজনীতিতে ধর্ম গুলিয়ে ফেললে সমাজে তার প্রভাব আটকানো যায়না।  পাকিস্তান/আফগানিস্তান এর’ খেসারত দিচ্ছে।

 

আমাদের ভাবতে হবে ভারত – বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কোন্নয়নে আমরা কোন দিকে অগ্রসর হবো।

 

গণতান্ত্রিক দেশে সরকার পরিবর্তন গণতন্ত্রের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এর জন্য বিদেশ নীতি বা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপর প্রভাব পড়া উচিত নয়। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত তৈরী হয় দু’দেশের নানা স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয় সমূহের উপর, কখনও কখনও ঐতিহাসিক কারণও এর পিছনে থাকে। পড়শি রাষ্ট্র হলেই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ভাল থাকবে এমন নয়। পাকিস্তান- ভারত সম্পর্ক এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কিন্তু বর্তমান পৃথিবীতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপর অনেক সময়ই বৈশ্বিক প্রভাব কাজ করে থাকে। ভারত উপমহাদেশে বা দক্ষিণ এশিয়ায় এমন নজির বিরল নয়, দু’দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই তা নানা সন্দেহ ও বাধার জন্ম দিতে পারে। কিন্তু আমাদের দুই দেশেরই পারস্পরিক স্বার্থ এবং অভ্যন্তরীন স্থিতিশীলতার কথা মাথায় রেখে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে দু’দেশের জনগণের মঙ্গলের লক্ষ্যে।

উদার, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও সমাজ তৈরি করার লক্ষ্যে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল। সংবিধানের প্রস্তাবনায় মূল নীতি — সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিসমূহ স্পষ্ট হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৩ থেকে সংবিধান নানামাত্রিক অভিঘাতের শিকার হয়। বিশেষত, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের হত্যাকান্ডের পর, সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে মূল লক্ষ্যের আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়। সংবিধান সংশোধনীর প্রথম পদক্ষেপটি ছিল এইরূপ “যে সকল মহান আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ ঐ সংবিধানের মূলনীতি হইবে।” কিন্তু এর পরিবর্তিত সংশোধনটি ছিল …  “যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল, সর্বশক্তিমান আল্লাহের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস; জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূল নীতি হইবে।” অর্থাৎ, সংশোধনী অংশে সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস যুক্ত করে এবং ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল ও সমাজতন্ত্রের ভিন্ন ব্যাখ্যার মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক আদর্শ ও উদ্দেশ্য পরিবর্তন করা হয়েছে, যা প্রথম সংবিধানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এখানে ইসলাম ধর্ম বিশ্বাস ও আল্লাহর উপরে পূর্ণ আস্থা রাখায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের অবদানকে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্ৰীষ্টান প্রকৃতপক্ষে বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। এটা পাকিস্তানী ধ্যান ধারনারই আর একটা পথ। যেখানে সংখ্যালঘু অধিকার ও অবদানকে অস্বীকার করা হয়েছে ।

১৯৭৩ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী আইন পাশ হয় এবং এটি ঐ সালের .২৫ নম্বর আইন, সংশোধণীর মাধ্যমে ২৬, ৬৩, ৭২, ১৪২ নং অনুচ্ছেদ সংশোধনকরা হয়। এই সংশোধনীর পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের

সংবিধানের চরিত্র ছিল অত্যন্ত গণতান্ত্রিক ও মানবিক; যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকারের ঘোষণা দেওয়া ছিল এবং তা স্থগিতের কোন বিধান বিদ্যমান ছিল না। কিন্তু এই সংশোধনীর মাধ্যমে মৌলিক অধিকার স্থগিতের অধিকার যেমন সরকারের হাতে দেওয়া হল তেমনিভাবে এর অপব্যবহার রোধের কোন বিধান রাখা হল না। এথেকে একথা বলা অসঙ্গত হবে না যে, বাংলাদেশকে পাকিস্তানী ভাবধারায় প্রত্যাবর্তনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রইল।

বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে চতুর্থ সংশোধনীটি (১৯৭৫ সালের ২৫ শে জানুয়ারী) আলোচিত, বিতর্কিত ও সমালোচিত সংশোধনী। এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে সংবিধানের একটি মৌলিক পরিবর্তন ঘটানো হয়। চতুর্থ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতির হাতে অসীম ক্ষমতা অর্পন করা হয় এবং তিনি একবার নির্বাচিত হলে তার অপসারণ প্রক্রিয়াকে প্রায় অসম্ভব করে দেওয়া হয়৷ “সংবিধানে ৫(ক) নামে একটি নতুন ভাগ সৃষ্টি করে ১১৭ (ক) নামে একটি নতুন অনুচ্ছেদ যোগ করা হয়। এর মাধ্যমে দেশের সকল রাজনৈতিক দল বন্ধ করে দিয়ে একদলীয় শাসন প্রবর্তন করা হয়। দেশে একটি মাত্র রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে সকল ক্ষমতা অর্পন করা হয় রাষ্ট্রপতির হাতে।” বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীই সেদেশের উদার গণতান্ত্রিক ভাবধারাকে বাতিল করে বাংলাদেশের ইসলামপন্থী হয়ে ওঠাকে সহজতর করে তোলে।

উদার বাঙালি মানসিকতাকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সংবিধানের প্রস্তাবনার উপরে “বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম” যুক্ত হওয়ার ফলে মুসলমান সমাজে একটি দ্বিতীয় পাকিস্তানের ধারণা তৈরি হয়ে গেল। আর সংখ্যালঘু হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান জনগণ পাকিস্তানের মতোই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়ে হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হল। এই পঞ্চম (১৯৭৮ সাল) সংশোধনীর ফলে ইসলামী রাষ্ট্রগুলির প্রতি বাংলাদেশের যে ঝোঁক বৃদ্ধি পেল তা সরকারী ঘোষণার মাধ্যমেই পরিষ্কার হয়ে যায়।

ইসলামী আদর্শকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে মুক্তিযুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ও আদর্শকে গুরুত্বহীন করার জন্য সংগঠিত হয়েছিল সপ্তম সংশোধনী (১৯৮৬ সালের ১০ই নভেম্বর)। মূল সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতিসমূহ ৪(১) অনুচ্ছেদে উল্লিখিত ছিল তা হল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা … তাকে সংশোধিত করে যে নতুন বিধানাবলী সংযোজিত হল, তা হল “৮(১) — সর্বশক্তিমান আল্লাহের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার — এই নীতিসমূহ এবং তৎসহ এই নীতিসমূহ হইতে উদ্ভুত এইভাবে বর্নিত অন্য সকল নীতি রাষ্ট্র-পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে। ১ (ক) সর্বশক্তিমান আল্লাহের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই যাবতীয় কার্যাবলীর মূল ভিত্তি।” এরপর ১৯৮৮ সালের ৭ই জুন তারিখে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী হিসাবে পাশ হয়। অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা এবং হাইকোর্ট বিকেন্দ্রীকরণের ব্যবস্থা করা হয়। এই বিকেন্দ্রীকরণটি ১৯৮৯ সালের ২ সেপ্টেম্বর এক ঐতিহাসিক বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার মাধ্যমে সংবিধান বহির্ভূত অকার্যকর ও বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়। আসলে এরশাদের আমলে সাংবিধানিক সংশোধন আনয়নের অন্যতম কারণ ছিল নিরঙ্কুশ শাসন প্রতিষ্ঠা করা। অন্যদিকে সংবিধানের মূল চরিত্রই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী। একই সঙ্গে অতি সাংবিধানিক কিছু কার্যক্রমও হাতে নিয়েছিল যা তিনি চেয়েছিলেন কনভেনশনে পরিণত করতে। এ প্রসঙ্গে দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, সংবিধানে রাষ্ট্রপতির খাত সৃষ্টি করা, স্ত্রীকে খুশি করার জন্য ফার্স্ট লেডি নামক পদ সৃষ্টি করা, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল বা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয় এরশাদ ও রওশন এরশাদের নামে। আসলে সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধি জেনারেল এরশাদ চেয়েছিলেন সাংবিধানিক বিকৃতায়নের মাধ্যমে সংবিধানকে সামনে রেখে অতি সাংবিধানিক কার্যক্রম পরিচালিত করতে। এভাবে সামরিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটিয়ে সামরিকায়ন সম্পন্ন করাই ছিল প্রধান লক্ষ্য।

অষ্টম সংশোধনীর বিরুদ্ধে সুপ্রীমকোর্টে আপীল বিভাগে মামলা দায়ের করা হয়েছিল। একমাস শুনানীর পর কোর্ট সংখ্যাগরিষ্ট ভোটে রায় প্রদান করে। বিচারকগণ “ঢাকায় হাইকোর্টের একটি স্থায়ী বেঞ্চসহ বিভিন্ন স্থানে হাইকের্টের ৬টি বেঞ্চ স্থাপনের বিধান সম্বলিত জাতীয় সংসদে পেশকৃত অষ্টম সংশোধন অবৈধ বলে ঘোষণা করেন। তবে সংশোধনীর অপর বড় অংশ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার বিষয়টি এই আদেশের অংশ নয়। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল থাকবে।” এই রায় এরশাদ বিরোধী আন্দোলনকে শক্তি যোগায় এবং একটি উদার জাতীয়তাবাদী মানসিকতার যে পরিচয় মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল তাকে ধূলিসাৎ করে দেওয়া হল। সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস হেতু জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রের কোন অস্তিত্বই আর সংবিধানে থাকলো না।

সংবিধানের ১২ নং অনুচ্ছেদ বাতিল করে বলা হলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িকতা ইসলাম রাষ্ট্রকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান,  রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের ব্যবহার। আর এসব কিছুই সেদেশের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে বাস্তবায়িত হওয়ার পথকে চিরতরে রূদ্ধ করে দিল। ২৫ নং অনুচ্ছেদে (২) উপ-অনুচ্ছেদে সংযোজন করা হয়, “রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তি মুসলিম দেশ সমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত সংরক্ষণ ও জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন। “এব্যতীত সংগঠনের স্বাধীনতা বিষয়ক ৩৮ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, “রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পন্ন কোন সাম্প্রদায়িক সমিতি উদ্দেশ্যানুযায়ী ধর্মভিত্তিক অন্য কোন সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার বা তাহার সদস্য হইবার অধিকার কোন ব্যক্তির থাকিবে না। ফলে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক এবং সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন গড়ায় আর কোন দ্বিধা রইল না। শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এরশাদ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করেন এবং রাষ্ট্রধর্মরূপে ইসলামের গ্রহণ বাংলাদেশকে অচিরেই ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। জিয়াউর রহমান ইসলামীকরণের যে প্রক্রিয়া শুরু করেন, এরশাদের আমলে তা পূর্ণতা লাভ করে।

অষ্টম সংশোধনীর পর আরও ছয় বার সংবিধান সংশোধিত হয়েছে। পরবর্তী কোন সংশোধনী থেকে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা থেকে বিরত থাকা যায়নি। বরং ২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসে শেখ হাসিনা (মুজিব কন্যা) দ্বিতীয় বারের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষাবলম্বী মানুষজন আশান্বিত হয় এই ভেবে যে, মাননীয় উচ্চ আদালত মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী যে সমস্ত সংশোধনী সামরিক সরকারগুলি এনেছিল তা বাতিল করার পক্ষে সুপ্রীম কোর্ট যে মতামত দিয়েছে তা ইতিবাচক। এবিষয়ে দেশের বুদ্ধিজীবী, অধিকাংশ রাজনৈতিক কর্মী ও সংবাদপত্রগুলি সুপ্রীম কোর্টের রায়ের পক্ষে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করে এবং শেখ হাসিনার কাছে তাঁরা দাবী উত্থাপন করেন যে, ১৯৭২ সালের সংবিধানকে মূল নীতি ও আদর্শসহ ফিরিয়ে আনা হোক, কারণ হাইকোর্ট এবং সুপ্রীমকোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলামসহ অন্যান্য যে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সংশোধনী আনা হয়েছিল তা বাতিল হয়ে গিয়েছে। সরকারের পক্ষে নূতনভাবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ভিত্তিক সংবিধানকে পুনঃপ্রচলন করার আর কোন বাধা থাকল না।

শেখ হাসিনার সরকার উচ্চ আদালতের রায়ের বাস্তবায়নের পক্ষে একটি সংবিধান সংশোধনী কমিটি গঠন করে। উক্ত কমিটির সুপারিশমালায় দেখা যায়, ১৯৭২ সালের সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের যে আদর্শ প্রতিফলিত হয়েছিল (সংবিধানের মৌলনীতি) তা যেমন পুনঃসংযোজিত করা হয়েছে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী যে সমস্ত সংশোধনী (পঞ্চম ও অষ্টম) মারফৎ বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত করা হয়েছিল তাহাও সংবিধানে স্থান পেয়েছে, তদুপরি, স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণাপত্র, শেখ মুজিবর রহমানের ৭ই মার্চ ১৯৭১ এর যেসকল ময়দানে রাজনৈতিক ভাষণকেও নূতনভাবে সংযোজিত করা হয়েছে। অতএব সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর (২০১১ সাল) সময় আশা করা গিয়েছিল যে, শেখ হাসিনা হয়তো রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে বাতিল করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি মৌলিক নীতিসমূহকে পুনরায় প্রত্যাবর্তন করবেন এবং সেদেশে সকল শ্রেণীর মানুষের বসবাসযোগ্য হয়ে উঠবে। কিন্তু সে আশাই যে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল সেকথা প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্তরূপে ২০১৯ সালের ২রা আগষ্ট তারিখের কথা বলা যায়। উক্ত তারিখে বাংলাদেশে মহিলা পরিষদ আয়োজিত একটি আলোচনা সভার শিরোনাম ছিল “মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিজ্ঞান ভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক, জেন্ডার সংবেদনশীল ও মানবিক পাঠ্যসূচী চাই। ঐ সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রী মহীবুল হাসান চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘যাদের পিছনে বেশী রাজনৈতিক শক্তি কাজ করে, সরকার তাদের কথা আমলে নিতে বাধ্য।” উপরিউক্ত মন্তব্য থেকে সহজেই স্পষ্ট হয় যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলি যথেষ্টই শক্তিশালী    হয়েছে ।

বাংলাদেশে যে উত্তরোত্তর মৌলবাদী ও ধর্মীয় রাজনীতি বৃদ্ধি ঘটেছে তাতে সংখ্যালঘুদের বসবাস ও নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে না কি ? এদেশের সংবিধানের বিতর্কিত বিষয়াবলীর সংযোজন কখনো কি জনগণের মঙ্গল বয়ে আনতে পারবে ? দেশের সরকার ও প্রশাসনের উদ্দেশ্য যদি হয় জনগণের মঙ্গলসাধন করার, তাহলে স্বচ্ছ আইন কানুন ও রাষ্ট্রীয় সংবিধানে ধর্ম – বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের ক্ষেত্রে সমান অধিকার থাকা আবশ্যিক। কিন্তু বাংলাদেশে তা আছে বলে আমার মনে হয় না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *