পূর্ণিমা নস্কর
১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং মুসলিম অনুপ্রবেশকারীগণ বাংলাদেশ ত্যাগ করে পূর্ব ভারত এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নিরন্তরভাবে আশ্রয় গ্রহণ করেই চলেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের উত্তর পূর্ব রাজ্য-সমূহে জনসংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির মধ্যে আসাম রাজ্যের কথা বলা যায়। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্টের পূর্বে অসম প্রদেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে ছিল বর্তমান অসম রাজ্য, মেঘালয়, নাগাল্যাণ্ড, মিজোরাম, অরুণাচলপ্রদেশ ও বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্ভূক্ত শ্রীহট্ট জেলা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে শ্রীহট্ট জেলার করিমগঞ্জ মহকুমার বদরপুর, পাথরকান্দী, রাতাবাড়ি ও কমিলগঞ্জের পুলিশ স্টেশনের অংশ নিয়ে অসম রাজ্যের কাছাড় জেলার অন্তর্ভূক্ত একটি মহকুমা গঠন করা হয়। ১৯৫১ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৯৬১ খৃষ্টাব্দের মধ্যে নাগাল্যাণ্ড ও অরুণাচলপ্রদেশ অসম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, আর কামরূপ জেলার ৮৫ স্কয়ার কিলোমিটার অংশ ভুটানের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ১৯৬১ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৯৭১ খৃষ্টাব্দে মেঘালয় গঠিত হওয়ায় অসম রাজ্যের সীমানা আরও সংকুচিত হয়। ১৯৮৭ সালে মিজোরাম ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে স্থাপিত হয় ।
ভারতের প্রতিবেশী রাজ্য বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক বিবর্তনের সুদূরপ্রসারী ফলাফলের প্রতিফলন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিতে পরিলক্ষিত হয় । আর এটি সম্ভব হওয়ার একমাত্র কারণ হল – বাংলাদেশ থেকে হিন্দু মুসলমান জনগণের ব্যাপক অনুপ্রবেশ। সীমান্তবর্তী জেলা হিসেবে যদি আমরা আসামের জনগণনার প্রতিবেদনের দিকে দৃষ্টিপাত করি তাহলে অনুপ্রবেশের ফলস্বরূপ, সাংস্কৃতিক প্রভাবের বিষয়টিকে সহজেই উপলব্ধি করা যাবে। আসাম রাজ্যের জনগণনার প্রতিবেদনটি নিম্নে সারণীর মাধ্যমে উপস্থাপন করা হল ।
সারণীঃ
জেলা বা রাজ্য | ধর্মীয় সম্প্রদায় ভিত্তিক জনসংখ্যা | ১৯৭১ মোট জনসংখ্যা | ১৯৮১ মোট জনসংখ্যা | ১৯৯১ মোট জনসংখ্যা | ২০০১ মোট জনসংখ্যা | ২০১১ মোট জনসংখ্যা |
১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ৬ | ৭ |
আসাম | সকল ধর্মীয় সম্প্রদায় | ১৪,৬২৫ | জনগণনা হয়নি | ২২,৪১৪ | ২৬৬৫৫৫২৮ | ৩১২০৫৫৭৬ |
হিন্দু | ১০,৬৫২ (৭২.৮৩%) | জনগণনা হয়নি | ১৫,২৯৭ (৬৮.২৫%) | ১৭২৯৬৪৫৫ (৬৪.`৮৯%%) | ১৯১৮০৭৫৯ (৬১.`৪৭%) | |
মুসলিম | ৩,৫৯২ (২৪.`৫৬%) | জনগণনা হয়নি | ৬,৩৭৩ (২৮.`৪৩%) | ৮২৪০৬১১ (৩০.৯২%) | ১০৬৭৯৩৪৫ (৩৪.`২২%) | |
খ্রিষ্টান | ৩৮১.০ (২.৬১%) | জনগণনা হয়নি | ৭৪৪.৪ (৩.৩২%) | ৯৮৬৫৮৯ (৩.৭০%) | ১১৬৫৮৬৭ (৩.৭৪%) |
উপরের সারণী বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের পর আসামে হিন্দু জনসংখ্যার পরিমাণ হ্রাস পেতে থাকে। ২০১১ সালে এই জনসংখ্যার পরিমাণ এসে দাঁড়ায় ৬১.৪৭ শতাংশ। আবার অন্যদিকে আসামে ১৯৭১ সালে মুসলিম জনসংখ্যার পরিমাণ ২৪.৫৬ শতাংশ থেকে ২০১১ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৩৪.২২ শতাংশে । হিন্দু- মুসলিম সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ব্যতীত আসামে অন্যান্য সম্প্রদায় হিসেবে খ্রিস্টান জনসংখ্যার পরিমাণ ও ১৯৭১ সালের তুলনায় ২০১১ সালে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশের কারণে। আসাম প্রদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হলেন অসমীয়া সম্প্রদায়। অসমীয়াদের সমাজ, সংস্কৃতিও ভিন্নতর। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে হিন্দু-মুসলিম অনুপ্রবেশকারীরা আসামে এসে বসবাস করছে। ফলে জন্মসূত্রে আয়ত্তীকৃত তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত হওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব না হওয়ার কারণে অসমীয়া সমাজে সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক আত্তীকরণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে । কিন্তু অসমীয়াদের মূল সংস্কৃতির সাথে অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশীদের সংস্কৃতির একটা পার্থক্য রয়েই যায়। তাই বর্তমানে আসামে সরকারিভাবে NRC ও CA প্রবর্তনের ফলে আসামের সমাজের ভিন্নতর দিক পাওয়া যায়। যদিও এটা সম্পূর্ণ ভিন্নতর বিষয়। তথাপি একথা বলা যায় যে, আসাম প্রদেশেও ব্যাপক বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ ঘটেছিল – কোন সন্দেহ নেই।
এই অঞ্চলের বিভিন্ন ধর্মের মানুষ যেমন নিজ নিজ স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রেখে পারস্পরিক প্রীতি সহযোগিতার ভাব নিয়ে বসবাস করতে পারে, তার জন্য উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি না পেলে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি যে অদূর ভবিষ্যতে জটিল থেকে জটিলতর হতে পারে, সে বিষয়ের সম্ভাবনাকে অবহেলা করা যায় না।
অন্যদিকে, একটি পরিকল্পিত উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশে মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত জেলাগুলিতে বসতি স্থাপন করা চলতে থাকে। আমরা এ বিষয়ে সীমান্ত জেলাগুলির মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বিশেষভাবে বামফ্রন্ট আমল থেকে (১৯৭৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত) খতিয়ে দেখতে পারি। এই চার দশকে সীমান্ত জেলাগুলির মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বা স্বাভাবিক বৃদ্ধির সঙ্গে তুলনা করা চলে না। আবার আমরা যদি বাংলাদেশে এই চার দশকের মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি প্রকৃতি বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাই ধীরে ধীরে বাংলাদেশের মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার স্তিমিত হয়ে এসেছে। অন্যদিকে সীমান্ত জেলাগুলির মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হিন্দু জনসংখ্যার থেকে অনেকটাই বেশি। এমনকি দ্বিগুণেরও অধিক। ভারতের হিন্দু জনসংখ্যার ক্রমহ্রাসমান বৃদ্ধির যে চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু জনসংখ্যার যে চিত্র আমাদের সামনে রয়েছে তার প্রেক্ষিতে মুসলিম জনসংখ্যার অত্যধিক বৃদ্ধির বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়, যদি না বাইরে থেকে মুসলিম জনসংখ্যা উক্ত অঞ্চলগুলিতে বসতি স্থাপন করে । ভারতের অন্য অঞ্চলের মুসলিম জনসংখ্যার বসতি স্থাপনের সম্ভাবনা এই অঞ্চলে নেই তার প্রধান কারণ হল – এখানে কর্মসংস্থান ও শিল্পের প্রসার তেমন না ঘটায় ভারতের অন্য অঞ্চলের জনসংখ্যার আকর্ষিত হওয়ার কোন কারণ নেই। তাহলে একথা অবিশ্বাস করার কোন কারণ আমরা পাই না যে, সীমান্ত অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী মুসলমানদের অনুপ্রবেশ ঘটেনি। যেহেতু ধর্মীয় জনবিন্যাসে একটি বিপুল পরিবর্তন চার দশকের জনগণনার মধ্য থেকে দেখতে পাওয়া যায়।
ইতিমধ্যেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, সীমান্ত অঞ্চলে গত চার দশকে নানা ধরণের অপরাধের মাত্রা বৃ্দ্ধি পেয়েছে, গরু পাচার, চোরাচালান, অবৈধ সীমান্ত পারাপার এবং ব্যাপক অনুপ্রবেশ। এর ফলে ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও এই অপরাধের আঁচ লেগেছে। অন্য একটি গুরুত্বপূ্র্ণ বিষয়, অনুপ্রবেশজনিত জেলাগুলিতে মাদ্রাসা সংখ্যা এবং শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়া, এর ফলে স্থানীয় সংস্কৃতির পাশাপাশি মৌলবাদী ইসলামি সংস্কৃতি ক্রমে জোরালো হয়ে উঠছে। এবিষয়টি নিয়ে অসমের মুখ্যমন্ত্রী শুধু সোচ্চারই হননি নানা ইতিবাচক ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু মুসলিম তোষণ ও ভোটের রাজনীতির ফাঁদে পরে পশ্চিমবঙ্গ যেভাবে শিক্ষা-সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে পিছিয়ে পরেছে – এ রাজ্যের জনজীবনে তার প্রভাব ইতিমধ্যেই পরিলক্ষিত হতে শুরু করেছে। প্রত্যেকটি সীমান্তবর্তী রাজ্য ও তার সমস্যা নিয়ে এখনই সোচ্চার না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি আমাদের ক্ষমা করবে ?