পূর্ণিমা নস্কর
স্বাধীনতা
কোন দেশের প্রাণ হলে সংস্কৃতি হয় তার সৌন্দর্য।
দেশের এই সংস্কৃতিকে বুকে আগলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার
লড়াই সে দেশের আবেগপ্রবণ মুক্তিযুদ্ধকে করেছিল উজ্জ্বল। আর এই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের
মধ্যে বিরাট একটা অংশ ছিল তরুণ প্রজন্ম। এই
তরুণদের টগবগ করা রক্ত, দূর্দমনীয় সাহস
স্বাধীনতা-সংগ্রামকে এক নতুন মাত্রায় উন্নীত করেছিল এবং সেইসব তরুণ
প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে রচিত হয়েছিল অসংখ্য গান।
সেইসব প্রাণশক্তিরূপিণী গানের ডালিকে স্মরণ করে বীর শহীদের প্রতি রইল আমার অন্তরের গভীর বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ। এই সমস্ত গানের সম্প্রচারের জন্য স্বাধীন
বাংলা বেতারকেন্দ্র বিশেষ ভুমিকা পালন করেছিল। সেই সমস্ত গান তৎকালীন উভয় বাংলার
আপামর জনসাধারণকে উদ্বেলিত করেছিল – যার রেশ আজও ম্রিয়মাণ হয়নি। সেইসব গানের
কিয়দংশ নিবেদন করার মধ্য দিয়ে সেই সূদুর সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে যে উন্মাদনার
সৃষ্টি হয়েছিল স্বাধীন বাংলায় ও পশ্চিমবঙ্গে তার একটা প্রতিচ্ছবি বা অনুরণন ফিরে পাওয়ার প্রয়াস এই প্রবন্ধে রয়েছে।
যে সব গান বেতার কেন্দ্রগুলি সম্প্রচার করেছিলঃ “মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি।
মোরা
একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি।” (১)
এই গানে পূর্ব
পাকিস্তানের কোটি কোটি মানুষের প্রাণ সজীব, উজ্জ্বল ওঠে। প্রতিরোধ সংগ্রামের
চূড়ান্ত পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় রচনার একটি অমোঘ অস্ত্রস্বরূপ ছিল গানটি। এর
রচয়িতা হলেন গোবিন্দ হালদার, সুরকার ও
শিল্পী ছিলেন আপেল মাহমুদ। শ্রোতাদের বিচারে গানটি সেরা গানগুলির মধ্যে
পঞ্চম স্থানে অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল।
চিরকালীন
শোষণ আর নিপীড়ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ইতি বাঙালি বিজয় দিয়ে দেখতে চেয়েছিল, যাতে এসে
সামিল হয়েছিল অসংখ্য মানুষের দেশপ্রেমের অনুভব আর প্রাণপণ লড়ে যাওয়ার গৌরব বাসনা।
সে সময় নাঈম গহর লিখেছিলেন—
“নোঙ্গর তোলো তোলো
সময় যে হলো হলো
নোঙ্গর তোলো তোলো।“ (২)
পরবর্তীতে সমর দাস এ গানটিতে সুরারোপিত করলে বাঙালি স্বাধীনতার
লড়াইয়ে নতুন করে মনে বল অনুভব করে এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত বাঙালির মনে দেশপ্রেমকে জাগরিত করতে
অনবদ্য ভূমিকা রাখে।
আরও একটি উল্লেখযোগ্য গান হল—
তীরহারা
এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে।
আমরা
কজন নবীন মাঝি হাল ধরেছি শক্ত করে। (৩)
গানটির
গীতিকার ও সুরকার আপেল মাহমুদ। কন্ঠশিল্পীরা হলেন আপেল মাহমুদ, রথীন্দ্রনাথ
রায় ও সহশিল্পীরা। গানটির মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তরুণ প্রজন্মের লড়াইয়ের
অগ্রসরতাকে প্রকাশ করা হয়েছে এবং গানটি ছিল মুক্তি সংগ্রামের তীব্র চেতনার এক
বজ্রকঠিন শপথ।
অপর একটি গান, যার কথা, সুর এবং গায়কি লাখ লাখ
মুক্তিযোদ্ধাকে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করে তুলেছিল। গানটি এইরূপ –
“পূর্ব
দিগন্তে সূর্য উঠেছে,
রক্ত
লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল,
জোয়ার
এসেছে জন সমুদ্রে
রক্ত
লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল,
বাঁধন
ছেঁড়ার হয়েছে কাল।” (৪)
সমবেত কণ্ঠ-শিল্পীদের দ্বারা গাওয়া গানটির গীতিকার
গোবিন্দ হালদার এবং সুরকার ছিলেন সমর দাস। এ গানটি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী
তরুণদের মধ্যে অদম্য সাহস সঞ্চার করে স্বাধীনতা সংগ্রামকে একটা ভিন্ন মাত্রায়
উন্নীত করেছিল।
সমাজের সর্বস্তরের জনতার অংশগ্রহণ যে স্বাধীনতা সংগ্রামকে শাসককুল আর
দাবিয়ে রাখতে পারবে না বুঝেই সিকান্দার আবু জাফর লিখেছিলেন –
“জনতার
সংগ্রাম চলবেই
আমাদের
সংগ্রাম চলবেই
জনতার
সংগ্রাম চলবেই।“ (৫)
শেখ লুৎফর রহমানের সুরে শিল্পীরা যখন সমবেতভাবে এই
গান গাইলেন তখন তা এক আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত শুধু সবদিক থেকে
সাহায্যই করেনি; মুক্তিযুদ্ধের গানেতেও তার অবদানের সাক্ষর রেখেছে বহুক্ষেত্রে।
ভারতের বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত প্রতিভাবান শিল্পীরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে
জাত ও ধর্মের বিচার না করেই গান রচনা করেন ও পরিবেশন করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি।
দৃষ্টান্তস্বরূপ গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গানটি –
“মাগো ভাবনা কেন
আমরা তোমার শান্তপ্রিয় শান্তছেলে
প্রতিবাদ করতে জানি
শত্রু এলে অস্ত্র হাতে লড়তে জানি
তোমার ভয় নেই মা আমরা”। (৬)
এখানে বাংলাদেশকে মায়ের স্থান দেওয়া হয়েছে। কত শত
তরুণ গানটি শুনতে শুনতে গৃহত্যাগী হয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল এবং ইতিহাসে আজ সেসব
তথ্য কিছু হলেও লিপিবদ্ধ হয়েছে।
বিখ্যাত সুরকার গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা আরও একটি
গান –
“শোন
একটি মুজিবুরের থেকে
লক্ষ
মুজিবুরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি- প্রতিধ্বনি
আকাশে
বাতাসে ওঠে রণি,
বাংলাদেশ
আমার বাংলাদেশ।” (৭)
গানটির সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী ছিলেন অংশুমান রায়। এই গানটি ছিল এমন একটি গান, যেটি স্বাধীন বাংলা
বেতার কেন্দ্র চালু হওয়ার অনেক আগেই ভারতের কোন এক বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত
হয়েছিল।
বাংলাদেশি সঙ্গীতজ্ঞরাও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অনেক
অবদান রেখেছেন। গাজী মাঝহারুল আনোয়ারের লেখা ও আনোয়ার পারভেজের সুরারোপিত এবং
কণ্ঠশিল্পী মুহাম্মদ আব্দুল জব্বারের সেই বিখ্যাত গান –
“জয়
বাংলা বাংলার জয়।
হবে
হবে হবে হবে নিশ্চয়।
কোটি
প্রাণ একসাথে জেগেছে অন্ধ রাতে
নতুন
সূর্য ওঠার এই তো সময়
জয় বাংলা বাংলার জয়।”
(৮)
গানটির জনপ্রিয়তা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে পরে এই
গানটি ‘জয় বাংলা’ চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয়। গানটি
মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাসহ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে সাহায্য করেছিল। এ প্রসঙ্গে ডিএল
রায়ের একটি বিখ্যাত গান—মাতৃভূমি নিয়ে গর্বিত হওয়ার গান।
“ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা
আমাদের এই বসুন্ধরা।” (৯)
এই গানটি বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে পুনঃপ্রত্যাবর্তনের দিক
নির্দেশ করে।
আব্দুল লতিফের লেখা ও গাওয়া অপর একটি উল্লেখযোগ্য গান
হল –
“ওরা
আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়
ওরা
আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়
ওরা
কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে পায়ে
ওরা
কথায় কথায় শিকল পরায় আমাদেরই হাতে পায়ে।” (১০)
এখানে তৎকালীন পাকিস্তানে (অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর
ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার সমান মর্যাদা) পূর্ববঙ্গে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির যে
প্রকৃষ্ট চর্চার কেন্দ্র ছিল সেখানে লোকজ সঙ্গীত একটা বড় স্থান জুড়ে রয়েছে। ফলে
সাধারণ মানুষ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু ঘোষণার প্রেক্ষিতে বিচলিত হয়ে পড়ে এবং
নিজেদের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার তাগিদ অনুভব করে।
মুক্তিযুদ্ধের ৭৮টি গানের মধ্যে রথীন্দ্রনাথ রায়ের
কণ্ঠে বহুল প্রচারিত উল্লেখ্য গানটি ছিল— “আমার
এদেশ সব মানুষের” (১১)
আব্দুল জব্বারের গাওয়া জনপ্রিয় গানটি হল—
সাত
কোটি মানুষের আর একটি নাম
মুজিবর,
মুজিবর, মুজিবর। (১২)
গানটির কথা লিখেছিলেন শ্যামল গুপ্ত এবং গানটিতে সুর
দিয়েছিলেন বিখ্যাত ভারতীয় সুরকার বাপ্পী লাহিড়ী।
ফেরদৌসী রহমানের গাওয়া অপর এক গান –
“আমার
মন জুড়ানো চোখ জুড়ানো।” (১৩)
আব্দুল লতিফের লেখা হৃদয় জুড়ানো গানটি ছিল এইরূপ –
“সোনা
সোনা লোকে বলে সোনা
সোনা
নয় ততো খাঁটি
বলো যত
খাঁটি তার চেয়ে খাঁটি
বাংলাদেশের
মাটিরে আমার জন্মভূমির মাটি
ধন্য
মানি জীবনটাকে এই বাংলাকে ভালোবেসে।” (১৪)
এ ব্যতীত এ প্রসঙ্গে বলা যায়, ১৯৭০ সালে তৎকালীন
পাকিস্তান আমলে সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সর্দার আলাউদ্দিন আহমেদের লেখা,
সুরে ও কণ্ঠে ধ্বনিত হয় বিখ্যাত যে গান—
“মুজিব
বাইয়া যাওরে
নির্যাতিত
দেশের মাঝে
জনগণের
নাওরে মুজিব
বাইয়া
যাওরে।” (১৫)
এই গানটির মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নাম বাংলার ঘরে ঘরে
আন্দোলিত হয়ে সুরের মুর্চ্ছনায় কোটি কোটি
মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময়ও গানটি তেমনিভাবে সুরের লহরি তোলে।
দেশকে ভালোবেসে, দেশের মাটির জন্য রচিত হয়েছে বহু
গান। সেইসব গান দেশের মানুষকে যুগিয়েছে অপার আনন্দ ও উৎসাহ-উদ্দীপনা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেরণার অন্যতম
উৎস ছিল দেশাত্মবোধক গান এবং অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের বড় অস্ত্র বা হাতিয়ার ছিল
এইসব দেশাত্মবোধক গানের কথা ও সুর। সেই সাথে ছিল উদাত্তকণ্ঠে পরিবেশনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবেশিত গানগুলি বাঙালি
মনে যে উৎসাহ, উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল এবং
তারই অনুপ্রেরণায় ইন্ধন যুগিয়ে দেশপ্রেম ও চেতনার শিখাকে প্রজ্বলিত করে
মুক্তি ও স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করে তুলেছিল জাতিধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নকেও করে তুলেছিল
ত্বরান্বিত।
যে সব কণ্ঠশিল্পীরা দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করে
বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নকে
বাস্তাবায়িত করেছিলেন তাঁরা হলেন—
রথীন্দ্রনাথ
রায়, আপেল মাহমুদ, শ্যামল মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, অনুপ ঘোষাল, রফিকুল আলম,
মোশারফ হোসেন, প্রবাল চৌধুরী, অজয় কিশোর রায়, ফকির আলমগীর, আব্দুল লতিফ, শাহীন
মাহমুদ, কাদেরি কিবরিয়া, হরলাল রায়, প্রমুখ।
এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, প্রাথমিক অবস্থায় স্বাধীন
বাংলা বেতার কেন্দ্রের (বালিগঞ্জ, কলকাতা), কোন নিজস্ব গান ছিল না। ডিএল রায়,
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামের
লেখা গানের সাথে গণনাট্য সংঘের গাওয়া গানগুলি সম্প্রচার করা হতো, প্রচার
করা হতো একুশে ফেব্রুয়ারীর সময়কার গানগুলিও।
পরবর্তীকালে মুক্তিকামী মেধাবী গীতিকার, সুরকার ও গায়কেরা স্বেচ্ছায় এসে
যোগ দেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে।
উভয় বঙ্গের কলা-কুশলীরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার
কেন্দ্রে তাঁদের সুরের মুর্ছনায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে করেছেন মহিমান্বিত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গীত পরিচালক সমর দাসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ‘বাংলাদেশে মুক্তি
সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ বেতারে গান পরিবেশন করেছিলেন। ধীরে ধীরে কালজয়ী দেশাত্মবোধক গানগুলি
মুক্তিসংগ্রামে গতিময়তা প্রদান করে মুক্তির আনন্দকে স্বাগত জানিয়েছিল।
তথ্যসূত্রঃ
১। উইকিপিডিয়া
২। বাংলাদেশের সময়, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮।
৩। বার্তা ২৮, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩।
৪। পূর্বে উল্লেখিত
৫। পূর্বে উল্লেখিত
৬। পূর্বে উল্লেখিত
৭। The Daily
Star, Bangladesh.
৮। দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৪ মার্চ, ২০২২।
৯। ভোরের কাগজ, বাংলাদেশ
১০। বার্তা ২৮, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩।
১১। সারা বাংলা, ঢাকা, ১৬ ডিসেম্বর ২০২১।
১২। The Daily
Star, Bangladesh.
১৩। ভোরের কাগজ, মার্চ, ২০২১।
১৪। ভোরের কাগজ, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, বাংলাদেশ।
১৫। The Daily
Star, Bangladesh.