Center For Research In Indo

মুক্তিযুদ্ধের গোপন ঘাঁটি সানি ভিলা

বিমল প্রামানিক ( ডাইরেক্টর, সেন্টার ফর রিসার্চ ইন ইন্দো-বাংলাদেশ রিলেশনস, কলকাতা। )

‘সানি ভিলা’ ২১ রাজেন্দ্র রোড, কলকাতা -২০ ঠিকানার তিনতলা বাড়িটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে । ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামি লিগ জয়লাভ করার পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, আওয়ামি লিগকে সামরিক জুন্তা নিয়মতান্ত্রিকভাবে কিছুতেই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসনভার গ্রহণ করতে দেবে না। যে-কোনো চূড়ান্ত অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে দেশকে ঠেলে দেওয়া হতে পারে এটা বুঝেই তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধির নিকট প্রয়োজনে সাহায্য সহযোগিতা চেয়ে গোপনে বিশেষ দূত প্রেরণ করেন । পূর্বপাকিস্তানে বিশেষ কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হলে আওয়ামি লিগের কোনো কোনো নেতাকে ভারতে আশ্রয় নিতে হতে পারে-একথা ভেবেই ভারত সরকার কলকাতায় একটি আশ্রয়স্থলেরও আগাম ব্যবস্থা করে রাখে । আর সেই বাড়িটিই হল ‘সানি ভিলা’ । পরিকল্পনা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর বিশেষ দূত শ্রীচিত্তরঞ্জন সুতার মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই এই বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। আওয়ামি লিগের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দের এখানেই এসে যোগাযোগ করার কথা ছিল । সেই মোতাবেক ২৬ মার্চের পর এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান, শেখ ফজলুল হক মণি, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, সিরাজুল আলম খান প্রমুখ এই বাড়িতে এসে ওঠেন। তারা ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগও করেন । অধ্যাপক ইউসুফ আলি তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “…আমার থাকার জায়গা তাঁরা করে দিলেন কীড স্ট্রীটের এম এল এ ভবনে। তারপর চেষ্টা চলল নেতৃবৃন্দের সাথে সংযোগ স্থাপনের। প্রথমে দেখা হলো জনাব কামরুজ্জামান সাহেবের সাথে বালিগঞ্জ এলাকায় রাজেন্দ্র রোডের নর্দান পার্কের একটি বাড়িতে । পরবর্তীকালে জানা গেল বাংলাদেশ থেকে আগত উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের জন্য এই বাড়িটি সংরক্ষিত ছিল । বাসাটির তিনতলায় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বেতার যন্ত্র ছাড়াও যোগাযোগ স্থাপনের অন্যান্য উপকরণ দ্বারাও এটি সজ্জিত ছিল।” ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “… আমরা বিমানে করে আবার কলকাতা ফিরে এলাম । এখানে এসে জানলাম, কলকাতায় গাজা পার্কের কাছে একটা বাড়িতে কামরুজ্জমান ভাই থাকেন । শেখ ফজলুল হক মণিও ঐ বাড়িতে আছেন । পরে আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ও সিরাজুল আলম খান এই বাড়িতে ঘাঁটি করেন।”

 মঈদুল হাসান ‘মূলধারা ৭১’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘দিল্লী থেকে কলকাতা ফিরে তাজউদ্দিন ৮ই এপ্রিল ভবানীপুর এলাকায় রাজেন্দ্র রোডের এক বাড়িতে কামরুজ্জামানসহ উপস্থিত আওয়ামী ও যুব নেতৃবৃন্দকে দিল্লী বৈঠকের ফলাফল অবহিত করেন। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনাকালে কোন বিবেচনা থেকে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ও সরকার গঠনকে অনিবর্তনীয় বিষয় হিসেবে উপস্থিত করেন তাও ব্যাখ্যা করেন।

মে মাসের প্রথম সপ্তাহেই পশ্চিমবঙ্গের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের এক বৈঠক বসে ‘সানি ভিলা’য়। ওই বৈঠকের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি পশ্চিমবঙ্গের সার্বিক সমর্থন আদায় করা। বলা যায় সে উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল । যদিও সি পি এম-এর পক্ষ থেকে এরকম একটা বক্তব্য রাখা হয়েছির যে,যদি বাংলাদেশের এই আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় পূর্বপাকিস্তানে ও ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে তবে তাদের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দান কঠিন হয়ে পড়বে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়েও সি পি এম- এর একটা বড় অংশই এতে সমর্থন দান করেছিল। পরবর্তীকালে পাকিস্তানের প্রতি চীনের সমর্থন সুস্পষ্ট হয়ে যাওয়ায় সি পি এম অনেকটাই নিজেদের গুটিয়ে নেয়। এই গুরুত্বপূর্ণ সভায় উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসের (ই) সাধারণ সম্পাদক, সি পি আই-এর গোপাল বন্দোপাধ্যায়, সি পি এম- এর সরোজ মুখার্জি, ফরোয়ার্ড ব্লকের অশোক ঘোষ, আর এস পি-র নিখিল দাশ এবং কংগ্রেস (স)-এর প্রতিনিধি। বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন তাজউদ্দিন আহমেদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, খন্দকার মোস্তাক আহমেদ, আব্দুস সামাদ আজাদ, জিল্লুর রহমান, পুলিন দে,অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ (ন্যাপ), আবদুস সালাম (সি পি বি), ফণিভূষণ মজুমদার, শেখ ফজলুল হক মণি, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, সিরাজুল আলম খান, চিত্তরঞ্জন সুতার প্রমুখ। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ। পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগর সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন তাজউদ্দিন আহমেদ এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম। সীমান্তে বি এস এফ-এর সঙ্গে যোগাযোগ করার পর তৎকালীন বি এস এফ-এর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান শ্রীগোলোক মজুমদার কলকাতা থেকে সীমান্তে গিয়ে তাদের গ্রহণ করেন এবং তার গাড়িতে সরাসরি কলকাতা বিমানবন্দরে নিয়ে আসেন। বি এস এফ-এর তৎকালীন প্রধান কে এফ রুস্তমজি ঐদিনই দিল্লি থেকে কলকাতা আসেন এবং বিমানবন্দরে বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পরিচয় এবং প্রাথমিক আলোচনার পর রুস্তমজির সঙ্গে তার গাড়িতেই প্রায় মধ্যরাতে নেতৃদ্বয় রাসেল স্ট্রিটের আসাম হাউসের অতিথিশালায় এসে ওঠেন। ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম তার সাক্ষাৎকারে বলেছেন।”…একটি সুন্দর বাড়িতে (আসাম হাউজ) আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হল । একটি ঘরে আমি আর তাজউদ্দিন ভাই, অন্য ঘরে রুস্তমজি” এই বাড়িতে দু’দিন থাকাকালীন তাজউদ্দিন আহমদ কলকাতায় আগত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আওয়ামি লিগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু সঠিক ঠিকানা না বলতে পারায় বি এস এফ এবং পুলিশের লোকজন তাদের খুঁজে বের করতে পারেনি। এই অবস্থায় ১ এপ্রিল গভীর রাতে বি এস এফ-র তত্ত্বাবধানে নেতৃদ্বয় দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান। লক্ষ্য, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। ৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমেদের সাক্ষাৎ হয় এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের বিষয় আলোচনা হয়।

দিল্লি থেকে কলকাতায় ফিরে তাজউদ্দিন আহমেদ ও আমিরুল ইসলাম ২বি লর্ড সিনহা রোডের গেস্টহাউসে ওঠেন। এই বাড়িটি তখন ছিল বি এস এফ-এর পূর্বাঞ্চলীয় হেড কোয়ার্টার । ১০ এপ্রিল রাতে এই বাড়িতেই প্রবাসী সরকার গঠনের বিষয়ে আওয়ামি লিগ নেতৃবৃন্দের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উপস্থিত ছিলেন তাজউদ্দিন আহমেদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, মিজানুর রহমান চৌধুরি, শেখ ফজলুল হক মণি, তোফায়েল আহমেদ, আমিরুল ইসলামসহ অনেক এম এন এ, এম পি এ ও বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ। ১২ এপ্রিল প্রবাসী সরকারের মন্ত্রিপরিষদ চুড়ান্ত করতে আগরতলা সার্কিট হাউসে আওয়ামি সংসদীয় দলের বৈঠক বসে। দীর্ঘ বাগ-বিতণ্ডার পর তাজউদ্দিন আহমেদকেই সবাই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হন। ১৩ এপ্রিল ছোটো বিমানে মন্ত্রিসভার সদস্যগণ আগরতলা থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন। ১৭ এপ্রিল বাংলদেশ সরকার গঠিত হওয়া পর্যন্ত তাজউদ্দিন আহমেদ এই বাড়িতেই ছিলেন। পরে বি এস এফ -এর ভাড়া করা ৫৭/৮ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে উঠে যান।

তথ্যসুত্রঃ

১। অধ্যাপক ইউসুফ আলির সাক্ষাৎকার, বাংলাদেশের স্বধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, পঞ্চদশ খণ্ড, ঢাকা, ১৯৮৫, পৃঃ ৩৪৭-৩৪৮

২। ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের সাক্ষাৎকার, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র,  পঞ্চদশ খন্ড,   পৃঃ  ১১০

৩। মঈদুল হাসান তরফদার, মূলধারা একাত্তর, ইউনিভার্সিটি  পাবলিশার্স লিঃ, ঢাকা, ১৯৮৬, পৃঃ ১৬।

৪। শ্রীসত্যরঞ্জন ঘোষ, কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী (অবঃ), মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন – সাক্ষাৎকার  (লেখক কর্তৃক গৃহীত, ১৯৯৪)

৫। ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের সাক্ষাৎকার, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০১

৬। শ্রীশরদিন্দু চট্টপাধ্যায়, আই, পি, এস,  প্রবাসী সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের লিয়াঁজো অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন — সাক্ষাৎকার, (লেখক কর্তৃক গৃহীত, ১৯৯৪)

৭। ঐ 

 

                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                           

 

 

 

 

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *