ডঃ আনন্দ বিকাশ চাকমা, সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে উনিশ শ’ একাত্তরের মার্চ মাসের ঘটনাবলী খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অকস্মাৎ পহেলা মার্চে জাতীয় পরিষদের পূর্বঘোষিত অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এ কারণে মার্চের শুরু থেকেই উত্তাল হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। আন্দোলন সফল করতে ২ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত টানা হরতাল আহূত ও পালিত হয়। এ মার্চ মাসেই পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে প্রথম উড্ডীন হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা, বাঙালি জাতি উপভোগ করে প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের শিহরণ জাগানো ভাষণ ও স্বাধীনতার মন্ত্রোচারণ, মার্চের গোড়া থেকেই বঙ্গবন্ধুর সম্মোহনী নেতৃত্বে পরিচালিত হয় বাঙালির সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন, এবং এই মার্চ মাসেই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বস্তুত মার্চ ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে বাঁক বদলানোর সময়। মার্চে বাঙালি দেখিয়েছে তাদের ঐক্যবদ্ধ গণশক্তির জাগরণ, স্বাধীনতার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা। মার্চ জুড়েই সেনাবাহিনীর গুলিতে আত্মবলিদান দিয়েছে আন্দোলনকারী ছাত্র, শ্রমিক, যুবারা। পাকবাহিনীর ২৫শে মার্চের রাতের বর্বরতম গণহত্যায় প্রাণ দেয় অগণিত বাঙালি। ২৬শে মার্চ ভোরের আলো ফোটার আগেই বাঙালির ভাগ্যবিধাতা স্বাধীনতার মন্ত্রগুরু বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে। পরে পশ্চিম পাকিস্তানে অন্তরীণ করে রাখে নয় মাস ধরে। কিন্তু বাঙালিকে দাবিয়ে রাখা যায়নি, বরং বাঙালি সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশমাতৃকাকে হানাদারমুক্ত করেছে। তাই বাংলাদেশ রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার ইতিহাসে মার্চ মাস আগুন ঝরা মার্চঃ দেশ পরিচালনার গণ-রায় প্রাপ্ত বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবকে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত রাখার পাকি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবার মাস, নিরস্ত্র, নিরীহ বাঙালিকে শত্রুর অন্যায় জাতি-নিধনাভিযানের বিরুদ্ধে দুর্বার গণপ্রতিরোধের মাস।
১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল। মহাকালের বিবেচনায় ২৩ বছর খুব বেশি বড় সময় নয়। পৃথিবীর স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও এটি সবচেয়ে ছোট সময়। ভারতবর্ষেও ১৮৮৫ সালে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার বছর থেকে ১৯৪৭-এ স্বাধীনতা প্রাপ্তি পর্যন্ত স্বাধীনতার লড়াই চলেছে সুদীর্ঘ ৬২ বছর। জাপানের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, রাজনৈতিক দমনপীড়ন ও উপনিবেশায়নের বিরুদ্ধে কোরিয়ান জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়কাল ছিল ২৬ বছর। কিন্তু বাঙালি মাত্র ২৩ বছরে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গেছে, এনেছে স্বাধীনতা। প্রতিষ্ঠা করেছে বিশ্বের বুকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম স্বদেশ-বাংলাদেশ। এ যেন বিস্ময়কর অবিশ্বাস্য ঘটনা। মিটিকুলাস। হ্যাঁ বাঙালি অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। তার কারণ যুগ যুগান্তরে শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত বাঙ্গালির জাতীয় জীবনে ভাগ্যবিধাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল একজন সত্যিকারের জননেতা—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। খোকা, মুজিব ভাই, শেখ সাহেব, বঙ্গবন্ধু হয়ে যিনি এখন বাঙালির জাতির পিতার সসম্মানে সুপ্রতিষ্ঠিত। পশ্চিমবঙ্গের একজন ইতিহাসবিদ যথার্থই বলেছেন, ‘ভারতের ইতিহাস পড়লেই দেখা যায় যে বাংলা বরাবরই স্বতন্ত্র ও স্বাধীনচেতা। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বাংলার ও বাঙালির সফল ও সর্বোৎকৃষ্ট প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন সুভাষচন্দ্র। পরবর্তীকালে সে ঐতিহ্যকে শিরোধার্য করে পাকিস্তানের বাংলা-বিরোধিতার দুর্বিষহ শাসনের জাল ছিন্ন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশনায়ক নেতাজী সুভাষচন্দ্রের প্রতিবাদী ও লড়াকু ঐতিহ্য থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দাসত্ব-বিরোধিতার ও বাঙালিকে ‘দাবায়ে রাখতে’ না পারার ঐতিহ্যে যাওয়াটা বাঙালির এক নিজস্ব উৎক্ষেপণ।’
শেখ মুজিব ব্রিটিশ আমলে রাজনীতির পাঠ ও প্রশিক্ষণ লাভ করেন সোহরাওয়ার্দী, হাশিম প্রমুখ নেতাদের সান্নিধ্যে এসে। সাতচল্লিশে দেশভাগের সময় খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেন পূর্ব বাংলার বাঙালির অধিকার বঞ্চিত রাখার ষড়যন্ত্রকে। তাই তিনি শপথ নেন পশ্চিম পাকিস্তানিদের সকল ষড়যন্ত্রকে চুরমার করে দিয়ে বাঙালির জীবনে সত্যিকারের স্বাধীনতা এনে দেওয়ার। এর জন্য তিনি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ভোগ, বিলাস, আরাম, আয়েশ, আমোদ-আহ্লাদ সব বিসর্জন দিয়ে বাঙালির মুক্তিপথের সন্ধানে সংগ্রামে নেমে পড়েন। কমরেড মনি সিংহ এর ভাষ্যমতে বঙ্গবন্ধু সেই ১৯৪৭ সাল থেকে স্বাধীনতার স্বপ্ন বুনেছিলেন। পরবর্তীকালে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দান, ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা, ১৯৪৯ এ আওয়ামি মুসলিম লিগের যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করেন। অতঃপর ১৯৫৩ তে পার্টির সাধারণ সম্পাদক, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট গঠনে জোরালো ভূমিকা গ্রহণ এবং নির্বাচনে বিজয়লাভ ও মন্ত্রিত্ব গ্রহণ। পরে ১৯৫৭ তে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে দলের সাংগঠনিক কাঠামো সুদৃঢ় করার নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ১৯৬৬-তে এসে আওয়ামি লিগের সভাপতি হিসেবে দলকে পুনরুজ্জীবিত করেন। একই বছর বাঙালির স্বাধিকারের সাঁকো ও মুক্তির সনদ খ্যাত ছয় দফা ঘোষণা করে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামকে নবচেতনায় উদ্দীপ্ত করেন। তাঁর ছয় দফা কর্মসূচি ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করে। বাঙালি জনগণ ছয় দফাকে নিজেদের দুঃখ ও শাপ মোচনের মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করে। ছয়দফাভিত্তিক আন্দোলনের জোয়ারে হতবিহ্বল হয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাঁকে কারারুদ্ধ করে রাখে বছরের পর বছর। এতেও বাঙালির স্বাধিকার লড়াইকে থামাতে না পেরে আইয়ুব সরকার বঙ্গবন্ধুর প্রাণনাশের নীল নকশা হিসেবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে একটি দেশদ্রোহ মামলা দায়ের করে। কিন্তু ততদিনে বাঙালি জনগণ তাদের নেতাকে চিনেছে। শেখ মুজিব দেশদ্রোহী নন, দেশপ্রেমিক। তারা বুঝেছে শেখ মুজিব একজন জননায়ক; বাঙালি জাতির ঐক্য, শক্তি ও সাহসের ঠিকানা। তাঁকে মুক্ত করতেই হবে। শুরু হয় দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থান। আইয়ুব হার মানলেন। শেখ মুজিবকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন। বাঙালি ফিরে পেল তাদের প্রিয় নেতাকে। ভালবাসায় সিক্ত করে ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত করলো লাখো মানুষের জনসভায়। বিদায় নিলেন আইয়ুব; শেখ মুজিবের নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্ব তখন অনন্য উচ্চতায়। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার মানুষ এখন তাঁর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ । তাঁর বজ্রকণ্ঠই সমগ্র জাতির কণ্ঠস্বর। এমন ঐক্য বাঙালি ইতিপূর্বে দেখেনি। স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার চেতনা এখন বাংলার ঘরে ঘরে। মানুষের মুখমণ্ডল ভিন্ন, চেতনায়, লক্ষ্যে, স্বার্থে সবাই যেন শেখ মুজিবের প্রতিচ্ছবি।
এ সময় এল সত্তরের নির্বাচন। ইয়াহিয়ার ঘোষিত নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে বাংলার অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো ধন্দে পড়ে গেল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কৌশল সবসময় ভিন্ন। তিনি নির্বাচনকেই স্বাধীনতা অর্জনের পথে হাতিয়ারে পরিণত করলেন। তিনি নির্বাচন করলেন। ছয় দফাকে নির্বাচনী ইশতেহারে রূপান্তর করলেন। এ পথে ও কৌশলে আসলো বাঙালির নিরঙ্কুশ বিজয়। বঙ্গবন্ধু সফল হলেন। এখন পার্লামেন্টে বসে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন এবং দেশ পরিচালনার দায়িত্বগ্রহণ। কিন্তু তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন ভুট্টো, ইয়াহিয়াসহ পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক-অসামরিক এস্টাবলিশমেন্ট। কিন্তু বঙ্গবন্ধু দমবার পাত্র নয়। বাঙালি ততক্ষণে যে কোন কঠিন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত। শুধু দরকার প্রিয় নেতার নির্দেশনা। ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অধিবেশন স্থগিত করলেন। বাঙালির বুঝতে বাকী রইল না। সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না। ইয়াহিয়ার ঘোষণার প্রতিবাদে ২ ও ৩ মার্চ সারাদেশে ঘোষিত হল হরতাল। পালিত হল সর্বাত্মক হরতাল। আর সিদ্ধান্ত হল ৭ই মার্চ পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষিত হবে। নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে লাখো মানুষের সমাবেশে একসভা, একটেবিল, একনেতার ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ। তাঁর মুখ থেকে, তাঁর অন্তরাত্মা থেকে বেরিয়ে এলো সেই অমর পঙক্তিঃ ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’
মার্চ জুড়ে সামরিক সরকার দেয় বিধি অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু সরকার দেয় অসহযোগ আন্দোলনের দফার পর দফা নির্দেশনা। এর মধ্যে ইয়াহিয়া খান ২৫শে মার্চ অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর শর্ত সাপেক্ষে অধিবেশন বসার কথা বললেন। ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ সহচরসহ ঢাকা এলেন। শুরু করলেন ক্ষমতা হস্তান্তর প্রসঙ্গে প্রহসনমূলক সংলাপ। বাংলাদেশের মানুষ যে কোন চরম ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। অবশেষে ইয়হিয়া খান কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ঢাকা ত্যাগ করেন। এভাবে ২ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে চলে বাঙালির অসহযোগ আন্দোলন তথা স্বাধীনতার অভিযাত্রা। বলতে গেলে পুরো মার্চ মাস জুড়ে বাংলাদেশের বেসামরিক প্রশাসন চলেছে বঙ্গবন্ধু তথা আওয়ামি লিগের নির্দেশে। অতঃপর ২৬ মার্চ গ্রেফতারের আগে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ২৬ মার্চ সকাল থেকে দৃশ্যপটে বঙ্গবন্ধু নেই কিন্তু তাঁর নামে এবং তাঁরই ঐন্দ্রজালিক নেতৃত্বে চলে বাংলার মাটি থেকে দখলদার পাকি শত্রুকে বিতাড়নের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। এভাবে মার্চ মাস বাঙালির স্বাধীনতার পথরেখা প্রশস্ত করে দেয়। এজন্য গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের তৃতীয় মাস মার্চ বাঙালির জীবনে হাজির হয় প্রতিরোধ চেতনার তাৎপর্য নিয়ে।
তথ্যসূত্রঃ
১। রঞ্জিত সেন, ভারত ইতিহাসের দুই ব্যক্তিত্ব মহাত্মা গান্ধী ও নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুঃ একটি ঐতিহাসিক সমীক্ষা
(কলকাতাঃ মিত্রম, ২০২২), পৃ.ভূমিকাংশ।
২) আফসান চৌধুরী সম্পাদিত ১৯৭১; অসহযোগ আন্দোলন ও প্রতিরোধ, ঢাকা, কথাপ্রকাশ, ২০২১।
৩) শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ঢাকা; ইউপিএল, ২০১২।