Center For Research In Indo

বাংলাদেশে চীনা তৎপরতা বৃদ্ধি ও তার সুদূরপ্রসারী ফলাফল

সুদীপ কুমার আচার্য্য, রিসার্চ স্কলার, CRIBR

চীন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ব্যবসায়ী ও উৎপাদক দেশ। তারা বাংলাদেশের স্বাভাবিক মিত্র এবং কৌশলগত ক্ষেত্রে অংশীদার রাষ্ট্র। প্রযুক্তিগত ভাবে চীন বিশ্বের বিস্ময়। IMF এর সাম্প্রতিক গবেষণায় চীনের অর্থনীতির অভূতপূর্ব উন্নতিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক বেশী অগ্রগণ্য বলে মনে করা হচ্ছে এবং ২০৩০ সাল নাগাদ তারা আমেরিকাকে পিছনে ফেলে বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে উঠে আসবে। চীন, রাশিয়া ও তার ভূতপূর্ব স্যাটেলাইট দেশগুলো, মধ্য এশিয়ার কিছু দেশ মিলিতভাবে যে সংখ্যায় কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন তৈরি করেছিল তা আজ এক অর্থনৈতিক খুঁটি স্বরূপ। অন্যদিকে আশিয়ান দেশগুলির অর্থনীতি এবং বাজারের উপর চীন কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। অন্যদিকে দক্ষিন চীন সাগরের উপর তার প্রভূত কর্তৃত্ব বিরাজমান। অভ্যন্তরীন ক্ষেত্রে নানান সংস্কার সাধন করে এবং উদার অর্থনীতির পথে হেটে মাও সে তুং এর চীন আজ ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছে। বর্তমানে বিশ্বের নানান দেশকে নিজ অর্থনৈতিক প্রকল্পের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে সুকৌশলী চীন অন্য ধরণের এক অর্থনৈতিক স্বপ্ন দেখছে যার মডেল বিশ্বজোড়া এক একচ্ছত্র মনোপলি অর্থনীতির জন্ম দিচ্ছে। পিছিয়ে পড়া তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির কাছে কোভিডকালীন সময়ে চীন ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। পাশাপাশি চীনের সমৃদ্ধি ও মডেল অর্থনীতি বিশ্বের দেশগুলির কাছে এক শিক্ষনীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হোলো পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে কিছু কিছু চীনের বন্ধুরাষ্ট্র নিজেদের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলছেন এবং অতিমাত্রায় চীন নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছেন যা দেশগুলির স্বাধীন সত্বাকে ক্রমশ বিলীন করে দেবে। চীনের উদ্দেশ্যই হল সম্পর্কের প্রথম পর্যায়ে স্যাটেলাইট বা অনুগামী রাষ্ট্রের ভিত পোক্ত করা। দ্বিতীয় পর্যায়ে নিজস্ব প্রভাব বৃদ্ধি, আঞ্চলিক সহযোগিতার নামে ‘ডমিনো তত্ত্বের’ প্রয়োগ। বিশ্বের যেসব দেশে ক্রমশ প্রগতিশীল চিন্তাধারার মানুষের অভাব ঘটছে, মৌলবাদীদের দাপট বাড়ছে, দারিদ্রের ভয়ংকরতা আছে অথবা যেখানে দুর্বৃত্তায়নের জন্য অর্থের উৎস প্রয়োজন সেখানে আপৎকালীন ভাবে আর্থিক বিনিয়োগকে স্বাগত জানানো হয়। এরকম দেশগুলিই বেজিংএর পছন্দের। কোনো বাধাবিঘ্ন ছাড়াই সহজ শর্তে চীন বাংলাদেশের বৃহৎ প্রকল্প নির্মাণ, যন্ত্রাংশ উৎপাদন, আর্থিক ঋণের যোগান, নানান বিনিয়োগ করে থাকে। যেমন শ্রীলংকার ক্ষেত্রে তারা ৫ বিলিয়ন ডলার অর্থ ঋণ দিয়েছিলো। যা শোধ করতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ভান্ডার ফুরিয়ে আসে কিন্তু প্রকল্প সাফল্য পায় না। ক্রমে অর্থনীতি হয়ে যায় ভঙ্গুর। দেশের ভবিষ্যৎ বলে কিছু থাকে না এবং সমস্ত দায়ভার বর্তায় জনগণের ওপর। একবিংশ শতকের গত দু-দশক জুড়ে বাংলাদেশ চীন সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হয়নি। চীনের সঙ্গে ইসলামীকরণের বছরগুলিতে সেই ১৯৭৬ সাল থেকে মিলিটারি জুন্টার আমলে বাংলাদেশের দৃঢ় সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল; সামরিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে পারস্পরিক বোঝাপড়ার সূচনাও এই সময়ে শুরু হয়। চীনের প্রযুক্তিগত উন্নতি এক্ষেত্রে ইতিবাচক রসদ জুগিয়েছে কিন্তু তার প্রয়োগ প্রক্রিয়া অনেকক্ষেত্রেই নেতিবাচক ও অনৈতিক। যাই হোক উৎপাদন ও প্রযুক্তিগত উন্নতির সহায়ক হিসাবে চীন বাংলাদেশকে সহযোগিতা করে আসছে। এর ফলে তারা সুনাম অর্জন করেছে। সাথে সাথে বাংলাদেশের ব্যক্তিগত উদ্যোগপতি বা বিত্তশালী মুনাফার কারবারীদেরও একটা অংশকে চীন Private Network এ যুক্ত করেছে। কেননা এঁরা তাদের প্রকল্পের উন্নতি ও অগ্রগতির রাস্তাকে সুগম করবে, অভ্যন্তরীন ক্ষেত্রে প্রভাবে সহায়ক হবে। এইভাবে বিগত পঁচিশ বছরে বাংলাদেশী মানসের বিশ্বাস ও ভিত্তি অর্জনে তারা সফল হয়েছে। কিন্তু এসব আসলে কমিউনিষ্ট তাঁবেদার তৈরী কলোনিয়াল শোষণের প্রথম ধাপ মাত্র যা সুক্ষভাবে আর্থিক বিকাশের নামে সম্পদের বর্হিগমনকে নিশ্চিত করেছে। ব্যাপারটি বিমূর্ত এবং খালি চোখে বোঝা যাবে না। অথচ বাংলাদেশের ৯৯ শতাংশ আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করার চীনা হিসাব বলে দিচ্ছে বাংলাদেশের চীন নির্ভরতা আকাশচুম্বী হচ্ছে। আবার রোহিঙ্গা শরণার্থী পুনর্বাসনে চীন ছিল বাংলাদেশ ও মায়ানমারের মধ্যে মিডিওকার তথা সৎ দালাল। রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের পর চীন মায়ানমারে তাদের দেখভাল করবে এ গ্যারান্টি দিয়েছে। Covid 19 এ পর্যুদস্ত বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ নানা খাতে বেড়ে গেছে। বর্তমানে চীন বাংলাদেশে রপ্তানি করে ১৭-১৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য সামগ্রী। কিন্তু আমদানির পরিমাণ ৭৫ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য। আন্তর্জাতিক সূত্রের হিসাব থেকে জানা যায় চীন বাংলাদেশকে প্রতি বছর ১০০ কোটি ডলারের মত সাহায্য দিয়ে আসছে। ২০১৬ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর রাষ্ট্রীয় সফরকালে ২০ বিলিয়ন ডলারের ২৫টি চুক্তি ও সমঝোতা হয়। ট্রেড, ইনভেস্টমেন্ট, কানেক্টিভিটি, তথ্য বিনিময়, সক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ সহ নানা বিষয় এখানে গুরুত্ব পায়। জিনপিং বাংলাদেশকে ২৪ বিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য করবেন ঘোষণা করেন।

    

বাংলাদেশে চীনের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার চুক্তি হয়ে গিয়েছিল ২০১৪ সালেই শেখ হাসিনার বেজিং সফরকালে। এই সময় বাংলাদেশ চীন থেকে ৬০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল কিন্তু চীনে রপ্তানীর পরিমাণ ছিল ৫০ কোটি ডলারেরও কম। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণে পটুয়াখালী জেলায় চীনা সহায়তায় পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। পায়রা (লেবুখালী) সেতু গড়ে তুলেছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘লনজিয়ান রোড এন্ড ব্রীজ কনস্ট্রাকশন’। অতি সম্প্রতি চীন পদ্মা সেতুর কাজ সমাপ্ত করেছে। পায়রা বন্দরে চীনের প্রভাব রয়েছে অপ্রতিহত এবং চীনা কোম্পানি সি এস আই সি এখানে কন্টেনার ইয়ার্ড তৈরীর বরাত পেয়েছে। টার্মিনাল নির্মাণের এই প্রকল্পের আওতায় তিন লাখ ২৫ হাজার বর্গফুট টার্মিনাল, হাই মাস্ট পুল, জলের ট্যাঙ্ক, পাম্প হাউস, সি এফ এস শেড, ওয়ার্কশপ, ফায়ার স্টেশন, প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ সবকিছুই চীনা প্রযুক্তিবিদরা করে দেবেন। এছাড়া চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং ও নানান কাজ করে চলেছে। বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত বরিশাল বিভাগের এই সমুদ্র বন্দরের ভাগ্য শ্রীলংকার হাম্বানটোটা বা পাকিস্তানের গদর বন্দরের মত হয় কিনা তাও পর্যবেক্ষণ যোগ্য। এছাড়া চট্টগ্রাম কক্সবাজারে প্রভাব বিস্তার, রেল ও নানান মেগা প্রজেক্টে চীনের উৎসাহ আছে। মিলিটারী হার্ডওয়ার তথা সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহে বাংলাদেশে চীন একনম্বর জায়গায় বিরাজমান। ভূ রাজনৈতিক কৌশলের দিক দিয়ে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ চীন থেকে দুটি উচ্চ প্রযুক্তির সাবমেরিন আমদানী করেছে। কিন্তু বিভিন্ন সমুদ্রবন্দরগুলিতে চীনের অভিভাবক সুলভ ভাবভঙ্গিমা বৃদ্ধি পেলে দক্ষিন-দক্ষিনপূর্ব এশিয়া বা ভারতমহাসাগরীয় শক্তিসাম্য বিপন্ন হতে পারে। অস্ত্রশস্ত্রের যোগানের ক্ষেত্রে বলা যায় যদি চিনা অস্ত্রশস্ত্র চোরাচালান হয় এবং বাংলাদেশী সন্ত্রাসবাদী বা মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলির হাতে চলে যায় তা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করাবে। চট্টগ্রাম দোহাজারি ভায়া মায়ানমার সীমান্তে ঘুনধুম রেলপথের কাজ (১২৮কিমি) ২০১১ সালেই চালু হয়েছিল। এর ফলে Trans Asian Railway Network এর সংগে বাংলাদেশের যোগাযোগ নিশ্চিত যা চীনের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগের মাধ্যম। অন্যদিকে কক্সবাজার ঘুনধুম মহাসড়ক সম্প্রসারণ করে মায়ানমার হয়ে চীনের দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলীয় ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিং সিটির সংগে আন্তর্দেশীয় মহাসড়ক পথে জুড়ে যাচ্ছে ঢাকা। এক্ষেত্রেও চীনের দুটি প্রতিষ্ঠান রেলপথ বাস্তবায়নে কাজ করেছে। বিনিয়োগ, শিল্পায়ন, রপ্তানি ও বাণিজ্যিক বন্ধন সহজ করাই চীনের প্রধান টার্গেট।   কিন্তু সাম্প্রতিককালে Quadrilateral, Security Dialogue এ বাংলাদেশের যোগদানকে বেজিং কঠোর দৃষ্টিতে দেখেছে। গত বছরের মে মাসে (২০২১) বাংলাদেশে চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেন Quad ঘনিষ্ঠ হয়ে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করছে ঢাকা। আসলে এটা ছিল বাংলাদেশের নীতি নিয়ন্ত্রণ বা তার ওপর চাপ তৈরীর কৌশলমাত্র। এছাড়া বাংলাদেশের ভোট প্রক্রিয়ায় বা সরকার নির্বাচনে পরোক্ষভাবে প্রভাব খাটানোর চেষ্টাও চীন করে থাকে। তবে বেল্ট ও রোড প্রকল্পে বাংলাদেশকে সংযুক্ত করা চীনের মুকুটে এক রঙীন পালকের সংযোজন করেছে। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে চীন ঢাকায় কনফুসিয়াস ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছে। তবে চীনা রপ্তানী, বিনিয়োগ ও লোনদান ইতিমধ্যেই শ্রীলঙ্কা বা জেবুতিতে যে ধরণের সংকট তৈরী করেছে তা বাংলাদেশের বিলম্বে বোধোদয় আনবে  কি না তা হয়তো ভবিষ্যৎ দশকগুলোতে বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহই আমাদের বলে দেবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *