পূর্ণিমা নস্কর
1947 সালে ভারত বিভাগের পূর্বে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতীয় চেতনা গঠনে ধর্মীয় অনুভূতি, অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। ফলে ভারত ভেঙ্গে অদ্ভুত এক রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, যার দুটি অংশের মধ্যে ব্যবধান ছিল প্রায় 1200 মাইলের। শুধুমাত্র ভৌগোলিক দূরত্বই নয়, পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে ধর্মীয় ঐক্য ব্যতিরেকে অন্যান্য অনেক বিষয়ে যথেষ্টই অমিল ছিল। তাই পাকিস্তানের ভাঙ্গন ছিল অনিবার্য। 1971 সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। 1971 এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার অমোঘ পরিণতি।
1971 সালে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হলেও বস্তুত বাঙালি মুসলমান আজ সংকটের সম্মুখীন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেসব মৌলিক প্রশ্নের সমাধান হয়ে গিয়েছিল বলে অনেকে ধরে নিয়েছিলেন, সেগুলি আবার নতুনভাবে জাতিকে চরম বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দিয়েছে। যেমন বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নিয়ে আজ নতুন করে বির্তক দেখা দিয়েছে।
আধুনিক জাতীয়তাবাদ হল প্রধানত একটি জাতিভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা। সুনির্দিষ্ট ভূখন্ডে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে আত্মপরিচয় সম্বন্ধে সন্মিলিত চেতনা ও ধারণা হল আধুনিক জাতীয়তাবাদের উৎস। জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হল দেশপ্রেম। দেশের প্রতি ভালবাসার সঙ্গে এসে যায় ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে দেশের সকল মানুষের মধ্যে একাত্মবোধ। সুতরাং আধুনিক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হল ধর্মনিরপেক্ষতা। আর এই ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মের সাথে রাষ্ট্রের পৃথকীকরণ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলা হলেও বাস্তবে ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতি উদার জাতীয়তাবাদকে ধংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
1975 সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর বাংলাদেশে পাকিস্তানি মনোভাবাপন্ন গোষ্ঠীর প্রভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার অপব্যাখ্যা করে একে রাষ্ট্রীয় নীতি থেকে বিসর্জন দেওয়া হয়েছে । পাকিস্তানি কায়দায় ধর্মকে রাজনীতির ক্ষেত্রে টেনে এনে ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ধর্ম (অষ্টম সংশোধনী, 1988 সাল) হিসাবে ঘোষণা করে বাঙালি ‘জাতিসত্তাকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের উপর নির্মম আঘাত ছাড়া কিছুই নয় ।
একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের আবির্ভাব হলেও এই বাংলাদেশ এক প্রাচীন সভ্যতার আবাসভূমি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে একাধিক জনগোষ্ঠী বঙ্গদেশে এসে বসবাস করছে । এসকল জনগোষ্ঠী সঙ্গে এনেছে তাদের নিজস্ব বিচিত্র সাংস্কৃতিক উপাদান। আর এসকল বহিরাগত উপাদানের সঙ্গে বাংলার দেশজ উপাদানের মিশ্রণ ও সমন্বয় সাধিত হয়েছে। বস্তুত, বাংলাদেশের মানুষ এক সুপ্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। বাংলাদেশের মানুষের জীবনধারা ও সংস্কৃতির মধ্যে এমন কতকগুলি দিক আছে যেগুলি বাংলাদেশে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে স্বতন্ত্র জাতিরূপে চিহ্নিত করেছে। জাতিসত্তার স্বতন্ত্রতা থাকা সত্বেও জাতীয়তাবাদের ভিত্তিভূমির মধ্যে ঐক্য বিরাজমান ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে এই দেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাতীয়তাবাদ নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিল। বাংলার মুসলমানরা তাদের আত্মপরিচয় এবং সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতাকে দুটি পরস্পর ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে নিরীক্ষণ করে এসেছেন । তারা “বাঙালি’’ না “মুসলমান” — এই প্রশ্ন তাদের মানসচেতনাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে কেউ কেউ নিজেদের ‘বাঙালিত্ব’কে অর্থাৎ দেশজ সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে ইসলামের ব্যাপক আবর্তের মধ্যে নিজেদের সম্পূর্ণভাবে বিলীন করতে চেয়েছেন, আবার অনদিকে কেউ কেউ ইসলাম ধর্মের প্রভাবকে উপেক্ষা করে সম্পূর্ণ দেশজ সংস্কৃতির মধ্যে নিজেদের সত্তাকে আবিষ্কার করার প্রয়াস পেয়েছেন ।
বাঙালি না মুসলমান — এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী মনোভাব সম্পন্ন জনগোষ্ঠী শেষমেশ ‘মুসলমান’ শব্দটিকেই বেশিকরে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেছে । ফলে জাতীয়তাবাদের মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে বাংলাদেশি (মুসলিম) জাতীয়তাবাদ বৃদ্ধি পেতে থাকে ।
তার পরিণতিতেই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকেই সেদেশের সংবিধান স্বীকৃত দিল । সংবিধানের 12 নং অনুচ্ছেদ সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে দেয়া হল; যেখানে বলা হয়েছিল – “(12) ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য – ক) সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতা, খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, ঘ) কোন বিশেষ ধর্মপালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।”
আজকে বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং সরকার বিরোধী আন্দোলনের ভিত্তি তা মূলত অনেকেই বাংলাদেশি জাতীয়তার নিরিখে দেখাতে চায়। বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের দাবীদার এবং তারা বিরোধী শক্তিকে শত্রু হিসেবেই জ্ঞান করে থাকে। ফলে আদর্শভিত্তিক রাজনীতির যেসব মেঠো বক্তৃতা বাংলাদেশি জনগণ শুনতে অভ্যস্ত — তাতে এ বিষয়টি সামনে উঠে আসছে যে, এ লড়াই মূলত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তির মধ্যে অর্থাৎ বাঙালি ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের লড়াই। কিন্তু বাস্তবে কি তাই ?