বিমল প্রামানিক
বিশিষ্ট বাঙালি চিন্তক জনাব আহমদ ছফা তার বাঙালি মুসলমানের মন ১ পুস্তকে বঙ্গসমাজ এবং মুসলমান বিষয়ে যে আলোচনার অবতারণা করেছেন সে বিষয়ে একটু আলোকপাত করা যেতে পারে। ‘বাঙালি মুসলমান বলতে যাদের বোঝায়, তারা মাত্র দুটি আন্দোলনে সাড়া দিয়েছিলেন এবং অংশ গ্রহণ করেছিলেন। তার একটি তিতুমীরের অনুসারীদের দ্বারা পরিচালিত ওয়াহাবি আন্দোলন। অন্যটি হাজি দুদুমিঁয়ার ফারায়েজি আন্দোলন। এই দুটি আন্দোলনেই মনে প্রাণে অংশ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু উচু শ্রেনীর মুসলমানেরা এই আন্দোলনের সমর্থন করেছেন তার কোন প্রমান পাওয়া যায় না। আসলে কৃষক জনগণই ছিলেন এই আন্দোলন দুটির হোতা। আধুনিক কোন রাষ্ট্র কিম্বা সমাজদর্শন এই আন্দোলন দুটিকে চালনা করেনি। ধর্মই ছিল একমাত্র চালিকাশক্তি। … এই আন্দোলন দুটি ছাড়া অন্য প্রায় সমস্ত আন্দোলন হয়ত উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, নয়তো হিন্দুসমাজের উদ্যোগে এবং কর্মপ্রয়াসের সম্প্রসারণ হিসেবে মুসলমান সমাজে ব্যাপ্তিলাভ করেছে। সমাজের মৌল ধারাটিকে কোন কিছুই প্রভাবিত করেনি। তার ফলে প্রাগৈতিহাসিক যুগের আদিম কৃষিভিত্তিক কৌমসমাজের মনটিতে একটু রঙ-টঙ লাগলেও কোন রূপান্তর বা পরিবর্তন হয়নি। … বিংশ শতাব্দীতেও এই মনের বিশেষ হেরফের ঘটেনি। বাঙালি মুসলমানের রচিত কাব্য সাহিত্য –দর্শন- বিজ্ঞান পর্যালোচনা করলেই এ সত্যটি ধরা পড়বে। কোন বিষয়েই তারা উল্লেখ্য কোন মৌলিক অবদান রাখতে পারেননি। সত্য বটে, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমুদ্দিন প্রমুখ কবি কাব্যের ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন । একটু তলিয়ে দেখলেই ধরা পড়বে, উভয়েরই রচনায় চিন্তার চাইতে আবেগের অংশ অধিক। তাছাড়া এই দুই কবির প্রথম পৃষ্ঠপোষক গুণগ্রাহী ছিল হিন্দু সমাজ, মুসলমান সমাজ নয় ।
মুসলমান সাহিত্যিকদের রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল হয়ত চর্বিত চর্বন নয়তো ধর্মীয় পুর্নজাগরণ । এর বাইরে চিন্তা, যুক্তি ও মনীষার সাহায্যে সামাজিক dogma বা বদ্ধমতসমূহের অসারতা প্রমাণ করেছেন, তেমন লেখক কবি মুসলমান সমাজে আসেননি। বাঙালি মুসলমান সমাজ স্বাধীন চিন্তাকেই সবচেয়ে ভয় করে। তার মনের আদিম সংস্কারগুলো কাটেনি। … অনেক কিছুরই সে সংবাদ জানে, কিন্তু কোন কিছুকে চিন্তা দিয়ে, যুক্তি দিয়ে, মনীষা দিয়ে আপনার করতে জানে না।‘২
স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র নিয়েও জনাব ছফার চিন্তা আলোচনার দাবি রাখে। ‘ইতিহাসে বিশ-ত্রিশ বছর কোন দীর্ঘ সময় নয়। বাঙালি মুসলমান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্র যন্ত্রটি প্রতিষ্ঠা করেছে সে রাষ্ট্রের সংকটের অন্ত নাই, কোথায়ও কোন দিক-নির্দেশনার চিহ্ন পরিদৃশ্যমান নয়। সামাজিক সভ্য এবং ধর্মীয় কুসংস্কার সাম্প্রতিককালে এমন প্রচণ্ড আকার নিয়ে দেখা দিয়েছে, অনেক সময় মনে হয় এই জাতি মেরুদণ্ডের উপর থিতু হয়ে কোনদিন দাঁড়াতে পারবে না। মধ্যযুগীয় ভূত এই জাতিকে এমনভাবে আষ্টে-পৃষ্টে বেঁধে রেখেছে তার নাগপাশ কখন কিভাবে ছাড়াতে পারবে এমন কথা একরকম চিন্তা করাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমান অস্থিরতা এবং মধ্যযুগীয় ধর্মীয় বদ্ধমতের পুনরুত্থানের একটি কারণ আমি নির্দেশ করতে চাই। শুরু থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নেতৃ্ত্বে যে দলটি গিয়েছিল তার আদর্শিক বৃত্তটি বিশ্লেষণ করলেই সেটি ধরা পড়বে। আওয়ামি লীগ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে। অন্যান্য দলও স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু আওয়ামি লীগের ভূমিকাটি যে প্রধান তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই আওয়ামি লীগের কি পরিচয়? আওয়ামি লীগের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা ভাষানী ছিলেন আসাম মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিখিল বঙ্গ মুসলিম লিগের প্রেসিডেন্ট এবং শেখ মুজিবুর রহমান নিখিলবঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। সুতরাং একথা বলা একটুও অযৌক্তিক হবে না যে, মূলত আওয়ামি লীগ মুসলিম লীগের একটা অংশ । পাকিস্তানের সঙ্গে বাস করে তাদের ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারছিল না বলে আওয়ামি লীগকে শেষ পর্যন্ত বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সূচনা করতে হয়েছিল। …” ৩
আওয়ামি লীগ যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু করেছিল তার স্বপক্ষে কিছু দূর্বল যুক্তি অবশ্যই উপস্থাপিত করা যেতে পারে, কিন্তু এই আন্দোলনের মধ্যে যে বাঙালির স্বাধীনতার একটা আকাঙক্ষা ফুটে উঠেছিল – একজন মুক্তিযোদ্ধা* হিসেবে কিছুতেই আমি এটা অস্বীকার করতে পারব না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর থেকে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পর্যন্ত বাঙালি যুব সমাজের অধিকাংশ যেভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল – তার প্রমান পাওয়া গেল যখন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা মাত্রা ছয় মাসের মধ্যে লক্ষাধিক ছাড়িয়ে গেল। শত প্রতিকূলতা সত্বেও পূর্বপাকিস্তানের একটা বড় সংখ্যক গ্রামীন সাধারণ মুসলমান মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতা ও খাদ্য যুগিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এগিয়ে এসেছিলেন – তা কখনও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বলে অভিহিত করা চলে না । স্বাধীনতার আকাঙক্ষা ব্যতিরেকে শত শত মুক্তিযোদ্ধা নিঃশেষে প্রাণদান করতে পারত না। অনেক মুক্তিযোদ্ধার পরিবার পরিজন পাকিস্তানি দালাল, রাজাকার ও সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হলেও তারা শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গেছে এবং বিজয়ী হয়েছে। এটাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস না বললে ইতিহাসের অপলাপ হয় । জনাব আহমদ ছফার মতে, শেখ মুজিব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন সে বিষয়ে একটু আলোচনা করা উচিত বলে মনে হয়। যেদিন বাংলাদেশ প্রবাসী সরকার মুজিবনগরে শপথ গ্রহণ করলো ১৭ এপ্রিল ১৯৭১, সে দিনটি মাত্র ২৫ মার্চ থেকে ২২ দিন পর। যে সমস্ত বুদ্ধিজীবীগণ, আমলাবৃন্দ বা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ঐ সময়ের মধ্যে ভারতে পৌঁছুতে পেরেছিলেন বা তার কিছুদিনের মধ্যে প্রবাসী সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের প্র্তি সমর্থন দান বা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন তার সংখ্যা নগণ্য বললে ভূল বলা হয় না। তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের বাঙালি রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী সমাজের অধিকাংশই একথা বিশ্বাস করতেন যে ইসলামি পাকিস্তান ভেঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের নামে যে আন্দোলন – সেটা বিচ্ছিন্নতাবাদ ছাড়া আর কিছু নয়। জনাব আহমদ ছফা সাহেবও তাই করবেন এটা অস্বাভাবিক ছিল না। তদুপরি পূর্বপাকিস্তানের মুসলমানগণ পাকিস্তানের মতোই ভারতকে শত্রু হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত ছিল। সেই ভারতের সাহায্যে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হতে পারে তা কি বাঙালি মুসলমান মনেপ্রাণে কখনোও বিশ্বাসযোগ্য বলে ভাবতে পারত? যখন তাদের চোখের সামনে লক্ষ লক্ষ বাঙালি হিন্দুর বাড়িঘর লুট হতে থাকল, বেদখল হল, ভস্মীভূত হল, মা-বোন ধর্ষিত হয়ে গেল – শুধুমাত্র প্রাণ রক্ষার তাগিদে প্রায় নব্বই লক্ষ হিন্দু বাঙালি ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হল, লক্ষ লক্ষ নিহত হয়ে গেল – তখন মুসলমান বুদ্ধিজীবীরা কি তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন না তাদের রক্ষা করার জন্য পাকিস্তানের কাছে কোন দাবি জানিয়েছিলেন? ১৪ ডিসেম্বর বাঙালি বুদ্ধিজীবী গণহত্যা দিবস পালিত হয়। যখন পাকিস্তান বাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গেছে। ৩ ডিসেম্বর ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু হয়েছে । ভারত ও প্রবাসী সরকারের যৌথ বাহিনী ঢাকা দখলের জন্য এগিয়ে যাচ্ছে, তখন বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা কাদের ভরসায়, কাদের নিরাপত্তার আশ্বাসে নিশ্চিত হয়ে ঢাকায় বসবাস করছিলেন? এতে স্বাভাবিকভাবেই মনে হয়, শেষ পর্যন্তও তারা পাকিস্তানের প্রতি বিশ্বাস হারাননি।
তিনি আরও লিখেছেন, “এই আওয়ামি লীগের আন্দোলন যতটা বেগ এবং আবেগ সঞ্চয় করেছে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের নেতৃত্ব কবুল করে নিয়েছিল। কিন্তু সমাজের ভিতর তারা কোন নতুন মূল্যচিন্তার জন্ম দিতে পারেনি; নতুন সংস্কৃতি নির্মান করতে পারেনি। তারা সেক্যুলারিজমের নীতিকে শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের অভ্যুত্থানের পর শেখ মুজিব সপরিবারে যখন নিহত হলেন তখন আর অনেকদিন পর্যন্ত আওয়ামি লীগ শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। মূলত আওয়ামি লীগই একমাত্র দল যারা আমাদের জনগণের ঐতিহাসিক সংগ্রামের উত্তাপ থেকে জন্ম নিয়েছে এবং তাই তার একটি ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে। মুস্কিলের কথা হল আওয়ামি লীগ যখন জেতে তখন মুষ্টিমেয় নেতা বা নেত্রীর বিজয় সূচিত হয়। কিন্তু আওয়ামি লীগ যখন পরাজিত হয় গোটা বাংলাদেশটাই পরাজিত হয়। … মুসলিম সমাজ এবং সংস্কৃতির ভিতরে একটা সেক্যুলারিজমের ভিত প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে আমাদের জনগণের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। শেষকথা আমি এই বলতে চাই যে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ধর্মীয় সংস্কারে পীড়িত মুসলিম সমাজের দিকে অত্যন্ত সাহস নিয়ে সহানুভূতির সঙ্গে তাকাতে হবে।৪”
আওয়ামি লীগ হেরে গেলে যে বাংলাদেশ পরাজিত হয় এটাই স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দূর্বলতা। অর্থাৎ আওয়ামি লীগকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ ভাবা যাচ্ছে না কেন ? আওয়ামি লীগ ব্যতিরেকে অন্য সকল রাজনৈতিক দলসমূহ কী বাংলাদেশের অস্তিত্বের পক্ষে বিপজ্জনক ? ঐ সমস্ত দলসমূহ কি ধর্মীয় সংস্কারে পীড়িত বাংলাদেশী জনগণকে ভবিষ্যতে পাকিস্তান বা আফগানিস্তান মার্কা রাষ্ট্র নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে পারে? বিগত পঞ্চাশ বছরেও স্বাধীন বাংলাদেশের আদর্শে দোদুল্যমানতার অবসান যখন ঘটানো সম্ভব হয়নি – তখন এসব প্রশ্ন অমূলক নয়।
তথ্যসূত্রঃ
১) আহমদ ছফা, বাঙালি মুসলমানের মন, খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০।
২) ঐ পৃষ্ঠাঃ ৩৬, ৩৭।
৩) ঐ পৃষ্ঠাঃ ১৭ ।
৪) ঐ পৃষ্ঠাঃ ১৭, ১৮।
(* লেখক তৎকালীন পাংশা থানার মুজিব বাহিনীর একজন কমাণ্ডার হিসেবে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করলেও বাংলাদেশ সরকার তার মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বন্ধ করে দিয়েছে শুধুমাত্র ভারতে বসবাস করার কারণে।)