Center For Research In Indo

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সামনে একটি বড় সঙ্কট

পূর্ণিমা নস্কর

বাংলাদেশের  স্বাধীনতার পূর্বেই পূর্বপাকিস্তানের  রাজনীতিতে শেখ মুজিবুর  রহমান  একজন অবিসংবাদী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তিনি জনগণের আস্থা অর্জন করেন এবং দেশের মানুষের মনে বিশেষ করে পাকিস্তানের পূ্র্বাঞ্চল তথা পূর্ব বাংলার জনগণের মনে প্রভূত আশার সঞ্চার করেছিল। ১৯৭০ সালের ৭ই জুন শেখ   মুজিবুর রহমান যখন বললেন, আসন্ন নির্বাচন হবে ছয়  দফার প্রশ্নে গণভোট; তখন জনগণের মধ্যে তৈরী হওয়া উত্তেজনা ও আশঙ্কা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে পুর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের  মোট ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে আওয়ামি লীগ জয়লাভ করেছিল। ফলে  পাকিস্তানের সরকার গঠনের  প্রশ্নে আওয়ামি লীগই প্রধান দাবিদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হল। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনে শেখ মুজিব যে পাকিস্তানের  প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন — এই ধারণা এবং বিশ্বাস এমনভাবে আন্দোলিত হতে থাকল যে, পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার একটা বাস্তব ভিত  পাকিস্তান রাষ্ট্রে  তৈরি হতে যাচ্ছে। আসলে এটাই ছিল আওয়ামি লীগের রাজনৈতিক সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ।  ছয়দফা দাবীর মধ্যে পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙ্গে আলাদা কোন রাষ্ট্র গঠনের কথা ছিল না। শুধু প্রদেশগুলির অধিকারের কথাই সেখানে প্রধান বিষয়রূপে উপস্থাপন করা হয়েছিল। এইরূপ পরিস্থিতিতে এমতাবস্থায় পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা হবে বলে মানুষের মনে  যে  উচ্চাশা তৈরি হয়েছিল; বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মনে —  তা যে অদূর ভবিষ্যতে বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে – এ বিষয়টি ছিল তখন আলোচনার  বিষয়বস্তু। তদুপরি, পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামি লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের ফল-স্বরূপ আওয়ামি লীগের সমর্থকসহ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণের মধ্যে  যে আবেগ ও উৎসাহ দেখা গেল; তা তাদের  আকাঙ্ক্ষারই একটা প্রতিফলন ।

 

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ শেখ মুজিবের ভাষণকে বাংলাদেশের মানুষ ধরেই নিয়েছিল যে এটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণারই নামান্তর।  দেখা যাচ্ছে, ১৯৭০ এর ৭ই ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের মধ্যবর্তী সময়, মাত্র তিন মাস। এত স্বল্প সময়ের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানি  ও পূর্ব পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া রাজনৈতিক জটিলতা, টানাপোড়েন ও  বিশ্বাস  অবিশ্বাসের  বাতাবরণ মোটেই অভিপ্রেত ছিল না। জনগণ এটা একেবারেই আশা করেনি। তারা ছিল আশা-নিরাশার  দোলাচলে ।  মানসিক দিক থেকে বা নীতি আদর্শের প্রেক্ষাপটে মাত্র তিন মাস এতই স্বল্প সময় যে, সাধারণ মানুষের পক্ষে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা  মোটেই সহজ ব্যাপার ছিল না।

সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানদের দাবী মেনে ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং পাকিস্তানি রাষ্ট্রের তেইশ বছর ইসলামি রাষ্ট্ররূপে পাকিস্তানকে প্রতিষ্ঠা করার যে সার্বিক চেষ্টা অব্যাহত ছিল তারও একটা বড় প্রভাব বাঙালি মুসলমানের  পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাছাড়া সংস্কৃতিগতভাবে বাঙালি মুসলমান পাকিস্তানি রাষ্ট্রে নিজেদের গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল বাঙালি হিন্দুর থেকে একটা পৃথক  জনগোষ্ঠী  (জাতিসত্ত্বা) হিসেবে। অর্থাৎ, দ্বি-জাতিতত্ত্বের বক্তব্য মেনেই। তার কারণ পাকিস্তান গঠণের সময় এই দ্বি-জাতিতত্ত্বই মুসলমান জনগণকে প্রভূতভাবে প্রভাবিত করেছিল। এখন ৭ই মার্চের ভাষণের পর পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমান জনসাধারণের মন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে স্থির করা আওয়ামি লীগ নেতৃবৃন্দ  যত সহজ কাজ ভেবেছিল কিন্তু  ব্যাপারটা তত সহজ ছিল না। দীর্ঘকালের চর্চিত ইসলামী সংস্স্কৃতি এবং পাকিস্তানি আবহাওয়া থেকে বেরিয়ে আসতে তাদের মনে উদ্রেক হওয়া প্রশ্নসমূহের  দিকে ফিরে দেখা যাক।

 

পাকিস্তানের একটি শক্তিশালী  সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে আওয়ামি লীগের পক্ষে সামরিক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া এবং তার পরিণতি নিয়ে অধিকাংশ মুসলমান জনগণই যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিল। তাদের মনে প্রথম প্রশ্নই ছিল – তাদের সামনে পাকিস্তানি সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে আওয়ামি লীগের লড়াই করার কোন পরিকল্পনা স্পষ্ট ছিল না। দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতা ঘোষণার পরিণতি কি হবে তাও  তারা  অনুমান করতে পারছিল না। কারণ শেখ মুজিবের হাতে কোন সামরিক  বাহিনী বা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর  সাথে লড়াই করার কোন শক্তি যে  নেই তা তারা জানত। তৃ্তীয়ত, মুক্তিযুদ্ধ পরিকল্পনার বিষয়ে আওয়ামি লীগের সঙ্গে  ভারতবর্ষের কোন বোঝাপড়া হয়েছে কিনা ? চতু্র্থত, পাকিস্তানের তেইশ বছর পাকিস্তান সরকারগুলি বা সামরিক শাসককুল বা পাকিস্তানের জনগণ ভারতকে শত্রু দেশ হিসেবে গণ্য করে এসেছে। এটা জনগণের কাছে কোন গোপন বিষয় ছিল না। ১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর থেকে ভারতকে সরকারিভাবে শত্রু দেশরূপে গণ্য করা হত। এখন ভারত কি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দেবে বা সম্পূর্ণ ভারতের উপর নির্ভরশীল  হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ চালান কি সম্ভব?  কারণ আমেরিকা, ইউরোপ ও ইসলামিক দেশগুলির  সমর্থন পাকিস্তানের পক্ষেই ছিল। এ প্রশ্ন মুসলমান জনগণকে দারুণভাবে ভাবিয়ে তুলেছিল। পঞ্চমত, বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষিতে যদি পাকিস্তান গণহত্যা বা crackdown করে তাহলে তা রোধ করা কি আওয়ামি লীগের পক্ষে  সম্ভব হবে ? ষষ্ঠত, যদি দীর্ঘমেয়াদী  সংগ্রামের প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর  বিরুদ্ধে কোন গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি আওয়ামি লীগের আছে কিনা সে বিষয়েও সাধারণ জনগণ সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিল।

 

এই সমস্ত নানা প্রশ্ন বিশেষ করে বাংলাদেশের  মুসলমান জনসাধারণের সামনে মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ  সম্পর্কে যে অনিশ্চয়তা তৈরি করে ফেলেছিল ; তা থেকে তারা সহজে বের হতে পারেনি। এটা ছিল তাদের কাছে বড় একটা  সঙ্কটপূর্ণ সময়। শেখ মুজিবের ডাকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে কি পড়বে না – এনিয়ে তারা ছিল   দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোলাচলে । তাদের পাকিস্তানি ও ইসলামি  জাতিসত্ত্বা এতটাই প্রবল ছিল, বাঙালি  জাতিসত্ত্বার যে প্রশ্ন শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সামনে  উত্থাপন করেছিলেন; তা মুসলমানদের ইসলামি       জাতিসত্ত্বাকে অতিক্রম করে তাদের মনে তেমন দাগ কাটতে পারেনি।  ফলে আমরা দেখতে পেলাম, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস, পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক সরকার অনেকটাই বাধাহীনভাবে প্রশাসন পরিচালনা ও জনগণের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখতে পেরেছিল। আসলে মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাংলাদেশের বাঙালি জনগণের সামনে একটি বড় সঙ্কট। আর  এই সঙ্কট থেকে এদেশের জনগণ অদ্যাবধি বাঙালি না  বাংলাদেশী পরিচয়ের  আবর্তে  ঘূর্ণায়মান রয়েছেন।

 

এ থেকে অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন, পাকিস্তানি আন্দোলনের  দ্বিজাতিতত্ত্বের ভূত কি বাঙালি মুসলমানদের এখনও  তাড়া করে চলেছে? নাকি তারা বাঙালি হিন্দুর থেকে আলাদা আইডেন্টিটি (identity) বজায় রাখার মানসে নিজেদের বাঙালি মুসলমান বলতে  স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে? অথবা বাংলাদেশকে বাঙালি মুসলমানের দেশ হিসেবেই প্রতিষ্ঠা করার  প্রবল ইচ্ছা  এই মানসিকতার পিছনে কাজ করে ?

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *