বিমল প্রামাণিক
ডাইরেক্টর, সেন্টার ফর রিসার্চ ইন ইন্দো-বাংলাদেশ রিলেশনস্, কলকাতা
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও সামরিক সরকার ঢাকাসহ পূর্ব-পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে বাঙালি জনগণের উপর গণহত্যা শুরু করে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত প্রথম সাধারণ নির্বাচনে বিপুল জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবর রহমানকে বঞ্চিত করা। বাঙালিদের উপর পাকিস্তানি শাসন এবং শোষণ অব্যাহত রাখা। এটা বুঝতে পেরেই ২৬শে মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের অত্যাচার ও গণহত্যার কারণে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে, গ্রাম ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে সীমানা পেরিয়ে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিতে শুরু করে। মাত্র আড়াই মাসের মধ্যে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহেই ভারতে শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০ লক্ষ। ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়া মহাদেশের অনেক দেশই এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। জুন মাসের ১ তারিখে বৃটিশ লেবার দলের এম পি মাইকেল বারনেস মুক্তিযুদ্ধের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ও পাকিস্তানি অত্যাচারের শিকার হয়ে যারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের দুর্দশা সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন ‘the world must help to find a solution to the tragedy.’ মিঃ বারনেস এবং মিঃ ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ, চেয়ারম্যান, ‘war on want’ বৃটেনের একটি দাতব্য সংস্থা, ভারতীয় সীমান্তে অবস্থিত অনেকগুলি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে বলেন, ‘the world community must come forward immediately with all possible aid.’
মিঃ চেসওয়ার্থ বৃটিশ ওভারসিজ মন্ত্রীকে ব্যক্তিগতভাবে সরেজমিনে এই জটিল সমস্যা অনুধাবনের জন্য অনুরোধ করে বলেন যে, এর বিস্তার ও গভীরতা নিরূপণ করা কঠিন; লন্ডন, ওয়াশিংটন এবং মস্কোর এ বিষয়ে নজর দেওয়া উচিৎ। তিনি আরও বলেন, ‘what is taking place here is a potential threat to world peace.’ ১
জাপানি এম পি কে. নিশিমুরা ভারতীয় সীমান্ত অঞ্চলে বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে ভয়াবহ চিত্র ও দুরবস্থার কথা উল্লেখ করে বলেন, “সীমান্ত অঞ্চলে শরণার্থী শিবিরগুলি পরিদর্শনকালে আমি দেখলাম হাজার হাজার পুরুষ, নারী ও শিশু সাংঘাতিক প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে শুধুমাত্র নিরাপত্তার জন্য ভারতে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যখন এমন অবস্থা বিরাজমান – বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রকৃত অবস্থা দেখা উচিৎ।”
মিঃ এনজিয়ার বি ডিউক, প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত এবং ইন্টারন্যাশানাল রেসকিউ কমিটি দলের প্রধান ভারত-পাক উপমহাদেশ সফর থেকে ফিরে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও ঘটনার সত্যাসত্য বিশ্লেষণপূর্বক নিক্সন প্রশাসনকে রিপোর্ট দিয়ে বলেন, “Pakistan Army has tried to maintain a desperate air of tension along the border by mortar fire.” তিনি আরও বলেন, জুলাই মাসের শেষে ভারতে আশ্রয়প্রার্থী পাকিস্তানি শরণার্থীর সংখ্যা ‘will have reached the seven million mark.’২
ইউ এস সিনেটর মিঃ এডওয়ার্ড কেনেডি ভারতের পূর্ব সীমান্তে সাড়ে চারদিন অত্যন্ত কষ্টসহকারে বৃষ্টির মধ্যে পায়ে হেঁটে অনেকগুলি বাংলাদেশি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। শরণার্থীদের কষ্ট-দুর্দশা দেখে তিনি বলতে বাধ্য হন, ‘It is the greatest human tragedy of our time.’ তিনি নারী, শিশু, বয়স্কদের দু্র্দশা ও পাকিস্তানি সেনার গুলিতে আহতদের করুণ অবস্থা দেখে খুবই বিচলিত বোধ করেন। তিনি বলেন, “the American people have read reports about the refugees with heartfelt feeling, but they can not fully assess the magnitude of the problem unless one seeks personally the plight of the refugees.”৩
সারা বিশ্বের সংবাদজগৎ বাংলাদেশের গণহত্যা ও নির্যাতনের খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রচার শুরু করে। ভারতের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী রাজ্যে পূর্ব-পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ থেকে ভীতসন্ত্রস্ত ও নির্যাতিত মানুষ জীবনের নিরাপত্তার জন্য শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিতে থাকে। পরিস্থিতি স্থানীয় প্রশাসনের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। ভারত সরকার এই গুরু দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে বাধ্য হয়। The Times পত্রিকা সম্পাদকীয়তে এ বিষয়ে লেখা হয়,
‘Bengal : Suffering Millions’
“For six weeks now the flow of refugees from East Pakistan into India has gone on relentlessly, into Tripura in the east, into Assam in the north, and heaviest of all into West Bengal. Despite the heroic effort assembled by the Indian Government and by voluntary agencies there is little hope that this gigantic mass of suffering people will find all their needs can be met. The first and most urgent need is food. As the monsoon rains begin any day now shelter will become more urgent. Worst of all-in a view of the difficulty of coping with it in such surrounding—is disease. As described in our report today cholera has now taken a hold that could be extremely dangerous. Yet another risk is that of communal tension in a city like Calcutta where the social fabric is brittle at best and where a stream of refugees is beginning to flow in.”৪
সানডে অস্ট্রেলিয়ান তার সম্পাদকীয়তে ‘Agony and Response’ শিরোনামে লেখেঃ
“In West Bengal today we are witnessing a human catastrophe for which even the tormented history of the twentieth century can offer few parallels. In the awesome scale of the disaster, in the uniquely harrowing quality of the suffering, there has been little to compare with what is happening at this moment to the refugees of East Pakistan. The known statistics of death and dislocation are appalling enough; the prospects are even more terrifying. They have already produced in some of us a paralysis of the will, and anesthesia of the mind, blinding us to the urgency of the crisis. Let us imagine, if we can, the combined populations of Melbourne and Sydney driven in terror from their homes by a marauding army, cast adrift in a wilderness without food or shelter, to face the imminent prospect of extermination from starvation or rampant disease.” ৫
আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, এশিয়া প্রভৃতি মহাদেশের বহু দেশের সংবাদপত্র বাংলাদেশ/ শরণার্থীদের দুর্দশা, নানা রোগে হাজার হাজার মৃত্যু ও তাদের উপর অত্যাচারের বহু খবর প্রকাশ করেছে, বহু সম্পাদকীয় ও প্রতিবেদনে গভীর বেদনা, উদ্বেগ ও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। স্ব স্ব দেশের সরকারের প্রতি এবিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখার জন্য আবেদন করেছে। বিশ্ব জনমত গঠনে তাদের ভূমিকা পালন করেছে। ভারতের সমস্ত ভাষার সংবাদপত্র ভারতে আশ্রিত বিপুল সংখ্যক শরণার্থী, পূর্ব-পাকিস্তানে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ও অত্যাচারের খবর প্রতিদিন প্রকাশ করে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে যা প্রভূত সাহায্য করেছে। ভারতে আশ্রয়প্রাপ্ত শরণার্থী সংখ্যা এবং তাদের ধর্মীয় পরিচয় দেখলে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও তাদের মুরুব্বিগণের আসল উদ্দেশ্য কি ছিল।
১৬ই আগস্ট ১৯৭১ পর্যন্ত ভারতে আশ্রিত শরণার্থীর ধর্মীয় বিভাজন ছিল নিম্নরূপঃ
হিন্দু ৬৯.৭১ লক্ষ
মুসলমান ৫.৪১ লক্ষ
অন্যান্য ০.৪৪ লক্ষ
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের প্রথম থেকেই একথা বুঝতে দেরি হয়নি যে, জনসংখ্যার নিরিখে পূর্ববঙ্গ/পূর্বপাকিস্তানে সংখ্যাধিক্য থাকায় গণতান্ত্রিক সরকার পদ্ধতি চালু হলে তাদের সংখ্যাগুরু প্রতিনিধিত্ব থাকবে। সেকারণে দেশবিভাগ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন কালাকানুন ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠিত করে হিন্দু বিতাড়ন তারা অব্যাহত রেখেছিল। তবুও ১৯৭০ সালের নির্বাচনে দেখা গেল পূর্বপাকিস্তানে মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ রয়ে গেছে এবং পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসন পূর্বপাকিস্তানে রয়ে গেছে, আর ১৪৪টি পশ্চিম পাকিস্তানে। আওয়ামি লিগের ১৬৭ আসনে জয়লাভ, অর্থাৎ ক্ষমতা থেকে শেখ মুজিবকে আইনানুগভাবে বঞ্চিত করা যাবে না। তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার উপায় কি? সামরিক জান্তার মস্তিস্কে গণহত্যা ছাড়া বিকল্প চিন্তা কেন এলো না? পূর্বপাকিস্তান থেকে এক কোটি হিন্দু জনসংখ্যা হঠাৎ করে কমিয়ে ফেলা ছাড়া আর কোন সহজ উপায় তারা ভাবতে পারেনি। এর পরিণতি নিয়ে কোন সুচিন্তিত মতামতও আমরা দেখতে পাইনি। এতে জনসংখ্যার হ্রাস ঘটিয়ে পূর্বপাকিস্তানকে বাগে আনা যেতে পারতো এমনই হয়ত পরিকল্পনা ছিল। তা না হলে ভারতে আশ্রিত সংখ্যা ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি প্রায় এক কোটির মধ্যে ৯৩ লক্ষই হিন্দু হবে কেন? আর এই ব্যাপক সংখ্যক শরণার্থীর কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে যে আন্তর্জাতিক জনমত গঠিত হলো – তা তো অস্বীকার করা যাবে না। শুধু পৃ্থিবীর বৃহৎ শক্তিবর্গই নয়, জাতিসঙ্ঘ সহ যে সকল সেবামূলক আন্তর্জাতিক সংস্থা ও এশিয়া-ইউরোপের দেশগুলি ভারতে আশ্রিত শরণার্থীদের পাশে এসে দাঁড়াল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়ে আলোচনা ও ভাবনা-চিন্তার অবকাশ তৈরি হল তা আমরা দেখেছি। একথা বলা মোটেই অসঙ্গত হবে না যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পিছনে শরণার্থীদের তথা হিন্দুদের যে অবদান রয়েছে তা অস্বীকার করা হবে ইতিহাসের মিথ্যাচার। অথচ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এমনভাবে জনগণের সামনে উপস্থাপিত করা হচ্ছে তা বড়ই বেদনার। ইতিহাসের সত্যতা কি কখনও চেপে রাখা যায়? ভারতে আশ্রয়প্রাপ্ত শরণার্থীর সংখ্যা রাজ্যভিত্তিক হিসেবে নীচে উল্লেখ করা হলঃ
২৫শে মার্চ থেকে ১৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত
পশ্চিমবঙ্গ … ৭৪৯৩,৪৭৪ জন
ত্রিপুরা … ১৪১৬,৪৯১ জন
মেঘালয় … ৬৬৭,৯৮৬ জন
অসম … ৩১২,৭১৩ জন
বিহার … ৮,৬৪১ জন
সর্বমোট … ৯৮৯৯,৩০৫ জন
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে হিন্দু বিতাড়নের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরীহ হিন্দু জনসাধারণের উপর শতাধিক ছোট-বড় গণহত্যা সংঘটিত করে। সরকারি ইতিহাসে তারও কোন উল্লেখ নাই। এই সমস্ত ঘটনায় সারা বাংলাদেশে বহু সংখ্যক হিন্দু পরিবার পাক-বাহিনী ও তার দোসরদের দ্বারা যে চুড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তারও কোন খতিয়ান নাই। তিরিশ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছে বলা হলেও তাদের ধর্মীয় পরিচয় জানার কোন উপায় নাই। এই সংখ্যার মধ্যে যে অধিকাংশ হিন্দু-ধর্মাবলম্বী সেটা গণহত্যাগুলির ইতিহাস খতিয়ে দেখলে সহজেই অনুমান করা যায়।
বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন চুকনগর গণহত্যা বইতে লিখেছেন “১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হানাদারদের গণহত্যা শুরু হয়। রাজাকার, শান্তিবাহিনী সংগঠিত হওয়ার পর গণহত্যার কার্যক্রম আরও পরিকল্পিতভাবে চলতে থাকে। স্থানীয় বাঙালি ও বিহারি সহযোগীরা হানাদারদের থানা-ইউনিয়ন পর্যায়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসতে থাকে। প্রথম টার্গেট হয় সংখ্যালঘু ও আওয়ামি লিগাররা। খুলনায় এ কার্যক্রম শুরু হয়। এবং এই সুত্র ধরে চুকনগর গণহত্যা সংঘটিত হয়।”৬
তিনি আরও লিখেছেন, “খুলনার বিভিন্ন থানায় (জায়গায়) হানাদার সহযোগীরা সাধারণ মানুষজনের উপর অত্যাচার শুরু করে বিশেষ করে হিন্দুদের উপর। ফলে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে ভিটে মাটি ত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখন যাবার পথটি ছিল বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে চুকনগরে আসা।” ২০শে মে বৃহস্পতিবার ১৯৭১ সালে এই গণহত্যা সংঘটিত হয়। সব প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ একই রকম। চুকনগরে এই সাক্ষাৎকার শুনতে শুনতে আবেগে আপ্লুত হয়ে জনকণ্ঠের রিপোর্টার লিখেছিলেন, “লাশের উপর লাশ, মায়ের কোলে শিশুর লাশ, স্বামীকে বাঁচাতে স্ত্রী জড়িয়ে ধরেছিল। মুহূর্তে সবাই লাশ হয়ে যায়। ভদ্রানদীর পানিতে বয় রক্তের বহর, ভদ্রানদী হয়ে যায় লাশের নদী। কয়েক ঘণ্টা পর, পাকিস্তানিদের গুলির মজুত ফুরিয়ে গেলে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে।”৭
তিনি আরও লেখেন, “চুকনগরে পাকিস্তানি হানাদাররা কত মানুষ খুন করেছে তার সঠিক সংখ্যা কেউ জানাতে পারেনি। রক্ষণশীল হিসাব অনুযায়ী সেদিন একই জায়গায় কমপক্ষে ছয় থেকে দশ হাজার মানুষ হত্যা করা হয়েছিল। এই হত্যাকাণ্ড চালাবার মাঝেও হানাদাররা কিছু নারীকে ধর্ষণ করে, কয়েকজনকে ট্র্যাকে তুলেও নিয়ে যায়।” ৮ এত কম সময়ে এত মানুষ হত্যা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। একজন বিশিষ্ট সাংবাদিকের কবিতার ভাষায় বেদনার প্রকাশঃ
বেদনার নাম চুকনগর
খুলনা জেলার ডুমুরিয়ার একটি ছোট্ট গ্রাম চুকনগর
ভদ্রানদীর তীরে এই গ্রামে প্রলয় নেমে এসেছিল একাত্তরের একদিন।
২০শে মে, সকাল দশটা।
ঘড়ির কাঁটা তখনও সচল
হাজার হাজার মানুষের পদভারে
চুকনগরের মাটি ভারাক্রান্ত
কিন্তু প্রতিবাদহীন।
মাটিই তো মাটির মানুষের
শেষ ঠিকানা,
মাটিতেই মিশে যায় নশ্বর দেহ।
একাত্তর ছিল মুক্তির কাল
একাত্তর ছিল ঘাতকদের সময়
একাত্তর ছিল আলো এবং অন্ধকারের সমবেত খেলা
একাত্তর ছিল উৎখাত ও
প্রতিষ্ঠার ঐকতান।
নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে
আপন বসত ছেড়ে কত কত দূর গ্রাম-জনপদের
শিশু-নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ
জোয়ান-তরুণ
সব বয়সী মানুষ ভয়ার্ত চোখে
খুঁজছিল পালানোর পথ।
উদ্বাস্তু জীবন বেছে নিয়ে
খুঁজছিল বাঁচার ঠিকানা।
পায়ে হেঁটে, নদী পথে
রাতের আঁধারে সমবেত হয়েছিল চুকনগরের নিরিবিলি শান্ত ভদ্রা তটে।
কত ছিল সংখ্যায় তারা?
পিঁপড়ের সার দেওয়া মানুষের মাথা গোনা ছিল নিষ্প্রয়োজন।
পাকিস্তানি হার্মাদ সেনারা ট্র্যাক ভরে এসে ছোটায় বুলেট বৃষ্টি
অসহায় মানুষের বুকে।
বাঁচার জন্য ঘরছাড়া মানুষেরা ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে হাজারে হাজারে।
মাতৃস্তনে মুখ রাখা ছয় মাসের শিশু
অসহায় তাকিয়ে দেখে রক্তে ভেজা মায়ের বুক।
হায়, মুহূর্তে জমে যায় লাশের স্তূপ
লাল রক্তের নদী সাঁতরে
পালাতে পারে না কেউ।
চুকনগর এক সঙ্গে হয়ে যায়
দশ মাইলাই।
এত রক্ত পিপাসা যাদের
কেমন মানুষ তারা, কি তাদের পরিচয়?
মৃত্যুর মিছিল থেকে জীবনের আয়োজন করেছে বাঙালি।
যাদের রক্তে আজ আমাদের
এই স্বাধীনতা
তারা আজ নাম পরিচয়হীন
স্মৃতির মিনার।
চুকনগরের স্মৃতিসৌধে
নতশিরে দাঁড়াই
বিহ্বলতা নিয়ে
কত প্রশ্ন উড়ে আসে
জুড়ে বসে মনে
যারা দিয়ে গেল প্রাণ
তাদের প্রতি কি দায় আমাদের,
আমরা কি তাদের মনে রেখেছি
তাদের করছি কি বিনীত সম্মান?
বিভুরঞ্জন সরকার
সংখ্যালঘু হিন্দুরা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে পূর্ব-পাকিস্তানে কেমন ধরণের নির্যাতন, অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ডের মুখোমুখি হয়েছেন সেটা অনুধাবনে চুকনগরের একটি গণহত্যার উদাহরণই যথেষ্ট মনে হয়। শুধুমাত্র ‘১৯৭১; গণহত্যা নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট’ প্রকাশিত, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এমন ৫০টি গণহত্যার ঘটনা পুস্তকাকারে প্রকাশ করেছে। হিন্দুদের ত্যাগ, দেশপ্রেম ও বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধকে জয়যুক্ত করার পিছনে যে মূল্য দিতে হয়েছে – তা বাংলাদেশের ইতিহাসে যথাযথ স্থান না পাওয়ার কারণগুলি আজ আর কারও অজানা নয়। বিশিষ্ট মনীষী আব্দুল গাফফার চৌধুরী লিখেছেন, “যে পাকিস্তান হটিয়ে আমরা স্বাধীনতা এনেছি, তাদের ফেলে যাওয়া ধর্মীয় জাতীয়তা, সাম্প্রদায়িক কালচারের আলখেল্লাটি মহাহর্ষে গায়ে চাপিয়ে আমরা পাকিস্তানিদের চাইতেও ‘ইসলামি উম্মাহার’ বড় শরিক সেজেছি। হাজার বছরের বাঙালি পরিচয় বর্জন করে বাংলাদেশি হয়েছি। … আসল কথা, আমরা পাকিস্তানিদের তাড়িয়ে নতুন পাকিস্তান বানিয়েছি। স্বাধীনতা কথাটা এখানে অবান্তর। আমরা নতুন পাকিস্তানে পাঞ্জাবি শাসকদের আসনে বসার গর্ব ও আভিজাত্য বোধ করছি। সম্ভবত এটাই ছিল আমাদের আসল লক্ষ্য”।৯
তথ্যসূত্রঃ
১। ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেস, নতুন দিল্লি, জুন ২, ১৯৭১।
২। হিন্দুস্তান টাইমস, নতুন দিল্লি, জুলাই ৩০, ১৯৭১।
৩। হিন্দুস্তান টাইমস, নতুন দিল্লি, আগস্ট ১৪, ১৯৭১।
৪। Editorial, The Times, London, June 1, 1971.
5. Editorial, The Sunday Australian, June 6, 1971.
6. 1971 : Chuknagarer Gonohatya : edited by Muntasir Mamoon, Bangladesh Charcha, Dhaka, 2002, pp.8-10.
7. Ibid., pp.8-10.
8. Ibid., pp.8-10.
৯। আব্দুল গাফফার চৌধুরী, একুশের অবক্ষয় ও সেকু্লারিজমের বিপর্যয়ঃ বাংলাদেশ বুদ্ধিবৃত্তিঃ ধর্ম সাম্প্রদায়িকতার সঙ্কট edited by Syed Amirul Islam and Kajal Bandyopadhyay, Jatiya Grantha Prokashan, Dhaka, 1999, pp.135-36.