বিমল প্রামাণিক
দেলোয়ার হোসেন সাঈদিকে নিয়ে বাংলাদেশের ইসলামী সমাজে এত মাতম কেন? যে লোকটা আমৃত্য কারাদণ্ড প্রাপ্ত একজন অপরাধী, যে কিনা যুদ্ধাপরাধে অপরাধী পাকিস্তানি কোলাবরেটর, বহু লুট ও হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে অভিযুক্ত, তাকে নিয়ে এত মাতম কারা করছে? জামাতে ইসলামী বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের বড় শত্রু। রাজাকার, আলবদর, আলসামসের জন্মদাতা, ত্রিশ লক্ষ গণহত্যার অন্যতম অভিযুক্ত – তার নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদি। কোন্ পাকিস্তানির দল তাকে ‘শহীদ’ বলে আখ্যায়িত করছে? পাকিস্তানের অতীত এখনও এদের তাড়া করে ফিরছে।
‘সে পিরোজপুরের সাঈদখালি গ্রাম এলাকায় দেইল্লা রাজাকার নামে একজন হিংস্র প্রকৃতির রাজাকার ছিল। পাড়েরহাট গ্রামে হাটবারে সে হিন্দু বাড়ির লুট করা মালামালও বিক্রি করতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেইল্লা রাজাকার এলাকা থেকে পালিয়ে যাওয়ায় তাকে তখন মুক্তিযোদ্ধারা ধরতে পারেনি। সেই লোকটিই এখন নাম পাল্টে বিভিন্ন এলাকায় দেলোয়ার হোসেন সাঈদি নামে ওয়াজ করে বেড়াচ্ছে।’ পিরোজপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কম্যান্ডের ১৯৮৭ সালের চিঠিতে এ তথ্য জানা যায়।
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় মোতাবেক ২০১৮ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে তার কৃতকর্মের জন্য আমৃত্যু যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণা করা হয়। ১৪ই আগস্ট ২০২৩ জেল হেফাজতেই তার মৃত্যু হয়।
মুসলমান সমাজে পাকিস্তান ও বাংলাদেশি আমলে ছোট-বড় শত শত দেলোয়ার হোসেন সাঈদির কেন জন্ম হল বুঝতে হলে ইতিহাসে ফিরে যেতে হবে। মোটা দাগে ১৯০৬ সালে মুসলিম লিগ গঠন, তিরিশ-চল্লিশের দশকে দ্বিজাতিতত্ত্ব, ১৯৪৭-এ বাংলাভাগ এবং পাকিস্তান গঠন। বাঙালি মুসলমানরা বাঙালি পরিচয় ত্যাগ করে মুসলমান পরিচয়ে থিতু হতে চাইল। তাদের হিন্দু-বিদ্বেষ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাল। বাঙালি সংস্কৃতি বৃহত্তর ভারতীয় সংস্কৃতিরই অঙ্গ। বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায় নিজ সংস্কৃতি বর্জন করে ভারতীয় মুসলমানগণের প্রভাব না এড়াতে পেরে নিজেদের আত্মপরিচয় খুঁজতে ভারত আক্রমণকারী লুটেরাদের ও আরব মরুভূমির ইসলামি পরিচয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ল। এমনকি ইংরেজ বিরোধী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালি হিন্দুদের চূড়ান্ত আত্মত্যাগ, শত শত হিন্দু যুবক ফাঁসির সাজা হাসিমুখে বরণ করল। দলে দলে আন্দামান ও ভারতের বিভিন্ন কারাগারগুলিতে নিজেদের জীবন-যৌবন বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করল না। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালি হিন্দুর অতি মূল্যবান এই স্বর্ণালি ইতিহাসের গৌরবকেও বাঙালি মুসলমানরা নিজেদের অংশীদার হিসেবে ভাবতে পারল না।
যদিও বাঙালি জাতি হিসাবে হিন্দুর সোনালি অতীত গ্রহণ করতে এখনও কুণ্ঠার সীমা-পরিসীমা নাই। সেকারণেই দেলোয়ার হোসেন সাঈদিদের বাঙালি মুসলমান সমাজে অভাব হয় না।
পঞ্চাশ বছর কাল ইতিহাসের নিয়মে সামান্য সময় হলেও বাঙালি মুসলমানদের সামনে একটা সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল – ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উজ্জ্বল ইতিহাসকে সংরক্ষণ করে নিজেদের রাষ্ট্র-সমাজ ও ব্যক্তি জীবনে প্রতিষ্ঠা করার এবং অনাগত উত্তরসূরিদের জন্য পূর্বসূরিদের আত্মত্যাগের বীরগাথার কালোত্তীর্ণ অবদান রেখে যাওয়ার। তা তো দেখা যাচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি সর্বজনবিদিত। নানা ঘটনা মুছে ফেলা হয়েছে, নানা ঘটনা বিকৃত করা হচ্ছে। এমনকি দেলোয়ার হোসেন সাঈদির মতো একজন জঘন্য যুদ্ধাপরাধীকে আজ ‘শহীদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। তার জানাজায় লক্ষ লক্ষ লোকের সমাবেশ হচ্ছে।
আজকে ভেবে দেখার সময় এসেছে, বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করতে পারলেও কেন নিজেদের পাকিস্তানি মানসিকতা থেকে উত্তরণ ঘটাতে ব্যর্থ হল। পাকিস্তান আমলে বাঙালি মুসলমান নিজেদের মুসলমান পরিচয়ে গর্ববোধ করত – এ অভিজ্ঞতা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনাকালীন সময়ে আমার ভালোভাবেই হয়েছিল। আর স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে যেভাবে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে পাকিস্তানি জোশের বিস্ফোরণ ঘটল – তা দেখে মোটেই অবাক হইনি কারণ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাঙালি মুসলমান সমাজে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছিল। মুসলমানদের বৃহদংশ পাকিস্তান ভেঙ্গে ভারতের সাহায্যে বাংলাদেশ গঠনের পক্ষে ছিল না। সরকারিভাবে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ-বাহিনীর সামনে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণ হলেও সাধারণ মুসলমানরা এখনও বিশ্বাস করে পাকিস্তান ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। মাত্র চার বছরের মধ্যেই আমরা দেখতে পেলাম স্বপরিবার শেখ মুজিবসহ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী প্রধান নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের মাটিতে নৃশংসভাবে খুন হয়ে গেল। বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে কোন প্রতিবাদ ধ্বনি শোনা গেল না ! নীরবে বাংলাদেশের কবর হয়ে গেল ‘পাকিস্তানের’ মাটিতে।
আজকে দেশে-বিদেশে লক্ষ লক্ষ মুসলমান সাঈদির জন্য শোক প্রকাশ করে, জানাজা পাঠ করে। হায়রে বাংলাদেশ ! কি বিচিত্র এই বাঙালি মুসলমান!
একটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, তা হল, ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে-সাত কোটি। ধরা হয়ে থাকে মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছে। এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। বাংলাদেশ মুক্ত হওয়ার পর এক কোটি শরণার্থীর মধ্যে কমপক্ষে ত্রিশ লক্ষ মানুষ ভারতে থেকে গেছে। ঐ ত্রিশ লক্ষের মধ্যে সেইসব মানুষও ধরা হয়েছে যারা মুক্ত বাংলাদেশে ফিরে নিজেদের স্থায়ী সম্পদ (স্থাবর) অর্থাৎ বাড়িঘর, জমিজমা, ব্যবসাবাণিজ্য উদ্ধার করতে না পেরে পুনরায় ভারতেই আশ্রয় নিয়েছিল। এটা আমরা দেখতে পাই, বাংলাদেশকেন্দ্রিক ভারতীয় সীমান্ত রাজ্যগুলির ১৯৮১’র সেন্সাসের (আদমশুমারি বা জনগণনা) জনসংখ্যা বৃ্দ্ধির হার থেকে। অন্যদিকে ১৯৭৪ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের আদমশুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যা ছিল সাত-কোটি চৌদ্দ লক্ষ। এর মধ্যে রয়েছে ১৯৭১ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত তিন শতাংশের অধিক হারে বৃদ্ধি জনসংখ্যার পরিমাণও। তাহলে হিসাবে পাওয়া যাচ্ছে, সাড়ে সাত-কোটির মধ্যে ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর ত্রিশ লক্ষ হিন্দু ভারতে থেকে যাওয়ায় মোট ৬০ লক্ষ জনসংখ্যা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে কমে যায়। আর বর্তমান বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি। অর্থাৎ স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে দশ কোটি জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে। এই দশ কোটি জনসংখ্যার সামনে গত পঞ্চাশ বছরে পাকিস্তানি গণহত্যার ইতিহাস এবং পাকিস্তানিদের বাঙালি সহযোগীদের ভূমিকা, জামাতের গণহত্যাকারীদের পরিচয়, মুসলিম লিগ, নেজামে ইসলাম, পীর মৌলানা, পাকিস্তানি বাহিনী ও সরকারের সহযোগী কর্মচারী, সাধারণ জনগণ – যারা পাকিস্তান সরকারের পক্ষে থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল – তার কতটুকু তুলে ধরা হয়েছে? ১৯৭৫ পরবর্তী সরকারগুলি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ১৯৭১ এর গণহত্যার ইতিহাস তুলে না ধরে চাপা দিয়েছে, ভূলিয়ে দিয়েছে। ফলে শত শত সাঈদির জন্ম হয়েছে। বাংলাদেশকে বোরখা, মাদ্রাসা আর উগ্র ইসলামী মৌলবাদ গ্রাস করে ফেলেছে। এসকল বিষয় কি মুক্তিযুদ্ধের দাবীদার আওয়ামি লিগ সরকারের অজানা? পরিবারসহ শেখ মুজিব ও জেলখানায় চার নেতা নিহত হওয়ার পর তদানীন্তন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, তাঁর একজন বাঙালি পরামর্শদাতাকে ডেকে বলেছিলেন, ‘আমি কি ভারতের পেটের মধ্যে একটি বিষফোঁড়া তৈরি করে ফেললাম।’ বিষফোঁড়া বড় হতে দিলে চিকিৎসা জটিল হওয়ার প্রবণতা থাকে।