Center For Research In Indo

টাকা ও রুপিতে বাংলাদেশ ও ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যের বিভিন্ন দিক।

শঙ্কর সরকার, বাংলাদেশ

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বৈদেশিক বাণিজ্য দুই দেশের প্রচলিত মুদ্রায় আংশিক শুরু হয়েছে  মূলত  করোনা পরবর্তী বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা ও রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং বাংলাদেশ ও ভারতের উভয় দেশের পরস্পরের ডলারের উপরে নির্ভরতা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে। রুপি ও টাকার মাধ্যমে লেনদেন পরিচালনা করে ভারত ও বাংলাদেশ বাণিজ্য সম্প্রসারণের সম্ভাবনা সম্পর্কে  বিভিন্নজন বিস্তারিত মূল্যবান বক্তব্য রেখেছেন এবং কথা বলেছেন যা দুই দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন এ ব্যবস্থার আওতায় ভারত থেকে পণ্য সামগ্রী সস্তায় আমদানি করা যাবে। বেশির ভাগ মানুষ এ ব্যবস্থাকে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর চাপ কমানোর একটি অস্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অল্প সংখ্যক বিজ্ঞজন অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, এ ব্যবস্থায় ডলারের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

 

এক: ফরেন এক্সচেঞ্জের ওপর রিজার্ভের চাপ

ভারত থেকে বাংলাদেশে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি করা পণ্যের মূল্য প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার,  রপ্তানি থেকে আয় মাত্র ২ বিলিয়ন ডলার। বাণিজ্য ঘাটতি ১৪ বিলিয়ন ডলার। এ পার্থক্য পূরণের জন্য রুপি হোক কিংবা ডলার, ইউরো হোক বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের বিদেশি হিসাব, ব্যাঙ্কের পরিভাষায় নস্টা একাউন্ট থেকে সংস্থান করতে হবে। বলা বাহুল্য সেই লেনদেনের ফলে প্রকারান্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন  এক্সচেঞ্জ রিজার্ভের ওপর প্রভাব পড়বে। এ শূন্যতা পূরণে বিকল্প কোন পন্থা নেই। মোটকথা রিজার্ভের ওপর চাপ অব্যাহত থাকবে।

  

দুই: আমদানি ব্যয়ভার লাঘব

বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো ভারতীয় রুপিসহ সব দেশের মুদ্রা বিনিময় হার নির্ধারিত করে বাংলাদেশের ইনটারভেনশন কারেন্সি মার্কিন ডলারের মাধ্যমে, ব্যাঙ্কের পরিভাষায় ক্রসরেট ব্যবহার করে। তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশের মতো অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কারেন্সির বিনিময় হার নির্ধারণ করা হয় মার্কিন ডলারের মাধ্যমে, ব্যাঙ্কের পরিভাষায় যাকে বলে ক্রস রেট। যেমন ভারতীয় রুপির বিনিময় হার নির্ধারণ করা হয় ডলার-রুপির বিনিময় হারের সাথে বাংলাদেশের টাকা-ডলারের বিনিময় হারের সাথে ক্রস করে। তাছাড়া বিভিন্ন ধরণের লেনদেনের জন্য ক্রস রেটের সমন্বয়ে করা হয় ব্যাঙ্কের নিজস্ব লাভের মার্জিন ও অন্যান্য খরচপাতি। উদাহরণ হিসেবে ভারতের রুপিতে ড্র করা রপ্তানি বিল ক্রয় করার জন্য ২৪ জুলাই ২০২৩ বাংলাদেশ সোনালী ব্যাংকের বিনিময় হার ছিল রুপি ১=টাকা ১.২৯৭৭। আমদানি বিল পরিশোধ করতে বিনিময় হার ছিল ১.৩৪২৬।  বিনিময় হার নির্ধারণ করা হয় ডলারের মাধ্যমে।   

 

        সহজভাবে বলা যায় ভারতীয় পণ্য আমদানি পণ্যের মূল্য রুপি হিসেবে পরিশোধ করতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে মার্কিন ডলার বা অন্য কোন কারেন্সিতে পরিশোধ করতে একই ব্যয় হবে। তাছাড়া ভারত বাংলাদেশের দুইটি কারেন্সির বিনিময় হার খুবই অস্থির। অল্প কয়েক মাসের ব্যবধানে টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৮৫ টাকা থেকে ১০৫-১০৬ টাকা। অন্যদিকে রুপির হিসাবে ডলারের মূল্য ২০২২ সালের গড় বিনিময় হার ৭৮.৬০৪৩ থেকে বর্তমান প্রায় কম বেশি ৮২.০০ রুপিতে পৌঁছে গেছে। এই উত্থান পতনের অনিশ্চিয়তার কারণে আমদানি বাবদ বাড়তি টাকা পরিশোধ করার ঝুঁকি থাকে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে বিনিময়হারজনিত ঝুঁকি ব্যাংক  থেকে আগাম রুপি কিনে নিলেই তা নিরসন করা যায়? ব্যাঙ্ক থেকে রুপি আগাম ক্রয় বিক্রয়ের মাধ্যমে বিনিময়হার ঝুঁকি নিরসনের ব্যবস্থা এখন নাই। থাকলেই বা কি ? ফরেন কারেন্সি আগাম বিক্রয়ের হার নির্ধারণ করা হয় তাৎক্ষণিক বিনিময় হার বা স্পট রেটের সাথে প্রিমিয়াম যোগ করে। মোটকথা দরদামে বাংলাদেশ – ভারত দুই দেশের কারেন্সিতে অথবা তৃতীয় কোন কারেন্সিতে লেনদেন  নিষ্পত্তি করার মধ্যে পার্থক্য নেই। শুধু বাংলাদেশের রপ্তানি মূল্য বাবদ ২ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ  ভারতীয় রুপি আমদানি পণ্যের মূল্য পরিশোধের সুযোগ আছে। কিন্তু তাতে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের কারও বাড়তি সুবিধা হবে না ডলার হোক কিংবা রুপি আমদানিকারকের ব্যয়ভারে কোন হেরফের হবে না। ভারতীয় রফতানিকারকরাও রুপির হিসাবে  রফতানি মূল্য আদায় করতে আগ্রহী হবে তেমন  আশা করা রায় না। রুপির পরিবর্তে মার্কিন ডলার অথবা অন্য কোন আন্তর্জাতিক কারেন্সিতে রফতানি মূল্য আদায় করতেই তাদের বেশি আগ্রহ। ক্রমশ নিম্নমুখী ভারতীয় মুদ্রার বিনিময় হারের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন  ডলারসহ আন্তর্জাতিক কোন কারেন্সিতে রফতানি চুক্তি করলে বাড়তি কিছু লাভের সম্ভাবনা থাকে। ব্যাঙ্কের কাছে রফতানি বিল আগাম বিক্রি করেও অতিরিক্ত প্রিমিয়াম পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ রকম  বিবিধ সুবিধা বিসর্জন করতে বললে তারা রুপির হিসাবে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করবে। কঠিন প্রতিযোগিতামূলক ধূসর পুঁজিবাদী বাণিজ্যিক জগতে ফ্রিল্যানস বলে কোন কথা নেই। এর প্রমাণ পাওয়া গেছে এশিয়ান ক্লিয়ারিং  ইউনিয়নের সময়ে। আফগানিস্তান ও মিয়ানমারসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের আওতায় প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে এ অঞ্চলের কারেন্সিতে লেনদেন ব্যবস্থা প্রবর্তনে ব্যর্থ হয়ে শেষমেশ মার্কিন ডলার, ইউরো এবং জাপানি ইয়েন মধ্যবতী কারেন্সি হিসাবে ব্যবহার করা রীতিসম্মত হয়েছে। দৈনিক লেনদেন ক্লিয়ারিং আ্যকাউন্টের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হলেও পণ্য আমদানির সময়ে পণ্যের মূল্য এবং পণ্য প্রাপ্তির সময়ে পণ্যের মূল্যের  যে রুপির পার্থক্য তা রুপির পরিবর্তে  মার্কিন ডলারের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। বাংলাদেশের  দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীর সব দেশের কারেন্সিই ফরেন কারেন্সি। ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে ভারত কিম্বা দুর্বল মিয়ানমার কারেন্সি অন্যান্য দেশের কারেন্সির মতোই মূল্যবান। যেমন সিঙ্গাপুরে ডলার  কিনতে আমাদের মার্কিন ডলার রিজার্ভ ব্যবহার করতে হয়। ভারতের রুপি এবং মিয়ানমারের চাট কিনতে প্রকারান্তরে রিজার্ভ থেকেই সংকুলান করা হয়। এই দুই কারেন্সিকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার যৌক্তিকতা নেই।     

 

 

 

তিন:  আমেরিকার ডলারের উপর নির্ভরতা

এই কথা সত্য যে রিজার্ভ কারেন্সি হিসাবে বিগত কয়েক বছর ধরে মার্কিন ডলারের গুরুত্ব কমে গেছে। ১৯৯৯ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নয়া কারেন্সি চালু হওয়ার  পর বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মার্কিন ডলারে বর্ণিত সম্পদের শেয়ার শতকরা ৭১ শতাংশ থেকে কমে ৫৯ শতাংশ হয়ে গেছে। ইউরো ছাড়াও অন্য কয়েকটি দেশের কারেন্সি ডলারের শেয়ারে ভাগ বসিয়েছে। বাংলাদেশের রিজার্ভের একাংশ ও বিকেন্দ্রীকরণের উদ্দেশ্য কারেন্সিতে ও অন্যান্য কারেন্সিতে বিনিয়োগ করা হয়। মার্কিন ডলারে বিনিয়োগ আরও কম করার এক্তিয়ার  আমাদের থাকলেও দৈনন্দিন লেনদেনের জন্য মার্কিন ডলারের গুরুত্ব মোটেও কমেনি। Bank for International Settlement কর্তৃক ত্রিবাষিক জরিপ অনুযায়ী ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্য ৮৮  শতাংশ ট্রানজেকশনের বিপরীতে দুটি কারেন্সির একটি ছিল মার্কিন ডলার। তিন বছর পর ২০২৩ সালে  অর্থাৎ মাত্র গত বছরের সার্ভে অনুযায়ী মার্কিন ডলারের ভূমিকা একই পর্যায়ে রয়েছে। আমরা চাইলেই ইচ্ছেমত লেনদেনের জন্য মার্কিন ডলারের পরিবর্তে অন্যান্য কারেন্সি ঢালাওভাবে ব্যবহার করতে পারার কোন সম্ভাবনা নেই।

 

বাংলাদেশের আমদানি রপ্তানি উভয়ের জন্য লেনদেনের কারেন্সির বিষয়টি নির্ভর করে বিদেশী ক্রেতা বিক্রেতার মর্জির উপর। অর্থনীতির ভাষায় বায়ার্স মার্কেটে আমেরিকান ক্রেতার কখনো অন্যান্য কারেন্সিতে আমদানি রফতানি মূল্য পরিশোধ করার সম্ভাবনা নেই। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পছন্দ ইউরো অথবা মার্কিন ডলারে লেনদেন করতে। আমদানির ক্ষেত্রে একই কথা। এমনকি ভারতীয় রপ্তানিকারকরা অবাধে রূপান্তরযোগ্য  কারেন্সিতে লেনদেন করতে বেশী আগ্রহী। 

 

মোটকথা বাংলাদেশ ও ভারতের দুই দেশের ব্যবসায়ীদের ভারতীয় রুপির অথবা বাংলাদেশ টাকায় লেনদেন করার জন্য বাধ্যতা আরোপ করা হলে তাতে জটিলতা দেখা দেবে। এ পরিস্থিতিতে চিরাচরিত ডলারে পেমেন্ট সিস্টেম ব্যবহার করার পাশাপাশি কোন কারেন্সিতে ব্যবসায়ীরা বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালনা করতে স্বস্তিবোধ  করে সে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি তাদের কাছে ছেড়ে দেওয়া উচিত। বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য দৃষ্টি দেওয়ার দরকার ট্যারিফ ও ননট্যারিফের দেয়াল যথাসম্ভব শিথিল করে উভয় দেশের অর্থনীতি মজবুত করা।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *