।।শিতাংশু গুহ, ২৯শে ডিসেম্বর ২০২৩, নিউইয়র্ক।।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর সংবিধান কার্যকর হবার পর ৭ই মার্চ ১৯৭৩ সালে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং নির্বাচনটি ভালোই ছিল। এরপর বঙ্গবন্ধু হত্যা, সামরিক শাসন পেরিয়ে ১৮ই ফেব্রুয়ারী ১৯৭৯ সালের জাতীয় নির্বাচন। জাতি প্রথম দেখলো ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’। আরো দেখলো নির্বাচনের আগে-পরে সংখ্যালঘু নির্যাতন। এ নির্বাচনে ভোটের গুরুত্ব ছিলনা, কারণ ফলাফল আগেভাগে ঠিক ছিল। প্রহসনের নির্বাচনের সেই শুরু। থেমে থেমে আজও তা চলছে, কেউ জানেনা এর শেষ কোথায়?
১৯৮৬ ও ১৯৮৮-এর নির্বাচনের আগে-পরে হিন্দুর ওপর অত্যাচার হয়েছে। ১৯৮৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়, সংখ্যালঘু নির্যাতন বাদ যায়না। ২০০১-র নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপি-জামাত বিজয় উৎসব পালন করে ব্যাপক হিন্দু নির্যাতনের মধ্য দিয়ে। এ যাবৎ নির্বাচনী সন্ত্রাসের মধ্যে ২০০১ এখনো শীর্ষে? ১৯৮১ সালে দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। এই নির্বাচনে বিচারপতি সাত্তার বিজয়ী হন। জিয়া হত্যার পর এই নির্বাচন ছিল আর একটি প্রহসন, লোক দেখানো এবং সময় ক্ষেপণ। নির্বাচনটি হয় ১৫ নভেম্বর ১৯৮১, এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন ২৪শে মার্চ ১৯৮২।
এ প্রসঙ্গে প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের একটি চমৎকার উক্তি আছে। বায়তুল মোকাররমে এক ভাষণে তিনি বলেন, দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হলো, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন ডঃ কামাল হোসেন ও বিচারপতি আব্দুস সাত্তার; জনগণ ভোট দিলো ড: কামাল-কে, জিতলেন সাত্তার সাহেব এবং ক্ষমতায় বসলেন হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ’। সুরঞ্জিতদার এই বক্তব্য থেকে তখনকার দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বুঝতে কারো অসুবিধা হবার কথা নয়! এটি আমি নিজকানে শুনেছি।
দেশে আরো দু’বার জনগণের ভোটে (!) প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়, সেটা ১৯৭৮ ও ১৯৮৬। এতে জনগণের সম্পৃক্ততা ছিল না, বরং তা ছিল অবৈধ ক্ষমতাকে বৈধ করার প্রক্রিয়া? একই লক্ষ্যে বাংলাদশে ১৯৭৭ ও ১৯৮৫-তে দুটি রেফারেন্ডাম হয়েছিল, যা ‘হ্যাঁ-না’ ভোট নামে সমধিক পরিচিত। তবে ১৯৯১ সালের রেফারেন্ডামটি ছিল ভিন্ন আঙ্গিকে। ১৯৮৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেয়, বিএনপি নেয়না। প্রচার আছে যে, আওয়ামী লীগ তখন সরকারের সাথে আপোষ করেছিল। আসলে তা নয়, বিএনপি চালাকি করে আওয়ামী লীগকে বোকা বানিয়ে নির্বাচন থেকে সরে পড়ে।
ঘটনাটি ছিল এরকম: নির্বাচনে যাওয়া-না-যাওয়া প্রশ্নে তখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় জোটের মধ্যে অনেকগুলো মিটিং হয়। চূড়ান্ত সভায় গভীর রাতে যৌথ সিদ্ধান্ত হয় যে, উভয় জোট নির্বাচনে অংশ নেবে এবং পরদিন তারা পৃথক পৃথকভাবে তা সাংবাদিকদের জানাবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক আওয়ামীলীগ পরদিন সকালে জানিয়ে দেয় যে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে। বিএনপি বিশ্বাসভঙ্গ করে। তারা প্রচার করে যে, আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে হাত মিলিয়েছে। ঐ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি সরকার গঠন করে, আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে বসে। শেখ হাসিনা বিরোধী নেত্রী হিসাবে এই প্রথম ক্ষমতার স্বাদ পান।
ধারণা করি, ঐসময় তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন যে, দলকে ক্ষমতায় আনতে হবে। সেই সুযোগ এসেছিল ১৯৯১ সালে। অতিরিক্ত কনফিডেন্সের কারণে তখন আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। শেখ হাসিনা বিরোধী নেত্রী হন। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী। এরশাদ জেলে যান। শেখ হাসিনা তখন সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন। যদিও তখন সেটি কেউ আমলে নেয়নি, প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগকে তখন জোর করে (প্রশাসনিক ক্যু!) হারানো হয়েছিল।
১৯৮৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরশাদ একাই প্রার্থী ছিলেন, সাথে ক’জন নাম না জানা প্রার্থী। ১৯৯১ থেকে নির্বাচনের কথা মোটামুটিভাবে সবার মনে আছে। সেদিকে যাবার আগে ১৯৮৮ সালের সংসদ নির্বাচনের কথা কিছুটা বলা দরকার। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জোট বা বিএনপি জোট অংশ নেয়নি। জাতীয় পার্টি খালি মাঠে বিজয়ী হয়। আসম রব তখন ‘গৃহপালিত’ বিরোধী নেতা হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন, মতিঝিলে জুতাপেটা হন। অবাক কান্ড যে, রওশন এরশাদ এবং আসম রব প্রায় একই ভূমিকা পালন করলেও রওশন এরশাদ ‘গৃহপালিত’ উপাধি পাননি!
১৯৭৫-এর পর থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে মূলত: অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল এবং যেনতেন প্রকারেণ ক্ষমতায় টিকে থাকার রাজনীতি চালু ছিল। নির্বাচনের লক্ষ্যও ছিল তাই? ঐসময় জেনারেলদের ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রয়োজনে ধর্মভিত্তিক দল বিএনপি-জাপার জন্ম হয়, ক্যান্টনমেন্টে। ১৯৮৮ সালে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হলে হিন্দু ও সংখ্যালঘুরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়? আবার ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতলে হিন্দুদের মনে কিছুটা আশার সঞ্চারহয়। যদিও ১৯৯৬-র নির্বাচনের পর হিন্দুদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন করে বিএনপি-জামাত গোষ্ঠী।
২০০১-র নির্বাচনে বিএনপি-জামাত জোট জয়ী হয় এবং তারা বিজয় উৎসব পালন করে সংখ্যালঘু বিশেষত: হিন্দুদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালিয়ে। ২০০১-২০০৬ এসময়ে বিএনপি-জামাত শাসনামলে দেশে জঙ্গীবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ বাড়লে স্বাভাবিকভাবে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার বাড়ে, বাংলাদেশে হচ্ছেটাও তাই। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ ২০০১-এর সংখ্যালঘু নির্যাতনের তদন্ত করতে একটি কমিশন গঠন করে। বিচার হয়নি। বাংলাদেশে হাজার হাজার মন্দির ও মূর্তি ভাঙ্গলেও আজ পর্যন্ত একজন এই অপরাধে শাস্তি পায়নি? এটাই সত্য।
বাংলাদেশে ২০০৮-এর ডিসেম্বরের নির্বাচনটি সম্ভবত: সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। সংখ্যালঘু নির্যাতন কম হয়েছে। আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় বসে। তারপর ২০১৪-র ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন। ১৫৩জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। যাকিছু ভোট পড়েছে, দিয়েছে হিন্দুরা। পত্রিকায় শাঁখা-সিঁদুরের ছবি এসেছে, হিন্দু আবার নির্যাতিত হয়েছে। ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ, বিচার হয়নি। ২০০৯ থেকে দেশে নুতন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। উন্নয়নের জোয়ার বইছে, সমানতালে চলছে সংখ্যালঘু নির্যাতন, দেশত্যাগ। ২০০৯ থেকে ২০১৭, এবং এখন পর্যন্ত (২০২৩) সংখ্যালঘু নির্যাতনের জন্যে দায়ী সরকার, বিচার নাই, ফলে নির্যাতন চলছে তো চলছেই।
নির্বাচন এলে নির্যাতনের মাত্রাটা বেড়ে যায়। আগেই বলেছি, বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুরা কম-বেশি নির্যাতিত হয়েছে। এই ধারা এখনো চলছে। সামনের নির্বাচনের আগে-পরে হবেনা এর গ্যারান্টি কোথায়? ৭ই জানুয়ারী ২০২৪-র নির্বাচন বয়কটের ডাক দিয়েছে একটি দল বা জোট, তারা প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে। যাঁরা নির্বাচন করছেন, তাঁরা ভোট দিতে উৎসাহ জোগাচ্ছেন। এমনিতে হিন্দুরা সচেতন, ভোট দেন, এবার ভোট দিতে গেলে কি রোষানলে পড়ার সম্ভবনা থাকবে না? এবার আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘু মনোনয়ন কম দিয়েছে, এবং কারো কারো মতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কারণে এঁরা অনেকেই জয়ী হতে পারবেন না?
১৫ই ফেব্রূয়ারি ১৯৯১ সালের নির্বাচনের কথা বলা হয়নি। ওটাও ছিলো প্রহসনের নির্বাচন। খালেদা জিয়ার ক্ষমতা ধরে রাখার অপপ্রয়াস। যদিও তার সেই আশা পূর্ণ হয়নি। ১২ই জুন ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হন। ৩০শে ডিসেম্বর ২০১৮ একাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এটি শুধু নামেই নির্বাচন, অভিযোগ রয়েছে, ‘দিনের ভোট রাতে’ হয়ে যায়। ব্যাপক কারচুপি হয়, মূলত: এটি ছিল ‘বিনে’ ভোটের নির্বাচন।
এপর্যন্ত ১১টি সংসদীয় নির্বাচন, ৩টি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং ৩টি রেফারেন্ডাম হয়েছে। তাতেও কিন্তু গণতন্ত্র এখনও ‘সোনার হরিণ’ রয়ে গেছে। নির্বাচন মানেই ঝামেলা, ভয়, শঙ্কা। শঙ্কাটা সংখ্যালঘুর মধ্যে বেশি। এতগুলো নির্বাচনের মধ্যে কয়টি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে তা বলা মুশকিল? জনগণ ২০০৮-এ একটি সুন্দর নির্বাচন দেখেছে, ২০১৪ এবং ২০১৮-তে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। এ সময়টায় যারা নুতন ভোটার হয়েছেন তারা কি এবার ভোট দিতে পারবেন?হয়তো পারবেন, কিন্তু পছন্দমত প্রার্থীকে কি ভোট দিতে পারবেন?ভোট তো দিতে হবে, হয় নৌকা বা স্বতন্ত্র প্রার্থীকে? এবারের নির্বাচনটি হচ্ছে, নৌকা ভার্সেস আওয়ামী লীগ (স্বতন্ত্র)।
নির্বাচনের আর মাত্র ক’দিন বাকি, তবু হয়তো নির্বাচন নিয়ে শেষ কথা বলার সময় শেষ হয়ে যায়নি। স্কুলে পড়েছিলাম, ‘ভার্সাই চুক্তি’র মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল’? আপাতত: প্রচন্ড বৈদেশিক চাপের মধ্যে সরকারের মুখে চিন্তার বলিরেখা। সমস্যা বহুবিধ। বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা’র ভয় আছে? বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারত-চীন-রাশিয়া একপক্ষে, আমেরিকা-ইউরোপ অন্যপক্ষে। ঢাকার মাঠে বিদেশীরা নির্বাচনী ফুটবল খেলছেন। কি হবে?ভাবছি, ভার্সাই চুক্তির মত ২০২৪-র নির্বাচন কি আর একটি নির্বাচনের পদধ্বনি নয়তো?