প্রতিকূলতার অর্ধশতক পেরিয়ে পশ্চিমবাংলার উদ্বাস্তু ও অভিবাসী নারীশক্তিঃ রাষ্ট্রস্তম্ভের বীরাঙ্গনা মানবীয় সম্পদ
(১৯৭১–২০২১)
সুদীপ কুমার আচার্য্য
(রিসার্চ এসোসিয়েট, সেন্টার ফর রিসার্চ ইন ইন্দো-বাংলাদেশ রিলেশনস)
স্বাধীনতা উত্তর পশ্চিমবঙ্গে অগোছালো সমাজব্যবস্থার অভ্যন্তরে নারী জাতিসত্ত্বা ও মর্যাদার বিষয়টি ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আর উদ্বাস্তু নারীজীবনে এসবের প্রভাব ছিল সবচেয়ে অধিক আবার ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইতে তাঁরাই ছিলেন প্রথম শ্রেণীতে। দেশভাগ বা পাকিস্তান আমলে পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু অভিপ্রয়াণ ছিল নিত্যনৈমিত্যিক ব্যাপার। এই সময় মোট উদ্বাস্তুর প্রায় ৪৬.২১ শতাংশ মহিলা পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছিলেন। এ ছিল অভিপ্রয়াণের একটা সূচনা মাত্র এবং এখানেই এর পরিসমাপ্তি ঘটেনি। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় ১ কোটিরও বেশি মানুষ পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর কিছু সংখ্যক শরণার্থী ফিরে গেলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় থেকে গিয়েছিলেন এই বঙ্গে। ২০১১-র জনগণনা পর্যন্ত এদেশে ৩০ লক্ষ অভিবাসী আছেন যার ৯৮ শতাংশ হলেন বাংলাদেশী। সেনসাস অনুসারে ১৯৭১-এ যেখানে ৪৬.২১ শতাংশ ছিলেন মহিলা, ২০০১-এ তা প্রায় ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।১ নানাভাবে ইনফিলট্রেশনের মাধ্যমে এই সংখ্যার পরিধি বেড়েছে। ২০১৬ সালের শেষদিক পর্যন্ত সরকারী হিসাব অনুযায়ী ভারতে অভিবাসী তথা বেআইনী অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশিদের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি। পশ্চিমবঙ্গে এই সংখ্যা ৫৭ লক্ষ, আসামে ৫০ লক্ষ । এইভাবে ভারতের প্রায় ১৭টি রাজ্যে অনৈতিকভাবে এরা থেকে গেছেন। (The Times of India report – Two crores Bangladeshi immigrants illegally stay in India, centre informs Rajya Sabha- report by Bharati Jain, November 17, 2016, রাজ্যসভায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেণ রিজিজুর দেওয়া তথ্য) কিন্তু সেনসাসে তার সঠিক সংখ্যা ধরা পড়ে না। বর্তমানে Citizenship Amendment Act, 2019, (১৯৫৫ সালের নাগরিক আইন সংশোধন করে ২০১৯ সালের ১১ই ডিসেম্বর সংসদে এটি পাশ হয়) (CAA) আইন লাগু করে এরকম অনেক পরিবারকে নাগরিকতা দেওয়া হবে আশা করা যায়। যাইহোক, আমাদের বর্তমান প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য হল, ১৯৭১ পরবর্তী এই অভিবাসী মহিলাদের এক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস গবেষণা। প্রধানত মূল লক্ষ্য প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে (সামাজিক সমস্যা, আর্থিক শোষণ, নির্বান্ধবতা, জোরপূর্বক উদ্বাসনের অসহায়তা, কর্মস্থলে নিরাপত্তার ভয়ংকর অভাব, উদ্বাস্তুদের প্রতি ভারতীয় আইনের প্রতিকূলতা) এই নারীদের সংগ্রামের ঐতিহ্য বিশ্লেষণ এবং পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক প্রেক্ষিতে তাদের বর্তমান ভূমিকা ও অবস্থার বিশ্লেষণ।
পশ্চিমবঙ্গে গত ৫০ বছরে এই অভিবাসী মহিলাদের কর্মজীবন, সমাজে তাঁদের মিশে যাওয়ার প্রচেষ্টা কতটা সফল হল? পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁদের বিশেষ ভূমিকা কতটা? এবং তাঁদের বর্তমান অবস্থান ইত্যাদির উপর আমরা বিশেষ দৃষ্টি দেব। এছাড়া তাঁদের সংগ্রাম, ব্যক্তিগত জীবন, পরবর্তী প্রজন্মকে মানুষ করার প্রচেষ্টা, প্রশাসনিক সাহায্য এবং ভারতীয় নাগরিকতার পিছনে ছুটে চলার দীর্ঘ আকুতি ইত্যাদি ছোট ছোট বিষয়গুলিকে দেখার চেষ্টা করব। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে তাঁদের প্রতি আচরণ এবং রাষ্ট্রের প্রতি ন্যূনতম কর্তব্য এবং উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই নেতিবাচক। মানব উন্নয়ন এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত এই অভিবাসী নারীরা ব্যক্তিগত অথবা দলগতভাবে এ দেশকে এগিয়ে দিচ্ছেন তা বলা বাহুল্য। একথা ভুলে যাওয়া অনুচিত হবে যে, মানব সম্পদ হিসাবে এই নারীসমাজের বিরাট ভূমিকা আছে এবং তা পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের উন্নতি সূচকের অগ্রগামিতায় ভূমিকা নিচ্ছে।
দীর্ঘদিন ভারতীয় ইতিহাস চর্চায় নারী ইতিহাসকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ১৯৪৭ পরবর্তীতে এ মনোভাবে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তথাপি অধ্যাপিকা রেখা পান্ডের মতে বলা যায়, ‘While the women’s movement is a much earlier phenomenon, the term Feminism is modern one’ অর্থাৎ ‘In the Indian context women’s history is still at its infancy’.২ তাছাড়া স্বাধীন এবং স্বাভাবিক গবেষণা হিসাবে নারী ইতিহাস নিয়ে গ্রন্থের অভাব আছে এবং চিন্তা ভাবনারও ঘাটতি আছে। বিশেষত উদ্বাস্তু নারী ইতিহাসের ক্ষেত্রে একথা প্রযোজ্য। তবে জাতীয় আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা নিয়ে জোয়ানা লিডল এবং রোমা যোশীর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Daughters of Independence’ রয়েছে। এই দুই লেখিকা তাঁদের গ্রন্থে জেন্ডারের সঙ্গে কাস্ট ও ক্লাস সম্পর্ক খুঁজেছেন। তাঁদের মতে পূর্বে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ, জাতিবর্ণ ব্যবস্থা, নারীদের অবদমিত করে রাখা এসব ছিল। কিন্তু সমতা, উচ্চমর্যাদার দিক দিয়ে ভারতের অনেকস্থানেই নারীর স্থান ছিল উচ্চে। ইউরোপিয়ান সাম্রাজ্যবাদ অর্থনৈতিক ঝঞ্ঝাট ও ক্রমাগত বিপত্তি সৃষ্টি করে, ভারতীয় সমাজ কাঠামো চূর্ণ করে নারী স্বাধীনতাকে সংকুচিত করে দেয়। পার্থ চ্যাটার্জী বলেন, কলোনিয়াল প্রশাসকরা ভারতীয় নারীর পূর্বতন চিত্রটাই পালটে ফেলে তাকে পরিবর্তিত করে অঙ্কন করেন।৩ তুলনায় পোষ্ট কলোনিয়াল সমাজে বিশেষত শরণার্থী ঢেউ শুরু হবার পর নানা সামাজিক আপত্তি বাধানিষেধ ভেঙ্গে ওপার বাংলার মহিলারা পশ্চিমবঙ্গে এসে এক নতুন রূপে দেখা দেন। কিন্তু এতৎসত্বেও ‘The contradiction for women today is that despite the liberality of the Laws, the inequalities remain. The implementation of the Laws to secure equality continue to be hindered by patriarchal family structures’ এবং সেজন্যই হয়ত It was from this aspect of the patriarchal family that she wished to escape.৪ জাতীয়তাবাদ কিভাবে নারী প্রশ্নের সমাধান করেছে তা নিয়ে কুমকুম সাংগারি এবং সুদেশ বেদ সম্পাদিত Recasting Women: Essays in Colonial History গ্রন্থে পার্থ চ্যাটার্জীর ভাষায় ‘New Woman is the product of a new patriarchy formed along class lines’.৫ কে. ললিতা ও সুশি থারু সম্পাদিত ১৯৯১ ও ১৯৯৩ সালে প্রমাণ সাইজের দুই খন্ডে ‘Women writing in India’ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম খন্ডে খ্রীষ্টপূর্ব ৬০০ থেকে বিংশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত ও দ্বিতীয় খন্ডে শুধুমাত্র বিংশ শতকের নারী ইতিহাস, সাহিত্যিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে নারীকেন্দ্রিক সারগর্ভ আলোচনা স্থান পেয়েছিল। কিন্তু পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু, অভিবাসী নারীসমাজ নিয়ে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য আলোচনা নেই।৬ তেলেঙ্গানার নারীসমাজের সংগ্রাম নিয়ে ‘We were making history life stories of women in the Telengana uprising’ এক অনবদ্য গ্রন্থ। এখানে তেলেঙ্গানা কৃষক আন্দোলনের লড়াকু নেত্রীদের কথা বলা হয়েছে যারা তেলেঙ্গানার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন পৃথক সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তেলেঙ্গানা গঠনের পর তারাই আজ ব্রাত্য। “We need not reiterate the fact that thousands of women played major roles in several articulations of the Telengana movement over the last decade. However, where are such women in today’s political world? What are the reasons for their absence in legislatures, leadership and government structures? Is history repeating itself?” (অন্বেষী নারী গবেষণা কেন্দ্র প্রকাশিত অনলাইন ব্লগ পোষ্টে কে ললিতার সাক্ষাৎকার ‘Language of silence’ –সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গোগো শ্যামলা এবং এ সুনীথা ২৩.০১.২০১৫)। দুঃখের বিষয় হল পশ্চিমবঙ্গে অভিবাসী বা অভিপ্রয়াণকারী নারীদের জীবনসংগ্রাম বা বিভিন্ন আন্দোলনে তাদের বলিষ্ঠ অংশগ্রহণ নিয়ে এমন পূর্ণাঙ্গ গবেষণা বেশি পাওয়া যায় না। ১৯৭৪ সালে ‘Economic & Political weekly’ (Vol. 9 & 10, March 1974) জার্নালের দুটি প্রবন্ধে পার্থনাথ মুখার্জী বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে চাঁদপাড়া, বকচরা ইত্যাদি এলাকায় ক্ষেত্র গবেষণা করে ১৯৭১ এর উদ্বাস্তু আগমন, তাঁদের স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তোলা, এলাকার স্থানীয় জনগণের সঙ্গে তাঁদের বোঝাপড়া ইত্যাদি নিয়ে লিখেছেন।৭ কিন্তু নারী উদ্বাস্তু সমস্যা বা তাঁদের প্রাথমিক সংগ্রামের কোনো মূল্যায়ণ তিনি করেননি। আরও কয়েক দশক পর একবিংশ শতকে এসে অধ্যাপিকা পলা ব্যানার্জী লিখিত ‘Women in Indian Borderlands’ নামে গ্রন্থটির দুটি অধ্যায়ে পশ্চিমবঙ্গের দু-তিনটি জেলা যেমন – মুর্শিদাবাদ, হুগলী, মালদহ, নদীয়া প্রভৃতি এলাকার অভিবাসী মহিলাদের নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে দেখানো হয়েছে রাষ্ট্র ডেমোক্রেসীর ছদ্মবেশ নিলেও আসলে অভিবাসী নারীদের কোনো space দিতে অস্বীকার করে। নতুন পরিবেশে জেন্ডার, এথনিসিটি, ধর্ম, শ্রেণীবিভাজন ইত্যাদি এই নারীদের সামনে প্রাচীর তোলে। “There is little reason to treat migrants from Bangladesh as aberration.৮
জেলাওয়াড়ি গবেষণার অন্য একটি নিদর্শন LAP Lambart Academic Publishing কর্তৃক প্রকাশিত – অশোক কুমারের ‘Bangladeshi Migration in South 24 Parganas District of West Bengal’। এখানে অশোকবাবু বাংলাদেশী পরিবারগুলির দক্ষিণ ২৪ পরগণায় আসা, স্থানীয় ক্ষেত্রে তাদের মানিয়ে নেওয়া এবং কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য আইনে নানান ফাঁদে অসহায় উদ্বাস্তু পরিবারের আটকে যাওয়া এসব নিয়ে লিখেছেন। “Political developments in India from the early 1990s have had a profound impact on the fragile living of these transnational migrants from Bangladesh. During this period, attitudes towards Bangladeshi immigrants have hardened considerably all over India.” সঞ্জয় হাজারিকার প্রদত্ত একটি সাইটেশন উল্লেখ করে তিনি দেখিয়েছেন, এমনকি অসমে CCYM নামক ছাত্রদলটি সেলুলার ফোনে মেসেজ ছড়ায়। “Save nation, save identity, let’s take an oath – no food, no job, no shelter to Bangladeshis” [(SMS on Bangladeshis’ North by North East column), Statesman, 24th May, 2005]। কিন্তু এরাজ্যে (W.B.) সর্বহারা অভিবাসী গরীব পরিবারগুলির আশ্রয়স্থল ছিল রেললাইনের পাশের ঝুপড়িগুলো, নোংরা পড়ে থাকা আবর্জনাযুক্ত অঞ্চলে বা অসহায়ভাবে নদীতীরবর্তী চর অঞ্চলগুলিতে। এই অসহায়তা, নিরাপত্তার অভাব, জনমানসে বিরোধীতা সব যোগ হয়ে একশ্রেণীর দ্বারা অনেক অভিবাসী পরিবার হয়ে পড়েছিলেন এক্সপ্লয়টেড বা শোষণের শিকার। অশোক কুমারের গ্রন্থে আমরা অবশ্য অভিবাসী নারীকেন্দ্রিক কোনো আলোচনা পাই না।৯ ২০১৬ তে ক্লেয়ার আলেকজান্ডার, জয়া চ্যাটার্জী এবং অন্নু জলাইস একটি অন্য স্বাদের বই ‘The Bengal Diaspora: Rethinking Muslim Migration’ প্রকাশ করেন। Two partitions within twenty five years in this densely populated region sparked off colossal displacements and migration….. Roughly 20 million Muslims and Hindus….. Yet despite the scale of these migrations, scholors of global migration have largely ignored them (migrants from East Pakistan)…… In the post fifty years, their leading journals, The International Migration Review has published not a single article on them….” ১০ তবে এক্ষেত্রে যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম বাংলাদেশী নারী অভিবাসীর সংখ্যা কম তাই হয়তো বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি। তবে তাতে গবেষণার একটি দিক অবশ্যই ধূসর থেকে যায়। কেননা, অনেক উদার বাঙালী মুসলিম পরিবারও পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছিলেন। সম্প্রতি ২০১৮-র মার্চে ব্লুমসবেরী ইন্ডিয়া থেকে প্রকাশিত হিরণ্য ভট্টাচার্য্যের লেখা ‘Operation Lebensraum’ নামক গ্রন্থে উদ্বাস্তু নিয়ে আসামকেন্দ্রিক আলোচনা করা হয়েছে। “The inadequency of living space with no usually available alternative means of livelihood, the unemployed people of East Bengal/East Pakistan/ and Bangladesh were forced by circumstances to look elsewhere and the easily accessible regions were Assam, West Bengal, Tripura, say, the north-eastern part of India. To start with, there were no motives other than economic ones”.১১ এই বইতে সরকারী ব্যর্থতার কথা বলা হলেও নারী দৃষ্টিভঙ্গি। থেকে উদ্বাস্তু নারী সমস্যা বা তাদের সমাজ অর্থনীতিতে ভূমিকা বা বর্তমান অবস্থানের কোনো আলোচনা করা হয়নি। অন্যদিকে পৌলমী চক্রবর্তী ‘The Refugee Women’ নামক গ্রন্থে দেশভাগ, স্বাধীনতা ও পরে নারীদের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এখানে তিনি নারীকে বিভিন্ন সাহিত্যিক দৃষ্টিকোন থেকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। তাঁর ভাষায় ‘Women as a metaphor for nation’ বা ‘Women as political subject’ এইভাবে মেঘে ঢাকা তারা , জ্যোতির্ময়ী দেবীর এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা (critique of metaphor making), সাবিত্রী রায়ের স্বরলিপি (violence of the metaphor) ইত্যাদিকে দেখা হয়েছে। বামপন্থী নারী রাজনীতি সমাজবাদ, রিফিউজি আন্দোলন নারী ইতিহাসকে নতুন করে লিখতে শেখায়; সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ যেভাবে নারী পরিচয়কে বেঁধে রেখেছিল তা থেকে, জেন্ডার ডমিনেশনের বাইরে বেরিয়ে।“ In Calcutta of the 1950s of an ‘ordinary girl’ (Nita in Meghe Dhaka Tara) returning from work at the end of the day from an office job was particularly a post partition phenomenon, indicating a new social category that had come into being in West Bengal, that of the ‘refugee woman’.১২
কিন্তু ১৯৭১ পরবর্তী নারী ইতিহাস এবং অনুপ্রবেশ সমস্যা যা ২০০১ এর পরেও ক্রমাগত বর্ধনশীল তা নিয়ে আলোচনা অনুপস্থিত। অর্থাৎ বেশিরভাগ লেখক লেখিকা উদ্বাস্তু জীবনের প্রথম অধ্যায়ে নারীকে নিয়ে আলোচনা করলেও দ্বিতীয় অধ্যায়ে (১৯৭১ পরবর্তী) অভিবাসী নারীদের নিয়ে বিশদে আলোচনা করেন নি।
পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশী অভিবাসী নারীর সংখ্যা ৫৭ লক্ষেরও বেশি। কিন্তু তাঁদের নিয়ে গবেষণার সংখ্যা নগন্য। এই নারীদের নিয়ে আলোচনা বা প্রতর্ক, বিতর্ক তেমন হয় না বললেই চলে। বিশেষত আমরা যখন গান্ধী পত্নী কস্তুরবার কথাই বিশেষ মনে রাখি না (যে প্রশ্ন তুলেছেন অনিতা অগ্নিহোত্রী, আনন্দবাজার সম্পাদকীয়তে ১৫ই অক্টোবর, ২০১৯, পৃষ্ঠা-৩) তখন উদ্বাস্তুরা অনেক দূরস্থান। উদ্বাস্তু জীবনে যারা ক্যাম্পগুলিতে থাকতেন তাঁদের দুর্দশার অন্ত ছিল না। ক্যাম্প যে মানুষের সম্মানবোধকে কত নীচে নামিয়ে দেয় তা আমি দেখেছি ঘুরে ঘুরে।১৩ তাছাড়া কখনও জীবজন্তু ঘুমন্ত শিশুদের তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা শোনা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রিফিউজিদের বাসস্থানের দূরবস্থায় এবং খাদ্যাভাবে মৃত্যু হত। মৃত্যুর কোনো সঠিক কারণ দর্শানো সম্ভব হয় না বেশির ভাগ সময়ে। ১৯৫১ এ ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে এরূপ বলা হয়- রোগে ভুগে নয়, খাদ্যের অভাবে, আলোবাতাসের অভাবে, শ্বাসকষ্টে এরা প্রত্যহ মারা যাচ্ছে। শিশুর মায়েরা বলছেন পেঁচোয় পাওয়া।১৪ দেশভাগ পেরিয়ে এসে আজকে তাঁরা কলোনি বা যে কানাগলিতে মাথা গুঁজে আছেন সেখানে তাদের কি বিরাট কোনো উন্নয়ন দেখা যায়? আজকের প্রেক্ষিতে কিছু কলোনি সবিস্তারে ঘুরে দেখে এই প্রাবন্ধিক গবেষকের মনে হয়েছে উত্তর হবে ‘না’। আরও কিছু গ্রন্থ যেমন – প্রফুল্ল চক্রবর্তীর ‘প্রান্তিক মানব পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু জীবনকথা’ প্রথম প্রকাশ ১৯৯৭ প্রতিক্ষণ পাবলিকেশনস, কলকাতা বা হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘উদ্বাস্তু’ প্রথম সংস্করণ ১৯৭০ সাহিত্য সংসদ, কলকাতা উদ্বাস্তুদের নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস। “১৯৫০ এর ফেব্রুয়ারীর একটি দিন, বনগাঁ সীমান্ত দিয়ে পূর্ববঙ্গের ছিন্নমূল বাঙালি হিন্দুদের স্রোত ভারতে ঢুকছে। অন্তহীন স্রোত কয়েক লাখ উদ্বাস্তুর মাঝখানে যশোর রোডের ওপর দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী নেহেরু। একপাশে শ্যামাপ্রসাদ, অন্যপাশে বিধানচন্দ্র রায়। কয়েক পুরুষের ভিটেমাটি ও অভ্যস্ত জীবনযাত্রা থেকে উৎখাত, দেশভাগের ফলে হঠাৎ বিদেশ হয়ে যাওয়া স্বদেশ থেকে পলায়ণকারী, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তায় উদ্বিগ্ন, ধর্ষিত, লুন্ঠিত, আর্ত-বিপন্ন মানুষদের দেখে বিষাদগ্রস্ত নেহেরু বলেছিলেন, ‘the partition of the country brought many evils at its train…’ আধুনিক ভারত ইতিহাসে ভয়ংকরতম সর্বনাশের ঘটনা দেশভাগ। আর মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো গণ-দেশান্তর বা গণ-বাস্তুত্যাগের মূলে এই ঘটনা। ভাঙা বাংলার পশ্চিমখন্ডে জিয়ন কাঠির খোঁজে আসে পূর্বখন্ডের মহাপ্রস্থানের যাত্রীরা, আজও আসে…। “উদ্বাস্তু নারীদের জন্য কলিকাতায় মহিলাদের তত্ত্বাবধানে অনেকগুলি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল যেখানে আশ্রয়বাসিনী মহিলাদের হাতের কাজ শেখানো বা নানান বৃত্তিমূলক শিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছিল। এদের মধ্যে আনন্দ আশ্রম, নারী সেবা সংঘ, উদয় ভিলা ইন্ডাস্ট্রিয়াল হোম এবং অল বেঙ্গল উইমেন্স হোম উল্লেখযোগ্য। তবে এসবই ১৯৫০-৭০ এর পূর্বে উদ্বাস্তু আগমনের প্রথম ধাক্কা সামলাতে কাজ করেছিল। ১৯৭১ এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তি বা এই সময়ের গণহত্যার স্মৃতি বুকে নিয়ে যে বিশাল সংখ্যক পরিবার দেশত্যাগী হয়ে ভারতে চলে এসেছিলেন তার জন্য যথেষ্ট ছিল না। কলোনী গঠনের মধ্য দিয়ে ছিঁটেফোটা মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেওয়া বাংলাদেশী অভিবাসী পরিবারের নারীর এ ছিল আরেক নতুন লড়াইয়ের সূচনা। বামপন্থী সরকারের সহযোগিতা থাকলেও তাদের প্রতি বিরূপতাও ছিল। সেই দায় মাথায় নিয়েই এই ছিন্নমূল পরিবারগুলির নারীদের জীবনে নেমে এসেছিল বেদনার আলেখ্য। এর মধ্যে নমঃশূদ্র গরীব কৃষিজীবি পরিবারের মানুষেরা ছিলেন, ছিলেন আরও নানান পেশার মানুষ। শুরু হয়েছিল দিনরাত পরিশ্রম করে তাদের ভাগ্যজয়ের করুণ লড়াই। আর নিষ্ঠুর প্রতিকূলতার বিরূদ্ধে ঐ পরিবারগুলির নারীদের বা শিশুদের, বৃদ্ধবৃদ্ধাদের জন্য সামনে পড়ে ছিল এক অশ্রুসিক্ত ক্যানভাস যেখানে আঁচড় কাটলেও তা থাকে না, ধুয়ে যায় অশ্রুজলে। প্রফুল্ল চক্রবর্তীর ‘The Marginal Men, 1990’ ‘লুমিয়ের বুকস কলকাতা থেকে প্রকাশিত গ্রন্থে প্রান্তিক, ভিটেমাটি ছেড়ে আসা মানুষের অসহায়তার কথা সমানভাবে ফুটে উঠেছে।১৫ কিন্তু এইভাবে ইতিহাস চর্চায় রাজনীতি, যুদ্ধ, কুটনীতি, খলনীতি, বলনীতি ইত্যাদি নিয়ে পাতার পর পাতা গবেষণা হলেও নারী অভিবাসী জীবনে ১৯৭১ পরবর্তী বিস্তৃত আলোচনা বা মানবিক গবেষণা নেই। তাছাড়া কিভাবে নারী হয়েও অভিবাসী নারীরা কর্মক্ষেত্রে সীমাহীন বিপুল দায়দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তা গবেষণার পাদপ্রদীপের আলোয় তুলে আনা জরুরী।
১৯৭১ পরবর্তী বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে উদ্বাস্তু নারীদের অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে বা পরিবার সহ মিলিটারি জুন্টার অত্যাচার দ্বারা লাঞ্ছিত হয়ে, একপ্রকার বাধ্য হয়েই তাঁরা ভিটেমাটি ছাড়েন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণায় দেখা যায় বাংলাদেশে এমন অনেক পরিবার ছিলেন যাঁরা প্রায় দু-তিন’শ বিঘা জমির মালিক ছিলেন কিন্তু নিজেদের পরিবারের মান-সম্ভ্রম রক্ষা করতে প্রাণ নিয়ে কলকাতায় পালিয়ে আসেন এবং বর্তমানে মুদির দোকান করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তাছাড়া অভিবাসী এই মেয়েরা অনেকেই নারী শ্রমিক, রং মিস্ত্রী এবং বাড়ির কাজের আয়া হিসাবে প্রতিদিন রেলে চড়ে গ্রাম থেকে হাজার হাজার সংখ্যায় কলকাতায় চলে আসেন। শিয়ালদহ পূর্ব ও দক্ষিণ শাখায় বিভিন্ন ট্রেনগুলিতে তাঁদের অগণিত সংখ্যায় দেখা যাবে। অবশ্য শিক্ষা এবং চাকুরীতেও উদ্বাস্তু পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মের মহিলাদের অত্যন্ত কম সংখ্যায় হলেও দেখা যায়। যাই হোক, গ্রামীণ সমাজ ও শহুরে পৌরসমাজে তাদের ভূমিকা নগণ্য নয়, পাশাপাশি আর্থিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও তাঁদের বিপুল যোগদান আছে।
অভিবাসী মহিলাদের পশ্চিমবঙ্গের সমাজে অংশগ্রহণের ফলে নৃতাত্ত্বিক, সংখ্যাগত, ভাষাতাত্ত্বিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমারেখার একটা বড় অংশই এই অভিবাসনের সাক্ষী এবং বাংলাদেশ থেকে এসে পশ্চিমবঙ্গের একেবারে প্রান্তের জেলাগুলিতে এই মহিলাদের বেশি সংখ্যায় বাস করতে দেখা যায়। ‘A novel phenomenon of demographic pressure-emanating and larger in the border region.’ ‘… Emerging picture consequent upon the internal demographic changes in the state as well as various districts of West Bengal.’২১ তাই এক্ষেত্রে সংখ্যাগত জনতাত্ত্বিক বিবর্তন বা বর্ধন ও তার প্রভাব বিশেষ আলোচনার বিষয়। অন্যদিকে কৃষিক্ষেত্রে এই মহিলাদের একটা ব্যাপক অংশগ্রহণের ফলে পশ্চিমবঙ্গে কৃষিক্ষেত্রে উন্নতি চোখে পড়ে। এছাড়া বিভিন্ন শিল্পাঞ্চল এবং শহরের কারখানাগুলিতে এদের সস্তা শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে দেখা যায়। “In West Bengal 19.2% of the (total migrants workers) population are cultivators, 25% labourers, 7.4% engaged in household industries and 48.5% in the rest classified as others include plantation, livestock, forestry, fishing, hunting,…..hotels, transport storage, personal service activity, private households……..teritorial organisations and bodies.”১৭ গ্রামীণ ক্ষেত্রে নানান কুটির শিল্পের সঙ্গে যেমন – কাঁসার বাসন, বিড়ি শিল্প, তাঁত শিল্প, মাদুর, মোমবাতি শিল্প, কাঁথা শিল্প, গেঞ্জি কারখানা, কুমোরের কাজকর্ম ইত্যাদিতে অভিবাসী মহিলাদের সুনিবিড় যোগাযোগ পরিলক্ষিত হয়। পাশাপাশি তাঁদের চাষের কাজে অংশগ্রহণ, লোকশিল্পে অংশগ্রহণ, নারী সমবায়ে ভূমিকা নেওয়া আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। উপরন্তু আর্থিক ক্ষেত্রে তাঁদের এই যোগদানের ফলে নারী স্বনির্ভরতায় নতুন ধরণের দিশা দেখা যাচ্ছে। অভিবাসী মহিলারা কী ধরণের জীবন সংগ্রামে অভ্যস্ত তা মরিচঝাঁপিতে তাঁদের বাস্তু নির্মাণ ও পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার বিষয়টি থেকে অত্যন্ত স্পষ্ট। ‘নিজেদের শ্রমে দন্ডকারণ্যের নির্বাসন থেকে এসে স্বদেশের মাটির বুকে ঘর বেঁধেছিল যারা, স্কুল তৈরি করেছিল যারা,…..তাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে ফের নির্বাসনে পাঠানো।১৮ বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে যেখানেই উদ্বাস্তু উপনগরী গড়ে উঠেছে সেখানেই সামাজিক এবং আর্থিক ক্ষেত্রে মহিলাদের ব্যাপক ভূমিকা ছিল।
এই প্রেক্ষিতে মহিলা অভিবাসীদের বর্তমান মর্যাদা, পারিবারিক ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা এবং সামগ্রিকভাবে সমাজ ও পরিবারের তাঁদের প্রতি আচরণের বিশ্লেষণ করা দরকার। বাংলাদেশের ভিটেমাটি ছেড়ে এদেশে চলে আসা প্রাথমিকভাবে তাদের কাছে প্রচন্ড সমস্যার ছিল এবং সেই সমস্যা নিরসনে তাঁরা প্রশাসনিক ব্যবস্থা থেকে কিছুটা সুযোগ সুবিধা পেয়েছেন যা তাঁদের বিশেষ সাহস জুগিয়েছে। এছাড়াও অত্যন্ত দরিদ্র অভিবাসী পরিবারের মহিলারা পশ্চিমবঙ্গে যেমন বিভিন্ন ধরণের পেশা বেছে নিয়েছেন এবং তার নেতিবাচক দিকও আছে। কেননা, বিভিন্ন পাবলিক রিপোর্ট বা সংবাদপত্রগুলিতে মাঝে মাঝেই বাংলাদেশী নারী বা শিশুদের বিদেশে পাচার, মাদক দ্রব্য চোরাচালান, ভিক্ষাবৃত্তি বা হোটেল বা রেস্টুরেন্ট ইত্যাদিতে সুলভ শ্রমিক অথবা পতিতাবৃত্তির কাজে লাগানো হয় বলে প্রকাশিত হয়।
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে আমরা ঔপনিবেশিক আমলের নারী, উনিশ শতক ও বিশ শতকের নারী প্রশ্নের সেকাল একাল, ব্রিটিশ আমলে বিপ্লবী নারীদের কথা এবং আধুনিক কালে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে নারীরা কতটা সচেতন সেই নিয়ে আলোচনা দেখতে পাই। বামপন্থী বা ডানপন্থী নারী রাজনীতি, চা বাগানের মহিলা শ্রমিক এবং সংখ্যালঘু ও তপশিলী জাতি ও উপজাতির নারীদের নিয়ে বিভিন্ন সাবঅল্টার্ণ গোত্রের লেখাপত্র এবং গবেষণা ইত্যাদি দেখতে পাই। কিন্তু অভিবাসী নারীদের বর্তমান অবস্থান, মর্যাদা ও ভূমিকার বিষয়টি সামাজিক ক্ষেত্রে অনেকটাই অনালোচিত বা অবহেলিত থেকে যায়। বিশেষত বাংলাদেশের সংস্কৃতি যা তারা বহন করে এনেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বুকে সেই সংস্কৃতি পশ্চিমবাংলার সমাজে যেভাবে মিশে গেল তার ফলাফল বিস্তৃত এবং সুদূরপ্রসারী এ নিয়ে সন্দেহ নেই। এইভাবে ১৯৭১ পরবর্তী অভিবাসী নারীদের নিয়ে যে ইতিহাস পরিচিতির অভাব আছে বর্তমান প্রবন্ধ তার কিছুটা পূরণ করবে আশা করা যায়। তবে অভিবাসী মানুষদের নিয়ে গবেষণার প্রধান সমস্যা তথ্যের অপ্রতুলতা। বর্তমান NRC (National Register of Citizens) সমস্যা বা রোহিঙ্গা বলে দাগিয়ে দেওয়ার ভয়ে অভিবাসী পরিবারের মহিলারা আজকাল নিজের পূর্ব পরিচয় দিতে ভয় পান। কিন্তু মুখের কথার ওপর ভিত্তি করে অভিবাসী নারী সমাজের ইতিহাস লেখার ওপর জোর দিতে হবে। কারণ তা তথ্য ও যুক্তিনিষ্ঠ, অনেকক্ষেত্রেই প্রাথমিক eye witness.
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন যে, পশ্চিমবঙ্গে অভিবাসী মহিলা হিসাবে বাংলাদেশী হিন্দু, বৌদ্ধ-খৃস্টান এবং মুসলিম মহিলারাও এসেছেন। হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃস্টান পরিবারগুলোর অনেকেই forced migration এর শিকার। এই গরীব পরিবারের মহিলারা প্রধানত অর্থনৈতিক কারণ বা রুটি রুজির আশায় পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের অন্য প্রদেশগুলিতে আশ্রয় নিয়েছেন। যাই হোক, সামাজিক ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে এসে তাঁরা সুরক্ষিত বোধ করেন এবং মানসিকভাবে যে নিশ্চয়তা পেয়েছেন তার সদর্থক দিক আছে। সর্বোপরি শিক্ষাক্ষেত্রে এই অভিবাসী মহিলাদের অংশগ্রহণ এবং শিক্ষার হার বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের যে এলাকাগুলিতে মহিলা অভিবাসীদের হার বেশি যেমন – লালবাগ, ডোমকল, কল্যাণী, তেহট্ট এবং বিভিন্ন মহকুমা যেমন – বনগাঁ, বসিরহাট ইত্যাদি অংশের নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। যেহেতু নারীশিক্ষা নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এক প্রধান অবলম্বন তাই অভিবাসী নারীদের উন্নয়ন বা অবস্থার পর্যালোচনা করতে গিয়ে অভিবাসী নারীর শিক্ষাকে প্রধান ও বিশেষ গুরুত্ত্ব দেওয়া দরকার। আর এইভাবেই অভিবাসী নারী সমাজ ও তার পরবর্তী প্রজন্ম ক্রমশ পশ্চিমবঙ্গের মূল ধারায় মিশে যাবে। কেননা, বাংলাদেশের জনগণনায় (১৯৭১-২০০৯ পর্যন্ত) প্রায় ৮ মিলিয়ন জনসংখ্যাকে ‘মিসিং পপুলেশন’ হিসাবে দেখানো হয়েছে।১৯ আর পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার এই অভিবাসীদের আর নিজেদের নাগরিক বলে স্বীকার করেন না। তাই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এই মহিলা ও তাদের পরিবারবর্গ বর্তমানে আমাদেরই এবং এদের প্রতি পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতীয় জনসমাজ তাঁদের দায় এড়াতে পারে না। তাছাড়া মাইগ্রেশন বা অভিবাসী সমস্যা নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কেও নানান প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। উভয় দেশের বৈদেশিক মন্ত্রকের আলোচনা ক্ষেত্রে এই নিয়ে দীর্ঘ মতান্তর, চর্চা বা আলোচনার ইতিহাস আছে। ‘This tussle over the migrants at the border rapidly expanded into a full-scale diplomatic row between the two countries with India forcefully maintaing that the migrants had no right to stay in India permanently, while Bangladesh accused India of expelling Bengali speaking Indian Muslims in the name of Bangladeshi migrants.’২০
যেহেতু অভিবাসী মহিলারা প্রতিনিয়ত ভারতবর্ষের মানব সম্পদ উন্নয়নে এবং অর্থনৈতিক পরিকাঠামোয় তথা সামাজিক সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করেছেন তাই তাঁদের জনসমাজে আত্মীকরণের মাধ্যমে কিভাবে বিকাশ লাভ ঘটানো যেতে পারে সেদিকে জরুরী এবং মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দেওয়া ও মানবাধিকার তথা নারী অধিকারের চিরন্তন প্রশ্নগুলো নিয়ে আরও বিশদে ভাবা দরকার এবং তাঁদের স্বাস্থ্য, চিকিৎসা সহ আর্থিক, সামাজিক, বৈষয়িক সুরক্ষার দিকগুলো যথোপযুক্তভাবে নীতি প্রণয়ন করে সুনিশ্চিত করা প্রয়োজন।
সূত্র নির্দেশ
১। সেন্সাস অফ ইন্ডিয়া, ১৯৭১, মাইগ্রেশন টেবিল P(II)-D-(i), সেন্সাস অফ ইন্ডিয়া, ১৯৮১, মাইগ্রেশন টেবিল পার্ট V (A & B), সেন্সাস অফ ইন্ডিয়া, ১৯৯১, মাইগ্রেশন টেবিল, D-2, সেন্সাস অফ ইন্ডিয়া, ২০০১, ২০১১, মাইগ্রেশন টেবিল, D-2, জাতীয় জনসংখ্যা গণনাপঞ্জী, ভারত সরকার, নতুন দিল্লী। আরও দ্রষ্টব্য – সেন্সাস অফ ইন্ডিয়া ২০১১, (৩০শে এত্রিল ২০১৩) প্রাইমারি সেন্সাস এবস্ট্রাক্ট, ডেটা হাইলাইটস, ড. চন্দ্রমৌলি সি., রেজিস্ট্রার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া, মিনিষ্ট্রি অফ হোম এফেয়ার্স, নিউ দিল্লী, সংগম বুক ডিপো।
২। পান্ডে রেখা, (অগাষ্ট, ২০০৯), ফেমিনিজম এন্ড দ্য উইমেন্স মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া – এ হিস্টোরিক্যাল পারস্পেকটিভ, জার্ণাল অফ উইমেন্স স্টাডিজ, ভল্যুম ১, নং-১, ব্যাঙ্গালোর, পৃষ্ঠা ২২-৩৯।
৩। চ্যাটার্জী পার্থ, (১৯৯৩), দ্য নেশন এন্ড ইটস ফ্রাগমেন্টস, কলোনিয়াল এন্ড পোস্ট কলোনিয়াল হিস্ট্রিজ, ষষ্ঠ অধ্যায়- নেশন এন্ড ইটস উইমেন দ্রষ্টব্য, প্রিন্সটন ইউনিভারসিটি প্রেস, প্রিন্সটন, নিউ জার্সি, পৃষ্ঠা-১১৬-১৩২।
৪। লিডল জোয়ানা, যোশী রমা, (১৯৮৬), ডটারস অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স, জেন্ডার, কাস্ট এন্ড ক্লাস ইন ইন্ডিয়া, কালী ফর উইমেন, নিউ দিল্লী।
৫। সাংগারি কুমকুম, বেদ সুদেশ (১৯৮৯) সম্পাদিত, রিকাস্টিং উইমেন গ্রন্থে, চ্যাটার্জী পার্থ প্রবন্ধ (দ্রষ্টব্য) – দ্য ন্যাশনালিস্ট রেজ্যুল্যুশন অফ দ্য উইমেন্স কোয়েশ্চেন, কালী ফর উইমেন, নিউ দিল্লী।
৬। থারু সুশি, ললিতা কে. সম্পাদিত (১৯৯১) ওমেন রাইটিং ইন ইন্ডিয়া, খন্ড-১, ছশো খ্রীষ্টপূর্ব থেকে বর্তমান পর্যন্ত, ফেমিনিষ্ট প্রেস, সিটি ইউনিভারসিটি অফ নিউইয়র্ক, খন্ড-২, বিংশ শতক (১৯৯৩),ফেমিনিষ্ট প্রেস, নিউইয়র্ক, ইউ. এস. এ. আরও দ্রষ্টব্য, ললিতা কে. বসন্ত কান্নবিরন, মালকোটে রমা, মহেশ্বরী উমা, থারু শশী, শত্রুঘ্ন বিনা (১৯৮৯) উই ওয়্যার মেকিং হিস্ট্রীঃ উইমেন এন্ড তেলেঙ্গানা আপরাইসিং, জেড বুকস, লন্ডন।
৭। মুখার্জী এন. পার্থ (৯ই মার্চ ১৯৭৪), দ্য গ্রেট মাইগ্রেশন অফ ১৯৭১- ইকনমিক এন্ড পলিটিক্যাল উইকলি, খন্ড ৯, সংখ্যা-১০, পৃষ্ঠা ৩৯৯-৪০৮।
৮। ব্যানার্জী পলা ও বসু রায়চৌধুরী অনুসূয়া (২০১১), উইমেন ইন ইন্ডিয়ান বর্ডার ল্যান্ডস, নতুন দিল্লী, সেজ পাবলিকেশন, মুখবন্ধ ও প্রথম অধ্যায় দ্রষ্টব্য।
৯। কুমার অশোক (২০১১), বাংলাদেশী মাইগ্রেশন ইন সাউথ ২৪ পরগণা, ইউ.কে., এল.এ.পি. ল্যাম্বার্ট একাডেমিক পাবলিকেশন।
১০। আলেকজান্ডার ক্লেয়ার, চ্যাটার্জী জয়া, জলাইস অণু (২০১৬), দ্য বেঙ্গল ডায়াসপোরা রিথিংকিং মুসলিম মাইগ্রেশন, রুটলেজ কনটেম্পোরারি সাউথ এশিয়া সিরিজ, টেলর ও ফ্রান্সিস গ্রুপ রুটলেজ, U.K. ও নিউইয়র্ক থেকে একযোগে প্রকাশিত।
১১। ভট্টাচার্য্য হিরণ্য, (২০১৮), অপারশেন লেবনসরাম, ইল্লিগ্যাল মাইগ্রেশন ফ্রম বাংলাদেশ, তৃতীয় অধ্যায়, ট্রান্সবর্ডার ইনফিলট্রেশন দ্রষ্টব্য, ব্লুমসবেরি ইন্ডিয়া, নিউ দিল্লী, পৃষ্ঠা ৩৪-৩৭।
১২। চক্রবর্তী পৌলমী (২০১৮), দ্য রিফিউজি উইমেন, নিউ দিল্লী, অক্সফোর্ড ইউনির্ভাসিটি প্রেস, দিল্লী।
১৩। সেন মণিকুন্তলা (Bengali year ১৩৫৯, ২৩শে শ্রাবণ), সেদিনের কথা, দ্রষ্টব্য অংশ- দ্বিখন্ডিত দেশঃ বাস্তুহারার মিছিল, নবপত্র প্রকাশন, কলকাতা, পৃষ্ঠা ১৮১-১৮৪।
১৪। সিংহ তুষার, (১৯৯৯), মরণজয়ী সংগ্রামে বাস্তুহারা, দাশগুপ্তা পাবলিকেশন, কলকাতা, পৃষ্ঠা-২৩।
১৫। বন্দ্যোপাধ্যায় হিরন্ময় (২০২৩, ফেব্রুয়ারী) বর্ধিত দীপ সংস্করণ, দীপ প্রকাশন, কলকাতা।
১৬। প্রামাণিক বিমল (অক্টোবর, ২০০৫), এনডেঞ্জার ডেমোগ্রাফি, নেচার এন্ড ইম্প্যাক্ট অফ ডেমোগ্রাফি চেঞ্জেস ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল, ১৯৫১-২০০১, কলকাতা পত্রলেখা, পৃষ্ঠা ৭-২২ ও ২৪-৬০; চক্রবর্তী বিপ্লব (২০১৭), ‘হাবড়ার আঞ্চলিক ইতিহাস ও উদ্বাস্তু মানুষের জীবন সংস্কৃতি, তৃতীয় খন্ড, চতুর্থ বর্ষ, পৃষ্ঠা-১৯, পশ্চিমবঙ্গ আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র।
১৭। ভদ্ররায় কস্তুরী (সেপ্টেম্বর ২০১৮), অয়ার্ক অফ ফিমেল মাইগ্রান্টস ফ্রম বাংলাদেশ ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল এন্ড ওড়িশা, অর্থবীক্ষণ, পর্ব ২৭, নং-২, পৃষ্ঠা ৬৫-৭৭, এছাড়াও দ্রষ্টব্য, ভদ্ররায় কস্তুরী, (২০১৪), Status of Women Migrants from Bangladesh to West Bengal and Orissa, স্মৃতি পাবলিকেশন, কলকাতা ।
১৮। পাল মধুময় (সম্পাদিত) (২০১০), দেশভাগঃ বিনাশ ও বিনির্মাণ, কলকাতা, গাংচিল পাবলিকেশনস, পাল মধুময় (সম্পাদিত) (২০১১), মরিচঝাঁপি, ছিন্ন দেশ, ছিন্ন ইতিহাস, কলকাতা, গাংচিল পাবলিকেশনস, এছাড়াও দ্রষ্টব্য, ঘোষ সেমন্তী (সম্পাদিত) (২০০৮), দেশভাগঃ স্মৃতি ও স্তব্ধতা, কলকাতা, গাংচিল পাবলিকেশনস।
১৯। প্রামাণিক বিমল (২০০৫), মুক্ত বাংলাদেশঃ রুদ্ধ বাংলাদেশ (জীবনের স্মৃতিকথা), ২০০৫, কলকাতা পত্রলেখা।
২০। কুমার চিরন্তন (জানুয়ারী, ২০০৯), মাইগ্রেশন এন্ড রিফিউজি ইস্যু বিটুইন ইন্ডিয়া এন্ড বাংলাদেশ, স্কলারস ভয়েস, এ নিউ ওয়ে অফ থিংকিং, ভল্যুম-১, নং-১, সেন্টার ফর ডিফেন্স স্টাডিজ রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট, পৃষ্ঠা ৬৪-৮২।
লেখক পরিচিতি
ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় স্যার রবার্ট মে ও স্রার ফেলিক্স কেরী প্রতিষ্ঠিত লন্ডন মিশনারী সোসাইটি বয়েজ হাইস্কুলের (১৮৩৭) একজন কৃতি প্রাক্তনী। ১৯৯৫-৯৬ সালে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন পর্ষদের থেকে প্রাইমারি ফাইনাল এক্সামিনেশন পরীক্ষায় ৮১ শতাংশ নম্বর সহ উত্তীর্ণ হয়ে তিনি উক্ত প্রতিষ্ঠানে পড়তে আসেন। স্কুলস্তর থেকেই জাতীয় বিজ্ঞান পরিষদের ট্যালেন্ট সার্চ, একাডেমিক সায়েন্স কালচার ও প্রমোশন সোসাইটি ও বঙ্গীয় ভূগোল মঞ্চের নানান ট্যালেন্ট হান্টে অংশ নিয়েছেন। ICCE (মুম্বাই) কর্তৃক Green Revolution Global Programme এ অংশ নিয়ে তাঁর ‘A’ স্কোর প্রাপ্ত একটি শংসাপত্র রয়েছে। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম। দক্ষিন ও দক্ষিন পূর্ব এশিয় ইতিহাস চর্চায় তাঁর আরেকটি M.A. ডিগ্রি রয়েছে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পররাষ্ট্রনীতি চর্চা বিষয়ে সাম্মানিক ফেলোশিপসহ ২০১৫ সালে এম. ফিল গবেষণা সমাপ্ত করেছেন। কলকাতার সেন্টার ফর রিসার্চ ইন ইন্দো-বাংলাদেশ রিলেশনস নামক প্রতিষ্ঠানে গবেষণা শিক্ষা নিয়েছেন এবং দশ বছর ধরে যুক্ত রয়েছেন। বর্তমানে সাবিত্রী গার্লস কলেজে শিক্ষক হিসাবে কর্মরত আছেন। তিনি ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেসের সদস্য এবং পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদের আজীবন সভ্য। ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসের প্লাটিনাম জুবিলি সেশনে (JNU) প্রতিনিধি হিসাবে অংশ নিয়েছেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসের আর একটি অধিবেশনে গবেষণাপত্র পাঠ করেছেন। অংশ নিয়েছেন রাজ্য, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের নানান সেমিনার, কনফারেন্স, ওয়েবনার ও ওয়ার্কশপে। বক্তৃতা দিয়েছেন এবং গবেষণা প্রবন্ধ পাঠ করেছেন যার বেশির ভাগই প্রকাশিত। কবিতা লিখতে ভালোবাসেন। অবসরে পুরানো বই সংগ্রহ, পুরাণ, নারী ইতিহাস ও আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা, নানান ধরণের থিয়েটার ও ইতিহাসমূলক চলচিত্র দেখতে ও ঐতিহাসিক স্থানে বেড়াতে ভালোবাসেন। তিনি Centre for Research in Indo-Bangladesh Relations নামক প্রতিষ্ঠানে একজন আর্টিকল কন্ট্রিবিউটর। গত ৩০ বছর ধরে তিনি নানান উদ্বাস্তু তথা অভিবাসী পরিবারগুলিকে কাছ থেকে দেখেছেন এবং বোঝার চেষ্টা করেছেন। বর্তমান গবেষণা প্রবন্ধটি তারই সংক্ষিপ্ত ফসল।
Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo.
Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo.