বিমল প্রামাণিক
বাংলাদেশে একটি প্রায় পরিমিত আর্থ-সামাজিত স্থিতাবস্থা বিরাজ করলেও কখনও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কোন শাসকের আমলেই ছিল না। ফলে গণতন্ত্রের চর্চা এবং বিকাশের পরিবেশ, পরিস্থিতি অনুকুল ছিল না। একথা বলতে দ্বিধা নাই যে, পাকিস্তানের চব্বিশ বছরে গণতন্ত্রের ভিত গড়ার কোন চেষ্টা হয়নি। অবশ্য দুনিয়ার কোন ইসলামি রাষ্ট্রেই গণতন্ত্রের নজির নাই।
স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি সংবিধান তৈরি হলেও—অঙ্কুরেই তা বিনষ্ট করা হয়। শুধু তাই নয়, মাত্র সাড়ে তিন বছরে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নেতৃবৃন্দকে সামরিক অভ্যূথানের মাধ্যমে নৃসংশভাবে হত্যা করা হয়। তখন থেকেই এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে বাংলাদেশটিও পাকিস্তানি ধারায়ই চলবে। সামরিকতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, গণতন্ত্রের নামে প্রহসন যা পাকিস্তানি পরম্পরা। কিন্তু বাংলাদেশের অদূরদর্শী বাম ও গণতান্ত্রিক ধারার বুদ্ধিজীবীগণ স্রোতের বিপরীতে নৌকা বাইতে রাজনৈতিক-কর্মী-নেতাদের বার বার গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, যার পিছনের ভোঁতা যুক্তির জাল ফাঁসতে বেশি সময় লাগেনি। ফলে, স্বাধীন বাংলাদেশ পঞ্চাশ বছর অতিক্রম করলেও গণতন্ত্রের আকাঙ্খা জনগণের পূর্ণ হয় নাই। বাংলাদেশের জনগণ ‘গণতন্ত্র’ একটি ইসলামিক দেশে সম্ভব নয় – একথা অনুধাবন করতে পারলেও – তারা ‘মনের উপর চোখ ঠেরে’ অকপটে স্বীকার করে না। তারা ভাবে ভারতে গণতন্ত্র থাকতে পারলে কেন আমাদের দেশে থাকবে না। অত্যধিক মুসলিম সংখ্যাধিক্য দেশের চিন্তার দৈন্যাবস্থার প্রধান কারণ বাঙালি হলেও ধর্মীয় বিভাজনে মুসলমান ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী এমন একটি ইসলামি নেতৃগোষ্ঠী দ্বারা প্রভাবিত ও চালিত হচ্ছে—যেখানে জাতিসত্তার উপরে ধর্মীয় পরিচয়কে স্থান দেওয়া হয়েছে। ফল হয়েছে, ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগোত্তরকালে বাঙালি মুসলমান সমাজে বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশ না হয়ে ইসলাম ধর্মের অক্টোপাস তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। এই অসহায় বাঙালি জনগোষ্ঠীর সামনে আজ আর কোন মুক্তিদূতের দেখা মিলছে না। তাদের হিন্দু-বিদ্বেষের আফিম দিয়ে মোহগ্রস্ত করে ফেলা হয়েছে – যা গত শতাব্দীর তিরিশ-চল্লিশের দশক থেকেই সক্রিয়ভাবে শুরু হয়েছিল। ধর্মীয় রাষ্ট্র কাঠামোয় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রকৃত অর্থেই কোন বিশেষ মূল্য পায় না। দেশবিভাগ পরবর্তী পাকিস্তানের চব্বিশ বছরের শাসনে পূর্ববঙ্গের অধিবাসীবৃন্দ মর্মে মর্মে এটা উপলব্ধি করেছিল। পূর্ববঙ্গে তথা বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অঙ্গনে জাতি পরিচয় ছাপিয়ে ধর্মীয় পরিচয় বাঙালি মুসলমান সমাজকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে যে – তারা আর তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না।
মুসলমান সমাজে বাঙালি জাতিসত্তাবোধ গভীরে প্রবেশ না করায় বাঙালি জাতিরাষ্ট্র গঠনে যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব, ১৯৭২ সালেই তা সামনে এসেছিল, ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তন তা চিরতরে অবসান ঘটিয়েছে বললেও অত্যুক্তি হবে না। একবার পিছনে ফিরে দেখা যাক। মুসলিম লিগ ১৯৪০ সালে পৃথক ও স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টির দাবিতে ‘লাহোর প্রস্তাব’ পাশ করে। দীর্ঘকাল অমুসলিমদের উপর বর্বরতাপূর্ণ মহাশক্তিধর প্রভুত্ব খাটানো মুসলিমদের ঐতিহাসিক আত্মগর্ব তাদেরকে স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ যুক্তভারতে একটা সংখ্যালঘু জাতি অথচ সমঅধিকারপ্রাপ্ত নাগরিক হওয়ার পরিণাম বহন করতে দিল না। তারা একটা পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সূচনা করে নির্মম সহিংসতা শুরু করে দেয়, যা ব্রিটিশদের উপলব্ধি করায় যে, হিন্দু ও মুসলিমরা একত্রে বাস করতে পারবে না। এ পরিস্থিতিই পরিণামে ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভক্তি ঘটায়। আনোয়ার শেখ মনে করেন, ইসলাম মৌলিকভাবে নিজেই বিভক্তি ও শাসনের একটা মতবাদ এবং ইসলামের এ ‘বিভক্তি ও শাসন’ মতবাদই ভারতের বিভক্তির জন্য দায়ী, ব্রিটিশদের বিভক্তিমূলক নীতি নয়। তিনি লিখেছে … “ কিন্তু যে ক্ষত সৃষ্টি করেছিল তাদের (ইসলামিক হানাদারদের) আদর্শ অর্থাৎ ইসলাম, যা তাদেরকে ভারতে বয়ে এনেছিল, তা স্মৃতি থেকে মোছা যাবে না, কেননা নিরাময়ের পরিবর্তে সে আঘাত একটা নিরাময়-অযোগ্য বিষ ফোঁড়ায় পরিণত হয়েছিল। যদিও সব মুসলিমের ৯৫ শতাংশই মূল জনসংখ্যা থেকে আসা, আর অবশিষ্ট মাত্র পাঁচ ভাগও শতশত বছর স্থায়ীভাবে বসবাস করার সূত্রে ভারতীয় হিসেবেই স্বীকৃতি প্রাপ্ত, তথাপি তারা সবাই মিলে নিজাদেরকে একটা পৃথক মুসলিম জাতি মনে করেছিল – এ বিশ্বাসে যে, তাদের জন্মভূমি একটা ‘দ্বার-উল-হার্ব’ বা ‘যুদ্ধক্ষেত্র’। এ অন্যায় মতাদর্শটি ভারতের বিভক্তির কারণ ছিল। আরবরা (আরব হানাদাররা) নিজেরা যা করতে ব্যর্থ হয়েছে, আরবীয় ‘বিভক্তি ও শাসন’ মতবাদটি তা করে দেয় তাদের জন্য”১
আবুল মনসুর আহমদ ১৯৭২-এ লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশ আসলে পাকিস্তানেরই সত্যতর রূপায়ণ’। অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালি মুসলমানের জাতিসত্তা বা বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তার প্রধান অন্তরায় ‘ইসলাম’। দ্বিজাতি- তত্ত্বের ভূত যা পাকিস্তানের জন্ম ও ভারত বিভক্তির প্রধান ভূমিকায় দেখা গেল, আজ দেশবিভাগোত্তর পঁচাত্তর বছর পেরিয়ে এসে সেই ভূত বাঙালি মুসলমানদের কাঁধে আরও চেপে বসেছে। কোরান, সুন্নত ও শরিয়ার বাঁধন শিথিল না হলে বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশ কখনও সম্ভব নয়। ইসলাম এবং জাতিসত্তা পরস্পর সাঙ্ঘর্ষিক। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী গবেষকগণ হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক বিষয়ক যে মতামত ব্যক্ত করেছেন এবং বাঙালি উদ্ধৃত করা হলঃ
“ The attitude of Muslims towards the minorities in fully influenced by the tenets of Islam. The tenets and practices of other religions are compared with that of Islam – and in the process, it is established now Islam as a religion is superior to other religions. The superiority is rationalized
Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo.
Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo.