Center For Research In Indo

বাংলাদেশে  ইসলামী মৌলবাদী অক্টোপাশে মতুয়া নারী সমাজ

Dr. Kakoli Sarkar

মতুয়া সমাজ বাংলাদেশে হিন্দুবিচ্ছিন্ন কোন অংশ হিসেবে পরিগণিত হয় না। বাংলাদেশে যে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় আছে মতুয়া সম্প্রদায় তার অংশ হিসাবেই পরিগণিত হয়। আমরা যদি সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে হিসাব করি তাহলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সবথেকে বড় অংশ এই মতুয়া সম্প্রদায়। বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান হিন্দু নির্যাতনের ধারাবাহিকতায় মতুয়া সম্প্রদায়ের দিকে একটু নজর দিলে আমরা দেখতে পাই এদের যন্ত্রণা সর্বাপেক্ষা অধিক। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের তুলনায় এদের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। একদিকে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন আর অন্যদিকে জীবিকার প্রয়োজনে লড়াই– এ দুইয়ের মাঝে পরে তারা এক অসম্ভব যন্ত্রণা ভোগ করে। বিষয়টিকে পরিষ্কার করার জন্য ২০১৮ সালের একটি ঘটনার কথা বলি।

        ২০১৮ সালে ২৩ শে আগস্ট কোরবানি ঈদের পরের দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পাইকপাড়ায় এক হিন্দু মহিলাকে নির্যাতন করা হয়। সেই মহিলা এক মুসলমানের বাড়িতে কাজ করতো। কোরবানি ঈদের দিন সেই মুসলমানের বাড়িতে গরু কোরবানি হবে। সেই কারণে ওই মহিলা ওই মুসলমান বাড়ির গৃহকর্তীকে বলেন যে, তিনি কোরবানি ঈদের দিন কাজে আসবেন না। যথারীতি কোরবানি ঈদের দিন তিনি কাজে যাননি। কোরবানি ঈদের পরদিন ওই মুসলমান বাড়ি থেকে গৃহকর্তির ছেলে ওই মহিলার বাড়িতে চড়াও হয়ে তাকে ভীষণভাবে মারধর করে এবং বাড়িঘর পুড়িয়ে দেবার জন্য পেট্রোল ঢেলে দেয়।

        এইরকম ঘটনার সম্ভাবনার কারণে বাংলাদেশে কোনো হিন্দু মহিলা অতি বাধ্য না হলে মুসলমানের বাড়িতে কাজ করতে যায় না। যেসব হিন্দুর একটু আর্থিক অবস্থা ভালো তারা কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশে মুসলমানের বাড়িতে কাজ করে না। তাছাড়া বাংলাদেশে মুসলমান ধর্মের অধিকাংশই বিশ্বাস করে যে, কোনো হিন্দু মেয়েকে মুসলমান ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে পারলে তারা প্রভূত পুণ্য অর্জন করবে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ওই মহিলা নিতান্ত জীবনের প্রয়োজনে ওই কাজ করতেন। মতুয়াদের সব থেকে বড় সমস্যা এখানে যে, তারা কেবল সংখ্যালঘুই নয় বরং অতি দরিদ্রও বটে।

        ইতিহাসের দিকে একটু দৃষ্টি দিলে আমরা দেখব যে বর্ণবাদের ধোঁয়া তুলে হিন্দু সমাজের পিছিয়ে রাখা (পতিত) মানুষগুলোর মধ্যে মতুয়া ধর্ম মতের প্রচার এবং প্রসার ঘটেছিল। শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর এবং তাঁর সহধর্মিনী শান্তি মাতা দেবী এই পিছিয়ে পরা মানুষগুলিকে সর্বপ্রথম একত্রিত করে একটি সঠিক জীবন দর্শন দিয়েছিলেন। শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের সাথে সাথে শান্তি মাতার অবদান অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, কেননা মতুয়া হিসেবে চিহ্নিতকরণের প্রধান দুটি উপকরণ, মতুয়ার গলার করঙ্গের মালা এবং হাতের লাঠি (ছরি)– দুটিই শান্তিমাতার দান। তিনি ভক্তদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতেন। লক্ষ্য করলে দেখা যায় এই ধর্ম মতের শুরু থেকেই নারীকে পুরুষের সমশক্তি হিসেবে স্থান দেওয়া হয়েছে। শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর শিষ্যদের নির্দেশ দিয়েছেন নাম সংকীর্তনে অথবা ধর্ম আলোচনার ক্ষেত্রে স্ত্রীকে সাথে নিয়ে আসতে হবে। এই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখি, এই ধর্ম মতে মহিলাদের নেতৃত্বে নাম সংকীর্তনের দল, মহিলা ধর্ম প্রচারক তথা গুরু। এইরকমই একজন গুরু ছিলেন স্বর্ণলতা দেবী, যিনি বরিশাল জেলার বানারীপাড়া থানার অন্তর্গত ব্রাহ্মণবাড়ী গ্রামে বাস করতেন। তাঁর প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের দক্ষিণে মতুয়া ধর্মের ব্যাপক প্রচার এবং প্রসার ঘটে। মৃত্যুকালে তিনি বহু সংখ্যক শিষ্য এবং ভক্ত রেখে গেছেন। একমাত্র মতুয়া ধর্ম মতের মধ্যেই আমরা নারীদের ব্যাপকভাবে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নাম সংকীর্তনে অংশগ্রহণ করতে দেখি এবং নাম সংকীর্তনে পুরুষদের পাশাপাশি তাঁরাও মাতাম (সাময়িক সমাধি) দেন। নারীদের এই আধিপত্য এই ধর্ম মতের প্রথম থেকেই ছিল। পিছিয়ে পরা সম্প্রদায়, যাদের মধ্যে এই ধর্ম মতের প্রচার এবং প্রসার তাদের মহিলারা প্রথম থেকেই জীবনের প্রয়োজনে যেমন ঘরের কাজ করতো, তেমনি স্বামীদের সাথে বাইরের কাজও করতে যেত। যেমন, ধান কাটার কাজে সাহায্য করা, বাজার–ঘাট করা প্রভৃতি। তখন উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুরা এইসব মহিলাদের নিচু চোখে দেখত এবং এখনো উঁচু শ্রেণীর হিন্দুরা এবং তার সাথে সাথে মুসলমানরাও বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে কীর্তন করা সহ বহুমুখী কাজ করার জন্য মতুয়া সমাজের মহিলাদের নিচু হিসেবে চিহ্নিত করে। শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর এবং তাঁর শিষ্যগন এই সমাজের জন্য ইংরেজদের শাসনকালে বহু স্কুল তৈরি করেছিলেন ইংরেজ শাসকের সহায়তায়। সেই সময় গুরুচাঁদ ঠাকুর মহিলাদের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ মূলক শিক্ষারও ব্যবস্থা করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল ইংরেজরা ভারত ছেড়ে চলে যাবার পর পাকিস্তান সরকার তার বেশিরভাগ স্কুলই বন্ধ করে দেয়। গুরুচাঁদ ঠাকুরের প্রচেষ্টায় ইংরেজ সরকারের নিকট থেকে বাংলার পিছিয়ে পড়া ৩৬ টি জনজাতির জন্য তিনি যে সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করেছিলেন, পাকিস্তান সরকারের শুরু থেকে সেটাও বন্ধ হয়ে যায়, যদিও ভারতবর্ষে এই সংরক্ষণ ব্যবস্থা ডঃ আম্বেদকরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সাংবিধানিক রূপ নেয়। ফলে বাংলাদেশে এরা আবার সেই তিমিরেই নিমজ্জিত হয়। বাংলাদেশে যে কটি জেলাতে তুলনামূলকভাবে মতুয়ারা বেশি সংখ্যায় আছে তার মধ্যে অন্যতম হলো বরিশাল, গোপালগঞ্জ, খুলনা, যশোর, পিরোজপুর প্রভৃতি। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এই সকল জেলাগুলিতে হিন্দু নির্যাতন বেশি পরিমাণে হয়।

       মতুয়ারা তাদের ধর্মের অংশ হিসেবে বিদ্যাশিক্ষাকে অপরিহার্য মনে করে। শিক্ষিত হবার প্রবণতা যেহেতু এদের মধ্যে বেশি তাই নির্যাতনের একটি অংশ হিসাবে বাংলাদেশে মৌলবাদী মুসলমানরা স্কুল-কলেজ গুলোকে বেছে নিয়েছে। গত ১২ ই সেপ্টেম্বর বরিশাল জেলার পিরোজ পুরের নেসারাবাদ উপজেলায় কামারকাঠি বালিকা বিদ্যালয়ে কাকলি রানী নামে এই সম্প্রদায়ের একজন শিক্ষিকাকে লাঞ্ছিত করা হয়। কাকলি রানীর বিরুদ্ধেঅ গুজব ছড়ানো হয় যে, তিনি ক্লাসে হিজাব পড়ার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন এবং মোহাম্মদের চরিত্র নিয়ে বাজে কথা বলেছেন। যদিও বাস্তবে তিনি এসব কিছুই করেননি। তিনি অত্যন্ত সহজ সরল একজন মানুষ। চক্রান্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে গুজব ছড়িয়ে তাঁকে এলাকাছাড়া করা হয়। আর এই কাজ যিনি করেন তিনি হলেন ওই এলাকার জলাবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তহিদুল ইসলাম তৌহিদ। জলাবাড়ি ইউনিয়নের বেশিরভাগ মানুষ হিন্দু তথা মতুয়া ধর্মাবলম্বী। বর্তমান ইউনিয়ন চেয়ারম্যান তৌহিদ একজন দুষ্কৃতিকারী, যিনি নির্বাচনের দিন প্রাক্তন চেয়ারম্যান আশীষ বরালকে কুপিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে জয়ী হয়। এই চেয়ারম্যান এবং তার দোসর মৌলবাদীদের প্রচেষ্টায় সাবেক স্বরূপকাঠি উপজেলার নামকরণ করা হয় রাজাকার নাসিরুদ্দিনের নামে নাসারাবাদ। জলাবাড়ি ইউনিয়নটি এই নাসারাবাদ উপজেলার অন্তর্গত। বলাই বাহুল্য এখানে কাকলি দেবীর মত মহিলারা বিদ্যা শিক্ষাদানের পরিবর্তে পালিয়ে জীবন বাঁচান। যেখানে সরকারের কোন দায় নেই হিন্দু মহিলাদের নিরাপত্তা দানের সেখানে হিন্দু মহিলারা অগ্নিকুণ্ডুর উপরে অবস্থান করবেন এটাই স্বাভাবিক।

         ২০২০ সালের ৩০ শে ডিসেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের পক্ষ থেকে মহাসচিব গোবিন্দচন্দ্র প্রামাণিক বলেন ২০২০ সালে বাংলাদেশে ৩৭ জুন হিন্দু নারী ধর্ষণের শিকার হয়, ১১ জনকে গণধর্ষণ করা হয়, ৫ জনকে ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয় এবং ২৪ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়, ২০০০ এর বেশি ধর্মান্তরিত করা হয়। এই সংখ্যাটা ২০২১ সালে আরও বেড়েছে বলাই বাহুল্য।

         বাংলাদেশে মৌলবাদী মুসলমানরা যখন হিন্দু নারীদের যৌন নির্যাতন করে তখন কোনো গোত্র বা বর্ণ দেখে তা করেনা, বরং হিন্দুদের প্রতি বিদ্বেষ বসতই তাদের মহিলাদের লাঞ্ছিত করে। শুধু মৌলবাদী মুসলমান পুরুষদের কাছেই এরা লাঞ্ছিত হয় না, বরং মৌলবাদী মুসলমান মহিলারাও এই লাঞ্ছনা কর্মে সমানে যোগ দেয়। গত ১৯ এ সেপ্টেম্বর মাধ্যমিক বোর্ড পরীক্ষা চলাকালে নরসিংদী সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে বিবাহিতা হিন্দু পরীক্ষার্থীদের শাখা সিঁদুরসহ পরীক্ষার হলে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। ওই স্কুলের হিজাব পরিহিতা একজন শিক্ষিকা হিন্দু মেয়েদের নির্দেশ দেয় শাখা ভেঙে, সিঁদুর মুছে পরীক্ষার হলে ঢুকতে নতুবা তাদের পরীক্ষার হলে ঢুকতে দেওয়া হবে না। হিজাব পরিহিতা ওই শিক্ষিকা কমপক্ষে পাঁচ জন মেয়েকে আধ ঘন্টার বেশি সময় ধরে আটকে রেখে শাখা ভাঙতে এবং সিঁদুর মুছতে বাধ্য করে। এই ঘটনার কারণে ওই শিক্ষিকার কোনো বিচার তো দূরের কথা, তিরস্কার পর্যন্ত করা হয়নি। এইভাবে সরকারের অবহেলা এবং অনিচ্ছার কারণে হিন্দু মেয়েদের জীবন ক্রমেই বিভীষিকাময় হয়ে যাচ্ছে।

          চলতি বছরে আমরা লক্ষ্য করেছি যে, মতুয়াদের মূল কেন্দ্র ওড়াকান্দীতে ঠাকুর হরিচাঁদের জন্মতিথি এবং বারুণী স্নান উপলক্ষে মতুয়ারা পুরুষ এবং নারী নির্বিশেষে যথেষ্ট উদ্দীপনার সঙ্গে সেখানে উৎসব পালন করেছে। সম্ভবত এর একটি কারণ এই যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদিজি বাংলাদেশ ভ্রমণের অংশ হিসাবে ওড়াকান্দিতে গিয়েছিলেন এবং হাসিনা সরকার তার ফলে ওড়াকান্দীকে খানিকটা হলেও গুরুত্ব দিয়ে উৎসবের নিরাপত্তার ব্যাপারে সক্রিয় হয়েছিলেন। কিন্তু এই শুভ প্রয়াসটি ছাড়া বাংলাদেশ সরকারের হিন্দুদের নিরাপত্তার প্রতি আর কোনো দায় আছে বলে মনে হয় না। লাঞ্ছিত হিন্দু মহিলারা থানায় নালিশ জানাতে গেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের আবেদন গ্রহণ করা হয় না। তাছাড়া অনেক হিন্দু মহিলা ভয়ে এবং লজ্জায় নিজেদের লাঞ্ছিত হবার কথা প্রকাশ করেন না। মৌলবাদী মুসলমান পুরুষদের কাছে হিন্দু নারী ভোগের সামগ্রী। বাংলাদেশ সরকারের চোখবন্ধ নীতির কারণে এই ইসলামী মৌলবাদীর সংখ্যা পূর্বের তুলনায় বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। হিন্দু মহিলা নির্যাতন বাংলাদেশে এখন একটি বিচারহীন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

CRIBR BULLETIN VOLUME (I), ISSUE 1, NOV 2022

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *