বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত ও দুর্বলতা
পূর্ণিমা নস্কর পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলনের পর থেকে নানা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তির প্রসার ও বিকাশ ঘটতে থাকে লক্ষণীয়ভাবে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ববঙ্গের পরিসীমায় বাঙালির বিকাশের প্রশ্ন যখন সামনে চলে এলো, তখন এদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের বিকাশে মূল প্রতিবন্ধক হিসাবে দেখা দিল পাকিস্তানি শাসকশ্রেণি। সে সময় নবপর্যায়ে এদেশে বাঙালি জাতীয়াবাদের উন্মেষের সম্ভাবনা তৈরী হল । সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই ধারার বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। শাসকশ্রেণির সকল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, রবীন্দ্রনাথ বর্জনের সরকারী প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে দেশবাসীর প্রতিরোধের কথা উল্লেখ করা যায় । এ প্রসঙ্গে আরো একটি কথা মনে রাখা দরকার, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও চেতনার ধারা সামনে আনার চেষ্টা হলেও সমস্ত আন্দোলনের গতিপথে দ্বি-জাতিতত্তেবর ব্যাপারটিকে কোন সময়ই সরাসরি আক্রমণ করা হয়নি। এব্যাপারে যা প্রশ্ন তোলা হয়েছে তা সবই হয়েছে পরোক্ষভাবে। দ্বিজাতিতত্তেবর ও পাকিস্তানের গঠন কাঠামোর কৃত্রিমতর ব্যাপারটি কখনই সামনে তুলে আনা হয়নি। অথচ জাতীয়তাবাদের চেতনার বিকাশে এই বিষয়টির প্রয়োজন ছিল খুবই বেশি। ভাষা আন্দোলনসহ পাকিস্তানি সরকারের দমন পীড়নের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকশিত হয়েছিল এর প্রভাব রাজনীতিতেও দেখা গেল। ১৯৫৫ সালের ২১ থেকে ২৩শে অক্টোবর পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামি মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। পূর্ববঙ্গে বাঙালিদের আশ্বস্ত করার লক্ষ্যে ১৯৫৫ সালের ৩রা ডিসেম্বর ঢাকায় বাংলা অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই দুইটি ঘটনা থেকে একথা অনুধাবন করতে কষ্ট হয় না যে, সংখ্যাগরিষ্ট বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে ভাষা/জাতি (সম্প্রদায়) ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের যে সূচনা ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছিল তা রাজনীতি, সমাজ ও শিক্ষাঙ্গনেও দেখা যেতে লাগল। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৯৫৫ সালের ১৪ই অক্টোবর ‘পূর্ব বাংলার’ নাম পরিবর্তন করে পাকিস্তান সরকার ‘পূর্ব পাকিস্তান’ করে দিল। পাকিস্তানের পক্ষে জনজাগরণের মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে এই সকল ঘটনা মোটেই গ্রহণযোগ্য ছিল না, বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের ধারাটি তার সফলতা ও দুর্বলতা দুইয়ের ভিত্তিতে অনুধাবন করতে গেলে এই বিশেষত্বটি উপলব্ধি করতে হবে। ১৯৪৮ সাল থেকে যে সত্যটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও পরবর্তীকালে ব্যাপক সংখ্যক মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল, তা হল, পাকিস্তানি শাসনে বাঙালি জাতির স্বাধীন চেতনা বিকাশের পথ মোটেই কুসুমাস্তীর্ন নয়। পাকিস্তানি শাসকদের শাসনের স্বরূপ ছিল ঔপনিবেশিক ধরণের। এদেশ থেকে সম্পদ পাচার, পশ্চাদপদতা অব্যহত রাখা এবং এদেশটাকে নিজেদের বাজার হিসাবে ব্যবহার করা ছাড়াও পাকিস্তানি শাসকশ্রেণি ভাষা ও সংস্কৃতির উপর আক্রমণ করে এবং জাতীয়তাবাদের বিকাশকে রুদ্ধ করা তাদের প্রাথমিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। বস্তুত, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল ভাষা সংস্কৃতির বিকাশ। এই পর্বের বিকাশকে জাতীয় অধিকার ও গণতন্ত্রের দাবিতে সংগ্রাম থেকে বিছিন্ন করে দেখা সম্ভব নয়। আসলে একুশের সর্বদলীয় ভাষা আন্দোলনে ছিল একাধিক মতাদর্শের সমাহার। তবুও তার মুখ্য চরিত্র ছিল জাতীয়তাবাদ ও প্রগতিশীলতা। এর সুপ্রভাব পড়ে সাহিত্যে, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে কিন্তু পাকিস্তানি শাসক চক্রের রক্তচক্ষু ও প্রতিকূলতার পটভুমিতে ১৯৫১ সালে চট্টগ্রামে সহিত্য সম্মেলন উদবোধন করেন বেগম সুফিয়া কামাল। ১৯৫১ এর সাহিত্য সংস্কৃতির সম্মেলনের পর ১৯৫৩ সালে কুমিল্লা এবং ১৯৫৪ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় সাহিত্য সংস্কৃতির সম্মেলনসমূহ। একদিকে এই সাহিত্য সংস্কৃতির সম্মেলনসমূহ, অন্যদিকে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন হলেও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশের ধারা তেমন গতি সঞ্চার করতে পারেনি। কারণ পূর্ব পাকিস্তানের জনতার মধ্যে দ্বি-জাতিত্তেবর ধারণা মোটেই দুর্বল ছিল না এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যেও দ্বি-জাতিতত্তব বিরোধী তেমন কোন কর্মকান্ড পরিলক্ষিত হয়নি। অথচ ব্রিটিশ ভারতে বিভিন্ন রাজনৈতিক বা স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঙালি মসুলমানদের তেমনভাবে যোগদানের নজির পাওয়া যায় না। বাঙালি মুসলমান সমাজে ইসলাম ধর্মের চর্চা গভীরভাবে দেখা না গেলেও বিভিন্ন মাওলানা, মৌলবী ও ইসলামিক সংগঠনগুলি মুসলমানদের মধ্যে ধর্মাচরণ ও ইসলামিক রীতি-নীতির একটি অভ্যাস বা অনুশীলন অব্যাহত রেখেছিল ফলে গভীরভাবে ধর্মচর্চা না করেও বাঙালি মুসলমানরা ইসলামের প্রভাব বলয়ের মধ্যে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে। সাধারণ মুসলমান সমাজে ইসালামী সংস্কৃতি ব্যতিরেকে উদার বাঙালি সংস্কৃতি চর্চা খুবই স্বল্প মাত্রায় দেখা যেত। সেকারণে পাকিস্তান আন্দোলনে দ্বি-জাতিতত্তব তাদের উপর সহজেই প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছিল। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন পরবর্তীতে সারা দেশের আবহে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার ধারা ক্রমে বেগবান হয়ে ওঠে এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের শিক্ষা ক্রমেই পুষ্ট হতে থাকে, কিন্তু দ্বি-জাতিতত্তেবর দ্বারা মুসলমান সমাজ এতটাই প্রভাবিত হয়েছিল যে, বাংলা ভাষার পরিবর্তে যখন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রস্তাব করা হল, তখন বাঙলি মুসলমানদের গণপরিষদে সকল প্রতিনিধি উর্দুর পক্ষে সমর্থন দিয়েছিলেন এই ভেবে যে, উর্দু হল মুসলমানদের ভাষা এবং পাকিস্তান একটি ইসলামিক রাষ্ট্র, আর এই ইসলামকে রক্ষা করতে হলে মুসলমানদের ভাষা উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করা যথাযথ। তারা মনে করতেন বাংলা ভাষার উপরে হিন্দুদের প্রভাব খুব বেশি; তার শব্দ ভান্ডারের সঙ্গে ইসলাম বা মুসলমানদের খুব একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক নেই। পাকিস্তান আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে মুসলিম নেতৃবৃন্দ বাঙালি মুসলমানদের কাছে এই ধারনাই তুলে ধরতে সচেষ্ট ছিলেন। বাংলাদেশের সমাজেও এই সময়কালে অর্থাৎ ভাষা আন্দোলন কিংবা তার পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি ইসলামি আদর্শের ভাল রকমেরই প্রভাব ছিল, ফলে উদার বাঙালি চেতনার বিকাশে তেমন কোন সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি ১৯৬৮ সালের আগে পর্যন্ত। আবার ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন হলেও শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য ১৯৬২ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত পূর্ববঙ্গ তথা পূর্বপাকিস্তানে বাঙালি নেতৃবৃন্দ বারে বারে ক্ষমতায় এলেও তারা শহীদ মিনার নির্মাণের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভেবেছেন বলে মনে হয় না। ঐ সময়কালে তৎকালীন যুক্তফ্রন্ট সরকারের নেতৃবৃন্দসহ অন্যান্য বাঙালি নেতৃবৃন্দ নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে যে ধরনের বিবাদে লিপ্ত ছিলেন, সেখানে ভাষা আন্দোলনের স্মারক নির্মাণের তেমন কোন গুরুত্বই ছিল না। তাহলে কি সমাজে ভাষা আন্দোলনের তেমন প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি ? অন্যদিকে, উদার বাঙালি চেতনার বিকাশে তেমন কোন সাংস্কৃতিক আন্দোলন ১৯৬৮ সালের আগে পর্যন্ত গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। কেননা ১৯৬০ এর দশকে বাঙালি সংস্কৃতি জগতের মাইলফলক হিসাবে ‘উদীচী ও ছায়ানট’ নামে দুটি সাংস্কৃতিক সংগঠন আত্মপ্রকাশ করল। সংস্কৃতিকর্মীরা বিভিন্ন নাটক, দেশপ্রেম মূলক কবিতা, প্রবন্ধ ও সিনেমা তৈরিতে জোরকদমে নেমে পড়লেন। আর এই পর্বেই তৈরি হলো জহির রায়হানের চলচ্চিত্র – ‘জীবন থেকে নেয়া’। উক্ত চলচ্চিত্রে বিধৃত হয়ে ওঠে দেশব্যাপী আন্দোলন ও সংগ্রামের সংহত ঐক্য এই আন্দোলনগুলি তখনও পর্যন্ত শহরকেন্দ্রিক থাকায় এর সীমাবদ্ধতাও ছিল, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এটাও একটা দুর্বল জায়গা বলা যায় কারণ জাতীয়তাবাদের অন্যতম মূল ভিত্তি হচ্ছে সাংস্কৃতিক চেতনা। সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশ ছাড়া কোন জাতীয়তাবাদের শক্তিশালী ভিত তৈরী হওয়া খুবই কঠিন। আর তা দীর্ঘমেয়াদী হওয়া প্রায় অসম্ভব। যদিও পরবর্তী সময়ে ছাত্র-যুব সমাজের মুখে মুখে ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা” তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ, জয় বাংলা, জয় বাংলা’ প্রভৃতি শ্লোগানের উচ্চারণ হতে দেখতে পাওয়া যায় কিন্তু তাতে একটি উগ্র জাতীয়তার গন্ধ অনেকে পেলেও ১৯৬৮-৭০ সালে ছাত্র আন্দোলনে এগুলি ছিল উচ্ছ্বাসভরা শ্লোগান। এই সমস্ত শ্লোগান থেকে একথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের একটি হাওয়া পূর্ব-পাকিস্তানের গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছিল। …