ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে কয়েকটি কথা
বিমল প্রামানিক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রচলিত যে সকল সংজ্ঞা আমরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেখতে পাই, তা সব সময় পড়শি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে প্রয়োগের সাফল্য আসে না বা দুই দেশের জনগণের উন্নয়নে ও অগ্রগতিতে সহায়ক হয় না৷ তাছাড়া পড়শি দেশগুলির মধ্য স্ব স্ব ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রভৃতি বিষয়গুলিও পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে থাকে। আমরা ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রের দিকে একবার আলোকপাত করতে পারি। পঁচাত্তর বছর পূর্বে ভারতের একটি রাজ্য বঙ্গদেশ বিভক্তির ফলে তার মুসলিম প্রধান পূর্বাংশ পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গঠিত হয় একটি মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান। আর সেই পাকিস্তানেরই পূর্বাংশ (পূর্ব পাকিস্তান) ১৯৭১ সালে একটি সশস্ত্র লড়াই এর মধ্য দিয়ে ভারতের সক্রিয় সহযোগিতা ও সাহায্যে বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত। একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাহলো, গত পঞ্চাশ বছর বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিপথ বড়ই সংঘাতময়, বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ ও রক্তাক্ত। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপরে তার প্রভাব পরিলক্ষিত হওয়াই স্বাভাবিক। পড়শি রাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরিতার নজির আমাদের উপমহাদেশে মোটেই বিরল নয়। এর পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে ভারত বিভাজন। এমনকি জাতিগত বিভাজনও এড়ানো যায়নি। যার জের এখনও আমরা টেনে চলেছি। এর পিছনেও রয়েছে ঐতিহাসিক কারণ। আর এই জাতিগত বিভাজনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্থাবর- অস্থাবর সম্পত্তি গ্রাসের প্রবণতা। এমন প্রবণতা দুনিয়ার অন্যদেশে আছে বলে জানা নেই। এশিয়ার অন্য একটি দেশ কোরিয়া সেখানে জাতিগত বিভাজন হলেও ধর্মীয় বিভাজন না থাকায় এই সমস্যা নেই। কিন্তু পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে এই সমস্যা প্রবল। ‘Islamisation has always been, historically a ‘power concept’. এদিক থেকে দেখতে গেলে ethnic identity বা জাতিগত পরিচয় ধর্মের নিরিখে অনেকটাই গুরুত্বহীন। এটি মৌলবাদী ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী। ভারতীয় উপমহাদেশে এই মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে এসেছে দ্বিজাতি তত্ত্ব — যা ভারতবর্ষকে দ্বিখন্ডিত করেছিল। ইতিহাসের অধ্যায় ভূলে গেলে চলবে না। ইসলামের সামাজিক কেন্দ্রাভিমুখী ধর্মীয় প্রবণতা থেকে উদার গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় উত্তরণ পাকিস্তান বা বাংলাদেশে এখনও সম্ভব হয়নি। ফলে ঐসব দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনসংখ্যা দ্রুত ক্রমহ্রাসমান। এসকল বিষয়ও ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপর ছায়াপাত করছে। এসকল বিষয় মাথায় রেখেই ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও পারস্পরিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলির অগ্রগতিও সমাধানের কথা ভাবতে হবে। তদুপরি রয়েছে দুদেশের সরকারগুলির বিদেশনীতির বৈচিত্র ও সময়ে সময়ে পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে পরিবর্তন। স্বাধীনতা-উত্তর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক একেবারেই মধুর ছিল একথা বলা যায় না। বর্তমান নেতৃত্ব ভারতে ও বাংলাদেশে একটি নিরন্তর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলেছে দু’দেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহের শান্তিপূর্ণ, উভয়দেশের গ্রহণযোগ্য সমাধান উদ্ভাবন ও বাস্তবায়নে। ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে যা দেশ বিভাগের পর থেকে চলে আসছিল, দু’দেশের সীমান্ত নির্ধারণে কোন সমস্যা নেই। ব্যবসা-বানিজ্যের প্রসার ঘটেছে। সীমান্তে অনুপ্রবেশ, চোরাচালান, গরুপাচার প্রভৃতি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে — যা দুই দেশের জনগণের বিশেষভাবে সীমান্ত জনগণের দৈনন্দিন জীবন-যাত্রায় ব্যাপকভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কারণ এই সমস্যাগুলি দুই দেশের সীমান্তে আইন-শৃঙ্খলার সাথে সরাসরি জড়িত। আর একটি বিষয় হচ্ছে, দু’দেশের সংশ্লিষ্ট নদীর জলবন্টন। জল- বন্টন সমস্যার উদ্ভব হয় দেশ বিভাগের ফলে। ভারত ও চিনে উৎপত্তি ছোট বড় অনেকগুলি নদী ভারতের পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ভারত একটি যুক্তরাজ্য। ফলে রাজ্যগুলির অধিকারও গুরুত্বপূর্ণ। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের ঐক্যমত এক্ষেত্রে গুরুত্ব পায়। তাছাড়া, রাজ্যগুলির জল ব্যবহারের উপর কেন্দ্র স্বাধীন মতামত চাপিয়ে দিতে পারে না। এসমস্ত বিষয়গুলি মাথায় রেখেই দু’দেশের মধ্যে জল বন্টনের চুক্তি হয়ে থাকে। দেশ-বিভাগের সময় এসব বিষয় ভেবে দেখার প্রয়োজনীয়তা ও সময় কি নেতাদের হাতে ছিল ! আর একটা বিষয় আমাদের ভেবে দেখতে হবে, তা হলো পড়শি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন শাসন প্রণালী, বাংলাদেশের শুরু থেকেই একটি অঘোষিত/ঘোষিত নীতি সমাজে এবং রাষ্ট্রে কার্যকর রয়েছে যে সংখ্যালঘু নাগরিকদের নিপীড়ন/নির্যাতন/বিতাড়ন। তার ধাক্কা এসে আছড়ে পড়ছে ভারতের সমাজে এবং অর্থনীতিতে। ফলে বাংলাদেশের সংলগ্ন ভারতের রাজ্যগুলিতে নানা সমস্যা ও প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে এর ঢেউ লাগছে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজনীতিতে। এর ফলে দুই প্রতিবেশী দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রভাব পড়ছে। ব্যক্তি গন্ডির বাইরে রাজনীতিতে ধর্ম গুলিয়ে ফেললে সমাজে তার প্রভাব আটকানো যায়না। পাকিস্তান/আফগানিস্তান এর’ খেসারত দিচ্ছে। আমাদের ভাবতে হবে ভারত – বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কোন্নয়নে আমরা কোন দিকে অগ্রসর হবো। গণতান্ত্রিক দেশে সরকার পরিবর্তন গণতন্ত্রের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এর জন্য বিদেশ নীতি বা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপর প্রভাব পড়া উচিত নয়। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত তৈরী হয় দু’দেশের নানা স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয় সমূহের উপর, কখনও কখনও ঐতিহাসিক কারণও এর পিছনে থাকে। পড়শি রাষ্ট্র হলেই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ভাল থাকবে এমন নয়। পাকিস্তান- ভারত সম্পর্ক এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কিন্তু বর্তমান পৃথিবীতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপর অনেক সময়ই বৈশ্বিক প্রভাব কাজ করে থাকে। ভারত উপমহাদেশে বা দক্ষিণ এশিয়ায় এমন নজির বিরল নয়, দু’দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই তা নানা সন্দেহ ও বাধার জন্ম দিতে পারে। কিন্তু আমাদের দুই দেশেরই পারস্পরিক স্বার্থ এবং অভ্যন্তরীন স্থিতিশীলতার কথা মাথায় রেখে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে দু’দেশের জনগণের মঙ্গলের লক্ষ্যে। উদার, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও সমাজ তৈরি করার লক্ষ্যে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল। সংবিধানের প্রস্তাবনায় মূল নীতি — সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিসমূহ স্পষ্ট হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৩ থেকে সংবিধান নানামাত্রিক অভিঘাতের শিকার হয়। বিশেষত, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের হত্যাকান্ডের পর, সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে মূল লক্ষ্যের আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়। সংবিধান সংশোধনীর প্রথম পদক্ষেপটি ছিল এইরূপ “যে সকল মহান আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ ঐ সংবিধানের মূলনীতি হইবে।” কিন্তু এর পরিবর্তিত সংশোধনটি ছিল … “যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল, সর্বশক্তিমান আল্লাহের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস; জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূল নীতি হইবে।” অর্থাৎ, সংশোধনী অংশে সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস যুক্ত করে এবং ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল ও সমাজতন্ত্রের ভিন্ন ব্যাখ্যার মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক আদর্শ ও উদ্দেশ্য পরিবর্তন করা হয়েছে, যা প্রথম সংবিধানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এখানে ইসলাম ধর্ম বিশ্বাস ও আল্লাহর উপরে পূর্ণ আস্থা রাখায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের অবদানকে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্ৰীষ্টান প্রকৃতপক্ষে বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। এটা পাকিস্তানী ধ্যান ধারনারই আর একটা পথ। যেখানে সংখ্যালঘু অধিকার ও অবদানকে অস্বীকার করা হয়েছে । ১৯৭৩ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী আইন পাশ হয় এবং এটি ঐ সালের .২৫ নম্বর আইন, সংশোধণীর মাধ্যমে ২৬, ৬৩, ৭২, ১৪২ নং অনুচ্ছেদ সংশোধনকরা হয়। এই সংশোধনীর পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের সংবিধানের চরিত্র ছিল অত্যন্ত গণতান্ত্রিক ও মানবিক; যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকারের ঘোষণা দেওয়া ছিল এবং তা স্থগিতের কোন বিধান বিদ্যমান ছিল না। কিন্তু এই সংশোধনীর মাধ্যমে মৌলিক অধিকার স্থগিতের অধিকার যেমন সরকারের হাতে দেওয়া হল তেমনিভাবে এর অপব্যবহার রোধের কোন বিধান রাখা হল না। এথেকে একথা বলা অসঙ্গত হবে না যে, বাংলাদেশকে পাকিস্তানী …