Center For Research In Indo

Author name: admin

স্বাধীনতার পথে বাংলাদেশঃ অগ্নিঝরা মার্চ ও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব

ডঃ আনন্দ বিকাশ চাকমা, সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে উনিশ শ’ একাত্তরের মার্চ মাসের ঘটনাবলী খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অকস্মাৎ পহেলা মার্চে জাতীয় পরিষদের পূর্বঘোষিত অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এ কারণে মার্চের শুরু থেকেই উত্তাল হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। আন্দোলন সফল করতে ২ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত টানা হরতাল আহূত ও পালিত হয়। এ মার্চ মাসেই পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে প্রথম উড্ডীন হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা, বাঙালি জাতি উপভোগ করে প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের শিহরণ জাগানো ভাষণ ও স্বাধীনতার মন্ত্রোচারণ, মার্চের গোড়া থেকেই বঙ্গবন্ধুর সম্মোহনী নেতৃত্বে পরিচালিত হয় বাঙালির সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন, এবং এই মার্চ মাসেই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বস্তুত মার্চ ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে বাঁক বদলানোর সময়। মার্চে বাঙালি দেখিয়েছে তাদের ঐক্যবদ্ধ গণশক্তির জাগরণ, স্বাধীনতার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা। মার্চ জুড়েই সেনাবাহিনীর গুলিতে আত্মবলিদান দিয়েছে আন্দোলনকারী ছাত্র, শ্রমিক, যুবারা। পাকবাহিনীর ২৫শে মার্চের রাতের বর্বরতম গণহত্যায় প্রাণ দেয় অগণিত বাঙালি। ২৬শে মার্চ ভোরের আলো ফোটার আগেই বাঙালির ভাগ্যবিধাতা স্বাধীনতার মন্ত্রগুরু বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে। পরে পশ্চিম পাকিস্তানে অন্তরীণ করে রাখে নয় মাস ধরে। কিন্তু বাঙালিকে দাবিয়ে রাখা যায়নি, বরং বাঙালি সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশমাতৃকাকে হানাদারমুক্ত করেছে। তাই বাংলাদেশ রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার ইতিহাসে মার্চ মাস আগুন ঝরা মার্চঃ দেশ পরিচালনার গণ-রায় প্রাপ্ত বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবকে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত রাখার পাকি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবার মাস, নিরস্ত্র, নিরীহ বাঙালিকে শত্রুর অন্যায় জাতি-নিধনাভিযানের বিরুদ্ধে দুর্বার গণপ্রতিরোধের মাস।১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল। মহাকালের বিবেচনায় ২৩ বছর খুব বেশি বড় সময় নয়। পৃথিবীর স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও এটি সবচেয়ে ছোট সময়। ভারতবর্ষেও ১৮৮৫ সালে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার বছর থেকে ১৯৪৭-এ স্বাধীনতা প্রাপ্তি পর্যন্ত স্বাধীনতার লড়াই চলেছে সুদীর্ঘ ৬২ বছর। জাপানের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, রাজনৈতিক দমনপীড়ন ও উপনিবেশায়নের বিরুদ্ধে কোরিয়ান জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়কাল ছিল ২৬ বছর। কিন্তু বাঙালি মাত্র ২৩ বছরে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গেছে, এনেছে স্বাধীনতা। প্রতিষ্ঠা করেছে বিশ্বের বুকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম স্বদেশ-বাংলাদেশ। এ যেন বিস্ময়কর অবিশ্বাস্য ঘটনা। মিটিকুলাস। হ্যাঁ বাঙালি অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। তার কারণ যুগ যুগান্তরে শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত বাঙ্গালির জাতীয় জীবনে ভাগ্যবিধাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল একজন সত্যিকারের জননেতা—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। খোকা, মুজিব ভাই, শেখ সাহেব, বঙ্গবন্ধু হয়ে যিনি এখন বাঙালির জাতির পিতার সসম্মানে সুপ্রতিষ্ঠিত। পশ্চিমবঙ্গের একজন ইতিহাসবিদ যথার্থই বলেছেন, ‘ভারতের ইতিহাস পড়লেই দেখা যায় যে বাংলা বরাবরই স্বতন্ত্র ও স্বাধীনচেতা। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বাংলার ও বাঙালির সফল ও সর্বোৎকৃষ্ট প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন সুভাষচন্দ্র। পরবর্তীকালে সে ঐতিহ্যকে শিরোধার্য করে পাকিস্তানের বাংলা-বিরোধিতার দুর্বিষহ শাসনের জাল ছিন্ন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশনায়ক নেতাজী সুভাষচন্দ্রের প্রতিবাদী ও লড়াকু ঐতিহ্য থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দাসত্ব-বিরোধিতার ও বাঙালিকে ‘দাবায়ে রাখতে’ না পারার ঐতিহ্যে যাওয়াটা বাঙালির এক নিজস্ব উৎক্ষেপণ।’শেখ মুজিব ব্রিটিশ আমলে রাজনীতির পাঠ ও প্রশিক্ষণ লাভ করেন সোহরাওয়ার্দী, হাশিম প্রমুখ নেতাদের সান্নিধ্যে এসে। সাতচল্লিশে দেশভাগের সময় খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেন পূর্ব বাংলার বাঙালির অধিকার বঞ্চিত রাখার ষড়যন্ত্রকে। তাই তিনি শপথ নেন পশ্চিম পাকিস্তানিদের সকল ষড়যন্ত্রকে চুরমার করে দিয়ে বাঙালির জীবনে সত্যিকারের স্বাধীনতা এনে দেওয়ার। এর জন্য তিনি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ভোগ, বিলাস, আরাম, আয়েশ, আমোদ-আহ্লাদ সব বিসর্জন দিয়ে বাঙালির মুক্তিপথের সন্ধানে সংগ্রামে নেমে পড়েন। কমরেড মনি সিংহ এর ভাষ্যমতে বঙ্গবন্ধু সেই ১৯৪৭ সাল থেকে স্বাধীনতার স্বপ্ন বুনেছিলেন। পরবর্তীকালে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দান, ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা, ১৯৪৯ এ আওয়ামি মুসলিম লিগের যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করেন। অতঃপর ১৯৫৩ তে পার্টির সাধারণ সম্পাদক, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট গঠনে জোরালো ভূমিকা গ্রহণ এবং নির্বাচনে বিজয়লাভ ও মন্ত্রিত্ব গ্রহণ। পরে ১৯৫৭ তে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে দলের সাংগঠনিক কাঠামো সুদৃঢ় করার নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ১৯৬৬-তে এসে আওয়ামি লিগের সভাপতি হিসেবে দলকে পুনরুজ্জীবিত করেন। একই বছর বাঙালির স্বাধিকারের সাঁকো ও মুক্তির সনদ খ্যাত ছয় দফা ঘোষণা করে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামকে নবচেতনায় উদ্দীপ্ত করেন। তাঁর ছয় দফা কর্মসূচি ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করে। বাঙালি জনগণ ছয় দফাকে নিজেদের দুঃখ ও শাপ মোচনের মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করে। ছয়দফাভিত্তিক আন্দোলনের জোয়ারে হতবিহ্বল হয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাঁকে কারারুদ্ধ করে রাখে বছরের পর বছর। এতেও বাঙালির স্বাধিকার লড়াইকে থামাতে না পেরে আইয়ুব সরকার বঙ্গবন্ধুর প্রাণনাশের নীল নকশা হিসেবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে একটি দেশদ্রোহ মামলা দায়ের করে। কিন্তু ততদিনে বাঙালি জনগণ তাদের নেতাকে চিনেছে। শেখ মুজিব দেশদ্রোহী নন, দেশপ্রেমিক। তারা বুঝেছে শেখ মুজিব একজন জননায়ক; বাঙালি জাতির ঐক্য, শক্তি ও সাহসের ঠিকানা। তাঁকে মুক্ত করতেই হবে। শুরু হয় দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থান। আইয়ুব হার মানলেন। শেখ মুজিবকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন। বাঙালি ফিরে পেল তাদের প্রিয় নেতাকে। ভালবাসায় সিক্ত করে ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত করলো লাখো মানুষের জনসভায়। বিদায় নিলেন আইয়ুব; শেখ মুজিবের নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্ব তখন অনন্য উচ্চতায়। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার মানুষ এখন তাঁর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ । তাঁর বজ্রকণ্ঠই সমগ্র জাতির কণ্ঠস্বর। এমন ঐক্য বাঙালি ইতিপূর্বে দেখেনি। স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার চেতনা এখন বাংলার ঘরে ঘরে। মানুষের মুখমণ্ডল ভিন্ন, চেতনায়, লক্ষ্যে, স্বার্থে সবাই যেন শেখ মুজিবের প্রতিচ্ছবি।এ সময় এল সত্তরের নির্বাচন। ইয়াহিয়ার ঘোষিত নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে বাংলার অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো ধন্দে পড়ে গেল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কৌশল সবসময় ভিন্ন। তিনি নির্বাচনকেই স্বাধীনতা অর্জনের পথে হাতিয়ারে পরিণত করলেন। তিনি নির্বাচন করলেন। ছয় দফাকে নির্বাচনী ইশতেহারে রূপান্তর করলেন। এ পথে ও কৌশলে আসলো বাঙালির নিরঙ্কুশ বিজয়। বঙ্গবন্ধু সফল হলেন। এখন পার্লামেন্টে বসে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন এবং দেশ পরিচালনার দায়িত্বগ্রহণ। কিন্তু তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন ভুট্টো, ইয়াহিয়াসহ পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক-অসামরিক এস্টাবলিশমেন্ট। কিন্তু বঙ্গবন্ধু দমবার পাত্র নয়। বাঙালি ততক্ষণে যে কোন কঠিন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত। শুধু দরকার প্রিয় নেতার নির্দেশনা। ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অধিবেশন স্থগিত করলেন। বাঙালির বুঝতে বাকী রইল না। সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না। ইয়াহিয়ার ঘোষণার প্রতিবাদে ২ ও ৩ মার্চ সারাদেশে ঘোষিত হল হরতাল। পালিত হল সর্বাত্মক হরতাল। আর সিদ্ধান্ত হল ৭ই মার্চ পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষিত হবে। নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে লাখো মানুষের সমাবেশে একসভা, একটেবিল, একনেতার ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ। তাঁর মুখ থেকে, তাঁর অন্তরাত্মা থেকে বেরিয়ে এলো সেই অমর পঙক্তিঃ ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’মার্চ জুড়ে সামরিক সরকার দেয় বিধি অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু সরকার দেয় অসহযোগ আন্দোলনের দফার পর দফা নির্দেশনা। এর মধ্যে ইয়াহিয়া খান ২৫শে মার্চ অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর শর্ত সাপেক্ষে অধিবেশন বসার কথা বললেন। ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ সহচরসহ ঢাকা এলেন। শুরু করলেন ক্ষমতা হস্তান্তর প্রসঙ্গে প্রহসনমূলক সংলাপ। বাংলাদেশের মানুষ যে কোন চরম ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। অবশেষে ইয়হিয়া খান কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ঢাকা ত্যাগ করেন। এভাবে ২ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে চলে বাঙালির অসহযোগ আন্দোলন তথা স্বাধীনতার অভিযাত্রা। বলতে গেলে পুরো …

স্বাধীনতার পথে বাংলাদেশঃ অগ্নিঝরা মার্চ ও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব Read More »

কুকি বিদ্রোহ মোকাবেলায় বাংলাদেশ ও ভারত একসাথে কাজ করবে

।।শিতাংশু গুহ, নিউইয়র্ক।। (১) সশস্ত্র কুকি বিদ্রোহ মোকাবেলায় বাংলাদেশ ও ভারত একসাথে কাজ করবে। সম্প্রতি ভারতের মিজোরাম ও বাংলাদেশ সীমান্তের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কেএনএ (কুকি চীন ন্যাশনাল আর্মি)-র তৎপরতায় ঢাকা ও দিল্লি নড়েচড়ে বসছে। বন্ধুবর সেলিম সামাদ-র এ সম্পর্কিত একটি নিবন্ধ ভারতের ১লা আগষ্ট ২০২৩ ‘ইন্ডিয়া ন্যারেটিভ’-এ ছাপা হয়েছে, উৎসাহীরা তা পড়ে নিতে পারবেন, কিন্তু আমি ভাবছি, নুতন করে কুকিদের তৎপরতার সাথে নির্বাচন জড়িত না-তো? ‘ইউ নেভার নো’! ২০২৪-এ বাংলাদেশ ও ভারতে সাধারণ নির্বাচন। বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব, শেখ হাসিনা-মোদী চমৎকার সম্পর্কের কারণে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আইএসআই বা তাদের বন্ধুরা তেমন একটা সুবিধা করতে পারছে না। আপাতত: নির্বাচনকে সামনে রেখে ওই অঞ্চলকে ‘অস্থিতিশীল’ করার একটি প্রচেষ্টা দৃশ্যমান। মোদির আমেরিকা সফরকালে টের পাওয়া যায় যে, একটি শক্তিশালী লবি মোদিকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চায়। একই লবি শেখ হাসিনাকেও হটাতে সচেষ্ট। দু’জনকে না সরাতে পারলেও অন্তত: একজনকে ঘায়েল করতে পারলে তারা কিছুটা সফল হবে। শেখ হাসিনা-মোদী বা বাংলাদেশ-ভারত এটি জানেন, তাই তারা এতদঞ্চলে ‘সন্ত্রাসবাদ’ যাতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে তার জন্যে একসাথে কাজ করতে আগ্রহী, এবং এটি দুই দেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট। (২) মাত্র সেদিন ১৪জন কংগ্রেসম্যান জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে এক চিঠি পাঠিয়ে বাংলাদেশকে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল থেকে বহিস্কার করা এবং সামনের নির্বাচনটি যাতে জাতিসংঘের তত্বাবধানে হয় সেজন্যে উদ্যোগী হবার আহবান জানিয়েছেন। মিডিয়ায় এটি ফলাও করে এসেছে। জাতিসংঘে কর্মরত একজনের সাথে এনিয়ে কথা তুলতে তিনি বললেন, ‘দিজ ইজ নট দি ওয়ে’। বললেন, জাতিসংঘ একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের নিয়ম মত এটি চলে। তবে তিনি বলেন, যাঁরা এসব লবিং করছে তারা যথেষ্ট প্রভাবশালী, এবং তাদের অর্থবিত্ত আছে। ইতিপূর্বে ঢাকায় এক ডজন রাষ্ট্রদূত ‘হিরো আলম’কে নিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। এসব চিঠিপত্র কেন, এমত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি স্পষ্ট জানালেন, ‘উনি তোমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকলে, তোমরা আরও চিঠিপত্র পাবে’। বাংলাদেশে কূটনীতিকরা কিন্তু ভেতরে ভেতরে একই কথা বলছেন। এদিকে এমিনিস্টি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে বিক্ষোভকারীদের ওপর শক্তি প্রয়োগের সমালোচনা করেছে। (৩) নির্বাচন আসছে, আমাদের বাম নেতারা আবার গা-ঝাড়া দিয়ে উঠছেন, কারণ মনোনয়ন লাগবে, ‘নৌকা’ প্রতীক না পেলে জেতা যাবেনা। রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু ও দিলীপ বড়ুয়াসহ ১২ জন বাম নেতা ৭দিন চীন ঘুরে এসে ফরমান দিয়েছেন, মার্কিন চাপ মোকাবেলায় চীনকে পাশে রাখা দরকার। বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে বামদের সমস্যা হলো, এঁরা দেশে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার, এবং চীনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তবে এদের প্রায় সবার ছেলেমেয়ে আমেরিকায় থাকে। নেতাদের বয়স হয়েছে, বর্ষীয়ান এসব নেতারা আমেরিকায় এসে বিনে পয়সায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে যান, কিছুটা সময় অবসর কাটিয়ে যান। আমার জানতে ইচ্ছে করে, তাঁদের এ সফরের খরচটা কারা দিয়েছেন? যাহোক, চীনের বিশেষ দূত ‘নীরবে’ ঢাকা সফর করে গেছেন। বামরা ও ইসলামী মৌলবাদীরা সব কাজ ‘নীরবে’ বা তলে তলে করতে পছন্দ করেন। (৪) বিএনপি’র সাম্প্রতিক কর্মসূচি পালনকালে জাতি ‘গয়েশ্বর’ নাটক দেখলো। ভিডিওতে দেখা গেলো ধাওয়া খেয়ে তিনি পড়ে যাচ্ছেন, পুলিশ তাঁকে উঠিয়ে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায়। পরবর্তী দৃশ্যে দেখা যায়, তিনি ডিবি প্রধান হারুনের অফিসে ‘লাঞ্চ’ করছেন, হারুন যথেষ্ট যত্নআত্তি করছেন। এই ভিডিও দেখে গয়েশ্বর বললেন, আমি শুধু হালকা সবজি ও রুই মাছ খেয়েছি। তিনি অভিমানের সুরে বলেছেন, আমাকে খাইয়ে ভিডিও প্রকাশ ‘নিম্নরুচির’ পরিচায়ক। এত খাতির দেখে নিন্দুকেরা হয়তো অন্যকথা বলছেন, তাই তিনি আবার বললেন, ‘গয়েশ্বরকে কিনতে পারে, এতটাকা সরকারের কাছে নেই’! পরে অবশ্য, সাংবাদিকদের ডিএমপি’র অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে আটক নয় বরং হামলা থেকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য হেফাজতে নিয়েছিলপুলিশ। জাতি আশা করবে, ডিবি হারুন, ভবিষ্যতে অন্য নেতাদের এমনি সমাদর করে লাঞ্চ খাওয়াবেন। পাদটীকা: মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, ‘ডেঙ্গু বাংলাদেশ থেকে আসছে’। দিদিকে বলা যায়, আমাদের ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান আপনি নিয়েছেন, এবার ডেঙ্গু নেন!

ডলারের পরিবর্তে বাংলাদেশ – ভারতের টাকা ও রুপিতে বৈদেশিক বাণিজ্য

শঙ্কর সরকার, বাংলাদেশ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের একটি যুগান্তকারী অধ্যায় শুরু হয়েছে দুই দেশের মধ্যে ডলারের পাশাপাশি টাকা ও রুপি দিয়ে বাণিজ্যিক লেনদেন পদ্ধতি শুরু করার মাধ্যমে। বাংলাদেশ যদি কোনো পণ্য অন্য যে কোন দেশ থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলে (লেটার অব ক্রেডিট) আমদানি করতে চায় তাহলে ডলার দিয়ে কিনতে হবে এবং পাশাপাশি বাংলাদেশ যদি কোন পণ্য যে কোন দেশে রফতানি করতে চায় তাহলে ডলারের মধ্যমে কেনা-বেচা করতে হবে। অর্থাৎ বৈদেশিক বাণিজ্য করতে আমেরিকান ডলার একটি অতি অপরিহার্য মুদ্রা। এই ডলার যদি বাজারে কম থাকে তাহলে সকল দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ক্ষতি হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে মার্কিন ডলারের বিকল্প যদি আমদানি ও রপ্তানিকারক দেশ দুটি নিজস্ব মুদ্রার মাধ্যমে আমদানি রফতানি বাণিজ্য করতে পারে তাহলে সেটা উভয় দেশের জন্য মঙ্গলজনক। তাতে ডলারের উপরে নির্ভরশীলতা অনেকটা কমে যাবে। ব্যতিক্রম ছাড়া বিশ্বের সব দেশের সাথে বাংলাদেশ এতদিন ডলারেই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য করে আসছে। ব্যতিক্রমের মধ্যে যেমন চীনা মুদ্রা ইউয়ানে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা এলসি খুলতে পারেন। ভারত অবশ্য ডলারের পাশাপাশি নিজস্ব মুদ্রা রুপিতে অনেক দেশের সাথে বাণিজ্য শুরু করেছে অনেক আগেই। তবে দেশটি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের সাথে শুরু করেছে রুপিতে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য। ভারত ২০২৩ সালের জুলাই মাস থেকেই রুপিতে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য করার কার্যক্রম উদ্বোধনের মাধ্যমে শুরু করেছে। বাংলাদেশ ও ভারতের উভয় সরকারের পক্ষ থেকে আপাতত ভারতীয় মুদ্রা রুপিতে এলসি খোলার মাধ্যমে বানিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। পরে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকা দিয়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে। তবে মার্কিন ডলারে বাণিজ্য কার্যক্রম চলার বিষয়টি আগের মতোই উন্মুক্ত থাকবে। ভারতের বিশ্ববিখ্যাত টাটা মোটরসের বাংলাদেশী এজেন্ট মেসার্স নিটল মটরস্ রুপিতে এলসি খোলার মাধ্যমে ভারতীয় গাড়ির প্রথম চালান বাংলাদেশে আমদানী করে এই যুগান্তকারী বাণিজ্যিক কার্যক্রমের শুভ সূচনা করেন। ভারতের সঙ্গে কারেন্সি সোয়াপ ব্যবস্থা বা নিজস্ব মুদ্রা বিনিময়ের মাধ্যমে উভয় দেশের আমদানি রফতানি বাণিজ্য করার আলাপ আলোচনা চলছে এক যুগ ধরে। তবে কোভিড শুরু এবং রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অনেক দেশের মত বাংলাদেশেও ডলার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি সামলাতে বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এ অবস্থায় ভারতের রাজধানী দিল্লিতে গত বছরের ডিসেম্বরে যখন দুই দেশের বাণিজ্য মন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক হয় তখন ভারতের পক্ষ থেকে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের মাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশী মুদ্রা টাকা ও ভারতীয় মুদ্রা রুপি ব্যবহাররের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে প্রস্তাব নেওয়া হয়। এরপর ভারতের বেঙ্গালুরুতে গত ২৪-২৫শে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জি ২০ ভুক্ত দেশগুলোর অর্থমন্ত্রী ও গভর্নরদের সম্মেলনের এক ফাঁকে দুই দেশের গভর্নরদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উভয় গভর্নর এই কাজটি দ্রুত গতিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে একমত হন। ডলার বা অন্য কোন মুদ্রা এড়িয়ে দুই দেশ যখন নিজেদের মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্যিক কাজকর্ম পরিচালনা করাকে আর্থিক পরিভাষায় বলে কারেন্সি সোয়াপ ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় অর্থাৎ ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য করতে বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাঙ্ক ভারতের ষ্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (এস বি আই) এবং আই সি আই সি আই ব্যাংক কিছু দিন আগে হিসেব খোলার অনুমতি দিয়েছে। এ হিসেবের নাম নষ্টর হিসাব। নষ্টর হিসাব খোলা নিয়ে বাংলাদেশের ও ভারতের চার ব্যাঙ্কের মধ্যে চিঠি চালাচালি এখনো চলছে বলে জানা গেছে। এক দেশের এক ব্যাঙ্ক অন্য দেশের কোন ব্যাঙ্কে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের হিসেব খুললে সেই হিসেবকে নষ্টের হিসেব বলা হয়। অনুরূপভাবে বিদেশের কোন ব্যাঙ্ক যদি বাংলাদেশের কোন ব্যাঙ্কে একই উদ্দেশ্য হিসেব খুলে থাকে তাকে বলা হয়েছে ভষ্ট্র হিসেব। বাংলাদেশ ইস্টার্ন ব্যাঙ্ক ও সোনালী ব্যাঙ্কের মাধ্যমে আপাতত রুপিতে এলসির মাধ্যমে ভারতের সাথে বাংলাদেশ বৈদেশিক বাণিজ্যে আমদানি রপ্তানি চলবে পরে অন্যান্য সিডিউলড ব্যাংকের মাধ্যমেও রুপিতে ভারতের সাথে আমদানি রফতানি বাণিজ্য বাংলাদেশের সাথে ভারতের চলবে। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থাৎ রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া (আরবিআই ) ইতিমধ্যে বাংলাদেশের ইস্টার্ন ব্যাংকের নষ্টর হিসাব খোলার অনুমতি দিয়েছে। ঠিক একইভাবে হিসাব খুলতে সোনালী ব্যাংক আরবিআইয়ের অনুমতি পেতে পারে দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে। আপাতত ভষ্ট্র হিসেব খোলার দিকটি বিবেচনায় থাকছে না বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূএগুলি জানায়। রুপির পাশাপাশি বাংলাদেশের মুদ্রা টাকাও যখন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে তখন ভষ্ট্র হিসেব খোলার বিষয়টি আসবে। কার্যক্রমটি ঢাকাতে উদ্বোধন করেন উভয় দেশের গভর্নরগন। সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেছেন বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশ পরস্পরের সঙ্গে আলাপ আলোচনা, পরীক্ষা নিরীক্ষা, এবং সুবিধা অসুবিধা যাচাই করে রুপিতে এলসি খুলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য শুরু হল এক নতুন পদ্ধতিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী 2021-22 অর্থবছরে বাংলাদেশ মোট আট হাজার নয়শ ষোল কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করে, এর মধ্যে এক হাজার তিনশ ঊনসত্তর কোটি ডলারের পণ্যের আমদানি করে ভারত থেকে। একই অর্থ বছরে বাংলাদেশ ভারতে রফতানি করে দুইশ কোটি ডলারের পণ্য। আমদানি রফতানি মিলিয়ে উভয় দেশের মধ্যে ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয় ওই অর্থ বছরে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থ বছরেও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের একই প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ ভারত চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি ও ইফাদ গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান তাসকিন আহমেদ এ নিয়ে বলেন, ডলারের বিকল্প ভাবনা করা ছাড়া আমাদের উপায় নেই। ভারতে আমরা যে ২০০ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করি সেটা রুপি দিয়ে করা যাবে। তবে খাদ্য পণ্যসহ অতি প্রয়োজনীয় পণ্যকে রুপিতে আমদানি করতে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। অবশ্য ডলারের সঙ্গে রুপির বিনিময়ে হার কত হবে, সেটা কি বাজার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে, তা এখনও ঠিক হয়নি বলে জানা গেছে। আন্তর্জাতিকভাবে অর্থনৈতিক লেনদেনের জন্য বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃত নয় ভারতীয় রুপি, আবার বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রয়েছে বড় ধরণের বাণিজ্যিক ঘাটতি। ফলে রুপিতে লেনদেন করতে বাংলাদেশ কোন ধরণের ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে কি না এমন প্রশ্নও রয়েছে। তাছাড়া এই পদ্ধতিতে বাণিজ্যিক কাজকর্ম যেহেতু শুরু হয়েছে তাই এই পদ্ধতি শুধু পণ্য বাণিজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। ভ্রমণ, চিকিৎসা, শিক্ষা, ইত্যাদি বিষয়ে ব্যবহার হবে। বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের প্রায় কেন্দ্রস্থলে। বাংলাদেশ সরকার তার বিশ্ব বাণিজ্য অত্যন্ত শক্তিশালী করতে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের পাশাপাশি চালনা ও পায়রা বন্দর আরও বেশি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ও দ্রুত গতিশীল বন্দর তৈরি করতে কাজ করে যাচ্ছে। তাছাড়া স্থল ও বিমান বন্দরগুলোর সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন করার জন্য কাজ করছে। বাংলাদেশ আয়তন অনুযায়ী একটি ছোট দেশ হলেও জনসংখ্যা ১৫, ২০ টি মধ্যপ্রাচ্যের অথবা ইউরোপীয় দেশগুলোর সমান। তাই স্বাভাবিক ভাবেই বাংলাদেশের একটি বড় বৈদেশিক বাণিজ্য থাকবে সবসময়। এখন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ভারতের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের গভর্নর গত ১৯শে জুন দেশের মুদ্রানীতি প্রণয়নের সময় বলেছেন টাকার পাশাপাশি রুপিতে ব্যবহার করা যাবে, পে কার্ড নামে এমন একটি ডেবিট কার্ড নিয়ে আসছে বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক। বাংলাদেশিরা ভারতের যে কোন স্থানে ঘুরতে গেলে এ কার্ড দিয়ে লেনদেন করবেন এবং কার্ডটি চালু হলে বাংলাদেশের জনগণের জন্য ডলার খরচ কমবে। গভর্নরের মতে কেউ ভারতে ভ্রমণের জন্য গেলে ভ্রমণকারীদের ১২ হাজার ডলারের যে ভ্রমণ কোটা আছে সে পরিমাণ অর্থ তিনি রুপিতে কেনাকাটা …

ডলারের পরিবর্তে বাংলাদেশ – ভারতের টাকা ও রুপিতে বৈদেশিক বাণিজ্য Read More »

আপনি বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দেবেন নাকি পূর্ব-পাকিস্তানের পক্ষে?

শিতাংশু গুহ, নিউইয়র্ক ক’দিন আগে বলেছিলাম, এবার নির্বাচন হবে অবাধ ও সুষ্ঠূ, নির্বাচনের পর বিতর্ক হবেনা বা সবাই ফলাফল মেনে নেবেন এবং শেখ হাসিনা আবার ক্ষমতায় আসবেন। অনেকের কাছে এ হিসাবটা মেলানো বেশ কষ্টকর। কেউ কেউ জানতে চাচ্ছেন, কিভাবে সম্ভব? কিছু মানুষ ‘গালাগালি’ দিচ্ছেন। রাজনৈতিক মঞ্চের হিসাবটা বড়ই জটিল, এজন্যেই হয়তো বলা হয়, রাজনীতিতে স্থায়ী শত্রু-মিত্র নেই? রাজনৈতিক আদর্শের কথা ভাবছেন? না, ওটি এখন কোথাও নেই, যেকোন মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়া বা থাকাই এখন আদর্শ! তবু যখন প্রশ্ন উঠবে, বা ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে যে, আপনি বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দেবেন নাকি পূর্ব-পাকিস্তানের পক্ষে? সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনগুলো মোটামুটি সুষ্ঠূ হয়েছে বা হচ্ছে, বিএনপি এতে অংশ নিচ্ছেনা বটে, কিন্তু আওয়ামী লীগ বিরোধী প্রার্থীদের ভোট দিচ্ছে, ভেতরে ভেতরে প্রচারণা চালাচ্ছে, ফলাফল সবার জানা। ছয় মাস আগে যাঁরা জোর দিয়ে বলতেন যে, আওয়ামী লীগের জয়ের কোন সম্ভাবনা নেই, এখন তারাই বলছেন, আওয়ামী লীগের বিকল্প নেই। এদের যুক্তি হচ্ছে, বাংলাদেশের মত একটি দেশে, যেখানে সেনাবাহিনী, পুলিশ, প্রশাসন সবাই সরকারের পক্ষে এবং জনগণ বিভক্ত, সেখানে নির্বাচনের ফলাফল সরকারি দলের পক্ষে যেতে বাধ্য। বিএনপি সমর্থক ভাসমান জনতা, জামাতের ক্যাডার ভিত্তি হয়তো উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পারে, নির্বাচনের ফলাফলে খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনা। বাংলাদেশে সাধারণ ভোটারদের একটি ‘আজব’ মনস্তাত্ত্বিক দর্শন আছে, এঁরা নিজের ভোটটি ‘নষ্ট’ (!) হতে দিতে রাজি নন! অর্থাৎ যাঁরা জিতবে, ভোট তারাই পাবেন। বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহ্যগতভাবে ‘এন্টি-গভর্মেন্ট’, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রাগ-ক্ষোভ তাই বেশি। সরকার যেমন যথেষ্ট ভাল কাজ করেছে, অপকর্মের তালিকা ততটা ছোট নয়! ১৯৭৩-১৯৭৫-এ যাঁরা জাসদ-এর রাজনীতি দেখেছেন, তাঁরা জানেন, ঐসময় জাসদ ফুলে-ফেঁপে উঠেছিলো, কারণ তখন রাজাকার, আলবদর, স্বাধীনতা বিরোধী, মৌলবাদী গোষ্ঠী, পাকিস্তানপন্থী সবাই জাসদে ঢুকে ‘দেশপ্রেমিক’ সেজে গিয়েছিলো। বর্তমান আওয়ামী লীগের অবস্থাও অনেকটা একই? সবাই এখন আওয়ামী লীগ! সবাই এখন বঙ্গবন্ধু-প্রেমিক। টঙ্গীর নির্বাচন সুষ্ঠূ হয়েছে। টঙ্গীর নির্বাচন থেকে কি আওয়ামী লীগ শিক্ষা নেবে? মজার ব্যাপার হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরকার যে তিনজনকে খুব কাছে টেনে নিয়েছে, এদের কেউ যৌবনে ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগ করেনি। এই তিনজনের একজন বাদে বাকি দু’জন ব্যর্থ। দেশেও একই অবস্থা, জামাত থেকে এসে যিনি আওয়ামী লীগের কোন না কোন ইউনিয়ন বা মহকুমার প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি হয়েছেন, তাঁর দলীয় আনুগত্য তো ছাত্রলীগের একজন কর্মীর মত হবার কথা নয়? দোর্দন্ড প্রতাপশালী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে যখন ফেলা যাচ্ছিলো না, তখন একদল ‘স্তাবক’ সেই কাজটি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু’র জন্যে একই কথা প্রযোজ্য। বঙ্গবন্ধু’র বৃদ্ধ পিতা মারা যাওয়ার পর মুস্তাক আহমদ যত কেঁদেছিলেন, বঙ্গবন্ধুও ততটা কাঁদেননি। বঙ্গবন্ধু নিহত হবার সময় দলের যে অবস্থা ছিলো, এখনো অবস্থাটা প্রায় একই? তফাৎ হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু সবাইকে বিশ্বাস করতেন, রাজনৈতিক পোড় খাওয়া শেখ হাসিনা কাউকেই বিশ্বাস করেন না! দলের অবস্থাটা তিনি জানেন বলেই এখন দলকে ‘ট্র্যাক-এ’ আনার চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে সুফল পেতে শুরু করেছেন। স্থানীয় নির্বাচনগুলো এর প্রমাণ। বিএনপি ফ্যাক্টর নয়, বিএনপি-জামাত চেষ্টা করছে গণ-অসন্তোষ নিজেদের পক্ষে টানতে, যা স্বাভাবিক। বিএনপি ভাবছে, আমেরিকা তাদের উদ্ধার করবে। এটি ভ্রান্ত ধারণা, বাইডেন গিয়ে তারেককে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবেনা, খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেবেনা। নুরু-কিবরিয়া ঝগড়ার মত দেশবাসী ফখরুল-রিজভী’র ‘বাহাস’ দেখবেন না? মোদীর আমেরিকা সফরে বোঝা গেছে যে, শেখ হাসিনা’র সরকারের বিরুদ্ধে যা হচ্ছে, তা একই সাথে মোদীরও বিরুদ্ধে, সুতরাং এই দুই নেতা-নেত্রী একত্রে তা প্রতিহত করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতার পক্ষে দু’জনকেই জিতে আসতে হবে। ইসলামী শক্তির একটি অংশ এবার সরকারের সাথে আছে, এঁরা ভোট না দিলেও বিরোধিতা করবে না? সফলতা-ব্যর্থতা নিয়েই একটি সরকার চলে! এতকাল আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা হলেও এখন সফলতা আলোচনায় আসছে। আদর্শিকভাবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মধ্যে হয়তো এ সময়ে তেমন বিশাল পার্থক্য নেই, কিন্তু বঙ্গবন্ধু’র সাথে জিয়ার তুলনা যেমন চলেনা, শেখ হাসিনা’র সাথেও তেমন খালেদা জিয়ার তুলনা অর্থহীন। শেখ হাসিনা ছাড়া বাংলাদেশ অচল, খালেদা জিয়া-তারেক রহমান থাকা পর্যন্ত বিএনপি’র ভবিষ্যৎ অন্ধকার! শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। আওয়ামী লীগের বিকল্প বিএনপি নয়! সরকার এবার নির্বাচনটি সিরিয়াসলি নিয়েছে। সরকারের লোকজন সর্বত্র পৌঁছাচ্ছেন। ডিজিটাল আইনের প্রতি ক্ষোভ আছে, আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘শিগগিরই সংশোধন আসছে’। হিন্দুরা সুরক্ষা আইন ও কমিশন চাচ্ছে, হয়তো সেটি পাবে। আওয়ামী লীগ নেতারা মুখে কিছুটা লাগাম টেনেছেন। অর্থাৎ ইতিবাচক অনেক কিছু ঘটছে, আরো ঘটবে। ঘটুক। বাংলাদেশ জিতুক। পূর্ব-পাকিস্তান হারিয়ে যাক। মিডিয়ায় দেখলাম, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী হজ্ব করতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন, সুসংবাদ যে তাঁকে পাওয়া গেছে। নির্বাচনের আগে যদি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা হারিয়ে না যান, বা তাঁরা মাঠে থাকেন, তাহলে জয় পাওয়া খুব একটা কঠিন হবেনা। –

`পাকিস্তানি প্রত্যয় এখনও সজীব’ কেন ?

বিমল প্রামাণিক বড় দেশের পাশাপাশি ছোট দেশ থাকলেই যে পারস্পরিক সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকবে না ইতিহাসে এমন কোন স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম দেখা যায় না। আবার পড়শি দেশের সঙ্গে বৈরি সম্পর্কের দৃষ্টান্তও পৃথিবীতে বিরল নয়। যেমন ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক। দেশভাগের কারণে সৃষ্ট দুটি দেশ জন্মলগ্ন থেকেই শত্রুভাবাপন্ন হওয়ার প্রধান কারণ ধর্মীয় ভিন্নতা, তিক্ততা। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পঁচাত্তর বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনও কি শত্রুতার পারদ কিছুমাত্র নীচে নেমেছে? এবিষয়টি নিয়ে নানা বিশ্লেষণ, তথ্য এবং ইতিহাস আমাদের দেশের নাগরিকদের জানা থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ইতিহাস সরল রেখায় চলে না। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল বিচ্ছিন্ন হয়ে যে নতুন দেশ গঠিত হল – সে দেশ পাকিস্তান আন্দোলনের মূল ভাবনা দ্বিজাতিতত্ত্বই শুধু অস্বীকার করলো না, বাঙালি জাতীয়তাবাদকেই আঁকড়ে ধরল। পাকিস্তান আন্দোলনের প্রাক্কালে বাঙালি মুসলমান নেতৃত্ব ইসলামি রাষ্ট্রের মোহে মুসলমানকে বাঙালি জাতিসত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করেই শুধু ভাবতে শুরু করলো না, বাঙালি হিন্দুদের পূর্ব-পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত করা তাদের অন্যতম প্রধান কাজ বলে মনে করতে লাগলো। সরকারিভাবে হিন্দু বাঙ্গালিরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়ে গেল। ভারতবর্ষকে প্রধান শত্রুতে পরিণত করে ফেলতেও ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানের চিন্তা চেতনায় আটকাল না। অথচ বিরাট সংখ্যক মুসলমান বাঙ্গালি-সহ ভারতে থেকে গেল ভারতের অন্যান্য নাগরিকের সমঅধিকার নিয়ে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও তাদের নাগরিক অধিকার খর্ব হল না। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে স্বাধীন বাংলাদেশের মুসলমান নেতৃবৃন্দ এবং জনগণ বাঙালি জাতিসত্ত্বা-ভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ কতটুকু মেনে নিতে পেরেছিলেন? মাত্র চারবছরেরও কম সময়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ঘোষণা ও পরিচালনাকারী মূল নেতৃবৃন্দকে কীভাবে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব হল? যারা ক্ষমতা দখল করলো তারাও তো বাঙালি মুসলমান! জাতীয়তাবাদী ভাবধারা থেকে রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা ইসলামি ভাবধারা প্রতিষ্ঠা করল, অনেকে বলেন পাকিস্তানিকরণ – তারাও তো বাঙালি মুসলমানই! তবে কি বাঙালি জাতিসত্তাভিত্তিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানের সমর্থন ছিল না ? না কি তারা পাকিস্তানপন্থী মুসলমানদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন? মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে একটি বড় সংখ্যক বাঙালি মুসলমান যে পাকিস্তানি সেনা শাসন ও অত্যাচারের সহযোগী হিসাবে পূর্ব-পাকিস্তানকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিল – আমরা তার প্রত্যক্ষদর্শী। তারা মোটেই কম শক্তিশালী ছিল না। হেন গর্হিত অপরাধ নেই যা তারা করেনি। স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পরে বাংলাদেশ সরকার ঐ সকল পাকিস্তানি দালাল ও ঘোরতর যুদ্ধাপরাধীদেরকে হাতে ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিচার করতে ব্যর্থ হল কেন? সেই সব যুদ্ধাপরাধীর তালিকাই বা জনসমক্ষে আনা হল না কেন? সেইসব পাকিস্তানি বাঙালি সেনা, পুলিশ, রাজাকার, আলবদর প্রভৃতি ও নয়মাস পাকিস্তান সরকারের চাকরিতে রত দালালগণ, মুক্তিযুদ্ধের যারা প্রধান শত্রু ছিল – তাদের বিচার-বিবেচনা ব্যতিরেকে সাধারণ ক্ষমতার আওতায় এনে নতুন স্বাধীন দেশের সমাজ-সংস্কৃতি–প্রশাসন এবং সর্বোপরি নীতি-আদর্শকে কি রক্ষা করা সম্ভব ছিল? না, তা যে কত বড় ভুল ছিল ১৯৭৫ সালের মধ্যেই নেতৃবৃন্দের সমূলে উৎপাটন ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পাকিস্তানি ভাবাদর্শে পুনরায় প্রতিষ্ঠাকরণ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও কি বাঙালি তা থেকে শিক্ষা নিতে পেরেছে? আজকে অর্ধ-শতাব্দি পেরিয়ে এসেও আমরা কি দেখছি – তা বলার প্রয়োজন আছে বলেই মনে করি। “Frequent failure of living with a multicultural ethos has jeopardized communal harmony, and defaced the secular fabric of the society. Islamization has always been, historically a `power concept’. When a secular forces come forward to protect social harmony on the basis of a dominant culture with a highly powerful assimilating forces, forces of Islamization might claim their due and finally crave for a division of the same, assertive secular society.” … After the assassination of Sheikh Mujib in 1975, the relevance of the very Bangladesh concept of 1971 was lost, and Bangladesh became a state tilting towards Islamization. All this shows that the emergent idea of a secular Bangladesh, partially apparent in 1971, was not only missing but was probably mistaken.”1 মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশে যে আদর্শের দোদুল্যমানতা, অর্ধশতক অতিক্রম করেও তার অবসান তো ঘটলোই না – বলা যায় আরও জটিলতা বেড়েছে। নানা স্বার্থবাদী রাজনৈতিক শক্তি, যারা মুক্তিযুদ্ধের ঘোরতর শত্রুতা করেই ক্ষান্ত হয়নি বরঞ্চ অতি দ্রুত বাংলাদেশকে পাকিস্তানিকরণের স্বপ্নে বিভোর ছিল, তারাই আজকে গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রামে অবতীর্ণ । গণতন্ত্র হত্যার দায় যারা কোন যুক্তিতেই এড়িয়ে যেতে পারে না – তাদের দ্বারা নাগরিক এবং মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বিশ্বাসযোগ্য হবে কেন? তাদের পূর্বসূরি, যারা বাংলাদেশের মানুষের নিকট অপরিচিত নয়, তাদের দুষ্কর্মের ইতিহাস — বাঙালিদের স্মৃতিশক্তি যতই ক্ষণস্থায়ী হোক –- তা এত অল্প সময়ে মুছে ফেলা যাবে কি? জনগণের গণতন্ত্র চর্চার দাবির মান্যতা যদি তৎকালীন পাকিস্তানে স্বীকৃতি পেত, তবে উপমহাদেশের মানচিত্র ভিন্নতর হতে পারতো। বর্তমানের শাসক সম্প্রদায় একথা অনুধাবন করে বলেই বাংলাদেশের মানুষের এখনও সরকারের প্রতি বিশ্বাস রয়েছে। যেহেতু জনগণই গণতন্ত্রে ক্ষমতার চাবিকাঠি, তাই তাদের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে। বর্তমান আওয়ামি লিগ সরকার বার বার একথা উচ্চারণ করায় জনগণের আস্থা অটুট থাকবে একথা আশা করা অমূলক নয়। পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আজকে জোরগলায় একথা বলছেন যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পূর্ব-পাকিস্তানে বর্বর গণহত্যা চালিয়ে পাকিস্তানের ইতিহাস কলঙ্কিত করেছিল। যদিও ইমরান খান বাহান্ন বছর পর একথা বলেছেন ব্যক্তিগত স্বার্থে। পাকিস্তানি মুসলমান নেতৃবৃন্দ একথা কখনও স্বীকার করেনা। এটা মুসলমান আক্রমণকারীদের জেহাদের অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের অঙ্গ। আজ যারা বাংলাদেশে তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রবক্তা সেজে মঞ্চে নাচনকোঁদন করছে তারাই তো উনিশশো একাত্তরের পাকিস্তানি কোলাবরেটরদের উত্তরসূরি। ইতিহাস থেকে একথা কি মুছে ফেলা হয়েছে না মানুষকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে ? ‘পাকিস্তানি প্রত্যয় এখনও সজীব’ প্রবন্ধে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, “১৯৪৭ থেকে ১৯৫৪ মুসলিম লীগই দেশ শাসন করেছে এবং এ প্রত্যয়টি বাঙালির মানসিকতায় প্রোথিত করেছে। মুসলিম লীগের অবসান হয়েছে, তারা আর ফিরে আসেনি কিন্তু এ প্রত্যয়টির প্রভাব বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে যথাযথভাবে আছে। বঙ্গবন্ধু এ প্রত্যয় থেকে বেরুবার চেষ্টা করেছেন, জয়লাভও করেছেন। কিন্তু তাকে হত্যার পর যখন বামপন্থী, আওয়ামি লিগার, মুক্তিযোদ্ধারা জিয়ার দলে ভিড়লেন তখন বোঝা গেলো, ১৯৭১ সালও বাঙালিকে এ প্রত্যয় থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে পারেনি।’’২ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তার লেখায় যেসব জায়গায় ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের বাঙালি হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন, তখন কি তারা দ্বিজাতিতত্ত্বের উপর প্রত্যয় হারিয়ে ফেলেছিলেন ? এমনকি শেখ মুজিবসহ মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নেতৃবৃন্দ নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া সত্ত্বেও যখন দল-মত নির্বিশেষে এমন কি যারা বাংলাদেশ মুক্ত করার জন্য লড়াই পর্যন্ত করেছিলেন তারাও বাংলাদেশের প্রতি প্রত্যয় দেখাতে ব্যর্থ হলেন কেন? এবিষয়ে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘জীবনের স্মৃতিদীপে’ গ্রন্থে অনেক প্রণিধানযোগ্য মন্তব্য করেছেন, তা থেকে একটি উদ্ধৃতি করা হলঃ “তাঁর (বিপ্লবী ত্রৈলক্যনাথ চক্রবর্তী) গ্রন্থে (জীবনস্মৃতি) তিনি হিন্দুদের প্রতি মুসলমান সরকার ও সম্প্রদায়ের যে অত্যাচারের বিবরণ দিয়েছেন – তারজন্য পূর্ববঙ্গের মুসলমানরাই যে দায়ী এ সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। পশ্চিম পাকিস্তানের সরকার এবিষয়ে হয়ত উদাসীন ছিলেন, এবং তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায় যে এবিষয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের পরোক্ষ সহানুভূতি ছিল তথাপি মূলতঃ যে পূর্বপাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশের মুসলমানরাই …

`পাকিস্তানি প্রত্যয় এখনও সজীব’ কেন ? Read More »

বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ ও মুক্তিযুদ্ধ

বিমল প্রামাণিক সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন সংবিধানে (১৯৭২) যে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইঙ্গিত মিলেছিল অচিরেই তা দ্রুত মুছে যেতে লাগল। “একটি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারা জাতীয় জীবনের বহুধাবিভক্ত স্রোতকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করে। বিদ্যমান অবস্থার একটি বড় প্রভাবসৃষ্টিকারী উপাদান হল এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিচয় বুঝতে হলে আমাদের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা মানতে হবে। পাকিস্তান সৃষ্টির কারণের মধ্যেই উগ্র সাম্প্রদায়িকতা বিদ্যমান থাকায় পাকিস্তানের পুরো আমলে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক প্রভাব এক জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে বাঙ্গালিত্বকে ছাড়িয়ে মুসলমানত্ব মুখ্য হয় এবং সযত্নে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্নতা আনয়নের দুর্বার চেষ্টা চালানো হয়। শাসকশ্রেনী রাজনীতি ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানদের ধর্মীয় পরিচয়কে সরকারিভাবে সামনে নিয়ে আসে এবং তা বাস্তবায়নে বহু উপাদানের সমাবেশ ঘটায় যাদের অন্যতম হলে ভারত বিরোধিতা ও হিন্দু বিরোধিতা।”১ স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষ যারা পাকিস্তান বাহিনীর দোসর লক্ষ লক্ষ বাঙালির গণহত্যাকারী, সম্পদ লুণ্ঠনকারী তাদের বিচারের আওতায় না এনে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে দিলেন শেখ মুজিবের সরকার। সাধারণ ক্ষমার আওতায় কারা ছিলেন? তারাই তো মুক্তিযুদ্ধের প্রধান শত্রু। মুসলিম লিগ, জামাতে-ইসলাম, নেজানে ইসলাম, শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ এরা সবাই গর্হিত অপরাধে অপরাধী। এটা বলা সমীচীন যে, “মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির দৃশ্যত পার্থক্য ও মালিকানাবোধ এবং সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ে উগ্রতার পরিমিতিবোধ পার্থক্যের প্রশ্ন ব্যতীত এসব শাসকদল সমলক্ষ্য ও সমউদ্দেশ্য অভিসারী পরস্পর কোন্দলরত এক গোষ্ঠীভূক্ত রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক জোট”।২ বর্তমান বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির রাজনৈতিক সংস্কৃতির উত্তরাধিকারকে প্রমাণিত করার জন্য জাতীয় জীবনের কিছু বিষয়কে উপস্থাপন করা হল। ‘ (১) আন্তর্জাতিক ইসলামি ঐক্যজোট (O.I.C. = Organisation of Islamic Conference) গঠন এবং এতে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি, (২) মুসলিম উম্মার স্বার্থ সংরক্ষণ, (৩) দেশে ক্রমবর্ধমান হারে সরকারি অর্থানুকূল্যে মসজিদ এবং মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা, (৪) ইসলামি শিক্ষা প্রসারে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, (৫) সংবিধানে পঞ্চম এবং অষ্টম সংশোধনী আনয়ন ও সংরক্ষণ বিষয়ে সমর্থনদান বা উদ্দেশ্যমূলক নীরবতা ও বাতিল বিষয়ে উদ্যোগহীনতা, (৬) সেকুলারিজম্ বিষয়ে বিরোধিতা বা কপটতাপূর্ণ বক্তব্য প্রদান, (৭) ধর্মীয় সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতির প্রতিফলন, (৮) সরকারি প্রচারমাধ্যমগুলিতে ধর্ম প্রচার, (৯) হজ পালনে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, (১০) জাতীয় বাজেটে নও মুসলিম পুনর্বাসন কর্মসূচি, (১১) ধর্ম বিষয়ে রাষ্ট্রনীতির বৈষম্যমূলক অবস্থান, (১২) ১৯৯০ ও ১৯৯২ সালে ভারতের বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশে অমুসলমানদের (হিন্দুদের) কয়েক হাজার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ভাঙ্গাসহ অন্যান্য নির্যাতনে সরকার ও রাজনৈতিক দলসমূহের নেতিবাচক ভূমিকা, (১৩) ১৯৭২ সালে একই দিনে সারা দেশব্যাপী দুর্গা প্রতিমা ভাঙচুর, (১৪) হজরত বাল চুরির ঘটনায় ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক উদ্বেগজনক পরিস্থিতি (দাঙ্গা), (১৫) ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের সময় সাদ্দাম মাতম, (১৬) শত্রু সম্পত্তি আইন, (১৭) ভারত-পাকিস্তান কার্গিল যুদ্ধকালীন (সাম্প্রদায়িক) অসহিষ্ণুতা, (১৮) আফগানিস্তানে তালেবান সরকার কর্তৃক প্রাচীন বৌদ্ধমূর্তির ধ্বংসসাধন (বাংলাদেশে উল্লাস), (১৯) ২০০১ সালের ১লা অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বাপর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত সাম্প্রদায়িক নির্যাতন। একটা নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ইতরবিশেষ পার্থক্যসহ বড় বড় সব রাজনৈতিক দলের অবস্থান হল এ বিষয়সমূহের পক্ষে।”৩ এমনকি বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামি লিগের শাসন আমলেও ২০১২ সালে চট্টগ্রামের পটিয়া, ফটিকছড়িসহ নানা জায়গায় এবং ২০২১ সালে কুমিল্লাসহ পঁচিশটি জেলায় সাম্প্রদায়িক নির্যাতন ও প্রতিমাসহ ধর্মস্থানগুলির ধ্বংসসাধন সরকার প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হল। ‘সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি বলতে বর্তমানে কি বুঝায় তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, আন্তর্জাতিক যে কোন বিষয়ে ভারতের অবস্থানের উপর নির্ভর করে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুদের নিরাপত্তার মাত্রা। অর্থাৎ কিনা ভারত এবং হিন্দুদের সমার্থকভাবে বিবেচনার পাকিস্তানি মনোভাব এখনও অটুট এবং এটা অত্যন্ত প্রভাবশালী। অবিশ্বাস্য হলেও এরূপ সমার্থক দৃষ্টিভঙ্গি মুক্তিযুদ্ধের মূল দলের শীর্ষস্থানেও অবস্থানের পরিচয় মেলে। সুতরাং আজকের বাংলাদেশের সাথে সেদিনের পাকিস্তানের লক্ষ্যনীয় বিশেষ কোন পার্থক্য নেই’।৪ বাংলাদেশের শুরু থেকেই রাজনীতিতে আদর্শ ও সমাজে নৈতিকতায় যে ঘুন ধরেছিল, গত পাঁচ দশকের সমাজ ও রাজনীতিতে তার প্রতিফলন স্পষ্ট। মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য ছিল পূর্ব-পাকিস্তানকে পাকিস্তানি শাসন থেকে মুক্ত করে বাঙালিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন। আন্দোলনরত জনগণ তাকে ‘বাংলাদেশ’ বলে অভিহিত করে। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে সাধারণ নির্বাচনের পরেও ‘বাংলাদেশের’ প্রশ্ন জনমনে দেখা দেয় নাই। মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণ, সেখানেও কোন স্বাধীন বাংলাদেশের রূপরেখা ঘোষিত হয়নি বা ঘোষণা করার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। এর পরেই ২৫শে মার্চ রাত থেকেই পাকিস্তানি গণহত্যা শুরু হয়ে গেল। ৭ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলনের ডামাডোলে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের’ বক্তব্য কোন কোন ছাত্রনেতার মুখে শোনা গেলেও জনসাধারণের উপর তার কোন প্রভাব দেখা যায়নি। অর্থাৎ পাকিস্তানি আদর্শ ও রাষ্ট্র তখনও জনমনে বদ্ধমূল। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে পূর্ব-পাকিস্তানের মুসলমান জনতা আরও কট্টর ভারত বিরোধি ও পাকিস্তানী মানসিকতায় পরিপুষ্ট হয়। এবিষয়টি আমি প্রত্যক্ষ করেছি। শেখ মুজিবের ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণার পিছনে এটি একটি বড় কারণ। ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে কোন আদর্শগত দৃঢ়তা লক্ষ করা যায়না। গত পাঁচ দশকের রাজনীতির ইতিহাসে যে সকল দল রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয় ছিল বা এখনও রয়েছে, প্রত্যেকটি দলই শুধু ক্ষমতা দখলের জন্য দলীয় নীতি-নৈতিকতা ও জনস্বার্থ বিসর্জন দিতে এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করেনি। যেহেতু ‘মুক্তিযুদ্ধ’ সমাজে ও রাজনীতিতে কোন নীতি-নৈতিকতা বা আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি বা সে সুযোগ পায়নি, ফলে দেখা যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধকারী আর মুক্তিযুদ্ধের শত্রুর সহাবস্থান একই সঙ্গে চলেছে। কারণ তারা একই পাকিস্তানি আদর্শে দীক্ষিত। আজকের বাংলাদেশে নয়, অতীতের সব সরকারই (গণতন্ত্রী- স্বৈরতন্ত্রী, প্রগতিশীল-প্রতিক্রিয়াশীল, মুক্তিযুদ্ধপন্থী- মুক্তিযুদ্ধবিরোধী) তাদের কর্মকাণ্ড, চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রগুলিতে একটি বিষয়ে একমত, বা ঐকমত্য পোষণ করে, তা হল ক্রমহ্রাসমান সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে। বিভিন্ন দলের বক্তব্যের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। যেমন, (১) সরকার ‘সংখ্যালঘু- সংখ্যাগুরু’ তত্ত্বে বিশ্বাস করে না। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খৃস্টান নির্বিশেষে সবাই বাঙালি বা বাংলাদেশী। তবে সংবিধানটিকে সংখ্যাগুরুর পক্ষে করা হল কেন ? (২) বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। কিন্তু সংখ্যালঘুরা ধারাবাহিকভাবে নির্যাতন ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার। এটা অস্বীকার করা মিথ্যাচারের সামিল। (৩) ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, এদেশে হয় না। কিন্তু ১৯৪৭ থেকে এ পর্যন্ত যত সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস হয়েছে এবং তা একপক্ষীয় ও ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়। (৪) ইসলাম শান্তির ধর্ম । অর্থাৎ অন্যান্য ধর্ম অশান্ত, তাই তারা দাঙ্গাবাজ, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য তারাই দায়ী। এটাই কি ‘শান্তির ধর্মের’ লক্ষ্য? (৫) এদেশ থেকে কোন নাগরিক ভারতে যায়নি। মিথ্যাবাদী এবং পাগল ব্যতীত সারা দেশের সব মানুষ জানে প্রতিনিয়ত সংখ্যালঘু জনগণ ভারতে চলে যাচ্ছে, দেশত্যাগ করছে চিরতরে। (৬) দুষ্কৃতিদের কোন দল বা সম্প্রদায় নেই। সত্য কথা হল, সন্ত্রাসীরা সবাই চিহ্নিত রাজনৈতিক দলের ক্যাডার। রাজনৈতিক দলগুলির এসব বক্তব্য দিতে কখনও লজ্জাবোধ করতে দেখা যায়নি। গলাবাজির রাজনীতির চোরাগলিতে হারিয়ে গেছে বাংলাদেশ, হারিয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধ। তথ্যসূত্রঃ ১। নির্যাতিত সংখ্যালঘু বিপন্ন জাতি, দেওয়ান বাজার, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ, ২০০২। পৃষ্ঠা ১৭৫। ২। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৭৬। ৩। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৭৬। ৪। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৭৭।

বাংলাদেশ রেলওয়ে নেটওয়ার্কে নতুন সংযোজন পদ্মা সেতু

শঙ্কর সরকার, বাংলাদেশ পদ্মা সেতুর উপর রেল চলাচল বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার একটা নতুন অধ্যায়। বাংলাদেশ সরকারের পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা বিশ্বব্যাংক অর্থ বিনিয়োগ বাতিল করলে ধারণা করা হয়েছিল বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এতবড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবে না এবং এ নিয়ে দেশে বিদেশে বিভিন্ন রকম আলোচনা সমালোচনা হয়। পদ্মা সেতুর নির্মাণে প্রথমে ১২ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল। পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়নে বিশ্বব্যাংক অস্বীকার করলে চীন প্রথমে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন করতে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায় এবং পরে চীন পদ্মা সেতু ২ প্রকল্প আরিচা পাটুরিয়া ঘাটে অর্থায়নের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে ঘোষণা দেয়। পরে বাংলাদেশের অন্য বন্ধুদেশ মালয়েশিয়া পদ্মা সেতুর নির্মাণে অর্থ বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে প্রস্তাব করে এবং তারপর ভারত সরকারও বাংলাদেশ সরকারের নিকট পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থ বিনিয়োগের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোয় এবং চীন, মালয়েশিয়া ও ভারতের অর্থ বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশের পর বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনা সরকার পদ্মা সেতু প্রকল্প বিষয়টি নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় প্রকল্পের কাজ শেষ করতে ২০ বা ২৫ হাজার কোটি টাকা যেটাই খরচ হোক ৫ থেকে ৬ অর্থ বছরের মধ্যে লাগবে এবং বাংলাদেশ সরকার সেই অর্থ ৫/৬ অর্থ বছরের জাতীয় বাজেট থেকে খুব সহজেই খরচ করতে পারবে। সমস্ত টাকাটা এক অর্থ বছরের মধ্যে খরচ হবে না। সুতরাং বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে সহজেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারবে এবং শেখ হাসিনা সরকার সমস্ত প্রকল্প পর্যবেক্ষণ করে পদ্মা সেতু নির্মাণের সময়োপযোগী সাহসী কাজ শুরু করে এবং শেষ করে। অবশেষে দীর্ঘ দিনের অপেক্ষায় পর গত ৪ এপ্রিল ২০২৩ মঙ্গলবার বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে প্রথমবারের মত রেল যোগাযোগ উদ্বোধন করেন। শেষ হলো অপেক্ষার পালা। পদ্মা নদীর বুকে সড়ক পথে গাড়ি চলাচল করছে অনেক দিন এবার ছুটবে রেলগাড়ি। উন্মুক্ত হল যোগাযোগের নতুন দিগন্ত। প্রথমে ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে সেতু অতিক্রম করে যাওয়া পর্যন্ত ‘গ্যাংকার’ চালানোর পরিকল্পনা ছিল। তবে এখন সাত বগির ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সূত্রমতে পদ্মা সেতুর রেল যোগাযোগ প্রকল্পে চীন থেকে কেনা নতুন সাতটি বগি ট্রেনের বহরে যুক্ত হবে। ট্রেন চলাচল করবে আমেরিকা থেকে আনা নতুন ইঞ্জিন দিয়ে। ইঞ্জিন ও বগিগুলো সৈয়দপুরে রেলওয়ে কারখানায় রাখা ছিল। সেখান থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গার উদ্দেশ্য যাত্রা করে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের একজন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা বলেন সেতুতে রেললাইন বসে যাবার পর তা পরিদর্শন করেছেন রেলমন্ত্রী। ঐদিন সেতুর উপর শুধু গ্যাংকার চালানোর পরিকল্পনা থাকলেও এখন আনুষ্ঠানিকভাবে রেলওয়ে ট্রায়াল কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনী দিনে দুপুর ১২ টায় পদ্মা সেতুতে প্রথম যাত্রা শুরু হয় এবং দুপুর ২ টায় টেনটি ভাঙ্গা থেকে মাওয়া পৌঁছায়। ৬.১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতুতে এখন শতভাগ রেললাইন বসে গেছে। এই ভাঙ্গা থেকে মাওয়া পর্যন্ত টানা ৪২ কিলোমিটার রেলপথ এখন রেলচলাচলের জন্য প্রস্তুত। রেলের কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকল্পের অধীনে প্রথমে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেন চালানো হবে। এই রেলপথ চালু হলে আরও ছয়টি রেলপথ এই রেলপথের সাথে যুক্ত হবে। প্রাথমিক ভাবনায় রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, দর্শনা, যশোরের বেনাপোল, খুলনা, রাজশাহীর ট্রেন এই পথে চালানোর পরিকল্পনা আছে। সেই ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে ভারতে যাবার মৈত্রী ট্রেনও এই পথে যাতায়াত করবে । পদ্মা সেতুর রেলওয়ে প্রকল্প চালু করার আগে অনেক জায়গায় গ্যাঙকার পরীক্ষামূলক ভাবে চালানো হয়েছে। এদিকে ঢাকা থেকে মাওয়া অংশে ১০ কিলোমিটার রেলপথ বসানো হচ্ছে খুব দ্রুতগতিতে। মাওয়া ভাঙ্গা অংশে ১২টি বড় সেতু, ২৬.৯৭ কিলোমিটার বাঁধ, ৬৯টি কালভার্ট ও আন্ডারপাস, ৭১০ টি ওয়াকিং পাইল, ৬৮ টি ভায়াডাক্ট ২ পিলার, ৬৭ টি স্পান, ১০৮ টি ভায়াডাক্ট ৩ পিলার, ১০৭ টি স্পান বসানো হয়েছে। ঢাকা থেকে রেলওয়ে সেতুর উপর দিয়ে ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত ৪২ কিলোমিটার বিশেষ ট্রেন যাতায়াত করবে। গেনডারিয়া, পাগলা, ডেমরা, কেরানীগঞ্জ এলাকায় খণ্ডখন্ডভাবে, রেললাইন বসানো হচ্ছে। বৃটিশ আমলের তৈরি সিঙ্গল রেলওয়ের পরিবর্তে বেশ মজবুত ও ঢালাই করে আংশিক ডবল লাইন রেলওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। রেলওয়ে কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী পদ্মা রেলসেতু প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, কেরানীগঞ্জ, হয়ে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং হয়ে শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও নড়াইল জেলা দিয়ে যশোরের সাথে রেল নেটওয়ার্ক যুক্ত হবে এবং এই যশোর ফরিদপুর ভাঙ্গা স্টেশনের সাথে রাজবাড়ী, কালুখালী, কুষ্টিয়া রেলওয়ে সেকশনটি পদ্মা সেতু হয়ে সরাসরি ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হবে। বর্তমান রেলপথে ঢাকার সঙ্গে খুলনার দূরত্ব ৪৬০ কিলোমিটার। পদ্মা সেতু প্রকল্পের আওতায় নতুন রেলপথটি চালু হলে দূরত্ব কমবে ২১২ কিলোমিটার। এ ছাড়া অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে নতুন পথে অনেক নতুন রেলযাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। তাতে প্রতিদিন সড়ক যোগাযোগের জন্য হাজার হাজার মানুষের ভোগান্তি কমবে, সময় বাঁচবে, জনজীবনে বয়ে আনবে নতুন মাত্রা। বাংলাদেশ রেলওয়ের এই নতুন পথে রেললাইন বসে গেলেও আরও কয়েক ধরনের কাজ বাকি আছে। সব কাজ শেষে নিয়মিত পরীক্ষামূলক চলাচলের ব্যবস্থা হবে। পদ্মা সেতুর এই নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যে সব কর্মকর্তা ও শ্রমিকরা দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তাঁরা আশা করছেন আগামী সেপ্টেম্বর/অক্টোবর ২০২৩ নাগাদ এই পথ যাত্রী পরিবহনের জন্য সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে যাবে। পদ্মা সেতুর রেলওয়ে সংযোগ প্রকল্প মোট ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা নির্মিতব্যয় ধরা হয় তার মধ্যে ১৮ হাজার ২১০ কোটি ১১ লাখ টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার বাকি ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা লোন দিচ্ছে চায়না এক্সিম ব্যাংক। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। ২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল প্রকল্পটি ফার্স্ট ট্রাক প্রকল্পের তালিকাভুক্ত করা হয়। পদ্মা সেতুর রেলওয়ে প্রকল্প শুধু রাজধানীর সাথে দেশের উত্তর ও দক্ষিণের রেল ও সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করা হয়েছে তাই নয় সমগ্র বাংলাদেশ সড়ক ও রেলপথ একটি অভিন্ন নেটওয়ার্কের আওতায় আসছে। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের সমন্বয়ে একটি আধুনিক উন্নত দক্ষিণ এশিয়া গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে এই পদ্মা সেতু।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রাজনৈতিক নানা পালাবদল এবং বাংলাদেশ—ভারত সম্পর্ক

বিভুরঞ্জন সরকারঃ বাংলাদেশের সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক (সেন্টার ফর রিসার্চ ইন ইন্দো-বাংলাদেশ রিলেশনস্ কলকাতা কর্তৃক ২০১0 সালে আয়োজিত সেমিনারে পঠিত) এক আজ আমরা দুটি পৃথক স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের নাগরিক হলেও মাত্র ছয় দশক আগেও অর্থাৎ গত শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত আমরা একই দেশের অধিবাসী ছিলাম। ১৯৪৭ সালে কোন প্রেক্ষাপটে, কীভাবে দেশভাগ হয়েছিল, সে ইতিহাস এখানে নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনাপর্বটা ছিল ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে ভারতবাসীর ঐক্যবদ্ধ চেতনার বহিঃপ্রকাশ। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মতের এবং পথের ভিন্নতা ছিল কিন্তু ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে দেশভাগের ধারণাটা যোগ হয়েছে একেবারে শেষ দিকে। যুক্ত বাংলাসহ গোটা ভারতবর্ষেই হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের সঙ্গে বসবাস করেছে। এক সঙ্গে রাজনীতি করতে তখন দুই সম্প্রদায়ের মানুষদের তেমন সমস্যা হয়নি। যুক্ত বাংলার হিন্দু সম্প্রদায় শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক কিংবা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে নেতা মেনে নিতে দ্বিধা করেননি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর এই সুসম্পর্ক বজায় থাকেনি। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা হয়েছে। স্বজন-সম্পদহারা হয়েছে দুই সম্প্রদায়ের অসংখ্য মানুষ। নানা প্রচার-অপপ্রচার-কূটকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছে যে হিন্দু এবং মুসলমান এক দেশে এক সাথে বসবাস করতে পারবে না। বৃটিশ শাসকদের ‘ভাগ করো এবং শাসন করো’ নীতি এবং কোন কোন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংকীর্ণতা, অদূরদর্শিতা ও নীতিহীনতার কারণে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষ পর্যায়ে দু’টি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে অনিবার্য করে তুলেছিল। ওই বিভক্তির ফলে বর্তমান বাংলাদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান ছিল বস্তুত একটি কৃএিম রাষ্ট্র। ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন দুটি অংশের আলাদা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অনুসারী মানুষদের কেবলমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করে এক রাষ্ট্রের নাগরিক বানানো হয়েছিল। মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের জীবনে আর কোন সমস্যা থাকবে না, সবাই রাজার হালে থাকবে – পাকিস্তান আন্দোলনের নেতাদের এমন প্রতারণাপূর্ণ প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই পাকিস্তানের পক্ষে এক ধরণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দিয়েছিলেন। যারা এই প্রতারণার বিষয়টি কিছুটা আঁচ-অনুমান করতে পেরেছিলেন, তারাও পরিস্থিতির চাপে বা অন্য যে কারণেই হোক না কেন পাকিস্তানবিরোধী জোরালো অবস্থান গ্রহণ করেননি। দু’একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু সাধারণ স্রোতটা ছিল পাকিস্তানের অনুকূলেই। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর রাজনীতির প্রধান উপজীব্য ছিল হিন্দু এবং ভারতবিরোধিতা। কিন্তু শাসকদের এ ধরণের সাম্প্রদায়িক ও একদেশদর্শী মনোভাব শুরু থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে শাসন-সঙ্কটের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। আর সে জন্যই বাঙালি মুসলমানদের মোহভঙ্গ হতে বেশি সময় লাগেনি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই ‘রাষ্ট্রভাষা’ প্রশ্নে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর প্রকৃত চেহারা বাঙালিদের সামনে উন্মোচিত হতে থাকে। জনসংখ্যার দিক থেকে বাঙালিরা ছিল পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু। সে হিসেবে বাংলাই হওয়া উচিৎ ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বলা হল উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা অর্থাৎ বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতেও তারা কুণ্ঠিত ছিল। উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বেশির ভাগই ছিলেন উর্দুভাষী। সে জন্য শাসকগোষ্ঠীর মুখের ভাষাকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়। আর এ থেকেই বাঙালিরা বুঝতে শুরু করে যে, ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা রাষ্ট্র কায়েম হলেও সে রাষ্ট্রে বাঙালিদের অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে টিকে থাকা সম্ভব হবে না। মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়ার বিষয়টিকে বাঙালিরা একেবারেই ভালো চোখে দেখেনি। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকার রাজপথে অকাতরে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে বাঙালি এক নতুন ইতিহাস রচনা করেছিল। ভাষা আন্দোলনকে ভারতীয় অনুচরদের ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করেও মানুষকে বিভ্রান্ত করা যায়নি। ভাষা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের প্রতি বাঙালির মনে যে ঘৃণার জন্ম নিয়েছিল, তা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ঘটনায় কেবল বেড়েছে। একের পর এক আন্দোলন-সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানের বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীকে অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি, ষাটের দশকে রবীন্দ্রবিরোধিতা তথা বাঙালির ভাষা- সংস্কৃতির ওপর আঘাত, শোষণ-বৈষম্য, পশ্চিম অংশের উন্নয়ন এবং পূর্ব অংশের প্রতি ক্রমাগত বঞ্চনা চলতে থাকায় বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভ- অসন্তোষ ধুমায়িত হতে থাকে। পাকিস্তানে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে তারা সবাই ছিল প্রতিক্রিয়াশীল ধ্যানধারণার অধিকারী, গণবিরোধী ও উচ্চাভিলাষী। গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি তাদের সামান্য শ্রদ্ধাবোধ ছিল না। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় অর্থাৎ পাকিস্তানের পূর্ব অংশে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিদার সংগঠন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ভরাডুবি এবং আওয়ামি লিগের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের অভূতপূর্ব বিজয় রাজনীতিতে নতুন বাতাবরণ সৃষ্টি করে। নির্যাতনের ফলাফল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে শঙ্কিত করে তুলেছিল। বাঙালির ন্যায়সঙ্গত দাবি-দাওয়া সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা না করে শাসকগোষ্ঠী ভুল পথ অনুসরণ করেছিল। ক্রমাগত, সাম্প্রদায়িক প্রচারণা, উগ্র ভারতবিরোধিতা, গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে যারা কথা বলে তাদের ঢালাওভাবে ভারতের দালাল হিসেবে প্রচার করা- এগুলোই ছিল পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর আত্মরক্ষার ঢাল এবং হাতিয়ার। অথচ অতি ব্যবহারে এই হাতিয়ার এক সময় ভোঁতা হয়ে যায় বা কার্যকারিতা হারায়। বাঙালি জাতি ভয়কে জয় করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। দুই ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর হঠাৎ আক্রমণ শুরু করার পরই বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং শুরু হয় এক অসম ও রক্তাক্ত যুদ্ধ। যুদ্ধটা বাঙালির ওপর আকস্মিকভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল সত্য, কিন্তু পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসন-শোষণ, অত্যাচার-নির্যাতনের কারণে এটা ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখা এক পর্যায়ে অসম্ভব হয়েই পড়বে। ভাঙনটা কবে, কীভাবে ঘটবে সেটাই ছিল দেখার বিষয়। পাকিস্তানি শাসকরাই বাঙালিকে স্বাধীনতার দিকে ঠেলে দিয়েছে, প্রতিরোধে বাধ্য করেছে। ধাপে ধাপে আন্দোলনের উত্তরণ ঘটেছে। নতুন নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। আর এসব আন্দোলনের সব পর্যায়েই শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতি ও সক্রিয় ভূমিকা ছিল। তাই বলা যায়, শেখ মুজিবুর রহমান রাতারাতি নেতা হননি। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করতে গিয়ে তিনি ধারাবাহিকভাবে জেল-জুলুম-অত্যাচার সহ্য করেছেন। পাকিস্তানের ২৪ বছরের ১২ বছর কেটেছে তাঁর কারাগারে। তিনি গোড়াতেই এটা উপলব্ধি করেছিলেন যে, পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্য থেকে বাঙালি তার অধিকার পাবে না। এ জন্য পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই। ষাটের দশকের প্রথম দিকেই তিনি আত্মগোপনে থাকা কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আলোচনা শুরু করেছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূল না থাকায় তখনই প্রকাশ্যে এ ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। অপেক্ষা করা হচ্ছিল উপযুক্ত সময় ও সুযোগের। শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সংবলিত ৬ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করার পর পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট, মিলিটারি ডিক্টেটর আইয়ুব খান এবং তার মন্ত্রণাদাতাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে শেখ মুজিব কোন পথে হাঁটছেন, কোথায় তাঁর গন্তব্য। শেখ মুজিবকে ঘায়েল করার জন্য তাঁকে প্রধান আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। আইয়ুব খান ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা ভেবেছিলেন এই ষড়যন্ত্রমূলক রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারা সম্ভব হবে। ভারতের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তান ভাঙার কাহিনী মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠলে শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা শূন্যে নেমে আসবে এবং সেই সুযোগে বিচারের নামে তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলান সহজ হবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটে উল্টো ঘটনা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফলে শেখ …

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রাজনৈতিক নানা পালাবদল এবং বাংলাদেশ—ভারত সম্পর্ক Read More »

বিএনপি-জামাত মিত্রতায় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কোনদিকে ?

পূর্ণিমা নস্কর বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুবই স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামি লিগের মতোই বিএনপির নামও সমভাবে উচ্চারিত হয়। একাত্তরের ঘাতকদের ফাঁসির দাবিতে (২০১৩ সালে) যখন এদেশের সর্বস্তরের মানুষসহ দেশ-বিদেশের মাটিতে পরিচালিত হওয়া বিভিন্ন ধরণের আলোচনা ও জনমানসে আশার সঞ্চার হয় তখন বিএনপির মতো একটি বড় দলের আচরণ, নেতৃবৃন্দের কথাবার্তা, নেতাকর্মী ও সমর্থকদের অবস্থান দেখে সাধারণ মানুষ বেশ বিস্মিত হয়। তাদের এই বিস্ময়ের প্রেক্ষাপট অনুসন্ধান করতে হবে জিয়াউর রহমানের সময়কাল থেকেই। ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসেই সশস্ত্র সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ মুজিবর রহমান ও তাঁর সরকারের পতনের পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে কয়েক দফা সামরিক অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের পর নভেম্বর মাসে সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল (পরবর্তীকালে লেঃ জেনারেল) জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। দেশে গণতন্ত্র রক্ষার নামে প্রহসনমূলক গণভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে জিয়াউর রহমান বিএনপি /বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর) গঠন করে সামরিক শাসনের সূচনা করেন।“১ ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য জিয়াউর রহমান সামরিকায়ণের উপর গুরুত্ব দেন। তিনি আইনের সুযোগ ও ক্ষমতাবলে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের চেতনা ও আদর্শকে ধুলিসাৎ করে পাকিস্তানি আদর্শ এবং ধ্যান-ধারণার পুনঃপ্রবর্তন করেন। তাঁর দ্বারা গ্রহণ করা প্রথম পদক্ষেপটি ছিল – বাংলাদেশে উদার প্রগতিশীল রাজনীতির বিকাশের পরিপন্থী ও দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল জামাত-ই-ইসলামির পুনঃপ্রতিষ্ঠা। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, জামাত-ই-ইসলামি ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘোরতর বিরোধী ও একটি ইসলামি মৌলবাদী দল। আর জামাত-ই-ইসলামি দলের অন্যতম নেতা গোলাম আজমকে (১৯৭২ সালে যার বাংলাদেশী নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়) রক্ষা করার মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের শত্রুকেই প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন । আসলে জামাত-ই-ইসলামি মৌলিকভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের সামরিকীকরণের বিরোধিতা করেনি। জামাত-ই-ইসলামির সাথে আমলাতন্ত্রের শ্রেণীগত কোন পার্থক্য ছিল না। ফলে ১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের পর, শেখ মুজিবর রহমানের পরবর্তী শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান তাঁর ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী ও শক্তিশালী করার জন্য জামাত-ই-ইসলামি দলের বিরোধিতা না করে তাদের সমর্থনের মাধ্যমেই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যান বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের অভিমুখে। এটাই পাকিস্তানপন্থী ইসলামি জাতীয়তা । ধর্মের দোহাই দিয়ে উগ্র সাম্প্রদায়িক শ্লোগানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা জামাত-ই-ইসলামি নামক রাজনৈতিক সংগঠনটির প্রতি জিয়াউর রহমান এতটাই মোহাবিষ্ট হয়েছিলেন যে, তিনি ইসলামি সাইমুন (বাতাস) কে দৃঢ়ভাবে বজায় রাখার জন্য সংবিধান সংশোধন আইন পাশ করেন। ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল পঞ্চম সংশোধন আইন পাশ হয়। পঞ্চম সংশোধনীতেই সংবিধানের প্রারম্ভে “‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’ বাক্যটি সংযুক্ত করেন। এব্যতীত দেশের নাগরিকগণ ‘বাংলাদেশী’ হিসেবে পরিচিত হবেন বলে ঘোষণা করা হয়। ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসকে অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। সংবিধানের অন্যান্য মূলনীতির মধ্যে সমাজতন্ত্রকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার অর্থে গ্রহণ করা হয়। আর মৌলিক অধিকারসমূহ বলবৎকরণের অধিকার বা এক্তিয়ার হাইকোর্ট বিভাগের ওপর ন্যস্ত করা হয়। একদলীয় ব্যবস্থা রহিত করে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার পদ্ধতি বহাল রাখা হয়।”২ সুতরাং, বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীটিই বাংলাদেশকে সহজেই ইসলামি রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হওয়ার পথকে প্রশস্ত করে দিয়েছিল। জিয়াউর রহমান মুজিব আমলের সংবিধানকে তছনছ করে দেন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ত্রিশ লক্ষ বাঙালির আত্মত্যাগের বিষয়টিকেও গুরুত্বহীন প্রমাণিত করে দিলেন। আসলে ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমানের প্রশ্রয়ে আত্মপ্রকাশ করা ঘাতক দালাল জামাত-ই-ইসলামি ও তাদের বাহিনী রাজাকার আলবদররা বাংলাদেশের মাটিতে জেঁকে বসেন। ১৯৭১-এর পরাজিত শক্তি জামাত সামরিক সরকারের আশীর্বাদে রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হয় এবং রাজনৈতিক দল করার অনুমতিও লাভ করে। এসময় খুব স্বাভাবিকভাবেই আশা করা যায়নি যে, জামাতীরা তাদের অতীত ভূমিকার জন্য অনুতপ্ত হবে। কিন্তু তারা উল্টে ঘোষণা করলো –‘একাত্তরে আমরা যা করেছি ঠিকই করেছি।’৩ আর এই অবস্থায় বিএনপি-জামাত সমঝোতা যে ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের ফসল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিতকে নড়বড়ে করে দেবে – তা বলাই বাহুল্য। বাংলাদেশের সামরিক শাসনকালের প্রারম্ভিক পর্যায় থেকে বিএনপি-জামাত সমঝোতা, বন্ধুত্বই মুজিব পরবর্তী বাংলাদেশী সমাজকে পুনরায় পাকিস্তানিকরণের পথকে আরও সহজ করে দিয়েছিল। বাংলাদেশী সমাজে এর প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় এইভাবে – জামাতীয়দের দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের মতো বিশ্বকবি, ‘বিজাতীয়, বিধর্মী কবি হিসেবে আখ্যায়িত। রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক রচিত গান, ‘আমার সোনার বাংলা’ তথা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতকে বাতিল করার প্রস্তাব বাংলাদেশের সমাজে উচ্চারিত হয়। পাঠ্যপুস্তক থেকে রবীন্দ্রনাথ বাতিল হয়। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বাংলাদেশে পূর্বতন সামরিক শাসন বজায় থাকল পরবর্তী শাসক এরশাদের হাত ধরে। অর্থাৎ জিয়াউর রহমানের আমলে ইসলামিকরণের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়, পরবর্তী শাসক, হুসেইন মহম্মদ এরশাদের আমলে (১৯৮২-১৯৯০) তা পূর্ণতা লাভ করে। তিনি বাংলাদেশে কোরাণ ও সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন গ্রহণ না করার কথা ঘোষণা করেন। প্রতি শুক্রবার এক এক মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায় করেন এবং নামাজ শেষে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কথা বলতে থাকেন। এছাড়া পাকিস্তানপন্থী পীরদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান, কওমী মাদ্রাসার পুনঃপ্রতিষ্ঠা – এসব কিছুই জামাতীদের মনোভাবকে সমর্থন করারই নামান্তর। এপ্রসঙ্গে আরও একটি ঘটনার কথা বলা যায়। সেটি হল –“১৯৮৭ সালে মে-জুন মাসে ফরিদপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলায় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, অত্যাচার ও লুটপাট সংঘটিত হয়। বায়তুল মোকারম মসজিদের (জাতীয় মসজিদ) মুসল্লিদের সভায় তখন মৌলবাদী জামাত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী ঘোষণা করেছিলেন, দিল্লি, মিরাটসহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় মুসলমান ভাইদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে হবে।”৪ এসব কিছু থেকে একথা বলা যায় যে, এরশাদ তাঁর পূর্ববর্তী শাসকের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন এবং তিনিও জামাত-ই-ইসলামি দলকে বাংলাদেশের মাটিতে তাদের শিকড় শক্ত করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। আর তাঁর এই মানসিকতার পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছিল “১৯৮৮ সালের জুন মাসে। সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর দ্বারা রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে।”৫ আর এটি ছিল এদেশে ইসলামিকরণ প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত রূপ এবং জামাতীদের সুপ্ত বাসনার পূর্ণ প্রতিবিম্ব। অতএব ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত সময়টুকুকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধীকাল বললে ভুল হবে না। কেননা সামরিক সমাজের প্রতিনিধিরা প্রথম থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের অবস্থান রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সুদৃঢ় করেছেন। জিয়াউর রহমান এধারা শুরু করেছিলেন এবং এরশাদ তা করেছিলেন সংহত। তাইতো ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, যাদের বিচার হওয়ার কথা ছিল যুদ্ধাপরাধী হিসেবে (জামাত নেতা গোলাম আজম সহ প্রমুখ) তারাই দেশের কর্ণধার হিসেবে মর্যাদা পেয়েছেন। জিয়াউর রহমান ও এরশাদের একযুগের শাসন, বাংলাদেশে বকলমে পাকিস্তানি শাসনকে শুধু প্রজ্বলিত রাখেনি; সেই শিখাকে অকম্পিত রাখার জন্যও ব্যবস্থা করা হয়। এরশাদের পতনের পর জিয়া পত্নী বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসেন। তিনিও তাঁদের থেকে ব্যতিক্রমী ছিলেন না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার সামনে জেনারেল জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। তাঁর রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক চিন্তা জিয়াউর রহমান থেকে ভিন্ন হওয়ার কথা নয়, কারণ তিনি তাঁরই উত্তরসূরি। ২০০১ সালে সামরিক-বেসামরিক আমলারা জোটবদ্ধ হয়ে বিএনপি-জামাতকে ক্ষমতায় আনতে সাহায্য করে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামাত ক্ষমতায় থাকে। এসময় স্বাধীনতা বিরোধীদের মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয় এবং এই ঘটনার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আদর্শের প্রতি অবজ্ঞা করা হয়। শুধু তাই নয়, এই সময়কালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস ও দুর্নীতির প্রসার ঘটার সাথে সাথে শুরু হয় এথনিক ক্লিঞ্জিং (ethnic cleansing)। শুরু হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সমূলে উৎপাটিত করার কাজ। খালেদা জিয়ার শাসনকাল বাংলাদেশের ইতিহাসে কালো অধ্যায় বললেও ভুল হবে না। এসময়কালে বাংলাদেশ যে রাজনীতি ও সরকারি মিথ্যাচার প্রত্যক্ষ করল তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু ছিল না। এপ্রসঙ্গে আওয়ামি লিগের …

বিএনপি-জামাত মিত্রতায় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কোনদিকে ? Read More »

পাকিস্তানি গণহত্যাঃ শরণার্থী সমস্যা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আন্তর্জাতিক জনমত গঠন

বিমল প্রামাণিক ডাইরেক্টর, সেন্টার ফর রিসার্চ ইন ইন্দো-বাংলাদেশ রিলেশনস্, কলকাতা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও সামরিক সরকার ঢাকাসহ পূর্ব-পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে বাঙালি জনগণের উপর গণহত্যা শুরু করে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত প্রথম সাধারণ নির্বাচনে বিপুল জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবর রহমানকে বঞ্চিত করা। বাঙালিদের উপর পাকিস্তানি শাসন এবং শোষণ অব্যাহত রাখা। এটা বুঝতে পেরেই ২৬শে মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের অত্যাচার ও গণহত্যার কারণে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে, গ্রাম ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে সীমানা পেরিয়ে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিতে শুরু করে। মাত্র আড়াই মাসের মধ্যে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহেই ভারতে শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০ লক্ষ। ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়া মহাদেশের অনেক দেশই এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। জুন মাসের ১ তারিখে বৃটিশ লেবার দলের এম পি মাইকেল বারনেস মুক্তিযুদ্ধের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ও পাকিস্তানি অত্যাচারের শিকার হয়ে যারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের দুর্দশা সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন ‘the world must help to find a solution to the tragedy.’ মিঃ বারনেস এবং মিঃ ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ, চেয়ারম্যান, ‘war on want’ বৃটেনের একটি দাতব্য সংস্থা, ভারতীয় সীমান্তে অবস্থিত অনেকগুলি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে বলেন, ‘the world community must come forward immediately with all possible aid.’ মিঃ চেসওয়ার্থ বৃটিশ ওভারসিজ মন্ত্রীকে ব্যক্তিগতভাবে সরেজমিনে এই জটিল সমস্যা অনুধাবনের জন্য অনুরোধ করে বলেন যে, এর বিস্তার ও গভীরতা নিরূপণ করা কঠিন; লন্ডন, ওয়াশিংটন এবং মস্কোর এ বিষয়ে নজর দেওয়া উচিৎ। তিনি আরও বলেন, ‘what is taking place here is a potential threat to world peace.’ ১ জাপানি এম পি কে. নিশিমুরা ভারতীয় সীমান্ত অঞ্চলে বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে ভয়াবহ চিত্র ও দুরবস্থার কথা উল্লেখ করে বলেন, “সীমান্ত অঞ্চলে শরণার্থী শিবিরগুলি পরিদর্শনকালে আমি দেখলাম হাজার হাজার পুরুষ, নারী ও শিশু সাংঘাতিক প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে শুধুমাত্র নিরাপত্তার জন্য ভারতে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যখন এমন অবস্থা বিরাজমান – বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রকৃত অবস্থা দেখা উচিৎ।” মিঃ এনজিয়ার বি ডিউক, প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত এবং ইন্টারন্যাশানাল রেসকিউ কমিটি দলের প্রধান ভারত-পাক উপমহাদেশ সফর থেকে ফিরে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও ঘটনার সত্যাসত্য বিশ্লেষণপূর্বক নিক্সন প্রশাসনকে রিপোর্ট দিয়ে বলেন, “Pakistan Army has tried to maintain a desperate air of tension along the border by mortar fire.” তিনি আরও বলেন, জুলাই মাসের শেষে ভারতে আশ্রয়প্রার্থী পাকিস্তানি শরণার্থীর সংখ্যা ‘will have reached the seven million mark.’২ ইউ এস সিনেটর মিঃ এডওয়ার্ড কেনেডি ভারতের পূর্ব সীমান্তে সাড়ে চারদিন অত্যন্ত কষ্টসহকারে বৃষ্টির মধ্যে পায়ে হেঁটে অনেকগুলি বাংলাদেশি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। শরণার্থীদের কষ্ট-দুর্দশা দেখে তিনি বলতে বাধ্য হন, ‘It is the greatest human tragedy of our time.’ তিনি নারী, শিশু, বয়স্কদের দু্র্দশা ও পাকিস্তানি সেনার গুলিতে আহতদের করুণ অবস্থা দেখে খুবই বিচলিত বোধ করেন। তিনি বলেন, “the American people have read reports about the refugees with heartfelt feeling, but they can not fully assess the magnitude of the problem unless one seeks personally the plight of the refugees.”৩ সারা বিশ্বের সংবাদজগৎ বাংলাদেশের গণহত্যা ও নির্যাতনের খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রচার শুরু করে। ভারতের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী রাজ্যে পূর্ব-পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ থেকে ভীতসন্ত্রস্ত ও নির্যাতিত মানুষ জীবনের নিরাপত্তার জন্য শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিতে থাকে। পরিস্থিতি স্থানীয় প্রশাসনের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। ভারত সরকার এই গুরু দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে বাধ্য হয়। The Times পত্রিকা সম্পাদকীয়তে এ বিষয়ে লেখা হয়, ‘Bengal : Suffering Millions’ “For six weeks now the flow of refugees from East Pakistan into India has gone on relentlessly, into Tripura in the east, into Assam in the north, and heaviest of all into West Bengal. Despite the heroic effort assembled by the Indian Government and by voluntary agencies there is little hope that this gigantic mass of suffering people will find all their needs can be met. The first and most urgent need is food. As the monsoon rains begin any day now shelter will become more urgent. Worst of all-in a view of the difficulty of coping with it in such surrounding—is disease. As described in our report today cholera has now taken a hold that could be extremely dangerous. Yet another risk is that of communal tension in a city like Calcutta where the social fabric is brittle at best and where a stream of refugees is beginning to flow in.”৪ সানডে অস্ট্রেলিয়ান তার সম্পাদকীয়তে ‘Agony and Response’ শিরোনামে লেখেঃ“In West Bengal today we are witnessing a human catastrophe for which even the tormented history of the twentieth century can offer few parallels. In the awesome scale of the disaster, in the uniquely harrowing quality of the suffering, there has been little to compare with what is happening at this moment to the refugees of East Pakistan. The known statistics of death and dislocation are appalling enough; the prospects are even more terrifying. They have already produced in some of us a paralysis of the will, and anesthesia of the mind, blinding us to the urgency of the crisis. Let us imagine, if we can, the combined populations of Melbourne and Sydney driven in terror from their homes by a marauding army, cast adrift in a wilderness without food or shelter, to face the imminent prospect of extermination from starvation or rampant disease.” ৫ আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, এশিয়া প্রভৃতি মহাদেশের বহু দেশের সংবাদপত্র বাংলাদেশ/ শরণার্থীদের দুর্দশা, নানা রোগে হাজার হাজার মৃত্যু ও তাদের উপর অত্যাচারের বহু খবর প্রকাশ করেছে, বহু সম্পাদকীয় ও প্রতিবেদনে গভীর বেদনা, উদ্বেগ ও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। স্ব স্ব দেশের সরকারের প্রতি এবিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখার জন্য আবেদন করেছে। বিশ্ব জনমত গঠনে তাদের ভূমিকা পালন করেছে। ভারতের সমস্ত ভাষার সংবাদপত্র ভারতে আশ্রিত বিপুল সংখ্যক শরণার্থী, পূর্ব-পাকিস্তানে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ও অত্যাচারের খবর প্রতিদিন প্রকাশ করে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে যা প্রভূত সাহায্য করেছে। ভারতে আশ্রয়প্রাপ্ত শরণার্থী সংখ্যা এবং তাদের ধর্মীয় পরিচয় দেখলে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও তাদের মুরুব্বিগণের আসল উদ্দেশ্য কি ছিল। ১৬ই আগস্ট ১৯৭১ পর্যন্ত ভারতে আশ্রিত শরণার্থীর ধর্মীয় বিভাজন ছিল নিম্নরূপঃ হিন্দু ৬৯.৭১ লক্ষমুসলমান ৫.৪১ লক্ষঅন্যান্য ০.৪৪ লক্ষ পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের প্রথম থেকেই একথা বুঝতে দেরি হয়নি যে, জনসংখ্যার নিরিখে পূর্ববঙ্গ/পূর্বপাকিস্তানে …

পাকিস্তানি গণহত্যাঃ শরণার্থী সমস্যা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আন্তর্জাতিক জনমত গঠন Read More »