পার্বত্য চট্টগ্রামের উদ্বাস্তু সমস্যা ও চাকমা জনজাতি
নন্দদুলাল মন্ডল পি.এইচ.ডি. গবেষক, ইতিহাস বিভাগ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা উদ্বাস্তু সমস্যা বর্তমানে গোটা বিশ্বের কাছে একটি বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিককালে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উদ্বাস্তুদের করুণ দুর্দশার কথা সংবাদ শিরোনামে উঠে আসছে। গণমাধ্যম উত্তাল হয়েছে মানবাধিকারের প্রশ্নে। উত্তর আমেরিকার মেক্সিকো থেকে দক্ষিণ আমেরিকার ভেনেজুয়েলা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, আফ্রিকা মহাদেশের কঙ্গো, সুদান, নাইজিরিয়া, পশ্চিম এশিয়ার ইরাক, সিরিয়া, থেকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মায়ানমার, বাংলাদেশ, ভারত বিশ্বের সর্বত্র এই উদ্বাস্তু সমস্যা বর্তমান। ২০১৭ সালের UNHCR Report অনুযায়ী গোটা বিশ্বে উদ্বাস্তুর সংখ্যা ৬৫.৬ মিলিয়ন। প্রতি ৩ সেকেন্ডে একজন ব্যক্তি নতুন করে উদ্বাস্তু হচ্ছে। যার মধ্যে প্রায় ৫০% শিশু।১ বিশ্বব্যাপী এই সমস্যা সমাধানের জন্য ইউনাইটেড নেশনস এর সাধারণ সভাতে ২০১৬ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর ১৯৩ টি দেশ ‘New York Declaration’-এ স্বাক্ষর করে।২ কিন্তু তাতে কি বিশ্বব্যাপী উদ্বাস্তু মানুষের সমস্যার কোন সমাধান হয়েছে? এইরকম একটি প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের চাকমা জনজাতির উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়ার ঘটনাক্রম এবং তাঁদের জীবন ও সংগ্রামের কয়েকটি দিক সংক্ষেপে এই প্রবন্ধে তুলে ধরার একটি প্রয়াস মাত্র। ১৯৪৭ সালের ভারতবিভাগ তথা বাংলাবিভাগ চট্টগ্রাম পার্বত্য জনজাতির ওপর অনেক বড় আঘাত এনে দিয়েছিলো। অবিভক্ত বাংলার চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে ৯৭ শতাংশ অমুসলিম জনসংখ্যা থাকা সত্ত্বেও তা পাকিস্তানের অন্তর্গত করা হয়। স্থানীয় মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এর বিরোধিতা করে এবং ভারতে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করেন। একুশে আগস্ট পর্যন্ত চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে ভারতের পতাকা উত্তোলন করে রেখেছিল স্থানীয় মানুষ। কিন্তু পাকিস্তানি আর্মি সেখানে গিয়ে ভারতের পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করে এবং স্থানীয় মানুষকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে। ১৯০০ সালে ‘চিটাগাং হিলট্রাক রেগুলেশন’ অনুযায়ী ইংরেজরা চট্টগ্রামের পার্বত্যাঞ্চলের জুম্মদের যে রক্ষাকবচ দিয়েছিল পাক সরকার সে আধিকার কেড়ে নেয়।৩ ফলত সেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুসলিম ধর্মের মানুষ আসতে থাকে। তাঁদের জমি দখল হতে থাকে। রাষ্ট্রীয় মদতে পূর্বপাকিস্তানের সমতলের অসংখ্য মানুষ সেখানে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। তাদের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নেমে আসে এবং সে কারণেই পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসীরা পলায়ন করতে শুরু করে। ১৯৬০-এর দশকে ‘কাপ্তাই হাইড্রোলিক প্রজেক্ট’ পার্বত্য চট্টগ্রামকে অভিশপ্ত করে তোলে। ১৯৬৪ সালে বাঁধ প্রকল্প রূপায়ণ হলে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ ঘর ছাড়া হয় যাদের মধ্যে ৭০ শতাংশ ছিল চাকমা বৌদ্ধ জনজাতির মানুষ। এই চট্টগ্রাম থেকে উদ্বাস্তু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোক মূলত ভারতের ত্রিপুরা, অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। পূর্বপাকিস্তান থেকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মধ্যে সব থেকে বড়ো উচ্ছেদ ঘটে কাপ্তাই বাধা নির্মাণের মধ্য দিয়ে। রাঙামাটির কাছে কর্নফুলি নদীর তীরবর্তী গ্রাম কাপ্তাই, এবং এখানেই কর্নফুলি নদীতে একটি বিরাট বাঁধ নির্মাণের মধ্য দিয়ে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। ১৯৬৪ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ সম্পূর্ণ হলে কর্ণফুলি নদীর উপত্যকা এলাকায় এক বিরাট হ্রদের সৃষ্টি হয়। তার ফলে বহু গ্রাম প্লাবিত হয়। এই এলাকায় মূলত বৌদ্ধধর্মাবলম্বী চাকমা জনজাতির বসবাস ছিল। এই চাকমারাই বাংলাদেশের বৃহত্তর বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী। ১৯৯১ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে চাকমা জনজাতির সংখ্যা প্রায় ২৫৩০০০।৫ চাকমাদের শতকরা ৯০ জনের বেশি চট্টগ্রামের রাঙামটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় কেন্দ্রীভূত। কিন্তু কর্ণফুলি নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণের ফলে যে বিশাল অঞ্চল প্লাবিত হয়েছিল সেখানে চাকমা জনজাতির লোকেরাই সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কিন্তু সরকারি তরফ থেকে কোনরকম পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করেই এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। তারা সেখান থেকে চলে যেতে বাধ্য হন। এক লক্ষেরও বেশি অধিবাসী কর্ণফুলির কৃত্রিম প্রকল্পের কারণে অন্যত্র চলে যায়। যাদের বেশিরভাগ ছিল চাকমা ও হাজং। চাকমারা বিরোধিতা করলে সেনাবাহিনী দিয়ে তাদের দমন করা হয় নির্মমভাবে। এমনকি ধর্ষণ, হত্যার মতো জঘন্য অমানবিক অত্যাচার সবই চলে তাদের ওপর।৬ অনেকেই স্থানচ্যুত হয়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে এবং জেলার অন্যত্র গিয়ে বসতি স্থাপন করে। এছাড়া ১৯৬৪ সালে হাজার হাজার চাকমা ভারতেও আশ্রয় নেয়। এরা প্রথমে চট্টগ্রাম লাগোয়া ত্রিপুরা ও মিজোরামে আশ্রয় গ্রহণ করে। একইসঙ্গে এত সংখ্যক উদ্বাস্তু আসার ফলে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে সংঘাতের আশঙ্কা দেখা দেয়। তদানীন্তন আসাম সরকার উদ্বাস্তু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষগুলিকে ৭০ শতাংশ বনাঞ্চলে ঘেরা NEFA অর্থাৎ বর্তমান অরুণাচল প্রদেশে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু সেখানকার স্থানীয় মানুষও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। কিছুদিনের মধ্যে এই প্রতিবাদের আঁচ সমগ্র উত্তরপূর্ব ভারতে ছড়িয়ে পরে। ফলে চাকমাদের মধ্যে এমন ধারণা গড়ে ওঠে যে, তাদের অভাব অভিযোগের প্রতি কর্তৃপক্ষ তথা দেশের সরকার (ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই) আন্তরিক নন। আর এর ফলস্বরূপ তৈরি হয় ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’। এই সমিতির মূল উদ্দেশ্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের অগণিত বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষদের অধিকারকে পুনঃস্থাপন করা। ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র পূর্বসূরি সংগঠন হিসাবে আমরা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতি কল্যাণ সমিতি’-র কথা বলতে পারি। এই ‘উপজাতি কল্যাণ সমিতি’ কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ও বাস্তুচ্যুতদের ক্ষতিপূরণের দাবিদাওয়া নিয়ে দীর্ঘদিন আন্দোলন চালিয়েছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধরা তাঁদের অধিকার আদায়ের জন্য পুনরায় নতুন আঙ্গিকে আন্দোলন শুরু করে। ১৯৭২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশে সরকারের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসনের দাবিসহ একাধিক দাবিদাওয়া পেশ করেন। যথা পার্বত্য চট্টগ্রামের নিজস্ব আইন পরিষদ গঠন, ১৯০০ সালের রেগুলেশন অনুসারে সুযোগ সুবিধা ইত্যাদি। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তাতে কর্ণপাত না করলে তাঁরা ‘শান্তি বাহিনী’ স্থাপন করে হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। তাঁরা নিজেদের অধিকার সুরক্ষার জন্য একটি সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। ফলে এই সশস্ত্র সংগ্রাম দমন করার জন্য বাংলাদেশ সরকার সেনা অভিযান চলায় ও ১৯৮৬ সালে প্রায় এক হাজার জন জুম্ম বৌদ্ধদের হত্যা করে। সারা বাংলাদেশ জুড়ে বৌদ্ধ বিরোধী পরিবেশ তৈরি হয়। এই রকম পরিস্থিতে ১৯৮৭ সালে প্রায় ৪৫,০০০ বৌদ্ধ চাকমা ভারতে অভিগমন করতে বাধ্য হন। অন্যদিকে ভারতের ‘জাতীয় মানবাধিকার আয়োগ’ চাকমা ও হাজং উদ্বাস্তুদের অধিকার প্রদানের জন্য কাজ করছিল। অবশেষে ১৯৯৬ সালে সুপ্রিম কোর্ট এই বৌদ্ধ উদ্বাস্তুদের নাগরিকতা প্রদানের নির্দেশ দেয়।৭ তা সত্ত্বেও স্থানীয় সরকার এই নির্দেশকে পুরোপুরি কার্যকর করেনি। কারণ দীর্ঘদিন পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে আসা উদ্বাস্তুদের নিয়ে স্থানীয় মানুষের ক্ষোভ ছিল। এই রাজনৈতিক কারণেই হয়তো স্থানীয় প্রাদেশিক সরকার ভারতের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় এর নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও স্থানীয়দের জনসমর্থন খোয়ানোর ভয়ে ও রাজনৈতিক লাভের আশায় চাকমা তথা চট্টগ্রাম থেকে আসা উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকার করে। অন্যদিকে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে উদ্বাস্তু বৌদ্ধদের পুনর্বাসন দিয়ে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনার কথা বলা হয়। ফলে ভারত থেকে অনেকে আবার চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। ২০০৩ সালে এর সংখ্যা ৬৫,০০০ অতিক্রম করে। কিন্তু সেখানেও ‘CHT Peace Accord’ সঠিক ভাবে রূপায়িত না হওয়ায় সমস্যা থেকে যায়। ক্ষমতা হস্তান্তর ও ভারত বিভাজনের মধ্যে যে উদ্বাস্তু সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল স্বাধীনতার ৭০ বছর কেটে গেলেও তা আজও সমাধান হয়নি। ভারত স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে সঙ্গে দুটি ভাগে বিভক্ত হয়েছিলো ধর্মের ভিত্তিতে। ফলে দেখা দেয় বাস্তুচ্যুতি তথা উদ্বাস্তু সমস্যা। তাই ভারতে নাগরিকত্ব সম্পর্কিত বিধি নিয়মগুলি দেশভাগ ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলি দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। ভারতীয় পার্লামেন্ট ১৯৫৫ সালে প্রথম নাগরিকত্ব আইন পাশ করে এই সমস্যা সমাধানকল্পে। কিন্তু সেটা …
পার্বত্য চট্টগ্রামের উদ্বাস্তু সমস্যা ও চাকমা জনজাতি Read More »