Center For Research In Indo

Author name: admin

পার্বত্য চট্টগ্রামের উদ্বাস্তু সমস্যা ও চাকমা জনজাতি

নন্দদুলাল মন্ডল পি.এইচ.ডি. গবেষক, ইতিহাস বিভাগ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা উদ্বাস্তু সমস্যা বর্তমানে গোটা বিশ্বের কাছে একটি বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিককালে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উদ্বাস্তুদের করুণ দুর্দশার কথা সংবাদ শিরোনামে উঠে আসছে। গণমাধ্যম উত্তাল হয়েছে মানবাধিকারের প্রশ্নে। উত্তর আমেরিকার মেক্সিকো থেকে দক্ষিণ আমেরিকার ভেনেজুয়েলা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, আফ্রিকা মহাদেশের কঙ্গো, সুদান, নাইজিরিয়া, পশ্চিম এশিয়ার  ইরাক, সিরিয়া, থেকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মায়ানমার, বাংলাদেশ, ভারত বিশ্বের সর্বত্র এই উদ্বাস্তু সমস্যা বর্তমান। ২০১৭ সালের UNHCR Report অনুযায়ী গোটা বিশ্বে উদ্বাস্তুর সংখ্যা ৬৫.৬ মিলিয়ন। প্রতি ৩ সেকেন্ডে একজন ব্যক্তি নতুন করে উদ্বাস্তু হচ্ছে। যার মধ্যে প্রায় ৫০% শিশু।১ বিশ্বব্যাপী এই সমস্যা সমাধানের জন্য ইউনাইটেড নেশনস  এর সাধারণ সভাতে ২০১৬ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর ১৯৩ টি দেশ ‘New York Declaration’-এ স্বাক্ষর করে।২ কিন্তু তাতে কি বিশ্বব্যাপী উদ্বাস্তু মানুষের সমস্যার কোন সমাধান হয়েছে? এইরকম একটি প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের চাকমা জনজাতির উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়ার ঘটনাক্রম এবং তাঁদের জীবন ও সংগ্রামের কয়েকটি দিক সংক্ষেপে এই প্রবন্ধে তুলে ধরার একটি প্রয়াস মাত্র।   ১৯৪৭ সালের ভারতবিভাগ তথা বাংলাবিভাগ চট্টগ্রাম পার্বত্য জনজাতির ওপর অনেক বড় আঘাত এনে  দিয়েছিলো। অবিভক্ত বাংলার চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে ৯৭ শতাংশ অমুসলিম জনসংখ্যা থাকা সত্ত্বেও তা পাকিস্তানের অন্তর্গত করা হয়। স্থানীয় মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এর বিরোধিতা করে এবং ভারতে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করেন। একুশে আগস্ট পর্যন্ত চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে ভারতের পতাকা উত্তোলন করে রেখেছিল স্থানীয় মানুষ। কিন্তু পাকিস্তানি আর্মি সেখানে গিয়ে ভারতের পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করে এবং স্থানীয় মানুষকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে। ১৯০০ সালে ‘চিটাগাং হিলট্রাক রেগুলেশন’ অনুযায়ী ইংরেজরা চট্টগ্রামের পার্বত্যাঞ্চলের জুম্মদের যে রক্ষাকবচ দিয়েছিল পাক সরকার সে আধিকার কেড়ে নেয়।৩ ফলত সেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুসলিম ধর্মের মানুষ আসতে থাকে। তাঁদের জমি দখল হতে থাকে। রাষ্ট্রীয় মদতে পূর্বপাকিস্তানের সমতলের অসংখ্য মানুষ সেখানে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। তাদের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নেমে আসে এবং সে কারণেই পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসীরা পলায়ন করতে শুরু করে।   ১৯৬০-এর দশকে ‘কাপ্তাই হাইড্রোলিক প্রজেক্ট’ পার্বত্য চট্টগ্রামকে অভিশপ্ত করে তোলে। ১৯৬৪ সালে বাঁধ প্রকল্প রূপায়ণ হলে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ ঘর ছাড়া হয় যাদের মধ্যে ৭০ শতাংশ ছিল চাকমা বৌদ্ধ জনজাতির মানুষ। এই চট্টগ্রাম থেকে উদ্বাস্তু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোক মূলত ভারতের ত্রিপুরা, অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। পূর্বপাকিস্তান থেকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মধ্যে সব থেকে বড়ো উচ্ছেদ ঘটে কাপ্তাই বাধা নির্মাণের মধ্য দিয়ে। রাঙামাটির কাছে কর্নফুলি নদীর তীরবর্তী গ্রাম কাপ্তাই, এবং এখানেই কর্নফুলি নদীতে একটি বিরাট বাঁধ নির্মাণের মধ্য দিয়ে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। ১৯৬৪ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ সম্পূর্ণ হলে কর্ণফুলি নদীর উপত্যকা এলাকায় এক বিরাট হ্রদের সৃষ্টি হয়। তার ফলে বহু গ্রাম প্লাবিত হয়। এই এলাকায় মূলত বৌদ্ধধর্মাবলম্বী চাকমা জনজাতির বসবাস ছিল। এই চাকমারাই বাংলাদেশের বৃহত্তর বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী। ১৯৯১ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে চাকমা জনজাতির সংখ্যা প্রায় ২৫৩০০০।৫ চাকমাদের শতকরা ৯০ জনের বেশি চট্টগ্রামের রাঙামটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় কেন্দ্রীভূত। কিন্তু কর্ণফুলি নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণের ফলে যে বিশাল অঞ্চল প্লাবিত হয়েছিল সেখানে চাকমা জনজাতির লোকেরাই সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত  হয়েছিল। কিন্তু সরকারি তরফ থেকে কোনরকম পুনর্বাসনের  ব্যবস্থা না করেই এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। তারা সেখান থেকে চলে যেতে বাধ্য হন। এক লক্ষেরও বেশি অধিবাসী কর্ণফুলির  কৃত্রিম প্রকল্পের কারণে অন্যত্র চলে যায়। যাদের বেশিরভাগ ছিল চাকমা ও হাজং। চাকমারা বিরোধিতা করলে সেনাবাহিনী দিয়ে তাদের দমন করা হয় নির্মমভাবে। এমনকি ধর্ষণ, হত্যার মতো জঘন্য অমানবিক অত্যাচার সবই চলে তাদের ওপর।৬ অনেকেই স্থানচ্যুত হয়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে এবং জেলার অন্যত্র গিয়ে বসতি স্থাপন করে।  এছাড়া ১৯৬৪ সালে হাজার হাজার চাকমা ভারতেও আশ্রয় নেয়। এরা প্রথমে চট্টগ্রাম লাগোয়া ত্রিপুরা ও মিজোরামে আশ্রয় গ্রহণ করে। একইসঙ্গে এত সংখ্যক উদ্বাস্তু আসার ফলে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে সংঘাতের আশঙ্কা দেখা দেয়। তদানীন্তন আসাম সরকার উদ্বাস্তু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষগুলিকে ৭০ শতাংশ বনাঞ্চলে ঘেরা NEFA অর্থাৎ বর্তমান অরুণাচল প্রদেশে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু সেখানকার স্থানীয় মানুষও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। কিছুদিনের মধ্যে এই প্রতিবাদের আঁচ সমগ্র উত্তরপূর্ব ভারতে ছড়িয়ে পরে। ফলে চাকমাদের মধ্যে এমন ধারণা গড়ে ওঠে যে, তাদের অভাব অভিযোগের প্রতি কর্তৃপক্ষ তথা দেশের সরকার (ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই) আন্তরিক নন। আর এর ফলস্বরূপ তৈরি হয়  ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’। এই সমিতির মূল উদ্দেশ্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের অগণিত বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষদের অধিকারকে পুনঃস্থাপন করা। ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র পূর্বসূরি সংগঠন হিসাবে আমরা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতি কল্যাণ সমিতি’-র কথা বলতে পারি। এই ‘উপজাতি কল্যাণ সমিতি’ কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ও বাস্তুচ্যুতদের ক্ষতিপূরণের দাবিদাওয়া নিয়ে দীর্ঘদিন আন্দোলন চালিয়েছিল।   ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধরা তাঁদের অধিকার আদায়ের জন্য পুনরায় নতুন আঙ্গিকে আন্দোলন শুরু করে। ১৯৭২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশে সরকারের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসনের দাবিসহ একাধিক দাবিদাওয়া পেশ করেন। যথা পার্বত্য চট্টগ্রামের নিজস্ব আইন পরিষদ গঠন, ১৯০০ সালের রেগুলেশন অনুসারে সুযোগ সুবিধা ইত্যাদি। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তাতে কর্ণপাত না করলে তাঁরা ‘শান্তি বাহিনী’ স্থাপন করে হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। তাঁরা নিজেদের  অধিকার সুরক্ষার জন্য একটি সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। ফলে এই সশস্ত্র সংগ্রাম দমন করার জন্য বাংলাদেশ সরকার সেনা অভিযান চলায় ও ১৯৮৬ সালে প্রায় এক হাজার জন জুম্ম বৌদ্ধদের হত্যা করে। সারা বাংলাদেশ জুড়ে বৌদ্ধ বিরোধী পরিবেশ তৈরি  হয়। এই রকম পরিস্থিতে ১৯৮৭ সালে প্রায় ৪৫,০০০ বৌদ্ধ চাকমা ভারতে অভিগমন করতে বাধ্য হন। অন্যদিকে ভারতের ‘জাতীয় মানবাধিকার আয়োগ’ চাকমা ও হাজং উদ্বাস্তুদের অধিকার প্রদানের জন্য কাজ করছিল। অবশেষে ১৯৯৬ সালে সুপ্রিম কোর্ট এই বৌদ্ধ উদ্বাস্তুদের নাগরিকতা প্রদানের নির্দেশ দেয়।৭ তা সত্ত্বেও স্থানীয় সরকার এই নির্দেশকে পুরোপুরি কার্যকর করেনি। কারণ  দীর্ঘদিন পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে আসা উদ্বাস্তুদের নিয়ে স্থানীয় মানুষের ক্ষোভ ছিল। এই রাজনৈতিক কারণেই হয়তো স্থানীয় প্রাদেশিক সরকার ভারতের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় এর নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও স্থানীয়দের জনসমর্থন খোয়ানোর ভয়ে ও রাজনৈতিক লাভের আশায় চাকমা তথা চট্টগ্রাম থেকে আসা উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকার করে। অন্যদিকে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি  স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে উদ্বাস্তু বৌদ্ধদের পুনর্বাসন দিয়ে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনার কথা বলা  হয়। ফলে ভারত থেকে অনেকে আবার চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। ২০০৩ সালে এর সংখ্যা ৬৫,০০০ অতিক্রম করে। কিন্তু সেখানেও ‘CHT Peace Accord’ সঠিক ভাবে রূপায়িত না হওয়ায় সমস্যা থেকে যায়। ক্ষমতা হস্তান্তর ও ভারত বিভাজনের মধ্যে যে উদ্বাস্তু সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল স্বাধীনতার ৭০ বছর কেটে গেলেও তা আজও সমাধান হয়নি। ভারত স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে সঙ্গে দুটি ভাগে বিভক্ত হয়েছিলো ধর্মের ভিত্তিতে। ফলে দেখা দেয় বাস্তুচ্যুতি তথা উদ্বাস্তু সমস্যা। তাই ভারতে নাগরিকত্ব সম্পর্কিত বিধি নিয়মগুলি দেশভাগ ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলি দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। ভারতীয় পার্লামেন্ট ১৯৫৫ সালে প্রথম নাগরিকত্ব আইন পাশ করে এই সমস্যা সমাধানকল্পে। কিন্তু সেটা …

পার্বত্য চট্টগ্রামের উদ্বাস্তু সমস্যা ও চাকমা জনজাতি Read More »

ভারতীয় উপমহাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশ ও তার পথে অন্তরায়

বিমল প্রামাণিক Director, Centre for Research in Indo-Bangladesh Relations বাংলাদেশের  হাল আমলের অনেক বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিক শাসনের গতিমুখ স্বৈরতান্ত্রিক। এর প্রতিফলন রাজনীতি ও প্রশাসনে পরিলক্ষিত হচ্ছে। রাহুল গান্ধীর সাংসদপদ বাতিল, দিল্লি দাঙ্গার বিচার প্রক্রিয়া এবং উত্তর প্রদেশে শাসন ব্যবস্থা ও প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে বলে উল্লেখিত হয়েছে। তাঁদের মতে, এর ফলে বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পাবে। তাঁরা এটাও মনে করেন, পৃথিবীতে অন্যতম বৃহৎ শক্তি হিসেবে ভারতের প্রতিষ্ঠা পাওয়া, বহুজাতিরাষ্ট্রে  বহুদলীয় গণতন্ত্রে  বিজেপি’র মতো  একটি হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন হওয়ায় স্বৈরতন্ত্রের প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি বিবিসি’র তরফে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিরোধী উদ্দেশ্য প্রণোদিত  অপপ্রচারে ভারতের কড়া পদক্ষেপও তাদের দৃষ্টিতে স্বৈরতান্ত্রিক কাজ মনে হচ্ছে। এখানে বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তি চর্চা নিয়ে কিছু আলোচনা করা যেতে পারে। ১৯৪৭ পরবর্তী পূর্বপাকিস্তানে তথা পূর্ববঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তি চর্চায় প্রায় খোলামেলাভাবেই দ্বিজাতিতত্ত্ব ভিত্তিক রাজনীতি চর্চা ও চিন্তায় বাঙালি বুদ্ধিজীবী মহলে ভিন্নমত দেখা যেতে থাকে। যেমন, ভাষা আন্দোলন ও শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিতর্কে তাঁরা জড়িয়ে পড়েন। গণতন্ত্র, সামরিক শাসনকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ আন্দোলন পরিলক্ষিত হয়। জাতিসত্তা ও গণতন্ত্র নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার পুরোধাগণ  কালের নিয়মেই গত হয়েছেন। যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁরাও বর্তমানে অশীতিপর বৃদ্ধ। স্বাধীন বাংলাদেশে গত পঞ্চাশ বছরে নানা অবাঞ্ছিত ঘটনাবলী বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার পরিসরকে সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর করেছে, সমাজ ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অসহিষ্ণুতা বেড়েছে। পাকিস্তান আমলের চেয়ে অনেকগুণ বেশি ধর্মীয় আগ্রাসী চিন্তায় সমাজ ও রাজনীতি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে।  বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার মৌলিক ধারণা তরলীকৃত হয়ে গেছে। একটি জাতির ইতিহাসের প্রধান স্তম্ভকেই (মুক্তিযুদ্ধ) যদি বিকৃত করে ফেলা যায় তবে তার গৌরবগাথা মুছে যেতে খুব বেশি সময় লাগে না, এটাই ইতিহাসের শিক্ষা ।  আজকের বাংলাদেশ তার জ্বলন্ত প্রমাণ। বুদ্ধিবৃত্তি চর্চায়ও  এর প্রভাব স্পষ্ট। আর একটি  গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ধর্ম ব্যতিরেকে হিন্দু বাঙ্গালির বুদ্ধিবৃত্তি চর্চায় পশ্চিমি প্রভাব বিশেষভাবে ইংরিজি শিক্ষার প্রভাব বাঙালি মানসের গভীরে বিস্তৃত। তাদের চর্চায় ভারতীয় দর্শন, ইতিহাস এবং সমাজ মোটের উপর উপেক্ষিত। তদুপরি বামপন্থী ইতিহাস চর্চার একপেশে প্রভাবে প্রভাবিত। সেকারণে তাদের চর্চায় ভারতীয়ত্ব, হিন্দুত্ব এসকল বিষয় অচ্ছুৎ বললেও ভুল হয়না। এর ফল ফলেছে, বৃহত্তর  ভারতের শিকড় থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অথচ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের অবদান মোটেই কম ছিল না। তখন  সর্বভারতীয় প্রেক্ষিত নিয়ে তাদের চিন্তায়, চর্চায় এবং ভূমিকায় বাঙ্গালিরা ছিল প্রথম সারিতে। কিন্তু মুসলমান বাঙ্গালির কোন বলিষ্ঠ ভূমিকা তখনই চোখে পড়ে যখন দ্বিজাতিতত্ত্বের নাকাড়া ভারতবর্ষে বেজে ওঠে। তাছাড়া, মুসলমান বাঙালি বৃটিশ শাসকদের প্রতি সহযোগিতার হাতই বাড়িয়ে দিয়েছিল। তারা নিজেদের ভারতীয় বলে পরিচয়ের চাইতে মুসলমান পরিচয়েই অধিকতর গর্ব করতো । এর প্রমাণ অবিভক্ত বাংলায় সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত । বাঙলায় বৃটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জেল-জুলুম অত্যাচারের যেসব দলিল আজও সংরক্ষিত রয়েছে তার চেয়ে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে ! এই যে বাঙালি জাতিসত্তার বিভাজন হয়ে গেল তার বড় কারণ ধর্ম । আর ইসলাম ধর্ম জাতিসত্তার ঘোরতর প্রতিবন্ধক।  আর জাতিসত্তার  বিকাশ ছাড়া গণতন্ত্র সুদূর পরাহত। বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার প্রধান সংকট এখানেই। ভারতের গণতন্ত্রের বিকাশ এবং সংহতকরণ যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হচ্ছে তা ভারতের পড়শি রাষ্ট্রগুলির জন্য মোটেই সুখকরবোধ হচ্ছে না। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত অধিকাংশ মতামত এবং মন্তব্য  এর সাক্ষ্য বহন করে। ২০১৪ সালে বিজেপি সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই এই ধরণের মতামতের বাড়াবাড়ি লক্ষ্য করা যায়। তদুপরি সরকারি নির্লিপ্ততায় ধারাবাহিক সংখ্যালঘু বিশেষভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নানা ধরণের নির্যাতনের যে সকল ঘটনা ঘটে চলেছে – সেসব ক্ষেত্রেই সরকারের ভূমিকা সম্পর্কিত বিষয়ে বুদ্ধিজীবীমহলে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া  লক্ষ্য করা যায় না। এ সম্পর্কে  অনেকেই সরকারের কঠোর প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া আইনের দিকে আঙুল তোলেন। তাছাড়াও ভারতে মুসলমানদের উপর নির্যাতন সংক্রান্ত ঘটনাবলী উল্লেখ করে বাংলাদেশের হিন্দু নির্যাতনে ন্যায্যতা গণ্য করে থাকেন। এই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি বা মানসিকতা মুসলমানদের মধ্যে পাকিস্তানের  আমলে যেমন দেখেছি, বাংলাদেশেও সেই মানসিকতার  কোন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। এর কারণও  সহজেই অনুমেয়। পাকিস্তান বা বাংলাদেশে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির  বাইরে তারা অমুসলমানদের দেখবে একথা তারা ভাবতেই পারেনা – এটাই তাদের ধর্মের সার কথা।  ইসলামে সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের কোন প্রশ্নই আসে না।  জাতীয়তাবাদী মানসিকতার নিরন্তর চর্চা ব্যতিরেকে বাঙালি মুসলমান মুখে বাঙালি পরিচয় দিলেও কখনও বাঙালি হতে পারবেন না। এটাই বাঙালি মুসলমানের বড় সঙ্কট। আর এই সঙ্কট থেকে না বেরিয়ে আসতে পারলে গণতন্ত্র চর্চার কোন সফলতা বাংলাদেশে আসতে পারে না।  নিজেদের দেশে গণতন্ত্রের বিকাশ না হলে ভারতের মতো একটি বহুজাতিক গণতান্ত্রিক প্রশাসন, সমাজ ব্যবস্থার অন্দরে প্রবেশ করে তার জটিল প্রক্রিয়া বুঝতে পারা অতো সহজ ব্যাপার নয়।  কোন একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল দিয়ে গণতন্ত্র বিচার সম্ভব নয়, গণতন্ত্র একটি সার্বিক ব্যবস্থা, দেশের সংবিধান থেকে সাধারণ মানুষের চেতনা – সবটাই সচল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অঙ্গ।  ধর্ম গণতন্ত্রে মুখ্য বিষয় নয়। নাগরিকের অধিকার, দায়িত্ববোধ, যা তৈরি হয় সামাজিক চেতনা থেকে, সেখানেই নীতি, আদর্শ, নৈতিকতার ভাবনা মানুষের মন এবং চিন্তাকে সমৃদ্ধ করে।  বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ তখনই সম্ভব যখন অবাধ গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কোন দেশে বিরাজ করে।  যার প্রকৃ্ত উদাহরণ আমরা ইউরোপের অনেক দেশে দেখতে পাই। আমাদের মতো দেশে বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার একটি বড় সমস্যা হলো দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি। বুদ্ধিজীবীমহল ভারতে বা বাংলাদেশে রাজনীতি ও দলীয় মতাদর্শের  বাইরে প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু ভারতে গণতন্ত্রের বেগবান ধারা সমাজে সচল থাকায় একপেশে মতামত গ্রহণযোগ্য যেমন হয়না এবং বিকল্প মতামতও উঠে আসে। এরফলে জনমত উপকৃত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে বা পাকিস্তানে গণতন্ত্রের উদারীকরণ না হওয়ার ফলে সমাজে জনমতের সঠিক প্রতিফলন সবসময় দেখা যায় না। বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ বা চর্চার জন্য গণতন্ত্রের উদারীকরণ যেমন প্রয়োজন, শিক্ষা ব্যবস্থাকে সংকীর্ণতা মুক্ত করাও তেমন জরুরী। কিন্তু বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে গত পঁচাত্তর বছরের ইতিহাসে  এমন নজির দেখা যায় না। ফলে বর্তমান বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তি চর্চারও ক্ষেত্রগুলি ক্রমেই সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর হয়ে যাচ্ছে। এক সময়ের বর্জিত পাকিস্তানি চেতনা বাংলাদেশি সমাজে শক্তিশালী হওয়ার  পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ভারতের প্রতিও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে। এর পিছনে শুধু কট্টর ইসলামি শক্তি ও দলগুলিই কাজ করছে না, সরকারি পৃষ্ঠপোষণও রয়েছে। আজকের পাকিস্তানের পরিণতি থেকে আবারও একথা প্রমাণিত হল যে অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা ও দারিদ্র্য দ্বিজাতিতত্ত্ব ও ধর্মীয়  রাষ্ট্রের অসারতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, ধর্মীয় কারণে পড়শি রাষ্ট্রের সঙ্গে শত্রুতা ও বৈরী মনোভাব  পোষণ করে নিজের দেশের জনগণের মঙ্গল হয় না। পাকিস্তানি বা বাংলাদেশি  সকল জনগণের ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য। বোরখা দিয়ে এ মারাত্মক সমস্যা  ঢেকে রাখা যাবে না, এতে দেশের সঙ্কট তৈরি হওয়া অনিবার্য। আর এই সঙ্কট এক সময় দেশের অস্তিত্বের উপরই আঘাত হানতে পারে।

বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী এক বিকল্প মুখ

সুদীপ কুমার আচার্য্য স্মরণাতীত কাল থেকে পৃথিবীর ইতিহাসে নাগরিক সভ্য সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের একাংশ মানবতার সদা জাগ্রত সৈনিক হিসেবে তাদের কর্তব্য পালন করে আসছেন। কোনটি ন্যায়/অন্যায় বা সমাজের জন্যে অশুভ সে নিয়ে তাদের প্রতিনিয়ত মাথাব্যথাই বোধকরি সমাজকে উজানের পথে ঠেলে নিয়ে চলেছে; সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে দূরে রেখেছে নানান বিরূপতাকে আরও স্পষ্ট করে বললে প্রগতিশীল সুসভ্য চেতনাকে বাদ দিলে সংস্কৃতির আধার প্রায় ফাঁপা হয়ে যায়। সমাজ সংস্কৃতিকে সাজাতে গ্রহণযোগ্য ও পরিশীলিত করে তুলতে সভ্য সমাজের কোন বিকল্প হয় না। এরিস্টোটলের পলিটিক নামক গ্রন্থে নাগরিক সমাজ বলতে কয়নোনিয়া পলিটিকে শব্দটি প্রথম আলোচিত হয় । তিনি গ্রীক পলিসের সভ্য নাগরিকদের বোঝাতে এ শব্দ ব্যবহার করেন । পরে রেনেসাঁ আমলের ইন্টেলেকচুয়াল মানবতাবাদী রাজনৈতিক ইতালিয় ঐতিহাসিক লিওনার্দো ব্রুনি (১৩৭০–১৪৪৪) উপরোক্ত শব্দটির অনুবাদ স্বরূপ civil society কথাটি ব্যবহার করেন এবং ক্রমশ নাগরিক সমাজ বিষয়টি আলোচনা ও গবেষণার মধ্যে দিয়ে বর্তমান কাল পর্যন্ত এক অন্য মাত্রা তথা সম্মান ও শ্রদ্ধা পেয়ে এসেছে। জার্মান দার্শনিক জর্জ উইলহেল্ম ফ্রেডরিখ হেগেল, ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস, কার্লমার্কস, ইতালিয় মার্ক্সীয় দার্শনিক আন্তনিও গ্রামশি, লেনিন ও ট্রটস্কি  ও আরও অনেকের বিভিন্ন লেখায় সীমাবদ্ধভাবে হলেও সুশীল সমাজের চূড়ান্ত উপযোগিতা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।  এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা সহ প্রথম বিশ্বের অনেক তাবড় পণ্ডিতগণ  সুশীল সমাজকে রাষ্ট্র সভ্যতার তৃতীয় বিষয় (unit) হিসেবে তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহলও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। উদারমনস্ক বুদ্ধিজীবী ও প্রগতিশীল নাগরিকগণ বাংলাদেশী সংস্কৃতির ধারক-বাহক ও এক অমূল্য সম্পদ। পূর্বতন পাকিস্তান আমল থেকেই বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী নাগরিক সমাজের একাংশ তাদের মত করে প্রতিবাদ করে এসেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের গত চার-পাঁচ দশকের ইতিহাস ক্রুরতা ও একের পর এক ভয়াবহ অধ্যায়ে কালিমালিপ্ত। যার অভিঘাত সংখ্যালঘু হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান সম্প্রদায় ও নানান জনজাতি আজও বুকে বয়ে বেড়াচ্ছেন। একদিকে ধার্মিক কট্টরতা ও অন্যদিকে সেই কট্টরতায় অন্ধ মৌলবাদীদের দাপট বাঙালী সংস্কৃতিকে কোনদিকে, কোন নরকের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তা মুক্তমনা ব্লগার খুনেই বোঝা যায়। যারা পূর্বতন পাকিস্তান আমল থেকে দেশের মাটিকে রক্ষা করার জন্যে বুকের রক্ত দিয়েছেন, বেয়নেটের বিরুদ্ধে, বন্দুক, গোলাবারুদের বিরুদ্ধে কখনও কলম হাতে, কখনও যুদ্ধাঙ্গনে দেশীয় পদ্ধতিতে প্রস্তুত শস্ত্র কাঁধে নিয়ে শহিদ হয়েছেন বা বিজয়কে ছিনিয়ে এনেছেন। তারা আজ বয়সভারে বৃদ্ধ, অবসন্ন কিন্তু একইভাবে স্বাধীনতা পরবর্তী আমলে ইসলামিকরণে অগ্রগতি ও মৌলবাদের রক্ত-চক্ষুকে উপেক্ষা করে নিজেদের আদর্শে অটল থেকেছেন। কখনও সাফল্য এসেছে আবার অনেকক্ষেত্রেই chauvinist দের দলে অসহায় হয়ে পড়েছেন। ইসলামিকরণ পর্যায়ে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ উদার পরিমণ্ডল গঠনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে পাশে পাননি।  সংখ্যালঘুর ওপর শোষণ ও নারকীয় অত্যাচার তাদের মানসিকভাবে আঘাত করেছে । বিশ্ববিদ্যালয়ে ও কলেজের আধুনিকমনস্ক যুবক/যুবতীরাই এক সময় আধুনিক বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন দেখতেন। উদারতা, গণতন্ত্র ও সৌভ্রাতৃত্বকে পাথেয় করে তারা universalism এর আদর্শকে ধমনীতে বহন করতেন। এখন প্রশ্ন হলো বাংলাদেশে সহিষ্ণুতার এ ভাবনা ও প্রাক্তন ঐতিহ্যর কতটুকু অবশিষ্ট আছে ? ঊনিশ ও বিশ শতকের রেনেসাঁ পর্ব থেকেই মুসলিম সমাজের একটি অংশ বৈজ্ঞানিক চিন্তা চেতনা, উদার ভাবনা, জ্ঞান ও বুদ্ধিমুক্তির দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন। মুসলিম সাহিত্য ও সমাজের কাজী আব্দুল ওদুদ, আবুল হুসেন, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজলের ন্যায় ব্যক্তিত্ব তাঁদের বিভিন্ন রচনা ও প্রবন্ধে ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার বিরোধী এক পরিমণ্ডল গঠনের চেষ্টা করেন। সামসুন্নাহার মাহমুদ, ফজিলাতুন্নেসা, বেগম সুফিয়া কামাল প্রমুখ মহীয়সী নারী সমাজের মুক্তির লক্ষ্যে নিজেদের নিয়োজিত করেন ।  পরবর্তীতে নগরগুলির এলিট ও মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক মানুষই উদারনৈতিক ভাবধারায় লালিত হয়েছিলেন ।  ভাষা আন্দোলন তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যুবাদের কথা বিশেষভাবে স্মরণীয় । পরে উদিচী, ছায়ানট ইত্যাদি গোষ্ঠীর মুক্তচিন্তা ও উদার ভাবনার চর্চা করার ঐতিহ্য রয়েছে । জেলাস্তরে বুদ্ধিজীবীরা অনেকে সক্রিয় রয়েছেন বাঙালী ভাবনাকে ধরে রাখার জন্য। কিন্তু তা সত্বেও গত পঞ্চাশ বছরে সরকার পরিবর্তন এবং নানান নীতিমালা, সরকারি আপোষমূলক মনোভাব, আন্তর্জাতিক মদতপুষ্টি তথা সংস্কৃতিকে ভু্লপথে চালিত করা, সন্ত্রাসী ইসলামী শক্তির উদার নাগরিক সমাজের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো বাংলাদেশের জন্য  এক অশনি সঙ্কেত । দেশের সব জেলা, সিটি কর্পোরেশন ও উপজেলায় ধর্মীয় উন্মাদনার যা পরিকল্পিত বহর তাতে নাগরিক বা corporate, cosmopolitan কালচারের বিশেষ বিকাশ হবে না তা হলফ করে বলা যায় । বর্তমান সময়ে ক্ষীণ হলেও  নাগরিক সমাজের একটা অংশের সকলকে নিয়ে এক গ্ণতান্ত্রিক প্রগতিশীল  বাংলাদেশ গঠনের ইচ্ছা আছে। কবি, মহিলা কবিদের সংগঠন, ডাক্তার, সাংবাদিক, মিডিয়া, চলচ্চিত্র নির্দেশক, বাচিক শিল্পী, প্রগতিশীল অভিনেতা, অভিনেত্রীগণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা, মুক্তমনা ছাত্র, ছাত্রীগণ, বিচারপতিগণ, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, সংখ্যালঘু ফোরাম, প্রভৃতি, মানুষের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছেন। দলীয় বুদ্ধিজীবীর বাইরে পরিবর্তনকামী দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা আজ নগণ্য কিন্তু সুস্থ ভবিষ্যৎ গঠনের দায়িত্ব এঁদের।  এঁরাই জাতিকে দিশা দেখাবেন। একটি স্বাভাবিক গণতন্ত্রে যে প্রকারের নির্বাচন হয় বাংলাদেশে সেই প্রকারের নির্বাচনে খামতি ছিল। ২০১৪ এবং ২০১৮ এর নির্বাচন দেখে বিশ্লেষকগণ তাঁদের মতামত খুব ইতিবাচক দেননি। আজ থেকে দু-তিন দশক পূর্বের বাংলাদেশ আর আজকের চতুর্থ শিল্পায়নের ফসলে লালিত cosmopolitan, মেট্রোরেলের           স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সোনার বাংলাদেশ অন্যরকম।  সেখানে আশু নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে বিশ্বের রাজনৈতিক ইন্টেলেকচুয়াল ও বিশ্লেষকগণ  এই প্রেক্ষাপটে নাগরিক তথা সুশীল সমাজকে দৃঢ়ভাবে জাতি- ধর্ম-বর্ণ ও আর্থিক প্রলোভন ভুলে নিরপেক্ষ হয়ে কাজ করতে হবে। একসময় দেশ-বিদেশের সিনেমা জগতের, ফুটবল ও ক্রিকেট জগতের বিখ্যাত মানুষদের কথা আলোচনা হতো বৈঠকি মেজাজে।   বর্তমানে সেই কালচার লুপ্তপ্রায়। অন্যদিকে সম্প্রতির ভাবনা, উচ্চ আদর্শ মনে লালিত করার বিষয়গুলিও যেন মিয়ানো বাদামের মতোই হয়ে গেছে যাতে রস নেই, স্বাদ, বর্ণ, গন্ধ নেই; যা কৃত্রিম এবং সুযোগ সন্ধানী, আপোষ করে এবং স্বার্থ মোহজালে বন্দী নাগরিক চেতনা এক অকাল কালো গহ্বরের  মধ্য দিয়ে যাত্রা করেছে যেন পৃথিবীর কোন শেষ স্টেশনের দিকে। একটি বুদ্ধিজীবী সমাজ, সুশীল সমাজ সংগঠিত হওয়ার খোলাপথগুলি মধ্যযুগীয় ভাবধারার পাল্লায় পরে যদি ক্রমাগত বন্ধ হতে থাকে তবে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী গৌরবের যে আদর্শ তার অকাল-মৃত্য নিশ্চিত। যা সংস্কৃতির মলিনতা বৃদ্ধি করবে, পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে নম্র শক্তির বিকাশে ও নানান সম্পর্কের মেলবন্ধনে পর্বত প্রমান বিঘ্ন হয়ে দাঁড়াবে। যাইহোক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিক্ষা নিরিক্ষা তথা কালো সংস্কৃতির পথ ধরা একটি সমাজের জন্য কি ধরণের বিপদ বা চ্যালেঞ্জ ডেকে আনতে পারে তা সুশীল সমাজের বুদ্ধিজীবী মাত্রই উপলব্ধি করবেন যদি তিনি নিরপেক্ষ হন এবং সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলার যোগত্যা রাখেন। কিন্তু ১৯৯০-১৯৯২, ২০০১-২০০৪  সাল পর্যন্ত বিএনপি, জামাতে ইসলামি ক্যাডার দ্বারা সংখ্যালঘুদের ওপর যথেচ্ছহারে সন্ত্রাস চলেছে। এর ফলে অত্যাচারের যে ঘৃণ্য নারকীয় রূপ আমরা দেখেছি তাতে শুধু সংখ্যালঘু জনগণই শঙ্কিত নয়, উদার সংস্কৃতির পরিমণ্ডল গঠনকারীরাও চিন্তিত। আরও লজ্জার যে বাংলাদেশী কালচার বিকাশের ৩০-৪০ বছরের মধ্যেই তাঁর কুসন্তানরা ততোধিক উল্কার গতিসহ ডালপালা মেলা শুরু করেছে।  এরা বাঙ্গালী সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলামী বা আরবী সংস্কৃতির মকটেলে কুন্ঠিত নয় বা লজ্জাবোধ করেন না। আফিম সেবনের ন্যায় উপভোগ করেন। পাশাপাশি ২০০১ থেকে তথাকথিত বাংলা ভাইয়ের এক নতুন ইসলামিক বিপ্লব তথা বাংলাদেশের Talibanization ঘোর বিপদের ইঙ্গিত দেয়। এসবই নৈরাজ্যের দিকে   যাত্রা যেখানে কিছু মানুষের গাজোয়ারি বাদে নাগরিকের কোনও say ছিল না । ২০১২ এর হাঙ্গামা, ২০২১ এর …

বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী এক বিকল্প মুখ Read More »

PADMA BRIDGE AND ITS IMPACT ON ROAD TRANSPORT

Shankar Sarkar The road transport & communication always play a vital role in every country all over the world  for the welfare and betterment. We can learn  lessons from history.  Notorious Afghan ruler Sultan Mahmud attacked India 18 times and killed many people & looted the valuable wealth like, gold, and money from Somnath Mandir. He built road, big highways and madrasas for his own country by using this looted wealth and  money and his country developed fast. For this reason, Sultan Mahmoud is the hero in the eyes of Islam.  Now a days, we often observe in the national daily newspapers in our country that Bangladesh is losing at least 25 to 30 thousand crores of  Bangladeshi taka only due to traffic jam in Dhaka city. Concerned ministry has been working to solve this problem. We know that nearly 15 million people are living in Dhaka city. Presently, if a person wants to travel from one area to another area of Dhaka city he requires at least 3 to 4 hours.  It is nothing but wastage of time. After 1971, every Bangladesh government especially from the time of Chief Martial Law Administrator (CMLA)  and former president H M Ershad tried to prevent Sheikh Hasina government to give  top priority of communication for the progress of Bangladesh. As for example, now I draw attention about the Benapole to Dhaka transport and communication issue especially after the completion of Padma bridge. Actually for the Padma Bridge directly connected with the whole south west part of Bangladesh with capital city Dhaka. Now one person can save 5 to 6 hours time which present   economic value Bangladeshi Tk 300( more or less) because at present a daily Bangladeshi unskilled labour  gets Tk 500 for his eight hours working time. In this way if 5000 people go through this Padma bridge from capital Dhaka to Benapole land port near about Bangladeshi Taka 1500000 is saved for the people of the country which is added per day with the national GDP of Bangladesh. And if this people is 10000 in that case amount will increase accordingly. In the same calculation per year amount is near about Bangladeshi Tk. 547500000. Every day thousands of businessmen, tourist, patients, student etc. various types & purpose peoples are going to visit India through this Dhaka-Benapole  high way  route by road. As far we know at least 20 Bus companies are operating  services from Dhaka to Benapole daily. Each Coach company takes 3 to  5 trips from Dhaka to Benapole. This 20 bus company at least carry 4000 people daily and for a period of one month the total number of passengers will be nearly  120000 and these passengers will save  about Taka 36000000 per month and per year Bangladeshi taka near about 43 crore to 50 crore which will add annual GDP of Bangladesh extra. Time is most important for every country of the world today. Every nation  has been trying to utilise  time properly.  Actually,  the Padma bridge is a blessing of Bangladesh for making economic structure more inevitable than before.  We have noticed that everyday near about 300 to 350 trucks ( loading capacity of per truck is 10 to 15 tons goods) move forward  from India via  Benapole  land port to Dhaka.  The Padma Bridge  is a conducive factor to  spread trade and business services all over Bangladesh quickly. We have come to know from a reliable source that everyday the goods carrying trucks carry goods at least US Dollar 25000 which is equivalent to Bangladeshi taka 2500000 valued goods by each truck. The Bangladeshi importers & Bangladesh government both are imported various types of goods  from India. The Bangladesh government, private companies & businessmen export goods to India. Though Bangladesh import much quantity from India.  On the other hand, Bangladesh export less quantity than India.  INLa trade different is very big. If we calculate the total cost value or economic value of 300 or 350  goods loaded truck it will be approximately per day US Dollar 75 00000 to US Dollars 9000000 which is equivalent to Bangladeshi taka cost of  75 crores. The amount will be Bangladeshi taka 2250 crore per month and  Bangladeshi taka 27000 crore per year. This amount is increasing  very  fast through the blessing of Padma Bridge. Only for the Padma bridge road transport and communication will bring big change in Bangladesh. It is the great contribution of the Padma bridge to Bangladesh economy. And not   only that same  goods loaded trucks are coming from Bhomra land port which is near to Benapole port. Through Bhomra & Benapole ports combinedly total amount valued cost will be near about 50000 crore taka. These huge quantity goods are quickly coming & spreading fast through out Bangladesh and its main route is the Padma Bridge. If there is no Padma bridge it will take long time and economic development  will be more slow.  The concerned experts say and  Bangladesh economists desire that at least Bangladesh will improve her GDP 10 per cent higher than before  only for the Padma Bridge. Not only that the roads and highways are developed and it will become more easier communication than past.  So now farmers will get more price for their out put. Students also will not lose time and can give more attention to studies and women will be  able to work out of the house and will earn for family and shall make national economy stronger. Businessmen will be able to make profit and can earn more. In simple words whole nation will be benefitted in enormous way due to the construction of Padma Bridge and other communication projects on Bangladesh. Sankor Sarkar  

BENGALEES OF KARACHI

DRONA BANDYOPADHYAY The Bengali speaking community is one of the largest ethno-linguistic community in the Indian subcontinent. They are settled across the world due to series of migration from Bengal to other parts of India and also to the other countries since colonial period. Since Bengal came first under the British colonial rule due to her flourishing pre-modern industrial and mercantile economy and lucrative geo-strategic location in the Induan subcontinent the Bengalees were foremost in availing the opportunities offered by the imperialist British rulers. The Hindu upper caste Bengalees  who were historically educated and collectively quite brilliant to accept and utilise new opportunities started to migrate to different cities and towns of India. This was why Hindu Bengali settlements were found from Peshawar to Rangoon and Karachi to Kanyakumari. After the religion based partition of 1947 the Hindu Bengalees left those cities and towns which became part of western Pakistan including Karachi, Quetta, Rawalpindi, Peshawar, Lahore,  etc.  But the brilliance of their renascent enlightenment has left a deep influence intellectual influence in the future life of Pakistan, the newly created Muslim homeland for Muslims of Indian subcontinent . The Nobel Prize winning world famous physicist Dr. Abdus Salam had credited his teacher  Prof. Anilendranath Ganguly of Lahore Government College for his stupendous achievement. This singular incident can be exemplified as an epitome of Hindu Bengali contribution in the intellectual development of Pakistani enlightened societal strata. The Muslim Bengalees started to arrive in Karachi during the British period when coastal city was started to be developed as a centre of fishing and  trade within the colonial province of Bombay. The fishermen from Noakhali, Chittagong and other impoverished districts of southern and Eastern Bengal came to Karachi for fishing and other laborious jobs. Kazi Nazrul Islam, the most famous Muslim poet of Bengal, also lived in Karachi for a short period of time. During the first World War (1914-1918) he joined in British Indian Army and enlisted in 49 Bengal Regiment. As a soldier he was posted in Karachi and lived in the city from 1917 to 1920. His first prose ‘ Baunduler Atmokahini’ which was published in Saogat  in May, 1929 and first poem ‘Mukti’ published in Bangiya Musolman Sahitya Patrika in July, 1919 were written in Karachi.  Nazrul also learnt Persian language from a Punjabi Islamic cleric in karachi too. So it can be opined that the city of  Karachi had played a significant path-breaking role to evolve the rich and radiant literary production of Nazrul in Bengali literature and music. Pakistan was created in August, 1947. Karachi was selected as the capital of Pakistan.  In 1948 Karachi metropolitan area was declared as Federal Capital Territory. From 1948 to 1959 Karachi had remained as national capital and main centre of trade , commerce and industry. Due to this reason people from East Pakistan came in droves to settle and work in the city. The newly emerging Muslim Bengali middle class came to Karachi to work in different government offices including National Secretariat, Karachi Port Trust, State Bank of Pakistan, etc. Many more educated people came from eastern Bengal to work in private sector as Karachi was the economic hub of the country. Many poor people from the eastern wing of Pakistan came to Karachi to work in industrial and fishing sectors in large numbers. After 1971 most of the educated Muslim had decided to go back to independent Bangladesh. The family of Runa Laila also migrated to Dhaka despite her highly successful career in film industry of Lahore and non -playback music industry of Karachi. In early 1970s her popularity was next to legendary Madam Noor Jahan as female playback singer. Not only Runa Laila but also Shehnaz Begum also left Karachi for Dhaka. She also had a quite successful musical career in Pakistan. She is still regarded as ‘Sohni Dharti Girl’ of 1970s as her version of patriotic song ‘ Sohni Dharti Allah Rakhe ‘ composed by highly talented music director Sohail Rana. During the grave political crisis and eventually civil war of 1971 in Pakistan which resulted in brutal destruction of life and property in East Bengal the then celebrated Bengali public figures based not only in Karachi like Runa Laila but also in Lahore like Shabnam and Robin Ghosh took a very indifferent stand on the savage stream of incidents which ravaged East Bengal but paved the political way for independent Bangladesh at the end through the disintegration of Pakistan. The creation of Bangladesh in early 1970s did not stop the migration of poor and unskilled people to come to Karachi in search of livelihood. It is estimated that about 30 lakhs of Bengalees live in Karachi and nearly all of them are poor and unskilled. These Muslim Bengalees have founded 132 colonies of their own for living .  Most of them have little access to education and job oriented skill development. They live in inhuman conditions with no availability of basic amenities of life like drinking water, sewerage system, etc. These basic amenities of life are a distant dream to them. The Karachi based Bengalees are patriotic Pakistanis and and stand for the ideals  and objectives of Pakistani state. They regard themselves as Muslims first and do not want to go back to Bangladesh which was created by dividing their beloved Pakistan which they call in Urdu ‘ Pyarey Pakistan’. But they have a connection with Bangladesh. Sometimes many of them visit to their ancestral village in Bangladesh in order to spend some days or weeks with their relations. They use Bangladeshi products like pan, jarda, lungi, saree, etc. which are essential objects of Bengali way of life. These Bengalees of Karachi also opened small shops in their colonies like Chittagong Colony, Machhar Colony to sell traditional Bangladeshi products and eateries across different parts of Karachi to offer popular Bangladeshi snacks like samosa, jilipi, peyaju, moya, etc. and cooked food items like bhat, different kinds of bharta, bhaji and fish. Due to nearly total migration …

BENGALEES OF KARACHI Read More »

নানামুখী প্রতিবন্ধকতায় বাংলাদেশের প্রিন্ট মিডিয়া

Dr. Kakoli Sarkar    যে কোনো রাষ্ট্রের জনমত গঠনের ক্ষেত্রে গণমাধ্যম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে বর্তমানে যে মৌলবাদী বাড়বাড়ন্ত তার পিছনে সে দেশের গণমাধ্যমের অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের মধ্যে কেবলমাত্র প্রিন্ট মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে আমি অতি সংক্ষেপে দু চার কথা বলতে চাই। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর তখন বাংলাদেশে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ছিল দশটি, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দৈনিক আজাদ, ইত্তেফাক, পূর্বদেশ, দৈনিক অবজারভার, দৈনিক বাংলা। তবে বাংলাদেশে প্রথম দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় বিজয়ের দুদিন পরে, অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর। সেই দিন বাংলাদেশের সকল পত্রিকায় ফুটে উঠেছে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বিজয়ের আনন্দ আর শহীদ পরিবারগুলোর অশ্রুবেদনাগাঁথা। সেই সময় বাঙালি জাতীয়তাবাদী ঝড়ের কাছে ইসলামপন্থী পত্রিকাগুলির আত্মগোপন করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। তবে জামায়াতে ইসলামী দলের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম তখনও প্রকাশিত হতো। জামায়াতে ইসলামী দলের মুখপত্র এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হতে শুরু করে ১৭ই জানুয়ারি ১৯৭০ থেকে। ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই পত্রিকাটি বিভিন্নভাবে স্বাধীনতাকামী মানুষের বিপক্ষে, রাজাকার ও পাকিস্তানিদের পক্ষে, মিথ্যা, বানোয়াট ও বিভ্রান্তিমূলক খবর ছেপে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিল। তবে এই পত্রিকার পাঠক সংখ্যা ছিল হাতে গোনা অর্থাৎ খুবই অল্প। কেবলমাত্র জামাত–শিবিরের কর্মীদের মধ্যেই এই পত্রিকাটি সীমাবদ্ধ ছিল। বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইন জারির মাধ্যমে সংবাদপত্রের নিয়ন্ত্রণে সরকারকে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়। ১৯৯০ এর পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে পত্রপত্রিকাগুলির বিশেষ কোন স্বাধীনতা লক্ষ্য করা যায় না, সরকার দ্বারা তাদের গন্ডি সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৬ই জুন বাংলাদেশ সরকার দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, দ্য বাংলাদেশ অবজারভার ও দ্য বাংলাদেশ টাইমস্ এই চারটি পত্রিকা ছাড়া বাকি সব পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। তবে ওই বন্ধ পত্রিকাগুলির কর্মীরা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন পেতেন। ১৯৭৬ সাল থেকে পুরানো পত্রিকাগুলি আবার ধীরে ধীরে প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত বাংলাদেশে সংবাদপত্র স্বৈরশাসকের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সরকারের সমালোচনামূলক খবর ছাপানোর অভিযোগে যখন তখন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হতো। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ সরকারের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিশেষ ক্ষমতা আইনের মাধ্যমে ১৬-১৭ এবং ১৮ নং ধারা অবলুপ্ত করলে সেন্সরশিপ ও প্রকাশনা নিষিদ্ধ সংক্রান্ত আইনের বিলুপ্তি ঘটে। ১৯৯০ এর পর থেকে পত্রপত্রিকার প্রকাশনার সংখ্যাটা বিশেষভাবে বেড়ে যায়। ফলে ১৯৭৫ সালের পর থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত বাংলাদেশে পত্রিকার জগতে যে ইসলামী মৌলবাদের প্রবেশ তা সরকারের প্রত্যক্ষ মদতেই ঘটেছিল। বাংলাদেশের সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং হোসেন মোহাম্মদ  এরশাদ উভয়ই ইসলামী মৌলবাদের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এই সময় কালের (১৯৭৫–৯০) মধ্যে বাংলাদেশে ইসলামী মৌলবাদ প্রচারে যে পত্রিকাটি সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সেটি হল ইনকিলাব। ইনকিলাব যেন বাংলাদেশের বুকে এক গভীর চক্রান্ত। আমরা জানি জামাতে ইসলামী দলের মুখপত্র হিসাবে দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকাটি ছিল এবং যেটি অবশ্যই ইসলামী মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষক ও পাকিস্তানপন্থী। কিন্তু ইনকিলাব এর সাথে দৈনিক সংগ্রামের পার্থক্য হল, দৈনিক সংগ্রামের পাঠক ছিল কেবলমাত্র জামাত শিবিরের সদস্যরা, কিন্তু ইনকিলাব একটি ব্যাপক অংশের পাঠক হাতে নিয়েই যাত্রা শুরু করে। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের একটি অংশকে পুঁজি করেই এই পত্রিকাটি শুরু হয়। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সংগঠনের নাম ‘জমিয়াতুল মোদারেসিন’ । এই জমিয়াতুলের অনুরোধেই দৈনিক ইনকিলাবের প্রকাশ বলে জানা যায়। ১৯৮৬ সালে মাওলানা আব্দুল মান্নানের উদ্যোগে এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। মাওলানা আব্দুল মান্নান আবার জমিয়াতুলের প্রধানও ছিলেন। মাওলানা আব্দুল মান্নানের পরিচয় হলো তিনি একজন রাজাকার, স্বাধীনতা বিরোধী। ১৯৭১ সালে এই আব্দুল মান্নান ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করে ডক্টর আলিম চৌধুরীর হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাকে ‘নর পিশাচ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবাদের অপরাধী হিসেবে সে কিছুদিন জেল খাটে। তারপর জেনারেল এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতায় জেল থেকে বেরিয়ে এসে সে  এরশাদের মন্ত্রিসভায় প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে। এখানে আব্দুল মান্নান ইনকিলাব পত্রিকা প্রকাশের পূর্বেই প্রতিটি কামিল মাদ্রাসাকে ১২ কপি করে পত্রিকার গ্রাহক হবার নির্দেশ দেয়। ফলে পত্রিকা প্রচারের আগেই এর প্রচার সংখ্যা দাঁড়ায়  ১ লক্ষ ২৮ হাজার আর তার আয় দাঁড়ায় ৭ কোটি ৬৮ লক্ষ। বিভিন্নভাবে মৌলবাদের বিষ মাদ্রাসাগুলিতে ছড়ানো এবং এরশাদ সরকারের গুণ কীর্তন করা– এটাই ছিল তার পত্রিকার উদ্দেশ্য। বিভিন্ন রকম গুজব ছড়ানোতে এই পত্রিকার জুড়ি মেলা ভার। তসলিমা নাসরিন থেকে শুরু করে বাবরী মসজিদ ধ্বংস, কোনো কিছুতেই এই পত্রিকা গুজব ছড়াতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেনি। ‘রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম’ প্রচারের পক্ষে এই পত্রিকাটি এরশাদের পাশে  থেকে সহযোগী হিসেবে ব্যাপকভাবে প্রচারকার্য চালিয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, ইনকিলাবের টাকার কাছে বহু বিশিষ্টজন বিক্রি হয়ে গেলেন, তাই তারা মুখ বন্ধ করে থাকলেন। বর্তমানে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে নষ্ট রাজনীতিকদের মিডিয়া মালিক হওয়া রোধ করা যাবে না। তাই বর্তমানে  বাংলাদেশ সরকার ইচ্ছা করলেও আর মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। বাংলাদেশের অর্থনীতির অনেকখানি  অংশ জুড়ে বসে আছে তৎকালীন রাজাকার, আলবদর বা পাকিস্তানপন্থী গোষ্ঠী, যারা ইসলামী মৌলবাদের প্রচারক। তাদের শিকড় এখন অনেক গভীরে, বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। বর্তমান সময়ে গণমাধ্যম পরিচালনাও একটি ব্যবসা। এই ব্যবসাটির অনেকখানি অংশ দখল করে আছে পাকিস্তানপন্থী ইসলামী মৌলবাদী গোষ্ঠী। এই সবকিছুর মধ্যেই কিছু পত্রিকা আছে যারা সাংবাদিকতার নৈতিকতাকে মনে রেখে চলতে চেষ্টা করেন। এখনো বাংলাদেশে কিছু প্রণম্য সাংবাদিক আছেন যাঁরা বোঝেন গণমাধ্যম পরিচালনার ব্যবসা অন্য ব্যবসা থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। তাই এখনো সংবাদপত্রেই দাবি ওঠে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসবে ছুটি প্রদানের। কেননা বাংলাদেশে সংবাদিকদের এগারো দিন ছুটি ঘোষিত আছে, এর মধ্যে নয় দিনই ইসলাম ধর্মকেন্দ্রিক ছুটি, একদিন পয়লা বৈশাখের ছুটি, আর একদিন মে দিবসের ছুটি। এর বাইরে জাতীয় তিন দিবসে তিনটি সরকারি ছুটি, তবে ওই ৩ দিন বিশেষ ব্যবস্থায় পত্রিকা বের হয়। অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসবে কোনরকম ছুটি নেই। যাই হোক, অর্থনীতিকে বাদ দিয়ে কোন কিছুই হতে পারে না। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনীতির যারা নিয়ন্ত্রক শক্তি হবে তারা গণমাধ্যমকেও নিয়ন্ত্রণ করবে। এখন সেটাই দেখার অপেক্ষা।

বাঙালি জাতিসত্তা বা জাতীয়তাবাদ কেন এত জরুরী

বিমল প্রামাণিক ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে যে বিষয়টি বারবার মনে বাজে তা হল জাতিসত্তা বা জাতীয়তাবাদ।  জাতীয়তাবাদের শক্তি এমনই যে পৃথিবীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী অনেক বৃহৎ শক্তির সঙ্গে অসম লড়াই সত্বেও শেষ পর্যন্ত  জয়ী হয়েছে।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এর যেমন নজির রয়েছে, সাম্প্রতিক অতীতে ভিয়েতনাম যুদ্ধ বা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তো এখনও আমাদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। ধর্মকে জাতিসত্তার বিকল্প হিসাবে  দাঁড় করানোর চেষ্টা বার বার ব্যর্থ হয়েছে। ধর্মযুদ্ধ আজকের পৃথিবীতে শুধু রক্তক্ষয় আর ধ্বংসের ইতিহাস। বর্বরতার ইতিহাস বললে কম বলা হয়। তা বলে কি ধর্মীয় রাষ্ট্রের ধারণা বা রাষ্ট্র পৃথিবী থেকে লোপ পেয়ে গেছে – তা তো নয় । কিন্তু তারা দূর্বল থেকে দূর্বলতর হচ্ছে।  একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের নামে সামরিকতন্ত্র তাদের সঞ্চিত ক্ষমতা-অর্থ-সম্পদের কারণে আরও কিছু বছর টিকে থাকবে বটে, কিন্তু শেষ কথা বলার ক্ষমতা নিয়ে তারা কম্পমান। জাতিরাষ্ট্র বা বহুজাতি রাষ্ট্রে গণতন্ত্র জনগণের সামনে আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। বহুজাতি রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের অভাব দেখা দিলে যেমন বিচ্ছিন্নতাবাদী  প্রবণতা তৈরি হতে পারে, উগ্রজাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিতে পারে এমনকি দেশ খণ্ডিতও হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ তার একটি উদাহরণ। অন্যদিকে, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দেউলিয়াপনার প্রেক্ষিতে ইসলামি সন্ত্রাসবাদ রফতানির ব্যবসা চালু রাখা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে।  ভারতীয় উপমহাদেশে উগ্র ইসলামি মৌলবাদ বা ইসলামি সন্ত্রাসবাদের প্রবণতা নতুন করে মাথাচাড়া দেওয়ার সম্ভাবনাও মোটেই উজ্জ্বল নয়। বিশেষকরে ভারত-পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে বাম মৌলবাদী চেতনার যে ব্যাপক ধ্বস নেমেছে ফলে বাম সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের কোন ভবিষ্যৎ নাই বলেই প্রতিপন্ন হচ্ছে। ফলে বাঙালি জাতিয়তাবাদী গণতান্ত্রিক শক্তির পায়ের নীচের মাটি ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। এটা আশার কথা বৈকি! মুজিব হত্যার পর পরই বাঙালি জাতিয়তাবাদের উচ্ছ্বাস হ্রাস পেতে শুরু করে। তারপর প্রায় চার দশক বাঙালি জাতিয়তাবাদ সমাজে তেমন সমাদৃত হতে দেখা যায়নি। পাকিস্তানে দ্বিজাতিতত্ত্বের  জৌলুস ফিকে হয়ে  যাওয়া, আর্থিক দুরবস্থা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক ইসলামি দেশের পাকিস্তান থেকে দূরে সরে যাওয়া ও তাদের ভারতের  প্রতি পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি বাঙালি মুসলমান মনে  জাতিসত্তা নিয়ে নতুন ভাবনার উদ্রেক দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশি মুসলমানের সামনে বিশ্ব-দুয়ার  খুলে যাওয়ায় বিরাট সংখ্যক মানুষ প্রায়শই দেশের বাইরে কাজকর্মসহ নানা কারণে ভ্রমণকালে স্ব-পরিচিতির ক্ষেত্রে  ‘বাংলাদেশি বাঙ্গালি’ সামনে চলে আসে। ধর্মীয় পরিচয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গৌণ হয়ে যায়। বাঙালি জাতীয়তা বড় হয়ে ওঠে।  বাঙালি জাতি যেভাবে ইতিহাস বা সংস্কৃতি চর্চা অতীতকাল থেকে করে চলেছে তা কখনও ধর্মের নিগড়ে বাঁধা পড়েনি। আজকে যারা বাঙালীকে মুসলমান পরিচয় দিয়ে বাঁধতে চায় তারা শুধু অজ্ঞই নয়, অজ্ঞাত কুলশীল।  এখানেই বাঙালি জাতিসত্তার বিজয় এবং ভবিষ্যৎ। যা কোন নিছক  রাজনৈতিক শাসক বা ধর্মান্ধ  জনগোষ্ঠীর উপর নির্ভরশীল নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সেটা প্রমাণ করেছে। আজ বাংলাদেশে দ্বিজাতিতত্ত্বের কদর কোথায়? বালুচ, সিন্ধ্রিসহ প্রভৃতি আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। গেরিলা সশস্ত্র লড়াইয়ের ময়দানে ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানের মূল ভিতে আঘাত হেনে চলেছে। যা ১৯৭১ সালে বাঙালিরা মোকাবিলা করেছিল। কিন্তু একথা ভুললে চলবে না যে, চল্লিশের দশকে দ্বিজাতিতত্ত্ব এবং পাকিস্তান দাবির মোড়কে কট্টর ভারত তথা হিন্দু- বিরোধিতা সাধারণ মুসলমান  জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করতে যেমন কার্যকার হয়েছিল, সেই অবস্থার সম্পূর্ণ অবসান হয় নাই। ইসলাম ধর্ম মুসলমান জনগোষ্ঠীকে দেশে দেশে তাদের স্ব স্ব জাতিসত্তাকে  যেভাবে অধিকতর তরলীকৃত করে কট্টর ইসলামি নিগড়ে সমন্বয় করতে চায় – সে চেষ্টায় এখনও ভাটা পড়ে নাই। জাতিসত্তা বা জাতি পরিচয়কে ইসলামে ভাল চোখে দেখা হয়না বলেই ১৯৭১ সালে বাঙালিদের উপর গণহত্যা চালাতে না ধর্মে, না মানবতায় পাকিস্তানি ও বাঙালি কট্টর মুসলমানদের বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।  আজকের পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়লেও ধর্মীয় কট্টরতার বাইরে এখনও বেরিয়ে আসতে পারেনি। প্রধান কারণ ইসলামের নামে শোষণ, শাসন, নির্যাতন পাকিস্তানের ইতিহাসের অঙ্গ । একটা বিষয় পরিষ্কার করে বলা দরকার বলে মনে করি । বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোন  স্বাধীনতা সংগ্রাম করেনি । ১৯৭১-এ ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙ্গালীদের মুক্তি আন্দোলন, যা সাধারণত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নামে খ্যাত । যে কোন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পিছনে থাকে দীর্ঘ ইতিহাস যার মধ্য দিয়ে একটা আদর্শবাদিতা এবং ঐকমত্য গড়ে ওঠে। সেটা বিদেশী শাসকের ক্ষেত্রে যেমন হয়, স্বদেশী রাজতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্রের ক্ষেত্রেও ভিন্নতর কিছু হয় না।  কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে কোন ভূখণ্ডকে মুক্ত করাই হয় প্রধান লক্ষ্য।  সেখানে আদর্শগত বা ঐকমত্য সবসময় প্রধান বিচার্য বিষয় নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রেও এটা সত্য । এক্ষেত্রে বাস্তবতা ছিল, একটি বড় সংখ্যক জনসংখ্যা আদর্শগতভাবে ধর্মীয় ঐক্য রক্ষায় পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। অন্যদিকে, ধর্মীয় ভিন্নতা না থাকা সত্বেও একটি বড় সংখ্যক মানুষ মতাদর্শগতভাবে পাকিস্তানি শাসনমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। যার মূলে কাজ করেছিল বাঙালি জাতিসত্তার ভিত্তি।  আজকের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা পাকিস্তান থেকে ভিন্নতর। এখানে গত চৌদ্দ বছর কমবেশি একটি স্থিতিশীল সরকার থাকায় অর্থনৈতিক ভিত যেমন শক্তিশালী  হয়েছে, সামাজিক অস্থিরতাও হাতের নাগালের বাইরে চলে যায়নি। সমাজে ইসলামি মৌলবাদ শক্তি সঞ্চয় করলেও সরকারি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে, যেটা পাকিস্তানের সাথে তুলনা করা চলে না। বাংলাভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি যেহেতু এখনও ধর্মের নিগড়ে বাধা পড়ে যায় নাই, দেশ বিভাগোওর কালে পাকিস্তানি শাসনে বাঙালি জাতিসত্তাকেও তরলীকৃত   করে পাকিস্তানিকরণও  সম্ভব হয়নি। এটা আমরা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণের প্রেক্ষিতে বাংলাভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন ও পূর্ববঙ্গে ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার মধ্যে দেখতে পাই। যখন বাঙালি জাত্যাভিমানের উপর বড় আঘাত এলো, জাতিসত্তাই সংকটের মুখে পড়ে গেল তখন বাঙ্গালির সুপ্ত জাতীয়তাবাদ ফেটে পড়তে দেখা গেল,  ধর্ম গৌণ হয়ে গেল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ  ইতিহাসে এর একটা বড় উদাহরণ । বাঙালি জাতীয়তাবাদের পূর্ণ বিজয় আজ ইতিহাসের দাবি।  “আত্মঘাতী বাঙ্গালির” অপবাদ তো  বাঙালি মুসলমানদেরই মোচন করতে হবে।

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সমস্যা হেলাফেলার বিষয় নয়

পূর্ণিমা নস্কর ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র  গঠিত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং মুসলিম অনুপ্রবেশকারীগণ  বাংলাদেশ ত্যাগ করে পূর্ব ভারত এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নিরন্তরভাবে আশ্রয় গ্রহণ করেই চলেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের উত্তর পূর্ব রাজ্য-সমূহে জনসংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির মধ্যে আসাম রাজ্যের  কথা বলা যায়। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্টের পূর্বে অসম প্রদেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে ছিল বর্তমান অসম রাজ্য, মেঘালয়, নাগাল্যাণ্ড, মিজোরাম, অরুণাচলপ্রদেশ ও  বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্ভূক্ত শ্রীহট্ট জেলা।  দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে শ্রীহট্ট জেলার করিমগঞ্জ মহকুমার বদরপুর, পাথরকান্দী, রাতাবাড়ি ও কমিলগঞ্জের পুলিশ স্টেশনের অংশ নিয়ে অসম রাজ্যের কাছাড় জেলার অন্তর্ভূক্ত একটি মহকুমা গঠন করা হয়।  ১৯৫১ খৃষ্টাব্দ  থেকে ১৯৬১ খৃষ্টাব্দের মধ্যে নাগাল্যাণ্ড ও অরুণাচলপ্রদেশ  অসম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, আর কামরূপ জেলার ৮৫ স্কয়ার কিলোমিটার অংশ ভুটানের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ১৯৬১ খৃষ্টাব্দ  থেকে ১৯৭১ খৃষ্টাব্দে মেঘালয়  গঠিত হওয়ায় অসম রাজ্যের সীমানা আরও সংকুচিত হয়। ১৯৮৭ সালে মিজোরাম ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে স্থাপিত হয় । ভারতের প্রতিবেশী রাজ্য বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক বিবর্তনের সুদূরপ্রসারী ফলাফলের প্রতিফলন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিতে পরিলক্ষিত হয় । আর এটি সম্ভব হওয়ার একমাত্র কারণ হল – বাংলাদেশ থেকে হিন্দু মুসলমান জনগণের ব্যাপক অনুপ্রবেশ। সীমান্তবর্তী জেলা হিসেবে যদি আমরা আসামের জনগণনার প্রতিবেদনের দিকে দৃষ্টিপাত করি তাহলে অনুপ্রবেশের  ফলস্বরূপ, সাংস্কৃতিক প্রভাবের বিষয়টিকে সহজেই উপলব্ধি করা যাবে। আসাম  রাজ্যের জনগণনার প্রতিবেদনটি নিম্নে সারণীর মাধ্যমে উপস্থাপন করা হল ।       সারণীঃ জেলা বা রাজ্য ধর্মীয় সম্প্রদায় ভিত্তিক  জনসংখ্যা  ১৯৭১ মোট জনসংখ্যা ১৯৮১ মোট জনসংখ্যা ১৯৯১ মোট জনসংখ্যা ২০০১ মোট জনসংখ্যা ২০১১ মোট জনসংখ্যা ১ ২ ৩ ৪ ৫ ৬ ৭  আসাম সকল ধর্মীয় সম্প্রদায় ১৪,৬২৫ জনগণনা হয়নি  ২২,৪১৪ ২৬৬৫৫৫২৮ ৩১২০৫৫৭৬ হিন্দু ১০,৬৫২ (৭২.৮৩%) জনগণনা হয়নি ১৫,২৯৭ (৬৮.২৫%) ১৭২৯৬৪৫৫ (৬৪.`৮৯%%) ১৯১৮০৭৫৯ (৬১.`৪৭%) মুসলিম  ৩,৫৯২ (২৪.`৫৬%) জনগণনা হয়নি ৬,৩৭৩ (২৮.`৪৩%) ৮২৪০৬১১ (৩০.৯২%) ১০৬৭৯৩৪৫ (৩৪.`২২%) খ্রিষ্টান ৩৮১.০ (২.৬১%) জনগণনা হয়নি ৭৪৪.৪   (৩.৩২%) ৯৮৬৫৮৯   (৩.৭০%) ১১৬৫৮৬৭  (৩.৭৪%)   উপরের সারণী বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের পর আসামে হিন্দু জনসংখ্যার পরিমাণ হ্রাস পেতে থাকে। ২০১১ সালে এই জনসংখ্যার পরিমাণ এসে দাঁড়ায় ৬১.৪৭ শতাংশ। আবার অন্যদিকে আসামে ১৯৭১ সালে মুসলিম জনসংখ্যার পরিমাণ ২৪.৫৬ শতাংশ থেকে ২০১১ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৩৪.২২ শতাংশে । হিন্দু- মুসলিম সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ব্যতীত আসামে অন্যান্য সম্প্রদায় হিসেবে খ্রিস্টান জনসংখ্যার পরিমাণ ও ১৯৭১ সালের তুলনায় ২০১১ সালে বৃদ্ধি পেয়েছে।  আর এটি সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশের কারণে। আসাম প্রদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হলেন অসমীয়া সম্প্রদায়। অসমীয়াদের সমাজ,  সংস্কৃতিও ভিন্নতর। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে হিন্দু-মুসলিম অনুপ্রবেশকারীরা আসামে এসে বসবাস করছে। ফলে জন্মসূত্রে আয়ত্তীকৃত তাদের নিজস্ব  সংস্কৃতির প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত হওয়া তাদের পক্ষে  সম্ভব না হওয়ার কারণে অসমীয়া সমাজে সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক আত্তীকরণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে । কিন্তু অসমীয়াদের মূল সংস্কৃতির সাথে অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশীদের সংস্কৃতির একটা পার্থক্য  রয়েই যায়। তাই  বর্তমানে আসামে সরকারিভাবে  NRC ও  CA  প্রবর্তনের ফলে আসামের সমাজের ভিন্নতর দিক পাওয়া যায়। যদিও এটা সম্পূর্ণ ভিন্নতর বিষয়। তথাপি একথা বলা যায় যে, আসাম প্রদেশেও ব্যাপক বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ ঘটেছিল – কোন সন্দেহ নেই। এই অঞ্চলের বিভিন্ন ধর্মের মানুষ যেমন নিজ নিজ স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রেখে পারস্পরিক প্রীতি সহযোগিতার ভাব নিয়ে বসবাস করতে পারে, তার জন্য উভয় সম্প্রদায়ের  মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি না পেলে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি যে অদূর ভবিষ্যতে জটিল থেকে জটিলতর হতে পারে, সে বিষয়ের সম্ভাবনাকে অবহেলা করা যায় না।   অন্যদিকে, একটি পরিকল্পিত উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশে মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত জেলাগুলিতে বসতি স্থাপন করা চলতে থাকে। আমরা এ বিষয়ে সীমান্ত জেলাগুলির মুসলিম  জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বিশেষভাবে বামফ্রন্ট আমল থেকে  (১৯৭৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত) খতিয়ে দেখতে পারি। এই চার দশকে সীমান্ত জেলাগুলির মুসলিম  জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বা স্বাভাবিক বৃদ্ধির সঙ্গে তুলনা করা চলে না। আবার আমরা  যদি বাংলাদেশে এই চার দশকের মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি প্রকৃতি বিশ্লেষণ   করি তাহলে দেখতে পাই ধীরে ধীরে বাংলাদেশের মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার স্তিমিত হয়ে এসেছে।  অন্যদিকে সীমান্ত  জেলাগুলির মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হিন্দু জনসংখ্যার থেকে অনেকটাই বেশি।  এমনকি দ্বিগুণেরও অধিক।  ভারতের হিন্দু জনসংখ্যার ক্রমহ্রাসমান বৃদ্ধির যে চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু জনসংখ্যার যে চিত্র আমাদের সামনে রয়েছে তার প্রেক্ষিতে মুসলিম জনসংখ্যার অত্যধিক বৃদ্ধির বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়, যদি না বাইরে থেকে মুসলিম জনসংখ্যা উক্ত অঞ্চলগুলিতে বসতি স্থাপন করে ।  ভারতের অন্য অঞ্চলের  মুসলিম জনসংখ্যার বসতি স্থাপনের সম্ভাবনা এই অঞ্চলে নেই তার প্রধান কারণ হল – এখানে কর্মসংস্থান ও শিল্পের প্রসার তেমন না ঘটায় ভারতের অন্য  অঞ্চলের জনসংখ্যার আকর্ষিত হওয়ার কোন কারণ নেই। তাহলে একথা অবিশ্বাস করার কোন কারণ আমরা পাই না যে, সীমান্ত অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী মুসলমানদের অনুপ্রবেশ ঘটেনি। যেহেতু ধর্মীয় জনবিন্যাসে একটি বিপুল পরিবর্তন চার দশকের জনগণনার মধ্য থেকে দেখতে পাওয়া যায়। ইতিমধ্যেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, সীমান্ত অঞ্চলে গত চার দশকে নানা ধরণের অপরাধের মাত্রা বৃ্দ্ধি  পেয়েছে, গরু পাচার, চোরাচালান, অবৈধ সীমান্ত পারাপার এবং ব্যাপক অনুপ্রবেশ।  এর ফলে ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও এই অপরাধের আঁচ লেগেছে। অন্য একটি গুরুত্বপূ্র্ণ বিষয়, অনুপ্রবেশজনিত জেলাগুলিতে মাদ্রাসা সংখ্যা এবং শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়া, এর ফলে স্থানীয় সংস্কৃতির পাশাপাশি মৌলবাদী ইসলামি সংস্কৃতি ক্রমে জোরালো হয়ে উঠছে। এবিষয়টি নিয়ে অসমের মুখ্যমন্ত্রী শুধু সোচ্চারই হননি নানা ইতিবাচক ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই গ্রহণ করা হয়েছে।  কিন্তু মুসলিম তোষণ ও ভোটের রাজনীতির ফাঁদে পরে পশ্চিমবঙ্গ যেভাবে  শিক্ষা-সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে পিছিয়ে পরেছে – এ রাজ্যের জনজীবনে তার প্রভাব ইতিমধ্যেই পরিলক্ষিত হতে শুরু করেছে। প্রত্যেকটি সীমান্তবর্তী রাজ্য ও তার সমস্যা নিয়ে এখনই সোচ্চার না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি আমাদের ক্ষমা করবে ?