Center For Research In Indo

Author name: admin

BENGALEES OF KARACHI

DRONA BANDYOPADHYAY The Bengali speaking community is one of the largest ethno-linguistic community in the Indian subcontinent. They are settled across the world due to series of migration from Bengal to other parts of India and also to the other countries since colonial period. Since Bengal came first under the British colonial rule due to her flourishing pre-modern industrial and mercantile economy and lucrative geo-strategic location in the Induan subcontinent the Bengalees were foremost in availing the opportunities offered by the imperialist British rulers. The Hindu upper caste Bengalees  who were historically educated and collectively quite brilliant to accept and utilise new opportunities started to migrate to different cities and towns of India. This was why Hindu Bengali settlements were found from Peshawar to Rangoon and Karachi to Kanyakumari. After the religion based partition of 1947 the Hindu Bengalees left those cities and towns which became part of western Pakistan including Karachi, Quetta, Rawalpindi, Peshawar, Lahore,  etc.  But the brilliance of their renascent enlightenment has left a deep influence intellectual influence in the future life of Pakistan, the newly created Muslim homeland for Muslims of Indian subcontinent . The Nobel Prize winning world famous physicist Dr. Abdus Salam had credited his teacher  Prof. Anilendranath Ganguly of Lahore Government College for his stupendous achievement. This singular incident can be exemplified as an epitome of Hindu Bengali contribution in the intellectual development of Pakistani enlightened societal strata. The Muslim Bengalees started to arrive in Karachi during the British period when coastal city was started to be developed as a centre of fishing and  trade within the colonial province of Bombay. The fishermen from Noakhali, Chittagong and other impoverished districts of southern and Eastern Bengal came to Karachi for fishing and other laborious jobs. Kazi Nazrul Islam, the most famous Muslim poet of Bengal, also lived in Karachi for a short period of time. During the first World War (1914-1918) he joined in British Indian Army and enlisted in 49 Bengal Regiment. As a soldier he was posted in Karachi and lived in the city from 1917 to 1920. His first prose ‘ Baunduler Atmokahini’ which was published in Saogat  in May, 1929 and first poem ‘Mukti’ published in Bangiya Musolman Sahitya Patrika in July, 1919 were written in Karachi.  Nazrul also learnt Persian language from a Punjabi Islamic cleric in karachi too. So it can be opined that the city of  Karachi had played a significant path-breaking role to evolve the rich and radiant literary production of Nazrul in Bengali literature and music. Pakistan was created in August, 1947. Karachi was selected as the capital of Pakistan.  In 1948 Karachi metropolitan area was declared as Federal Capital Territory. From 1948 to 1959 Karachi had remained as national capital and main centre of trade , commerce and industry. Due to this reason people from East Pakistan came in droves to settle and work in the city. The newly emerging Muslim Bengali middle class came to Karachi to work in different government offices including National Secretariat, Karachi Port Trust, State Bank of Pakistan, etc. Many more educated people came from eastern Bengal to work in private sector as Karachi was the economic hub of the country. Many poor people from the eastern wing of Pakistan came to Karachi to work in industrial and fishing sectors in large numbers. After 1971 most of the educated Muslim had decided to go back to independent Bangladesh. The family of Runa Laila also migrated to Dhaka despite her highly successful career in film industry of Lahore and non -playback music industry of Karachi. In early 1970s her popularity was next to legendary Madam Noor Jahan as female playback singer. Not only Runa Laila but also Shehnaz Begum also left Karachi for Dhaka. She also had a quite successful musical career in Pakistan. She is still regarded as ‘Sohni Dharti Girl’ of 1970s as her version of patriotic song ‘ Sohni Dharti Allah Rakhe ‘ composed by highly talented music director Sohail Rana. During the grave political crisis and eventually civil war of 1971 in Pakistan which resulted in brutal destruction of life and property in East Bengal the then celebrated Bengali public figures based not only in Karachi like Runa Laila but also in Lahore like Shabnam and Robin Ghosh took a very indifferent stand on the savage stream of incidents which ravaged East Bengal but paved the political way for independent Bangladesh at the end through the disintegration of Pakistan. The creation of Bangladesh in early 1970s did not stop the migration of poor and unskilled people to come to Karachi in search of livelihood. It is estimated that about 30 lakhs of Bengalees live in Karachi and nearly all of them are poor and unskilled. These Muslim Bengalees have founded 132 colonies of their own for living .  Most of them have little access to education and job oriented skill development. They live in inhuman conditions with no availability of basic amenities of life like drinking water, sewerage system, etc. These basic amenities of life are a distant dream to them. The Karachi based Bengalees are patriotic Pakistanis and and stand for the ideals  and objectives of Pakistani state. They regard themselves as Muslims first and do not want to go back to Bangladesh which was created by dividing their beloved Pakistan which they call in Urdu ‘ Pyarey Pakistan’. But they have a connection with Bangladesh. Sometimes many of them visit to their ancestral village in Bangladesh in order to spend some days or weeks with their relations. They use Bangladeshi products like pan, jarda, lungi, saree, etc. which are essential objects of Bengali way of life. These Bengalees of Karachi also opened small shops in their colonies like Chittagong Colony, Machhar Colony to sell traditional Bangladeshi products and eateries across different parts of Karachi to offer popular Bangladeshi snacks like samosa, jilipi, peyaju, moya, etc. and cooked food items like bhat, different kinds of bharta, bhaji and fish. Due to nearly total migration …

BENGALEES OF KARACHI Read More »

নানামুখী প্রতিবন্ধকতায় বাংলাদেশের প্রিন্ট মিডিয়া

Dr. Kakoli Sarkar    যে কোনো রাষ্ট্রের জনমত গঠনের ক্ষেত্রে গণমাধ্যম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে বর্তমানে যে মৌলবাদী বাড়বাড়ন্ত তার পিছনে সে দেশের গণমাধ্যমের অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের মধ্যে কেবলমাত্র প্রিন্ট মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে আমি অতি সংক্ষেপে দু চার কথা বলতে চাই। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর তখন বাংলাদেশে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ছিল দশটি, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দৈনিক আজাদ, ইত্তেফাক, পূর্বদেশ, দৈনিক অবজারভার, দৈনিক বাংলা। তবে বাংলাদেশে প্রথম দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় বিজয়ের দুদিন পরে, অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর। সেই দিন বাংলাদেশের সকল পত্রিকায় ফুটে উঠেছে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বিজয়ের আনন্দ আর শহীদ পরিবারগুলোর অশ্রুবেদনাগাঁথা। সেই সময় বাঙালি জাতীয়তাবাদী ঝড়ের কাছে ইসলামপন্থী পত্রিকাগুলির আত্মগোপন করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। তবে জামায়াতে ইসলামী দলের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম তখনও প্রকাশিত হতো। জামায়াতে ইসলামী দলের মুখপত্র এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হতে শুরু করে ১৭ই জানুয়ারি ১৯৭০ থেকে। ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই পত্রিকাটি বিভিন্নভাবে স্বাধীনতাকামী মানুষের বিপক্ষে, রাজাকার ও পাকিস্তানিদের পক্ষে, মিথ্যা, বানোয়াট ও বিভ্রান্তিমূলক খবর ছেপে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিল। তবে এই পত্রিকার পাঠক সংখ্যা ছিল হাতে গোনা অর্থাৎ খুবই অল্প। কেবলমাত্র জামাত–শিবিরের কর্মীদের মধ্যেই এই পত্রিকাটি সীমাবদ্ধ ছিল। বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইন জারির মাধ্যমে সংবাদপত্রের নিয়ন্ত্রণে সরকারকে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়। ১৯৯০ এর পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে পত্রপত্রিকাগুলির বিশেষ কোন স্বাধীনতা লক্ষ্য করা যায় না, সরকার দ্বারা তাদের গন্ডি সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৬ই জুন বাংলাদেশ সরকার দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, দ্য বাংলাদেশ অবজারভার ও দ্য বাংলাদেশ টাইমস্ এই চারটি পত্রিকা ছাড়া বাকি সব পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। তবে ওই বন্ধ পত্রিকাগুলির কর্মীরা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন পেতেন। ১৯৭৬ সাল থেকে পুরানো পত্রিকাগুলি আবার ধীরে ধীরে প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত বাংলাদেশে সংবাদপত্র স্বৈরশাসকের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সরকারের সমালোচনামূলক খবর ছাপানোর অভিযোগে যখন তখন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হতো। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ সরকারের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিশেষ ক্ষমতা আইনের মাধ্যমে ১৬-১৭ এবং ১৮ নং ধারা অবলুপ্ত করলে সেন্সরশিপ ও প্রকাশনা নিষিদ্ধ সংক্রান্ত আইনের বিলুপ্তি ঘটে। ১৯৯০ এর পর থেকে পত্রপত্রিকার প্রকাশনার সংখ্যাটা বিশেষভাবে বেড়ে যায়। ফলে ১৯৭৫ সালের পর থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত বাংলাদেশে পত্রিকার জগতে যে ইসলামী মৌলবাদের প্রবেশ তা সরকারের প্রত্যক্ষ মদতেই ঘটেছিল। বাংলাদেশের সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং হোসেন মোহাম্মদ  এরশাদ উভয়ই ইসলামী মৌলবাদের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এই সময় কালের (১৯৭৫–৯০) মধ্যে বাংলাদেশে ইসলামী মৌলবাদ প্রচারে যে পত্রিকাটি সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সেটি হল ইনকিলাব। ইনকিলাব যেন বাংলাদেশের বুকে এক গভীর চক্রান্ত। আমরা জানি জামাতে ইসলামী দলের মুখপত্র হিসাবে দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকাটি ছিল এবং যেটি অবশ্যই ইসলামী মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষক ও পাকিস্তানপন্থী। কিন্তু ইনকিলাব এর সাথে দৈনিক সংগ্রামের পার্থক্য হল, দৈনিক সংগ্রামের পাঠক ছিল কেবলমাত্র জামাত শিবিরের সদস্যরা, কিন্তু ইনকিলাব একটি ব্যাপক অংশের পাঠক হাতে নিয়েই যাত্রা শুরু করে। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের একটি অংশকে পুঁজি করেই এই পত্রিকাটি শুরু হয়। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সংগঠনের নাম ‘জমিয়াতুল মোদারেসিন’ । এই জমিয়াতুলের অনুরোধেই দৈনিক ইনকিলাবের প্রকাশ বলে জানা যায়। ১৯৮৬ সালে মাওলানা আব্দুল মান্নানের উদ্যোগে এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। মাওলানা আব্দুল মান্নান আবার জমিয়াতুলের প্রধানও ছিলেন। মাওলানা আব্দুল মান্নানের পরিচয় হলো তিনি একজন রাজাকার, স্বাধীনতা বিরোধী। ১৯৭১ সালে এই আব্দুল মান্নান ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করে ডক্টর আলিম চৌধুরীর হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাকে ‘নর পিশাচ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবাদের অপরাধী হিসেবে সে কিছুদিন জেল খাটে। তারপর জেনারেল এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতায় জেল থেকে বেরিয়ে এসে সে  এরশাদের মন্ত্রিসভায় প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে। এখানে আব্দুল মান্নান ইনকিলাব পত্রিকা প্রকাশের পূর্বেই প্রতিটি কামিল মাদ্রাসাকে ১২ কপি করে পত্রিকার গ্রাহক হবার নির্দেশ দেয়। ফলে পত্রিকা প্রচারের আগেই এর প্রচার সংখ্যা দাঁড়ায়  ১ লক্ষ ২৮ হাজার আর তার আয় দাঁড়ায় ৭ কোটি ৬৮ লক্ষ। বিভিন্নভাবে মৌলবাদের বিষ মাদ্রাসাগুলিতে ছড়ানো এবং এরশাদ সরকারের গুণ কীর্তন করা– এটাই ছিল তার পত্রিকার উদ্দেশ্য। বিভিন্ন রকম গুজব ছড়ানোতে এই পত্রিকার জুড়ি মেলা ভার। তসলিমা নাসরিন থেকে শুরু করে বাবরী মসজিদ ধ্বংস, কোনো কিছুতেই এই পত্রিকা গুজব ছড়াতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেনি। ‘রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম’ প্রচারের পক্ষে এই পত্রিকাটি এরশাদের পাশে  থেকে সহযোগী হিসেবে ব্যাপকভাবে প্রচারকার্য চালিয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, ইনকিলাবের টাকার কাছে বহু বিশিষ্টজন বিক্রি হয়ে গেলেন, তাই তারা মুখ বন্ধ করে থাকলেন। বর্তমানে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে নষ্ট রাজনীতিকদের মিডিয়া মালিক হওয়া রোধ করা যাবে না। তাই বর্তমানে  বাংলাদেশ সরকার ইচ্ছা করলেও আর মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। বাংলাদেশের অর্থনীতির অনেকখানি  অংশ জুড়ে বসে আছে তৎকালীন রাজাকার, আলবদর বা পাকিস্তানপন্থী গোষ্ঠী, যারা ইসলামী মৌলবাদের প্রচারক। তাদের শিকড় এখন অনেক গভীরে, বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। বর্তমান সময়ে গণমাধ্যম পরিচালনাও একটি ব্যবসা। এই ব্যবসাটির অনেকখানি অংশ দখল করে আছে পাকিস্তানপন্থী ইসলামী মৌলবাদী গোষ্ঠী। এই সবকিছুর মধ্যেই কিছু পত্রিকা আছে যারা সাংবাদিকতার নৈতিকতাকে মনে রেখে চলতে চেষ্টা করেন। এখনো বাংলাদেশে কিছু প্রণম্য সাংবাদিক আছেন যাঁরা বোঝেন গণমাধ্যম পরিচালনার ব্যবসা অন্য ব্যবসা থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। তাই এখনো সংবাদপত্রেই দাবি ওঠে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসবে ছুটি প্রদানের। কেননা বাংলাদেশে সংবাদিকদের এগারো দিন ছুটি ঘোষিত আছে, এর মধ্যে নয় দিনই ইসলাম ধর্মকেন্দ্রিক ছুটি, একদিন পয়লা বৈশাখের ছুটি, আর একদিন মে দিবসের ছুটি। এর বাইরে জাতীয় তিন দিবসে তিনটি সরকারি ছুটি, তবে ওই ৩ দিন বিশেষ ব্যবস্থায় পত্রিকা বের হয়। অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসবে কোনরকম ছুটি নেই। যাই হোক, অর্থনীতিকে বাদ দিয়ে কোন কিছুই হতে পারে না। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনীতির যারা নিয়ন্ত্রক শক্তি হবে তারা গণমাধ্যমকেও নিয়ন্ত্রণ করবে। এখন সেটাই দেখার অপেক্ষা।

বাঙালি জাতিসত্তা বা জাতীয়তাবাদ কেন এত জরুরী

বিমল প্রামাণিক ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে যে বিষয়টি বারবার মনে বাজে তা হল জাতিসত্তা বা জাতীয়তাবাদ।  জাতীয়তাবাদের শক্তি এমনই যে পৃথিবীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী অনেক বৃহৎ শক্তির সঙ্গে অসম লড়াই সত্বেও শেষ পর্যন্ত  জয়ী হয়েছে।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এর যেমন নজির রয়েছে, সাম্প্রতিক অতীতে ভিয়েতনাম যুদ্ধ বা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তো এখনও আমাদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। ধর্মকে জাতিসত্তার বিকল্প হিসাবে  দাঁড় করানোর চেষ্টা বার বার ব্যর্থ হয়েছে। ধর্মযুদ্ধ আজকের পৃথিবীতে শুধু রক্তক্ষয় আর ধ্বংসের ইতিহাস। বর্বরতার ইতিহাস বললে কম বলা হয়। তা বলে কি ধর্মীয় রাষ্ট্রের ধারণা বা রাষ্ট্র পৃথিবী থেকে লোপ পেয়ে গেছে – তা তো নয় । কিন্তু তারা দূর্বল থেকে দূর্বলতর হচ্ছে।  একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের নামে সামরিকতন্ত্র তাদের সঞ্চিত ক্ষমতা-অর্থ-সম্পদের কারণে আরও কিছু বছর টিকে থাকবে বটে, কিন্তু শেষ কথা বলার ক্ষমতা নিয়ে তারা কম্পমান। জাতিরাষ্ট্র বা বহুজাতি রাষ্ট্রে গণতন্ত্র জনগণের সামনে আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। বহুজাতি রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের অভাব দেখা দিলে যেমন বিচ্ছিন্নতাবাদী  প্রবণতা তৈরি হতে পারে, উগ্রজাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিতে পারে এমনকি দেশ খণ্ডিতও হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ তার একটি উদাহরণ। অন্যদিকে, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দেউলিয়াপনার প্রেক্ষিতে ইসলামি সন্ত্রাসবাদ রফতানির ব্যবসা চালু রাখা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে।  ভারতীয় উপমহাদেশে উগ্র ইসলামি মৌলবাদ বা ইসলামি সন্ত্রাসবাদের প্রবণতা নতুন করে মাথাচাড়া দেওয়ার সম্ভাবনাও মোটেই উজ্জ্বল নয়। বিশেষকরে ভারত-পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে বাম মৌলবাদী চেতনার যে ব্যাপক ধ্বস নেমেছে ফলে বাম সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের কোন ভবিষ্যৎ নাই বলেই প্রতিপন্ন হচ্ছে। ফলে বাঙালি জাতিয়তাবাদী গণতান্ত্রিক শক্তির পায়ের নীচের মাটি ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। এটা আশার কথা বৈকি! মুজিব হত্যার পর পরই বাঙালি জাতিয়তাবাদের উচ্ছ্বাস হ্রাস পেতে শুরু করে। তারপর প্রায় চার দশক বাঙালি জাতিয়তাবাদ সমাজে তেমন সমাদৃত হতে দেখা যায়নি। পাকিস্তানে দ্বিজাতিতত্ত্বের  জৌলুস ফিকে হয়ে  যাওয়া, আর্থিক দুরবস্থা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক ইসলামি দেশের পাকিস্তান থেকে দূরে সরে যাওয়া ও তাদের ভারতের  প্রতি পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি বাঙালি মুসলমান মনে  জাতিসত্তা নিয়ে নতুন ভাবনার উদ্রেক দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশি মুসলমানের সামনে বিশ্ব-দুয়ার  খুলে যাওয়ায় বিরাট সংখ্যক মানুষ প্রায়শই দেশের বাইরে কাজকর্মসহ নানা কারণে ভ্রমণকালে স্ব-পরিচিতির ক্ষেত্রে  ‘বাংলাদেশি বাঙ্গালি’ সামনে চলে আসে। ধর্মীয় পরিচয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গৌণ হয়ে যায়। বাঙালি জাতীয়তা বড় হয়ে ওঠে।  বাঙালি জাতি যেভাবে ইতিহাস বা সংস্কৃতি চর্চা অতীতকাল থেকে করে চলেছে তা কখনও ধর্মের নিগড়ে বাঁধা পড়েনি। আজকে যারা বাঙালীকে মুসলমান পরিচয় দিয়ে বাঁধতে চায় তারা শুধু অজ্ঞই নয়, অজ্ঞাত কুলশীল।  এখানেই বাঙালি জাতিসত্তার বিজয় এবং ভবিষ্যৎ। যা কোন নিছক  রাজনৈতিক শাসক বা ধর্মান্ধ  জনগোষ্ঠীর উপর নির্ভরশীল নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সেটা প্রমাণ করেছে। আজ বাংলাদেশে দ্বিজাতিতত্ত্বের কদর কোথায়? বালুচ, সিন্ধ্রিসহ প্রভৃতি আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। গেরিলা সশস্ত্র লড়াইয়ের ময়দানে ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানের মূল ভিতে আঘাত হেনে চলেছে। যা ১৯৭১ সালে বাঙালিরা মোকাবিলা করেছিল। কিন্তু একথা ভুললে চলবে না যে, চল্লিশের দশকে দ্বিজাতিতত্ত্ব এবং পাকিস্তান দাবির মোড়কে কট্টর ভারত তথা হিন্দু- বিরোধিতা সাধারণ মুসলমান  জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করতে যেমন কার্যকার হয়েছিল, সেই অবস্থার সম্পূর্ণ অবসান হয় নাই। ইসলাম ধর্ম মুসলমান জনগোষ্ঠীকে দেশে দেশে তাদের স্ব স্ব জাতিসত্তাকে  যেভাবে অধিকতর তরলীকৃত করে কট্টর ইসলামি নিগড়ে সমন্বয় করতে চায় – সে চেষ্টায় এখনও ভাটা পড়ে নাই। জাতিসত্তা বা জাতি পরিচয়কে ইসলামে ভাল চোখে দেখা হয়না বলেই ১৯৭১ সালে বাঙালিদের উপর গণহত্যা চালাতে না ধর্মে, না মানবতায় পাকিস্তানি ও বাঙালি কট্টর মুসলমানদের বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।  আজকের পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়লেও ধর্মীয় কট্টরতার বাইরে এখনও বেরিয়ে আসতে পারেনি। প্রধান কারণ ইসলামের নামে শোষণ, শাসন, নির্যাতন পাকিস্তানের ইতিহাসের অঙ্গ । একটা বিষয় পরিষ্কার করে বলা দরকার বলে মনে করি । বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোন  স্বাধীনতা সংগ্রাম করেনি । ১৯৭১-এ ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙ্গালীদের মুক্তি আন্দোলন, যা সাধারণত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নামে খ্যাত । যে কোন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পিছনে থাকে দীর্ঘ ইতিহাস যার মধ্য দিয়ে একটা আদর্শবাদিতা এবং ঐকমত্য গড়ে ওঠে। সেটা বিদেশী শাসকের ক্ষেত্রে যেমন হয়, স্বদেশী রাজতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্রের ক্ষেত্রেও ভিন্নতর কিছু হয় না।  কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে কোন ভূখণ্ডকে মুক্ত করাই হয় প্রধান লক্ষ্য।  সেখানে আদর্শগত বা ঐকমত্য সবসময় প্রধান বিচার্য বিষয় নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রেও এটা সত্য । এক্ষেত্রে বাস্তবতা ছিল, একটি বড় সংখ্যক জনসংখ্যা আদর্শগতভাবে ধর্মীয় ঐক্য রক্ষায় পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। অন্যদিকে, ধর্মীয় ভিন্নতা না থাকা সত্বেও একটি বড় সংখ্যক মানুষ মতাদর্শগতভাবে পাকিস্তানি শাসনমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। যার মূলে কাজ করেছিল বাঙালি জাতিসত্তার ভিত্তি।  আজকের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা পাকিস্তান থেকে ভিন্নতর। এখানে গত চৌদ্দ বছর কমবেশি একটি স্থিতিশীল সরকার থাকায় অর্থনৈতিক ভিত যেমন শক্তিশালী  হয়েছে, সামাজিক অস্থিরতাও হাতের নাগালের বাইরে চলে যায়নি। সমাজে ইসলামি মৌলবাদ শক্তি সঞ্চয় করলেও সরকারি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে, যেটা পাকিস্তানের সাথে তুলনা করা চলে না। বাংলাভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি যেহেতু এখনও ধর্মের নিগড়ে বাধা পড়ে যায় নাই, দেশ বিভাগোওর কালে পাকিস্তানি শাসনে বাঙালি জাতিসত্তাকেও তরলীকৃত   করে পাকিস্তানিকরণও  সম্ভব হয়নি। এটা আমরা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণের প্রেক্ষিতে বাংলাভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন ও পূর্ববঙ্গে ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার মধ্যে দেখতে পাই। যখন বাঙালি জাত্যাভিমানের উপর বড় আঘাত এলো, জাতিসত্তাই সংকটের মুখে পড়ে গেল তখন বাঙ্গালির সুপ্ত জাতীয়তাবাদ ফেটে পড়তে দেখা গেল,  ধর্ম গৌণ হয়ে গেল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ  ইতিহাসে এর একটা বড় উদাহরণ । বাঙালি জাতীয়তাবাদের পূর্ণ বিজয় আজ ইতিহাসের দাবি।  “আত্মঘাতী বাঙ্গালির” অপবাদ তো  বাঙালি মুসলমানদেরই মোচন করতে হবে।

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সমস্যা হেলাফেলার বিষয় নয়

পূর্ণিমা নস্কর ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র  গঠিত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং মুসলিম অনুপ্রবেশকারীগণ  বাংলাদেশ ত্যাগ করে পূর্ব ভারত এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নিরন্তরভাবে আশ্রয় গ্রহণ করেই চলেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের উত্তর পূর্ব রাজ্য-সমূহে জনসংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির মধ্যে আসাম রাজ্যের  কথা বলা যায়। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্টের পূর্বে অসম প্রদেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে ছিল বর্তমান অসম রাজ্য, মেঘালয়, নাগাল্যাণ্ড, মিজোরাম, অরুণাচলপ্রদেশ ও  বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্ভূক্ত শ্রীহট্ট জেলা।  দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে শ্রীহট্ট জেলার করিমগঞ্জ মহকুমার বদরপুর, পাথরকান্দী, রাতাবাড়ি ও কমিলগঞ্জের পুলিশ স্টেশনের অংশ নিয়ে অসম রাজ্যের কাছাড় জেলার অন্তর্ভূক্ত একটি মহকুমা গঠন করা হয়।  ১৯৫১ খৃষ্টাব্দ  থেকে ১৯৬১ খৃষ্টাব্দের মধ্যে নাগাল্যাণ্ড ও অরুণাচলপ্রদেশ  অসম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, আর কামরূপ জেলার ৮৫ স্কয়ার কিলোমিটার অংশ ভুটানের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ১৯৬১ খৃষ্টাব্দ  থেকে ১৯৭১ খৃষ্টাব্দে মেঘালয়  গঠিত হওয়ায় অসম রাজ্যের সীমানা আরও সংকুচিত হয়। ১৯৮৭ সালে মিজোরাম ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে স্থাপিত হয় । ভারতের প্রতিবেশী রাজ্য বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক বিবর্তনের সুদূরপ্রসারী ফলাফলের প্রতিফলন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিতে পরিলক্ষিত হয় । আর এটি সম্ভব হওয়ার একমাত্র কারণ হল – বাংলাদেশ থেকে হিন্দু মুসলমান জনগণের ব্যাপক অনুপ্রবেশ। সীমান্তবর্তী জেলা হিসেবে যদি আমরা আসামের জনগণনার প্রতিবেদনের দিকে দৃষ্টিপাত করি তাহলে অনুপ্রবেশের  ফলস্বরূপ, সাংস্কৃতিক প্রভাবের বিষয়টিকে সহজেই উপলব্ধি করা যাবে। আসাম  রাজ্যের জনগণনার প্রতিবেদনটি নিম্নে সারণীর মাধ্যমে উপস্থাপন করা হল ।       সারণীঃ জেলা বা রাজ্য ধর্মীয় সম্প্রদায় ভিত্তিক  জনসংখ্যা  ১৯৭১ মোট জনসংখ্যা ১৯৮১ মোট জনসংখ্যা ১৯৯১ মোট জনসংখ্যা ২০০১ মোট জনসংখ্যা ২০১১ মোট জনসংখ্যা ১ ২ ৩ ৪ ৫ ৬ ৭  আসাম সকল ধর্মীয় সম্প্রদায় ১৪,৬২৫ জনগণনা হয়নি  ২২,৪১৪ ২৬৬৫৫৫২৮ ৩১২০৫৫৭৬ হিন্দু ১০,৬৫২ (৭২.৮৩%) জনগণনা হয়নি ১৫,২৯৭ (৬৮.২৫%) ১৭২৯৬৪৫৫ (৬৪.`৮৯%%) ১৯১৮০৭৫৯ (৬১.`৪৭%) মুসলিম  ৩,৫৯২ (২৪.`৫৬%) জনগণনা হয়নি ৬,৩৭৩ (২৮.`৪৩%) ৮২৪০৬১১ (৩০.৯২%) ১০৬৭৯৩৪৫ (৩৪.`২২%) খ্রিষ্টান ৩৮১.০ (২.৬১%) জনগণনা হয়নি ৭৪৪.৪   (৩.৩২%) ৯৮৬৫৮৯   (৩.৭০%) ১১৬৫৮৬৭  (৩.৭৪%)   উপরের সারণী বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের পর আসামে হিন্দু জনসংখ্যার পরিমাণ হ্রাস পেতে থাকে। ২০১১ সালে এই জনসংখ্যার পরিমাণ এসে দাঁড়ায় ৬১.৪৭ শতাংশ। আবার অন্যদিকে আসামে ১৯৭১ সালে মুসলিম জনসংখ্যার পরিমাণ ২৪.৫৬ শতাংশ থেকে ২০১১ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৩৪.২২ শতাংশে । হিন্দু- মুসলিম সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ব্যতীত আসামে অন্যান্য সম্প্রদায় হিসেবে খ্রিস্টান জনসংখ্যার পরিমাণ ও ১৯৭১ সালের তুলনায় ২০১১ সালে বৃদ্ধি পেয়েছে।  আর এটি সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশের কারণে। আসাম প্রদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হলেন অসমীয়া সম্প্রদায়। অসমীয়াদের সমাজ,  সংস্কৃতিও ভিন্নতর। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে হিন্দু-মুসলিম অনুপ্রবেশকারীরা আসামে এসে বসবাস করছে। ফলে জন্মসূত্রে আয়ত্তীকৃত তাদের নিজস্ব  সংস্কৃতির প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত হওয়া তাদের পক্ষে  সম্ভব না হওয়ার কারণে অসমীয়া সমাজে সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক আত্তীকরণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে । কিন্তু অসমীয়াদের মূল সংস্কৃতির সাথে অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশীদের সংস্কৃতির একটা পার্থক্য  রয়েই যায়। তাই  বর্তমানে আসামে সরকারিভাবে  NRC ও  CA  প্রবর্তনের ফলে আসামের সমাজের ভিন্নতর দিক পাওয়া যায়। যদিও এটা সম্পূর্ণ ভিন্নতর বিষয়। তথাপি একথা বলা যায় যে, আসাম প্রদেশেও ব্যাপক বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ ঘটেছিল – কোন সন্দেহ নেই। এই অঞ্চলের বিভিন্ন ধর্মের মানুষ যেমন নিজ নিজ স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রেখে পারস্পরিক প্রীতি সহযোগিতার ভাব নিয়ে বসবাস করতে পারে, তার জন্য উভয় সম্প্রদায়ের  মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি না পেলে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি যে অদূর ভবিষ্যতে জটিল থেকে জটিলতর হতে পারে, সে বিষয়ের সম্ভাবনাকে অবহেলা করা যায় না।   অন্যদিকে, একটি পরিকল্পিত উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশে মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত জেলাগুলিতে বসতি স্থাপন করা চলতে থাকে। আমরা এ বিষয়ে সীমান্ত জেলাগুলির মুসলিম  জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বিশেষভাবে বামফ্রন্ট আমল থেকে  (১৯৭৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত) খতিয়ে দেখতে পারি। এই চার দশকে সীমান্ত জেলাগুলির মুসলিম  জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বা স্বাভাবিক বৃদ্ধির সঙ্গে তুলনা করা চলে না। আবার আমরা  যদি বাংলাদেশে এই চার দশকের মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি প্রকৃতি বিশ্লেষণ   করি তাহলে দেখতে পাই ধীরে ধীরে বাংলাদেশের মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার স্তিমিত হয়ে এসেছে।  অন্যদিকে সীমান্ত  জেলাগুলির মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হিন্দু জনসংখ্যার থেকে অনেকটাই বেশি।  এমনকি দ্বিগুণেরও অধিক।  ভারতের হিন্দু জনসংখ্যার ক্রমহ্রাসমান বৃদ্ধির যে চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু জনসংখ্যার যে চিত্র আমাদের সামনে রয়েছে তার প্রেক্ষিতে মুসলিম জনসংখ্যার অত্যধিক বৃদ্ধির বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়, যদি না বাইরে থেকে মুসলিম জনসংখ্যা উক্ত অঞ্চলগুলিতে বসতি স্থাপন করে ।  ভারতের অন্য অঞ্চলের  মুসলিম জনসংখ্যার বসতি স্থাপনের সম্ভাবনা এই অঞ্চলে নেই তার প্রধান কারণ হল – এখানে কর্মসংস্থান ও শিল্পের প্রসার তেমন না ঘটায় ভারতের অন্য  অঞ্চলের জনসংখ্যার আকর্ষিত হওয়ার কোন কারণ নেই। তাহলে একথা অবিশ্বাস করার কোন কারণ আমরা পাই না যে, সীমান্ত অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী মুসলমানদের অনুপ্রবেশ ঘটেনি। যেহেতু ধর্মীয় জনবিন্যাসে একটি বিপুল পরিবর্তন চার দশকের জনগণনার মধ্য থেকে দেখতে পাওয়া যায়। ইতিমধ্যেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, সীমান্ত অঞ্চলে গত চার দশকে নানা ধরণের অপরাধের মাত্রা বৃ্দ্ধি  পেয়েছে, গরু পাচার, চোরাচালান, অবৈধ সীমান্ত পারাপার এবং ব্যাপক অনুপ্রবেশ।  এর ফলে ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও এই অপরাধের আঁচ লেগেছে। অন্য একটি গুরুত্বপূ্র্ণ বিষয়, অনুপ্রবেশজনিত জেলাগুলিতে মাদ্রাসা সংখ্যা এবং শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়া, এর ফলে স্থানীয় সংস্কৃতির পাশাপাশি মৌলবাদী ইসলামি সংস্কৃতি ক্রমে জোরালো হয়ে উঠছে। এবিষয়টি নিয়ে অসমের মুখ্যমন্ত্রী শুধু সোচ্চারই হননি নানা ইতিবাচক ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই গ্রহণ করা হয়েছে।  কিন্তু মুসলিম তোষণ ও ভোটের রাজনীতির ফাঁদে পরে পশ্চিমবঙ্গ যেভাবে  শিক্ষা-সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে পিছিয়ে পরেছে – এ রাজ্যের জনজীবনে তার প্রভাব ইতিমধ্যেই পরিলক্ষিত হতে শুরু করেছে। প্রত্যেকটি সীমান্তবর্তী রাজ্য ও তার সমস্যা নিয়ে এখনই সোচ্চার না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি আমাদের ক্ষমা করবে ?

দ্রুতগতির দুনিয়ায় বাংলাদেশ মেট্রোরেলের বিভিন্ন দিক ও বাস্তবতা

সুদীপ কুমার আচার্য্য বর্তমান বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামি লিগ সরকার জন উন্নয়নের স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মেট্রোরেল প্রকল্পের একটি অংশের সম্প্রতি কাজ সমাপ্ত করলেন এবং জনগণের জন্য MRT 6  নামক লাইনটিকে (উত্তরা – আগারগাঁও) উদ্বোধন করা হল গত ২৮ শে ডিসেম্বর ২০২২। বর্তমানে এটিকে সর্বসাধারণের জন্যে খুলে দেওয়া হয়েছে। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন ভাড়া যথাক্রমে ৬০ ও ২০ টাকা।  স্বাধীনতা দিবসে অর্থাৎ  ২০২৩ এর ২৬শে মার্চ উত্তরা – আগারগাঁও রুটে পূর্ণাঙ্গভাবে মেট্রোরেল পরিষেবা শুরু হয়ে যাবে। রাজধানী ঢাকার রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম ও ভিড়ভাট্টার ভয়ঙ্কর অবস্থা চলে আসছে বছরের পর বছর। ঢাকা মহানগরীতে প্রায় ২ কোটি মানুষ বাস করেন। মুঘল আমলে ঢাকার নাম ছিল জাহাঙ্গীরনগর, সপ্তদশ শতক থেকেই ঢাকা একটি বাণিজ্য কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়। পরবর্তীতে ব্রিটিশ যুগ থেকেই ঢাকা ছিল এক বর্ধিষ্ণু নগরী।  কালের পট পরিবর্তনে তার উপর চাপ আরও বেড়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু যানজটের বিভীষিকায় নাকাল হন সাধারণ মানুষ থেকে, অফিসযাত্রী, মুমূর্ষু রোগী থেকে পর্যটনে আসা বিদেশী নাগরিক। সুতরাং এই মেগা প্রকল্পটি নেওয়ার অন্যতম লক্ষ্য ঢাকাকে পরিচ্ছন্নভাবে, সুষ্ঠুভাবে এবং সুন্দর করে তোলা। যানজট থেকে মুক্তি  এবং মানুষের দুদর্শা লাঘব করা। এই প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছিল ২০১৩ সালে। ২০১৬ সালের ২৬শে জুন প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। MRT 6 লাইনটির স্টেশন নির্মাণ সংখ্যা সংশোধিত হয়ে ১৭টি (কমলাপুর পর্যন্ত) হয়। মেট্রো ৬ এর আংশিক উদ্বোধন উপলক্ষে দিয়াবাড়ীতে যে সমাবেশের আয়োজন করা  হয়েছিল তা নিয়ে উৎসাহের অন্ত নেই। এই উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়েছে  (পঞ্চাশ টাকার স্মারক নোট)। উন্নয়নের মুকুটে অবশ্যই এটি একটি নতুন পালক সংযোজন। ২০৩০ সালের মধ্যে মেট্রোরেল নেটওয়ার্ক  পুরোপুরি সম্পন্ন হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। মতিঝিল পর্যন্ত MRT 6 লাইনের কাজ আংশিকভাবে সমাপ্ত হয়েছে (৮৬%)। বাংলাদেশের প্রযুক্তিবিদরা MRT 6  লাইনে চার পাঁচবার পরিবর্তন করেছেন।  মেট্রো প্রকল্পে আসল ঋণ ১৬,৫৯৫ কোটি টাকা, ২.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা মেট্রোরেল প্রকল্পে সর্বমোট বাজেট। মেট্রোরেল প্রকল্পে যে পরিমাণ শক্তি বা বিদ্যুৎ ব্যয় হবে তা প্রতি ঘণ্টায় ১৩.৪৭  মেগাওয়াট। এর জন্য ৫টি Power supply station  তৈরী করা হয়েছে। অর্থাৎ কোন একটি লাইনে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলে মেট্রো পরিষেবা ব্যাহত হবে না। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে হোটেল সোনারগাঁও থেকে বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক পর্যন্ত দূরত্ব ৪.৪০ কিলোমিটার, তৃ্তীয়  ক্ষেত্রে পল্লবী থেকে উত্তরা লাইনটির দূরত্ব হবে ৪.৭ কিলোমিটার। পুরোটাই মাটির ওপর  ওভারব্রিজের ওপর দিয়ে যাবে। মাটি থেকে উচ্চতা রাখা হয়েছে ১৩ মিটার  যাতে নীচ দিয়ে গাড়ি, ঘোড়া, সাধারণ মানুষও সমানতালে চলতে পারে। উত্তরা থেকে সোনারগাঁও ২১.২৬ কিলোমিটার প্রায় ৩৮ মিনিটে যাওয়া যাবে। পূর্বে আধঘণ্টার পথ যেতে এক ঘণ্টার অধিক সময় লাগত, ক্ষতি হত অর্থনীতির, নষ্ট হত মূল্যবান সময়। মনে করা হচ্ছে যে এবার তা থেকে মুক্তি মিলবে ।  এই প্রকল্পে মোট খরচ ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৫৯ লক্ষ টাকা। যার মধ্যে জাইকা নামক জাপানি উন্নয়ন সংস্থা ব্যয় করেছে ৭৫ শতাংশ (১৭ হাজার কোটি) বাকী টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। এর ফলে ব্যবসা বাণিজ্যে গতি আসতে চলেছে। সময় সংক্ষেপের ফলে উপকৃত হবে অনেক মানুষ। উত্তরা থেকে মতিঝিল সাত জোড়া ট্রেন চলবে। প্রত্যেক ট্রেনে অন্তত ২৩০০ যাত্রী চলাচল করতে পারবে। গতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার। টিকিট একমুখী কাটা যাবে। ডেইলি প্যাসেঞ্জাররা স্মার্ট কার্ড ও পরে রিচার্জের মাধ্যমে  কাজ চালাতে পারবে।  মেট্রোর এই প্রকল্প নিয়ে  ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ও জাপান সরকারের  পক্ষ থেকে সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষর সম্পাদিত হয়েছে। DMRTC নামক সরকারি প্রতিষ্ঠান এই প্রকল্পটির তদারকি  শুরু করেছে। পূর্বেই মিরপুর স্টেশন থেকে ২০২১ এর ২৯ নভেম্বর এবং আগারগাঁও থেকে ২০২১ এর ১লা ডিসেম্বর পরীক্ষামূলকভাবে যাত্রা শুরু করেছিল।  এর যাত্রী পরিবহণ ক্ষমতা হবে প্রত্যেক দিন প্রায় ১ লক্ষ। তবে বাস্তবে কতটা কার্যকারী হবে তা পূর্ণভাবে ট্রেন চলাচল শুরু নাহলে বলা যাবে না। মেট্রোরেলে ৬টি বগি থাকছে। দিয়াবাড়ি (উত্তরা নর্থ)  থেকে আগারগাঁওয়ের ভাড়া ৬০ টাকা। জীবনযাত্রার মান এতে হবে উন্নত। গতিময়তার যুগে এর যে বিশেষ প্রয়োজন ছিল তা বলাই বাহুল্য।  মরিয়ম আফিজা মেট্রোরেলের প্রথম চালিকা ছিলেন এবং গত বুধবার ২৮শে ডিসেম্বর তার ট্রেনে প্রথম যাত্রীর নাম জননেত্রী শেখ হাসিনা। যাঁরা মেট্রোরেল চালাবেন তাঁদের ট্রেনিং সম্পন্ন হয়েছে। আফিজা ছাড়াও ছয়জন মহিলা চালক আছে।  জাপানের মিতসুবিশি-কাওয়াসাকি কোম্পানির এক্সপার্টরা কারিগরি প্রশিক্ষণ যেমন  দিয়েছেন তেমনই দেশীয় প্রযুক্তি ও অপারেটিং সিস্টেমের ট্রেনিংও কর্তৃপক্ষ চালকদের দিয়েছেন। কিছুদিন আগেই জাপান থেকে ব্যাংকক হয়ে একটি জাহাজ মেট্রোরেলের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, কোচ ইত্যাদি নিয়ে বাংলাদেশের মংলা বন্দরে আসে। এরপর এগুলিকে workshop এ নিয়ে এসে ফিটিংস করা  হয়। মেট্রো কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে প্রায় ৫২ জন প্রযুক্তিবিদ নিয়োগ করেছেন মেট্রোর ষোলটি বিভাগে। পাশাপাশি ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড প্রায় ৩৩০ জন অভিজ্ঞ কর্মচারী নিয়োগ করছেন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে।  ঢাকা মেট্রোর পরিকাঠামো অত্যাধুনিক। তিনতলা স্টেশন। রেলকোচের ভিতরে দিব্যাঙ্গ (Physically challenged), বয়স্ক নাগরিক (Senior Citizen) এবং অন্তঃসত্ত্বা মা  (Pregnant Mother) যাত্রীদের জন্য আসন সংরক্ষণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঘোষণা করেছেন যে মুক্তিযোদ্ধা ও তার পরিবারের সদস্যরা মেট্রোয় যাতায়াতে আংশিক ছাড় পাবেন। আপতকালীন ব্যবস্থাও করা হয়েছে। সকাল ৮টা  থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত আপাতত মেট্রো পরিবহণ শুরু হয়েছে। কিন্তু দিন ও রাতের পূর্ণাঙ্গ পরিষেবা পেতে আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে।  একটির নির্মাণ চলছে আরও পাঁচটির নির্মাণ হবে। পরিকল্পনা করা হয়েছে ১০৪টি স্টেশন বানানোর যেখানে ভুগর্ভস্থ ৫৩টি ও উড়ালপুল হয়ে যাবে ৫১টি। (মোট ১২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ বানানোর  পরিকল্পনা রয়েছে) অন্যান্য লাইনগুলি  হলঃ MRT 1   (বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর ) MRT 1   পূর্বাচল যাত্রাপথ ( নতুন বাজার থেকে তিলগঞ্জ, MRT2 গাবতলী চট্টগ্রাম রোড। MRT5          (উত্তর যাত্রাপথ)  (হেমায়েতপুর – ভাটরা), MRT5 (দক্ষিণ যাত্রাপথ) গাবতলি কল্যাণপুর শ্যামলী সোনারগাঁও হাতিরঝিল আফতাবনগর হয়ে দাশেরকান্দি)।  ২০৩০ সালের মধ্যে সমস্ত প্রকল্প সমাপ্ত করবার চেষ্টা চলছে। সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য এর ফলে নিশ্চিতভাবেই আসবে। নতুন এক আর্থিক দিশা পাবেন বাংলাদেশের মানুষ। কিন্তু পাতালরেল অর্থনীতির  সমীকরণে মূলত উপকার হবে উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত বা অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন এক শ্রেনীর বিত্তশালীর, সরকারী আয় বাড়বে, দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। কিন্তু প্রায় ৭০ শতাংশ নিম্নবিত্ত ও গ্রামীণ জনসাধারণের  জীবনযাত্রার বিশেষ রকমফের ঘটবে বলে মনে হয় না।   সমীক্ষা অনুসারে ঢাকায় যে ৩ লক্ষের অধিক রিকশাচালক আছেন তাদের রুটিরুজি পথ চলতি মানুষের যাতায়াতের ভাড়ার ওপর নির্ভর করে যা সামাজিকভাবে একটি শ্রেণিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। রিকশা অর্থনীতি মেট্রোর এই গতিময়তার যুগে খুব একটা প্রভাবিত হবে বলে মনে করা হচ্ছে না। যারা আংশিক দূরত্ব অতিক্রম করবেন তাদের জন্য  মেট্রোর উপযোগিতা কম। কারণ ঢাকা ছাড়াও আরও  নানান অফিস ও বাণিজ্যকেন্দ্র এবং গুরুত্বপূর্ণ  শহরগুলির ভিতরে এখনো মেট্রো পোঁছায়নি। সাধারণ মানুষের  ধরাছোঁয়ার মধ্যে টিকিটের দাম না আনতে পারলে সাধারণ মানুষও বিশেষ উপকৃত হবে না। সর্বশেষে বলি একবার জনৈক  সাংবাদিক চিনের চেয়ারম্যান মাও-সে-তুং কে  জিজ্ঞাসা করেছিলেন সমাজে ফরাসী বিপ্লবের কী উপযোগিতা বা প্রভাব দেখা যায়?  মাও বলেন  `It is too early to say’. একইভাবে সম্প্রতি মেট্রো প্রকল্পের যে অঙ্কুরোদগম হল এখনই তার সুদূরপ্রসারী …

দ্রুতগতির দুনিয়ায় বাংলাদেশ মেট্রোরেলের বিভিন্ন দিক ও বাস্তবতা Read More »

বাংলাদেশ-রাশিয়া সম্পর্কের বর্তমান সংকট ও তিক্ততাঃ গতিপথ কোনদিকে?

সুদীপ কুমার আচার্য্য রুশ-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্পর্ক দীর্ঘকালের।  বাংলাদেশের উত্থানের প্রেক্ষাপট বিচার করলে ভারত ব্যতীত অন্য যে দেশটি মুক্তিযুদ্ধের কালে (১৯৭১) বাংলাদেশের পাশে সামরিক সাহায্য  ও আর্থিক দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশী করে উপস্থিত ছিলো তারা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। অন্যদিকে আমেরিকার নিক্সন প্রশাসন পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে সপ্তম  নৌবহর পাঠিয়েছিল। ইয়াহিয়া খানের আরেক বন্ধু চীনও জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তি ভেস্তে দিতে সেই সময়ে ভারত-সোভিয়েত-বিরোধী একতরফা  কথাবার্তা বলে যাচ্ছিল।  অর্থাৎ cold war এর আবর্তে পড়ে ভারতীয় ও সোভিয়েত সংযুক্ত ক্ষমতা বা মোকাবিলা কৌশল না থাকলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সফলতা  পেত না। নতুন কোন রাষ্ট্র গড়ে উঠত কী না তাতেও সন্দেহ আছে!  কেননা সোভিয়েত ইউনিয়ন বা U.S.S.R. ছিল অন্যতম রাষ্ট্র  যা বাংলাদেশকে  স্বীকৃতি দিয়েছিল গড়ে ওঠার সময়েই।  আজ এত বছর পর  পিছনে তাকালে দেখা যায় সেই `Age of Extremes’ এর সময়কাল অতিক্রান্ত, U.S.S.R. ভেঙে পড়েছে এবং একমেরু, দ্বিমেরু থেকে বহুমেরু বিশ্বে বিশ্বক্ষমতার  ভরকেন্দ্রের স্থানান্তর ঘটে চলেছে। ১৯৭২ থেকে যে বাংলাদেশ-রুশ কূটনৈতিক সম্পর্কের সূচনা তা পেরিয়ে গেছে অর্ধ শতাব্দী  কিন্তু পরিণত কতটা হয়েছে তা ভেবে দেখতে হবে। কেননা গত কুড়ি বছরে চীন-ইরাণ-পাকিস্তান জোটের প্রতি বাংলাদেশ অনেক বেশী দায়বদ্ধতা দেখিয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে কিছুটা জোয়ার এসেছে তার দিকে আন্তর্জাতিক মহল বিশেষত আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলির নজর আছে। চীন, মার্কিন বদান্যতা বা প্রসাদ লাভের তাগিদ বিশ্বের অন্যান্য বিকাশশীল দেশ যেমন শ্রীলঙ্কার মতন বাংলাদেশেরও ছিল বা আছে। হয়ত সে কারণেই গত কয়েক বছরে এসব দেশ  বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বা কখনও  পররাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে মাথা গলাতে চাইছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের উচিত শক্তহাতে বিষয়গুলির প্রতিরোধ করা, যা না করে তারা ভীত সন্ত্রস্ত চিত্তে নয়া আর্থিক সাম্রাজ্যবাদের বাঁধা গতে বা স্নায়বিক যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির ন্যায় স্যাটেলাইট রাষ্ট্র বনে যেতে চাইছে।  যা স্বকীয়তা, স্বাধীনতা, সাম্য, সার্বভৌমত্ব ও পারস্পরিক বোঝাপড়া বা সৌভ্রাতৃ্ত্বের বিরোধী। একথা সত্য যে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক নানান লবি তাদের কসরৎ দেখিয়ে থাকে কিন্তু এসব  উপেক্ষা করে  কূটনৈতিক বোঝাপড়া বা নিকট বন্ধুদের সহযোগিতার মাধ্যমে তাকে ম্যানেজমেন্ট করাই পররাষ্ট্রনীতির  অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত। বর্তমান কঠিন সময়ে বাংলাদেশের প্রতিবেশী বিভিন্ন বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ট সহযোগিতা ও সম্পর্কের  মাধ্যমে  উন্নয়ন। কোনো দূরবর্তী  দেশের অঙ্গুলিহেলনে ওঠাবসা নয়। এরকমই এক বন্ধু রাষ্ট্র রাশিয়ার প্রতি সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের ভুলনীতি সম্পর্কে জটিলতা বাড়িয়েছে।  সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাই যার প্রমাণ। গত ২০২২ সালের ১৪ই নভেম্বর রাশিয়ার পিটসবার্গের বন্দর থেকে ছেড়ে  একটি মালবাহী জাহাজ  উরসা মেজর  বঙ্গোপসাগরে এসে উপস্থিত হয় এবং তারা বাংলাদেশের মংলা  বন্দরে ঢুকে মালপত্র খালাসের  জন্য আসছিলেন। কিন্তু আকস্মিকভাবে বাংলাদেশের নৌ-দপ্তর থেকে জাহাজটিকে বন্দরে ভিড়তে দেওয়া হয়নি এবং অগত্যা ভারতের হলদিয়া বন্দরের জেটিতে সেটি  মালপত্র খালাস করে। কারণ পেন্টাগনের হুমকি। ঢাকার বিদেশমন্ত্রককে  মার্কিন  দূতাবাস থেকে জাহাজটির বিরুদ্ধে কঠোর আপত্তি জানানো হয়েছিল। এই ম্যাসেজটি আসার পরই বাংলাদেশ নৌ-দপ্তর উরসা মেজরকে তার জলসীমা ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বলে। আসলে কার্গো জাহাজটিতে বাংলাদেশের পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুরে যে পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্র গড়ে উঠেছে তারই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছিল। এনিয়ে ২২শে ডিসেম্বর ২০২২ রাশিয়ার দূত বাংলাদেশ পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে গিয়ে ম্যারিটাইম অ্যাফেয়ার্স সচিব  (Maritime Affairs Secretary)  রিয়ার অ্যাডমিরাল খুরশিদ আলমের সঙ্গে ৩০ মিনিট একান্ত বৈঠক করেন কিন্তু কোন  কাজ হয়নি।  অর্থাৎ বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করার আপত্তি অটুট থাকে। এখন প্রশ্ন হল আমেরিকার আপত্তির কারণ কী ?  এবং এসব কারণকে পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কেন গুরুত্ব দেবে তার রহস্য কি? ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ  শুরু হবার পর থেকেই জো বাইডেন প্রশাসনের  তোপের মুখে রাশিয়া, ইউ.এস.এ. প্রায় ৬৯টি রাশিয়ান জাহাজকে  ব্ল্যাক লিস্টেড করেছে বা কালো তালিকায় তুলেছে। বিশেষত  মিলিটারী কার্গো জাহাজ যাতে সামরিক অস্ত্র শস্ত্র বা গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিকৌশলজনিত  সরঞ্জাম  থাকতে পারে। এরকমই একটি জাহাজ  স্পার্টা-৩ (SPARTA- 3), আমেরিকা ও তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলির বন্দরে এসব জাহাজকে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। তাই বাংলাদেশকেও মার্কিন প্রশাসনের তরফে এ নিয়ে কড়া বার্তা দেওয়া হয় । বলা হচ্ছে স্পার্টা-৩ জাহাজটি নিজের রং পাল্টে নতুন চেহারা নিয়ে ২৪শে ডিসেম্বর  বাংলাদেশের মংলায় ঢোকার চেষ্টা করছিল।  বাংলাদেশের তরফে বিবৃতি দিয়ে বলা হয় উরসা মেজর নামধারী এই জাহাজটি বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ বা বন্দরে ঢুকতে পারবে না।  কারণ এরকম নামের বা এই রুটের কোন জাহাজকে কখনো বাংলাদেশ তাদের কোন কাজে লাগায়নি ।  কিন্তু আসলে রুশ-বাংলাদেশ যৌথ পারমাণবিক প্রকল্পের সরঞ্জামই  এটি বহন করছিল ।  এতে কোন কিছু বিপদজনক ছিল না তথাপি এটি বাংলাদেশ নৌ-দপ্তরের সবুজ সংকেত পায়নি। আশ্চর্যের বিষয় হল রূপপুর কেন্দ্রটির মেগাপ্রকল্পে অনেক রাশিয়ান ও ইউক্রেনিয়ান প্রযুক্তিবিদ একসাথে কাজ করছেন । রাশিয়া বাংলাদেশকে সস্তায় তেল ও জ্বালানি সরবরাহে সাহায্য করেছে; এছাড়া রাশিয়া বাংলাদেশে প্রাকৃতিক  গ্যাস, যন্ত্রপাতি, সার রপ্তানি করে।    মানবসম্পদ উন্নয়নে নানান সহযোগিতা ও সর্বোপরি পরমানু বিদ্যুৎকেন্দ্রটির তৈরীতে ১২.৬৫ বিলিয়ন অর্থসাহায্য করেছে । মস্কোস্থিত Russian State Nuclear Energy Corporation একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা সংস্থা যারা হিমবাহ, হিমশৈল বা মেরু অঞ্চলে সমুদ্রে রাস্তা বানানোর জন্য বরফ ভাঙ্গার কাজের জন্য পরমাণুচালিত জাহাজ বানায়।  নিউক্লিয় রিঅ্যাক্টর, নিউক্লিয় জ্বালানি, ইয়রেনিয়াম খনি খনন, পারমাণবিক গবেষণার উন্নতি, হাওয়া শক্তি, হাইড্রোজেন জ্বালানি তৈরী করে, পৃথিবীর নিউক্লিয়ার ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে এরা প্রধানতম। বাংলাদেশেও  এঁরাই কাজ করছেন (রোসাটম সংস্থা) । ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারীতে ২৪০০ মেগাওয়াট এই প্রকল্পটি  রাশিয়ার যৌথ উদ্যোগে তৈরী হওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হয় । এছাড়া আর্থিক ক্ষেত্রে নানান বাংলাদেশী পণ্য গম, চামড়া, বস্ত্র, পাট, বরফজাত খাদ্য, চা, সেরামিক দ্রব্য রাশিয়া আমদানি করে থাকে।  অর্থাৎ  বাংলাদেশের একটি ভাল রপ্তানি বাজার  রয়েছে রাশিয়ায়।  ২০২০ সালে বাংলাদেশ প্রায় ৭৯ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রাশিয়া থেকে আমদানি করেছিল; ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে  রাশিয়া বাংলাদেশকে প্রায় ১০০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা করেছিলো। সুতরাং আর্থিক ক্ষেত্রে  বোঝাপড়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। কিন্তু এই বিষয়টিকে  স্বল্প গুরুত্ব দিয়ে দেখা ঠিক  নয়।  রাশিয়ার বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মারিয়া জাকারোভা দাবী করেন আমেরিকার চাপেই বাংলাদেশ নতি স্বীকার করে রুশ জাহাজকে বন্দরে প্রবেশ করতে দেয়নি। আমেরিকার স্বার্থ এক্ষেত্রে কাজ করছে কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণে বাংলাদেশের উচিত স্বাধীনভাবে কাজ করা ।    তাছাড়া পারমাণবিক প্রকল্পগুলির দিকেও আমেরিকার নজর আছে । যাইহোক এক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা ছিল যথেষ্ট প্রশংসনীয় এবং বৃহৎ শক্তিধর দুটি রাষ্ট্রের পারস্পরিক বিবাদের মধ্যে থেকে বাংলাদেশকে তারা পুরোটাই স্বস্তি দিতে পেরেছে যা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর পক্ষেও অত্যন্ত ইতিবাচক। অর্থাৎ  মার্কিন  যুক্তরাষ্ট্রের চাপকে উপেক্ষা করেই ভারতবর্ষ  পরমাণুকেন্দ্রের এসব সরঞ্জাম হলদিয়া বন্দরে নামানোর  অনুমতি দেয় এবং যা স্থলপথে পুনরায় বাংলাদেশে পৌঁছে দেওয়া হয়।  অর্থাৎ ভারতীয় ট্রানজিটের সুফল পেল বাংলাদেশ।  অন্যথায় বিষয়টি আরও জটিল হতো । রাশিয়ার পক্ষ থেকে  মস্কোর ঢাকা এমব্যাসী  থেকে রাষ্ট্রদূত কামরুল ইসলামকে ডেকে কড়া বার্তা  দেওয়া হয়েছে।  রাশিয়া জানিয়েছে এরকম পদক্ষেপ রুশ-বাংলাদেশ  বন্ধুত্বের জন্য একেবারেই শুভ ইঙ্গিত নয় । ঐতিহাসিক কারণে এবং বাস্তবতার নিরিখে দুই দেশের বন্ধুত্বের সম্পর্ক এক্ষেত্রে ধাক্কা খাবে। বাস্তবিকভাবেই  বর্তমান সরকার গত ১৬ই জানুয়ারী বাংলাদেশে ৬৯টি রুশ জাহাজ প্রবেশে নিষেধ জারী করেছিল, এখন এটি জাতীয় স্বার্থের কতটা অনুকূলে যাবে তা সময় এলে বোঝা যাবে। পাশাপাশি মার্কিন বা ব্রিটিশ লবির সঙ্গে বাংলাদেশের …

বাংলাদেশ-রাশিয়া সম্পর্কের বর্তমান সংকট ও তিক্ততাঃ গতিপথ কোনদিকে? Read More »

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সামনে একটি বড় সঙ্কট

পূর্ণিমা নস্কর বাংলাদেশের  স্বাধীনতার পূর্বেই পূর্বপাকিস্তানের  রাজনীতিতে শেখ মুজিবুর  রহমান  একজন অবিসংবাদী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তিনি জনগণের আস্থা অর্জন করেন এবং দেশের মানুষের মনে বিশেষ করে পাকিস্তানের পূ্র্বাঞ্চল তথা পূর্ব বাংলার জনগণের মনে প্রভূত আশার সঞ্চার করেছিল। ১৯৭০ সালের ৭ই জুন শেখ   মুজিবুর রহমান যখন বললেন, আসন্ন নির্বাচন হবে ছয়  দফার প্রশ্নে গণভোট; তখন জনগণের মধ্যে তৈরী হওয়া উত্তেজনা ও আশঙ্কা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে পুর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের  মোট ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে আওয়ামি লীগ জয়লাভ করেছিল। ফলে  পাকিস্তানের সরকার গঠনের  প্রশ্নে আওয়ামি লীগই প্রধান দাবিদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হল। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনে শেখ মুজিব যে পাকিস্তানের  প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন — এই ধারণা এবং বিশ্বাস এমনভাবে আন্দোলিত হতে থাকল যে, পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার একটা বাস্তব ভিত  পাকিস্তান রাষ্ট্রে  তৈরি হতে যাচ্ছে। আসলে এটাই ছিল আওয়ামি লীগের রাজনৈতিক সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ।  ছয়দফা দাবীর মধ্যে পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙ্গে আলাদা কোন রাষ্ট্র গঠনের কথা ছিল না। শুধু প্রদেশগুলির অধিকারের কথাই সেখানে প্রধান বিষয়রূপে উপস্থাপন করা হয়েছিল। এইরূপ পরিস্থিতিতে এমতাবস্থায় পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা হবে বলে মানুষের মনে  যে  উচ্চাশা তৈরি হয়েছিল; বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মনে —  তা যে অদূর ভবিষ্যতে বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে – এ বিষয়টি ছিল তখন আলোচনার  বিষয়বস্তু। তদুপরি, পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামি লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের ফল-স্বরূপ আওয়ামি লীগের সমর্থকসহ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণের মধ্যে  যে আবেগ ও উৎসাহ দেখা গেল; তা তাদের  আকাঙ্ক্ষারই একটা প্রতিফলন ।   ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ শেখ মুজিবের ভাষণকে বাংলাদেশের মানুষ ধরেই নিয়েছিল যে এটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণারই নামান্তর।  দেখা যাচ্ছে, ১৯৭০ এর ৭ই ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের মধ্যবর্তী সময়, মাত্র তিন মাস। এত স্বল্প সময়ের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানি  ও পূর্ব পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া রাজনৈতিক জটিলতা, টানাপোড়েন ও  বিশ্বাস  অবিশ্বাসের  বাতাবরণ মোটেই অভিপ্রেত ছিল না। জনগণ এটা একেবারেই আশা করেনি। তারা ছিল আশা-নিরাশার  দোলাচলে ।  মানসিক দিক থেকে বা নীতি আদর্শের প্রেক্ষাপটে মাত্র তিন মাস এতই স্বল্প সময় যে, সাধারণ মানুষের পক্ষে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা  মোটেই সহজ ব্যাপার ছিল না। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানদের দাবী মেনে ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং পাকিস্তানি রাষ্ট্রের তেইশ বছর ইসলামি রাষ্ট্ররূপে পাকিস্তানকে প্রতিষ্ঠা করার যে সার্বিক চেষ্টা অব্যাহত ছিল তারও একটা বড় প্রভাব বাঙালি মুসলমানের  পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাছাড়া সংস্কৃতিগতভাবে বাঙালি মুসলমান পাকিস্তানি রাষ্ট্রে নিজেদের গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল বাঙালি হিন্দুর থেকে একটা পৃথক  জনগোষ্ঠী  (জাতিসত্ত্বা) হিসেবে। অর্থাৎ, দ্বি-জাতিতত্ত্বের বক্তব্য মেনেই। তার কারণ পাকিস্তান গঠণের সময় এই দ্বি-জাতিতত্ত্বই মুসলমান জনগণকে প্রভূতভাবে প্রভাবিত করেছিল। এখন ৭ই মার্চের ভাষণের পর পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমান জনসাধারণের মন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে স্থির করা আওয়ামি লীগ নেতৃবৃন্দ  যত সহজ কাজ ভেবেছিল কিন্তু  ব্যাপারটা তত সহজ ছিল না। দীর্ঘকালের চর্চিত ইসলামী সংস্স্কৃতি এবং পাকিস্তানি আবহাওয়া থেকে বেরিয়ে আসতে তাদের মনে উদ্রেক হওয়া প্রশ্নসমূহের  দিকে ফিরে দেখা যাক।   পাকিস্তানের একটি শক্তিশালী  সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে আওয়ামি লীগের পক্ষে সামরিক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া এবং তার পরিণতি নিয়ে অধিকাংশ মুসলমান জনগণই যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিল। তাদের মনে প্রথম প্রশ্নই ছিল – তাদের সামনে পাকিস্তানি সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে আওয়ামি লীগের লড়াই করার কোন পরিকল্পনা স্পষ্ট ছিল না। দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতা ঘোষণার পরিণতি কি হবে তাও  তারা  অনুমান করতে পারছিল না। কারণ শেখ মুজিবের হাতে কোন সামরিক  বাহিনী বা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর  সাথে লড়াই করার কোন শক্তি যে  নেই তা তারা জানত। তৃ্তীয়ত, মুক্তিযুদ্ধ পরিকল্পনার বিষয়ে আওয়ামি লীগের সঙ্গে  ভারতবর্ষের কোন বোঝাপড়া হয়েছে কিনা ? চতু্র্থত, পাকিস্তানের তেইশ বছর পাকিস্তান সরকারগুলি বা সামরিক শাসককুল বা পাকিস্তানের জনগণ ভারতকে শত্রু দেশ হিসেবে গণ্য করে এসেছে। এটা জনগণের কাছে কোন গোপন বিষয় ছিল না। ১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর থেকে ভারতকে সরকারিভাবে শত্রু দেশরূপে গণ্য করা হত। এখন ভারত কি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দেবে বা সম্পূর্ণ ভারতের উপর নির্ভরশীল  হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ চালান কি সম্ভব?  কারণ আমেরিকা, ইউরোপ ও ইসলামিক দেশগুলির  সমর্থন পাকিস্তানের পক্ষেই ছিল। এ প্রশ্ন মুসলমান জনগণকে দারুণভাবে ভাবিয়ে তুলেছিল। পঞ্চমত, বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষিতে যদি পাকিস্তান গণহত্যা বা crackdown করে তাহলে তা রোধ করা কি আওয়ামি লীগের পক্ষে  সম্ভব হবে ? ষষ্ঠত, যদি দীর্ঘমেয়াদী  সংগ্রামের প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর  বিরুদ্ধে কোন গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি আওয়ামি লীগের আছে কিনা সে বিষয়েও সাধারণ জনগণ সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিল।   এই সমস্ত নানা প্রশ্ন বিশেষ করে বাংলাদেশের  মুসলমান জনসাধারণের সামনে মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ  সম্পর্কে যে অনিশ্চয়তা তৈরি করে ফেলেছিল ; তা থেকে তারা সহজে বের হতে পারেনি। এটা ছিল তাদের কাছে বড় একটা  সঙ্কটপূর্ণ সময়। শেখ মুজিবের ডাকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে কি পড়বে না – এনিয়ে তারা ছিল   দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোলাচলে । তাদের পাকিস্তানি ও ইসলামি  জাতিসত্ত্বা এতটাই প্রবল ছিল, বাঙালি  জাতিসত্ত্বার যে প্রশ্ন শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সামনে  উত্থাপন করেছিলেন; তা মুসলমানদের ইসলামি       জাতিসত্ত্বাকে অতিক্রম করে তাদের মনে তেমন দাগ কাটতে পারেনি।  ফলে আমরা দেখতে পেলাম, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস, পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক সরকার অনেকটাই বাধাহীনভাবে প্রশাসন পরিচালনা ও জনগণের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখতে পেরেছিল। আসলে মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাংলাদেশের বাঙালি জনগণের সামনে একটি বড় সঙ্কট। আর  এই সঙ্কট থেকে এদেশের জনগণ অদ্যাবধি বাঙালি না  বাংলাদেশী পরিচয়ের  আবর্তে  ঘূর্ণায়মান রয়েছেন।   এ থেকে অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন, পাকিস্তানি আন্দোলনের  দ্বিজাতিতত্ত্বের ভূত কি বাঙালি মুসলমানদের এখনও  তাড়া করে চলেছে? নাকি তারা বাঙালি হিন্দুর থেকে আলাদা আইডেন্টিটি (identity) বজায় রাখার মানসে নিজেদের বাঙালি মুসলমান বলতে  স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে? অথবা বাংলাদেশকে বাঙালি মুসলমানের দেশ হিসেবেই প্রতিষ্ঠা করার  প্রবল ইচ্ছা  এই মানসিকতার পিছনে কাজ করে ?  

বাংলাদেশি মুসলমান সমাজ কোন পথে ?

বিমল প্রামানিক বিশিষ্ট  বাঙালি চিন্তক জনাব আহমদ ছফা  তার বাঙালি মুসলমানের মন ১  পুস্তকে বঙ্গসমাজ এবং মুসলমান বিষয়ে যে আলোচনার  অবতারণা  করেছেন সে বিষয়ে একটু আলোকপাত করা যেতে পারে। ‘বাঙালি মুসলমান বলতে যাদের বোঝায়, তারা মাত্র দুটি আন্দোলনে সাড়া দিয়েছিলেন এবং অংশ গ্রহণ করেছিলেন। তার একটি তিতুমীরের অনুসারীদের দ্বারা পরিচালিত ওয়াহাবি আন্দোলন। অন্যটি হাজি দুদুমিঁয়ার ফারায়েজি আন্দোলন। এই দুটি আন্দোলনেই মনে প্রাণে অংশ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু উচু শ্রেনীর মুসলমানেরা এই আন্দোলনের সমর্থন করেছেন তার কোন প্রমান পাওয়া যায় না। আসলে কৃষক জনগণই ছিলেন এই আন্দোলন দুটির হোতা।  আধুনিক কোন রাষ্ট্র কিম্বা সমাজদর্শন এই আন্দোলন দুটিকে চালনা করেনি। ধর্মই ছিল একমাত্র চালিকাশক্তি। … এই আন্দোলন দুটি ছাড়া অন্য প্রায় সমস্ত আন্দোলন হয়ত উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে,  নয়তো হিন্দুসমাজের উদ্যোগে এবং কর্মপ্রয়াসের সম্প্রসারণ হিসেবে মুসলমান সমাজে ব্যাপ্তিলাভ করেছে।  সমাজের মৌল ধারাটিকে কোন কিছুই প্রভাবিত করেনি। তার ফলে প্রাগৈতিহাসিক যুগের আদিম কৃষিভিত্তিক কৌমসমাজের  মনটিতে একটু রঙ-টঙ লাগলেও কোন রূপান্তর বা পরিবর্তন হয়নি। … বিংশ শতাব্দীতেও এই মনের বিশেষ হেরফের ঘটেনি।  বাঙালি মুসলমানের রচিত কাব্য সাহিত্য –দর্শন- বিজ্ঞান পর্যালোচনা করলেই এ সত্যটি ধরা পড়বে। কোন বিষয়েই তারা উল্লেখ্য কোন মৌলিক অবদান রাখতে পারেননি। সত্য বটে, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমুদ্দিন প্রমুখ কবি কাব্যের ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন ।  একটু তলিয়ে দেখলেই ধরা পড়বে, উভয়েরই রচনায় চিন্তার চাইতে আবেগের অংশ অধিক। তাছাড়া এই দুই কবির প্রথম পৃষ্ঠপোষক গুণগ্রাহী ছিল হিন্দু সমাজ,  মুসলমান সমাজ নয় ।    মুসলমান সাহিত্যিকদের রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল হয়ত চর্বিত চর্বন নয়তো ধর্মীয় পুর্নজাগরণ । এর বাইরে চিন্তা, যুক্তি ও মনীষার সাহায্যে সামাজিক dogma বা বদ্ধমতসমূহের অসারতা প্রমাণ করেছেন, তেমন লেখক কবি মুসলমান সমাজে আসেননি।  বাঙালি মুসলমান সমাজ স্বাধীন চিন্তাকেই সবচেয়ে ভয় করে। তার মনের আদিম সংস্কারগুলো কাটেনি। … অনেক কিছুরই সে সংবাদ জানে, কিন্তু কোন  কিছুকে চিন্তা দিয়ে, যুক্তি দিয়ে, মনীষা দিয়ে আপনার  করতে জানে না।‘২ স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র নিয়েও জনাব ছফার চিন্তা আলোচনার দাবি রাখে। ‘ইতিহাসে বিশ-ত্রিশ বছর কোন দীর্ঘ সময় নয়।  বাঙালি মুসলমান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্র  যন্ত্রটি প্রতিষ্ঠা করেছে সে রাষ্ট্রের সংকটের অন্ত নাই, কোথায়ও কোন দিক-নির্দেশনার চিহ্ন পরিদৃশ্যমান নয়। সামাজিক সভ্য এবং ধর্মীয় কুসংস্কার সাম্প্রতিককালে  এমন প্রচণ্ড আকার নিয়ে দেখা দিয়েছে, অনেক সময় মনে হয় এই জাতি মেরুদণ্ডের উপর থিতু হয়ে কোনদিন দাঁড়াতে পারবে না।  মধ্যযুগীয় ভূত এই জাতিকে এমনভাবে আষ্টে-পৃষ্টে বেঁধে রেখেছে তার নাগপাশ কখন কিভাবে ছাড়াতে পারবে এমন কথা একরকম চিন্তা করাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান   অস্থিরতা এবং মধ্যযুগীয় ধর্মীয়  বদ্ধমতের পুনরুত্থানের একটি কারণ আমি নির্দেশ করতে চাই।  শুরু থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নেতৃ্ত্বে যে দলটি গিয়েছিল তার আদর্শিক বৃত্তটি বিশ্লেষণ করলেই সেটি ধরা পড়বে।  আওয়ামি লীগ বাংলাদেশের  মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে। অন্যান্য দলও স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছে।  কিন্তু আওয়ামি লীগের ভূমিকাটি যে প্রধান তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই  আওয়ামি লীগের কি পরিচয়? আওয়ামি লীগের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা ভাষানী ছিলেন আসাম মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী  নিখিল  বঙ্গ মুসলিম লিগের প্রেসিডেন্ট এবং শেখ মুজিবুর রহমান নিখিলবঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। সুতরাং একথা বলা একটুও অযৌক্তিক হবে না যে, মূলত আওয়ামি লীগ মুসলিম লীগের একটা অংশ ।  পাকিস্তানের সঙ্গে বাস করে তাদের ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারছিল না বলে আওয়ামি লীগকে শেষ পর্যন্ত বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সূচনা করতে হয়েছিল। …” ৩  আওয়ামি লীগ যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু করেছিল তার স্বপক্ষে কিছু দূর্বল যুক্তি অবশ্যই উপস্থাপিত করা যেতে পারে, কিন্তু এই আন্দোলনের মধ্যে যে বাঙালির স্বাধীনতার একটা আকাঙক্ষা ফুটে উঠেছিল – একজন মুক্তিযোদ্ধা* হিসেবে কিছুতেই আমি এটা অস্বীকার করতে পারব না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর  থেকে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পর্যন্ত বাঙালি যুব সমাজের অধিকাংশ যেভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নে  আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল – তার প্রমান পাওয়া গেল যখন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার  সংখ্যা মাত্রা ছয় মাসের মধ্যে লক্ষাধিক ছাড়িয়ে গেল। শত প্রতিকূলতা সত্বেও  পূর্বপাকিস্তানের একটা বড় সংখ্যক গ্রামীন সাধারণ মুসলমান মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতা ও খাদ্য যুগিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এগিয়ে এসেছিলেন – তা কখনও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বলে  অভিহিত করা চলে না । স্বাধীনতার আকাঙক্ষা ব্যতিরেকে  শত শত  মুক্তিযোদ্ধা নিঃশেষে প্রাণদান করতে পারত না। অনেক মুক্তিযোদ্ধার পরিবার পরিজন পাকিস্তানি দালাল, রাজাকার ও সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হলেও তারা শেষ পর্যন্ত  লড়াই চালিয়ে গেছে এবং বিজয়ী হয়েছে। এটাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস না বললে ইতিহাসের অপলাপ হয় ।  জনাব আহমদ ছফার মতে, শেখ মুজিব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য  হয়েছিলেন সে বিষয়ে একটু  আলোচনা করা উচিত বলে মনে হয়। যেদিন বাংলাদেশ প্রবাসী  সরকার মুজিবনগরে শপথ গ্রহণ করলো ১৭ এপ্রিল ১৯৭১,  সে দিনটি মাত্র  ২৫ মার্চ  থেকে ২২ দিন পর। যে সমস্ত বুদ্ধিজীবীগণ, আমলাবৃন্দ  বা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ঐ সময়ের মধ্যে ভারতে পৌঁছুতে পেরেছিলেন বা তার কিছুদিনের মধ্যে প্রবাসী সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের প্র্তি  সমর্থন দান বা সক্রিয়  অংশগ্রহণ করেছিলেন তার সংখ্যা নগণ্য বললে ভূল বলা হয় না। তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের বাঙালি  রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী সমাজের অধিকাংশই একথা বিশ্বাস করতেন যে ইসলামি পাকিস্তান ভেঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের নামে যে আন্দোলন – সেটা বিচ্ছিন্নতাবাদ ছাড়া আর কিছু নয়। জনাব আহমদ ছফা সাহেবও তাই করবেন এটা অস্বাভাবিক  ছিল না। তদুপরি পূর্বপাকিস্তানের মুসলমানগণ পাকিস্তানের মতোই ভারতকে শত্রু হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত ছিল। সেই ভারতের সাহায্যে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হতে পারে তা কি বাঙালি মুসলমান মনেপ্রাণে কখনোও বিশ্বাসযোগ্য বলে ভাবতে পারত? যখন তাদের চোখের সামনে লক্ষ  লক্ষ বাঙালি হিন্দুর বাড়িঘর লুট হতে থাকল, বেদখল হল, ভস্মীভূত হল, মা-বোন ধর্ষিত হয়ে গেল – শুধুমাত্র প্রাণ রক্ষার তাগিদে প্রায় নব্বই লক্ষ হিন্দু বাঙালি ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হল, লক্ষ লক্ষ নিহত হয়ে গেল – তখন মুসলমান  বুদ্ধিজীবীরা কি তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন না তাদের রক্ষা করার জন্য পাকিস্তানের কাছে কোন দাবি জানিয়েছিলেন? ১৪ ডিসেম্বর বাঙালি বুদ্ধিজীবী গণহত্যা দিবস পালিত হয়।  যখন পাকিস্তান বাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গেছে। ৩ ডিসেম্বর ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু হয়েছে । ভারত ও প্রবাসী সরকারের যৌথ বাহিনী ঢাকা দখলের জন্য এগিয়ে যাচ্ছে, তখন বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা কাদের ভরসায়, কাদের নিরাপত্তার আশ্বাসে নিশ্চিত হয়ে ঢাকায় বসবাস করছিলেন?  এতে  স্বাভাবিকভাবেই মনে হয়, শেষ পর্যন্তও তারা পাকিস্তানের প্রতি বিশ্বাস হারাননি।   তিনি আরও লিখেছেন, “এই আওয়ামি লীগের আন্দোলন যতটা বেগ এবং আবেগ সঞ্চয় করেছে সমাজের  সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের নেতৃত্ব কবুল করে নিয়েছিল। কিন্তু সমাজের ভিতর  তারা কোন নতুন মূল্যচিন্তার জন্ম দিতে পারেনি; নতুন সংস্কৃতি নির্মান করতে পারেনি। তারা সেক্যুলারিজমের নীতিকে শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের অভ্যুত্থানের পর শেখ মুজিব সপরিবারে যখন নিহত হলেন তখন আর অনেকদিন পর্যন্ত আওয়ামি লীগ শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি।  মূলত আওয়ামি লীগই একমাত্র দল যারা আমাদের জনগণের ঐতিহাসিক সংগ্রামের উত্তাপ থেকে জন্ম নিয়েছে …

বাংলাদেশি মুসলমান সমাজ কোন পথে ? Read More »

বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের সম্পর্ক

বিমল প্রামানিক বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের সম্পর্ক আর পাঁচটা দেশের মতো নয়। যেহেতু ভারত বিভাজনের প্রাক্কালে  বাংলাও বিভাজিত হবে এ বিষয়টি পূর্ববর্তী সময়েই নির্ধারিত হয়ে যায়। বাংলার রাজনীতি, বাংলার সমাজ এমনকি বাংলার সংস্কৃতি পর্যন্ত বিভাজনের শিকার হয়। কেন এমনটা হয়েছিল তা পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশের ইতিহাস পড়ে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে না। এর পিছনে রয়েছে মুসলমান দেশগুলির ইতিহাস চর্চার দৃষ্টিভঙ্গি। সব সময়ই তারা ধর্মের সঙ্গে ইতিহাসের মিশেলের উর্দ্ধে উঠতে পারে না, এর প্রধান কারণই হচ্ছে ক্ষমতাশীন সরকার এবং সমাজ – যেখানে ইতিহাসবিদ অসহায়; সেখানে ইতিহাস চর্চার কোন নিরপেক্ষতার অবকাশ নেই।  এ বিষয়টি গত স্বাধীনতা পরবর্তী পঁচাত্তর বছরের কঠিন বাস্তবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত  হিসেবে আমরা দেখতে পাচ্ছি। আরও একটি বিষয় গত পঞ্চাশ  বছরের বাংলাদেশি সমাজে প্রকট হয়েছে। যে সমস্ত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং উৎসব আবহমান বাঙালি সংস্কৃতি হিসেবে বাংলার গ্রামেগঞ্জে দৈনন্দিন জীবন যাত্রায় অঙ্গ হিসেবে গত কয়েক শতাব্দীকাল মেহনতি মানুষের চিত্ত বিনোদন করে এসেছে – তা মাত্র কয়েক বছরে মানুষের জীবন থেকে  কিভাবে উধাও হয়ে গেল বা কেন তার প্রয়োজনীয়তা  আর অনুভূত হ্য় না – তা নিয়ে কী আদৌ আমরা  চিন্তিত ? যাত্রাগান, কবিগান, পালাগান, জারী, সারি, লোকগান, প্রভৃতি ছিল গ্রামীন জীবনের ঐতিহ্য তদুপরি, দেহতত্ত্বমূলক ফকিরি বা বাউল গান – যারা ছিল পৃষ্ঠপোষক বা শিল্পী তারাও সামাজিক চাপে  হারিয়ে যেতে বসেছে।  তার স্থান পূরণ করছে গ্রামে গ্রামে ধর্মীয় ওয়াজ মাহফিল। যার পিছনে রয়েছে অর্থ-বিত্ত এবং সামাজিক-রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা। বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব নাসিরুদ্দিনের ইউসুফের ভাষ্য মত, শহুরে থিয়েটার আজ মৃতপ্রায়। সরকারি অসহযোগিতা ও সামাজিক প্রতিকুলতা এই মৃত্যু আরও ত্বরান্বিত করছে। আমরা যদি পিছনে ফিরে তাকাই, তাহলে সামাজিক অগ্রগতির কয়েকটি দিক কিছুতেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না। তা হলো বৃটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা লড়াই এর ময়দানে জেল-জুলুম, ফাঁসি অত্যাচারের শিকার হলো –স্বাধীনতা- উত্তর কালে তারা সমাজে বা রাষ্ট্রে কী প্রতিষ্ঠা পেল – প্রকৃ্তপক্ষে তারাই প্রতিষ্ঠা পেল যারা বৃটিশদের সহযোগী বা সাহায্যকারী  হিসেবে কাজ করে অর্থবিত্ত –শিক্ষা দীক্ষায় অগ্রণী হয়েছিল। আর বিভক্ত পূর্ববঙ্গে হিন্দু স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নাম মুসলিম শাসনে একেবারেই চাপা পড়ে গেল। আর বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে বলতে গেলে শাসকদের ইতিহাস বললেই যথাযথ বলা হয় । শাসকের সাথে সাথে  ইতিহাসের পরিবর্তন।  ভারতের ইতিহাসকেও এক কথায় এর অন্যথাচারণ বলা যাবে না। শেখ মুজিব ইতিহাসের এই গতি-প্রকৃতি বুঝেই পাকিস্তানি কোলাবরেটর (collaborator)  তথা দালাল বা সহযোগিরূপে কর্মরতদের  ১৯৭৪ সালে সাধারণ ক্ষমার আওতায় নিয়ে আসেন।  উনি কোটি কোটি মুসলমানদের শাস্তির মুখে দাঁড় করাতে পারতেন না, যারা তাঁর আত্মীয়স্বজন, এক সময়ের সহকর্মী, যারা তাকে ১৯৭০ সালে বিপুল ভোট দিয়ে পাকিস্তানি ক্ষমতার আসনে বসাতে চেয়েছিলেন।  এটাই বাংলাদেশের প্রকৃ্ত ইতিহাস। এবার আসি বাংলাদেশ এবং ভারতের জনগণের সম্পর্কের ক্ষেত্রগুলিতে।  বিশেষভাবে বলতে হবে বঙ্গ বিভাগের ফলে যে বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যার প্রত্যাবাসন ঘটেছে পূর্ব এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভারতে ও পাকিস্তানে তার নিরসন ১৯৭১ সালেই হয়ে গেল বলে অনেকে ভেবেছিলেন – কিন্তু হয়নি। পূ্র্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশ থেকে হিন্দু মাইগ্রেশন (migration) বন্ধ তো হয়ই নি উপরোক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে ভারতে মুসলমান অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে।  এর পিছনে  অনেক কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে। ঐসব কারণে ভারতে NRC এবং  CAA এর  মতো  আইন চালু হয়েছে ।  এতে দু’দেশের জন সম্পর্কের অস্বাভাবিকতা বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যে সকল দূর্বলতা ও অনৈতিকতার ফলে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি রোগী ভারতে এসে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছেন বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসা-কেন্দ্রগুলিতে – তাতে হাসপাতাল এবং ডাক্তারগণ আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন বটে, বাংলাদেশি রোগীগণও উপকৃ্ত হচ্ছে বলা যায় আর্থিক এবং সুচিকিৎসা উভয়ক্ষেত্রে,  এক্ষেত্রে জনগণের সম্পর্ক অধিকতর মজবুত হচ্ছে। আর একটি বিষয়ে আমরা নজর দিতে পারি। তা হলো বাংলাদেশি এবং পশ্চিমবঙ্গের বই বিভিন্ন মেলায়  বিপণনের ব্যবস্থা।  আমরা দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছি কলকাতা বইমেলা ছাড়াও বাংলাদেশি বই প্রকাশকদের  কলকাতায় আলাদা একটি  “ বাংলাদেশি বইমেলা” করা হয়ে থাকে। কলকাতার পাঠকরা বাংলাদেশি লেখকদের বই পড়ার যেমন সুযোগ পায় প্রকাশকরাও  ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হয়। অথচ কলকাতার বাংলা প্রকাশকরা বাংলাদেশের  কোন মেলায় তাদের বই প্রদর্শন  এবং  বিক্রয় করার কোন সুযোগ পায়না। এটা যদি ভারত সরকার বা বাংলাদেশ সরকারের কোন অঘোষিত নীতি হয়ে থাকে – তবে  এই বৈষম্যমূলক নীতির অবসান হওয়া বাঞ্ছনীয়। বাঙালির চিন্তা ও মেধার বিকাশ কয়েকশো বছর ধরে এই অঞ্চলের বাংলাভাষী জনগণকে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছে সেটা রুদ্ধ করার চেষ্টা আত্মঘাতী প্রচেষ্টার  সামিল বৈকি? কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলাদেশের সরকার বাঙালি হিন্দু লেখকদের প্রবন্ধ, কবিতাসহ অন্যান্য লেখা বাংলাদেশের স্কুল সিলেবাস থেকে বাদ দিয়ে যে সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানি ইসলামি মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে তাকে মোটেই সমর্থন করা যায় না। যারা আবার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে নিজেদের  পরিচয় দিয়ে থাকে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতির অবারিত দ্বার রুদ্ধ করা একটা আত্মঘাতী জাতির লক্ষণ। বই বিপণনে বাধা দিয়ে ভারতীয় তথা কলকাতার প্রকাশকদের ব্যবসা বন্ধ করার চেষ্টা শুধু নিন্দনীয়ই নয় এতে ক্ষতি হচ্ছে বাংলাদেশের বাঙালি পাঠকদের।  বাংলাদেশের পাঠকদের সাহিত্য- সংস্কৃতির অমূল্য-ভান্ডার থেকে বঞ্চিত রেখে তাদের বাংলাভাষা ও সাহিত্যের  বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবাধ বিকাশের সুযোগ না দেওয়া বাঙালি জাতিকে শুধু মৌলবাদের দিকেই ঠেলে দেবে না, ভবিষ্যৎ প্রগতিও রুদ্ধ করবে। বাংলাদেশি বই ব্যবসায়ীদের ভারতীয় বাংলা বই বাংলাদেশের বাজারে অবাধ বিক্রয়ের  বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে তা থেকে একথা না বলে উপায় নেই যে, তাদের অধিকাংশের মন- মানসিকতায় এখনও সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানি যুগের অন্ধকার থেকে বাংলাদেশের মুক্ত অঙ্গনের আলোর ছোঁয়া লাগেনি। শুধু ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ই নয় সরকারের ভূমিকাও নেতিবাচক। “জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এন সি টি বি)  কর্তৃক অনুমোদিত পাঠ্যপুস্তকগুলোতে যে ভূল ও তথ্য-ইতিহাস  বিকৃতির ছড়াছড়ি, একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, এটি তিন ধরণের। এক, বানান ও তথ্যগত বিকৃতি; দুই, বাক্য গঠনে ভূলঃ তিন, মৌলবাদ ও সাম্প্রাদায়িক মনোবৃত্তির অনুপ্রবেশ  ঘটানো।  এক ও দুই নম্বরের ভুলগুলো সঠিক পরিকল্পনা এবং সুষ্ঠু  ব্যবস্থাপনার  অভাবে হতে পারে। কিন্তু তৃতীয় ভুলটি  পরিকল্পিত এবং যারা করেছেন, তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই একটি সাম্প্রদায়িক জাতি রাষ্ট্র গঠনের জন্য এই কাজটি করে চলেছেন।“১ তথ্যঃ ১) প্রসঙ্গ কথা, পাঠ্য পুস্তকে সাম্প্রদায়িকী-করণ  -– বাদ দেওয়া হয়েছে যেসব লেখা, বাংলাদেশ  ঊদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ২০১৭,  ঢাকা।