বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের সম্পর্ক
বিমল প্রামানিক বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের সম্পর্ক আর পাঁচটা দেশের মতো নয়। যেহেতু ভারত বিভাজনের প্রাক্কালে বাংলাও বিভাজিত হবে এ বিষয়টি পূর্ববর্তী সময়েই নির্ধারিত হয়ে যায়। বাংলার রাজনীতি, বাংলার সমাজ এমনকি বাংলার সংস্কৃতি পর্যন্ত বিভাজনের শিকার হয়। কেন এমনটা হয়েছিল তা পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশের ইতিহাস পড়ে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে না। এর পিছনে রয়েছে মুসলমান দেশগুলির ইতিহাস চর্চার দৃষ্টিভঙ্গি। সব সময়ই তারা ধর্মের সঙ্গে ইতিহাসের মিশেলের উর্দ্ধে উঠতে পারে না, এর প্রধান কারণই হচ্ছে ক্ষমতাশীন সরকার এবং সমাজ – যেখানে ইতিহাসবিদ অসহায়; সেখানে ইতিহাস চর্চার কোন নিরপেক্ষতার অবকাশ নেই। এ বিষয়টি গত স্বাধীনতা পরবর্তী পঁচাত্তর বছরের কঠিন বাস্তবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা দেখতে পাচ্ছি। আরও একটি বিষয় গত পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশি সমাজে প্রকট হয়েছে। যে সমস্ত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং উৎসব আবহমান বাঙালি সংস্কৃতি হিসেবে বাংলার গ্রামেগঞ্জে দৈনন্দিন জীবন যাত্রায় অঙ্গ হিসেবে গত কয়েক শতাব্দীকাল মেহনতি মানুষের চিত্ত বিনোদন করে এসেছে – তা মাত্র কয়েক বছরে মানুষের জীবন থেকে কিভাবে উধাও হয়ে গেল বা কেন তার প্রয়োজনীয়তা আর অনুভূত হ্য় না – তা নিয়ে কী আদৌ আমরা চিন্তিত ? যাত্রাগান, কবিগান, পালাগান, জারী, সারি, লোকগান, প্রভৃতি ছিল গ্রামীন জীবনের ঐতিহ্য তদুপরি, দেহতত্ত্বমূলক ফকিরি বা বাউল গান – যারা ছিল পৃষ্ঠপোষক বা শিল্পী তারাও সামাজিক চাপে হারিয়ে যেতে বসেছে। তার স্থান পূরণ করছে গ্রামে গ্রামে ধর্মীয় ওয়াজ মাহফিল। যার পিছনে রয়েছে অর্থ-বিত্ত এবং সামাজিক-রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা। বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব নাসিরুদ্দিনের ইউসুফের ভাষ্য মত, শহুরে থিয়েটার আজ মৃতপ্রায়। সরকারি অসহযোগিতা ও সামাজিক প্রতিকুলতা এই মৃত্যু আরও ত্বরান্বিত করছে। আমরা যদি পিছনে ফিরে তাকাই, তাহলে সামাজিক অগ্রগতির কয়েকটি দিক কিছুতেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না। তা হলো বৃটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা লড়াই এর ময়দানে জেল-জুলুম, ফাঁসি অত্যাচারের শিকার হলো –স্বাধীনতা- উত্তর কালে তারা সমাজে বা রাষ্ট্রে কী প্রতিষ্ঠা পেল – প্রকৃ্তপক্ষে তারাই প্রতিষ্ঠা পেল যারা বৃটিশদের সহযোগী বা সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করে অর্থবিত্ত –শিক্ষা দীক্ষায় অগ্রণী হয়েছিল। আর বিভক্ত পূর্ববঙ্গে হিন্দু স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নাম মুসলিম শাসনে একেবারেই চাপা পড়ে গেল। আর বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে বলতে গেলে শাসকদের ইতিহাস বললেই যথাযথ বলা হয় । শাসকের সাথে সাথে ইতিহাসের পরিবর্তন। ভারতের ইতিহাসকেও এক কথায় এর অন্যথাচারণ বলা যাবে না। শেখ মুজিব ইতিহাসের এই গতি-প্রকৃতি বুঝেই পাকিস্তানি কোলাবরেটর (collaborator) তথা দালাল বা সহযোগিরূপে কর্মরতদের ১৯৭৪ সালে সাধারণ ক্ষমার আওতায় নিয়ে আসেন। উনি কোটি কোটি মুসলমানদের শাস্তির মুখে দাঁড় করাতে পারতেন না, যারা তাঁর আত্মীয়স্বজন, এক সময়ের সহকর্মী, যারা তাকে ১৯৭০ সালে বিপুল ভোট দিয়ে পাকিস্তানি ক্ষমতার আসনে বসাতে চেয়েছিলেন। এটাই বাংলাদেশের প্রকৃ্ত ইতিহাস। এবার আসি বাংলাদেশ এবং ভারতের জনগণের সম্পর্কের ক্ষেত্রগুলিতে। বিশেষভাবে বলতে হবে বঙ্গ বিভাগের ফলে যে বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যার প্রত্যাবাসন ঘটেছে পূর্ব এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভারতে ও পাকিস্তানে তার নিরসন ১৯৭১ সালেই হয়ে গেল বলে অনেকে ভেবেছিলেন – কিন্তু হয়নি। পূ্র্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশ থেকে হিন্দু মাইগ্রেশন (migration) বন্ধ তো হয়ই নি উপরোক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে ভারতে মুসলমান অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। এর পিছনে অনেক কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে। ঐসব কারণে ভারতে NRC এবং CAA এর মতো আইন চালু হয়েছে । এতে দু’দেশের জন সম্পর্কের অস্বাভাবিকতা বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যে সকল দূর্বলতা ও অনৈতিকতার ফলে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি রোগী ভারতে এসে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছেন বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসা-কেন্দ্রগুলিতে – তাতে হাসপাতাল এবং ডাক্তারগণ আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন বটে, বাংলাদেশি রোগীগণও উপকৃ্ত হচ্ছে বলা যায় আর্থিক এবং সুচিকিৎসা উভয়ক্ষেত্রে, এক্ষেত্রে জনগণের সম্পর্ক অধিকতর মজবুত হচ্ছে। আর একটি বিষয়ে আমরা নজর দিতে পারি। তা হলো বাংলাদেশি এবং পশ্চিমবঙ্গের বই বিভিন্ন মেলায় বিপণনের ব্যবস্থা। আমরা দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছি কলকাতা বইমেলা ছাড়াও বাংলাদেশি বই প্রকাশকদের কলকাতায় আলাদা একটি “ বাংলাদেশি বইমেলা” করা হয়ে থাকে। কলকাতার পাঠকরা বাংলাদেশি লেখকদের বই পড়ার যেমন সুযোগ পায় প্রকাশকরাও ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হয়। অথচ কলকাতার বাংলা প্রকাশকরা বাংলাদেশের কোন মেলায় তাদের বই প্রদর্শন এবং বিক্রয় করার কোন সুযোগ পায়না। এটা যদি ভারত সরকার বা বাংলাদেশ সরকারের কোন অঘোষিত নীতি হয়ে থাকে – তবে এই বৈষম্যমূলক নীতির অবসান হওয়া বাঞ্ছনীয়। বাঙালির চিন্তা ও মেধার বিকাশ কয়েকশো বছর ধরে এই অঞ্চলের বাংলাভাষী জনগণকে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছে সেটা রুদ্ধ করার চেষ্টা আত্মঘাতী প্রচেষ্টার সামিল বৈকি? কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলাদেশের সরকার বাঙালি হিন্দু লেখকদের প্রবন্ধ, কবিতাসহ অন্যান্য লেখা বাংলাদেশের স্কুল সিলেবাস থেকে বাদ দিয়ে যে সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানি ইসলামি মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে তাকে মোটেই সমর্থন করা যায় না। যারা আবার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতির অবারিত দ্বার রুদ্ধ করা একটা আত্মঘাতী জাতির লক্ষণ। বই বিপণনে বাধা দিয়ে ভারতীয় তথা কলকাতার প্রকাশকদের ব্যবসা বন্ধ করার চেষ্টা শুধু নিন্দনীয়ই নয় এতে ক্ষতি হচ্ছে বাংলাদেশের বাঙালি পাঠকদের। বাংলাদেশের পাঠকদের সাহিত্য- সংস্কৃতির অমূল্য-ভান্ডার থেকে বঞ্চিত রেখে তাদের বাংলাভাষা ও সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবাধ বিকাশের সুযোগ না দেওয়া বাঙালি জাতিকে শুধু মৌলবাদের দিকেই ঠেলে দেবে না, ভবিষ্যৎ প্রগতিও রুদ্ধ করবে। বাংলাদেশি বই ব্যবসায়ীদের ভারতীয় বাংলা বই বাংলাদেশের বাজারে অবাধ বিক্রয়ের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে তা থেকে একথা না বলে উপায় নেই যে, তাদের অধিকাংশের মন- মানসিকতায় এখনও সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানি যুগের অন্ধকার থেকে বাংলাদেশের মুক্ত অঙ্গনের আলোর ছোঁয়া লাগেনি। শুধু ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ই নয় সরকারের ভূমিকাও নেতিবাচক। “জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এন সি টি বি) কর্তৃক অনুমোদিত পাঠ্যপুস্তকগুলোতে যে ভূল ও তথ্য-ইতিহাস বিকৃতির ছড়াছড়ি, একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, এটি তিন ধরণের। এক, বানান ও তথ্যগত বিকৃতি; দুই, বাক্য গঠনে ভূলঃ তিন, মৌলবাদ ও সাম্প্রাদায়িক মনোবৃত্তির অনুপ্রবেশ ঘটানো। এক ও দুই নম্বরের ভুলগুলো সঠিক পরিকল্পনা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে হতে পারে। কিন্তু তৃতীয় ভুলটি পরিকল্পিত এবং যারা করেছেন, তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই একটি সাম্প্রদায়িক জাতি রাষ্ট্র গঠনের জন্য এই কাজটি করে চলেছেন।“১ তথ্যঃ ১) প্রসঙ্গ কথা, পাঠ্য পুস্তকে সাম্প্রদায়িকী-করণ -– বাদ দেওয়া হয়েছে যেসব লেখা, বাংলাদেশ ঊদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ২০১৭, ঢাকা।