Center For Research In Indo

– Copy

দ্বিজাতিতত্ত্ব ও বাঙালি মুসলমানদের ভবিতব্য

বিমল প্রামাণিক

 

বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার প্রধান প্রবাহ বা ধারা এখনও দ্বিজাতিতত্ত্বের পরম্পরামুক্ত হতে পারছে না এবং আদৌ পারবে কিনা তা গবেষণার বিষয়। আর দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত গড়ে উঠেছে ভারত তথা হিন্দু বিরোধিতার স্তম্ভের উপর, সেখানে মুসলমান জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক-মানবিক উন্নয়নের চেয়েও ভারত তথা হিন্দু বিরোধীতা বরাবরই অগ্রাধিকার পেয়ে এসেছে। যা বাঙালি জাতিসত্তা  বিকাশের প্রধান অন্তরায়। ফলে পাকিস্তানের চব্বিশ বছর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পাঁচ দশক অতিক্রান্ত হলেও বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠীর বৃহদংশ মধুতুল্য ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ কেই আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরে রয়েছে। পূর্বপাকিস্তানের চব্বিশ বছর বাঙালি মুসলমানদের চিন্তন বা দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে কোন সঙ্কট বা সমস্যার সৃষ্টি হয়নি। তখন সরাসরি ভারতকে বলা হতো শত্রু রাষ্ট্র এবং অমুসলমানগণ ছিল রাষ্ট্রের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, যেহেতু পাকিস্তান ঘোষিত ইসলামিক রাষ্ট্র। বিভাজিত রাষ্ট্রের নাগরিকদের দুর্বল স্মৃতি ও সুদীর্ঘকাল অবিভক্ত ভারতে সকল জাতিধর্ম সম্প্রদায় একসঙ্গে বসবাসহেতু  বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে যে একটা পারস্পরিক কার্যকর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল – ধর্মান্তরিত হলেও যার বৈশিষ্ট  একেবারে মুছে ফেলা যায়নি – সেকথা মাথায় রেখেই দেশবিভাগ ও পূর্বপাকিস্তান  কায়েম করার পরপরই ঘনঘন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত করে পূর্বপাকিস্তান থেকে হিন্দু উচ্ছেদ শুধু তরান্বিত করা হল না, বাঙালি মুসলমানদের চাঙ্গা রাখতে এবং কট্টর ভারত ও হিন্দু বিদ্বেষ চাগিয়ে তুলতে কয়েকবার ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেও পাকিস্তানের ধর্মীয় বিকারগ্রস্ত মনোবৃত্তির  পরিবর্তনের কোন লক্ষণ দেখা গেল না। বাঙালি মুসলমান – সাচ্চা মুসলমানে পরিগণিত হওয়ার বিশ্বাসে পাকিস্তান আঞ্চলিক শোষণ ও বৈষম্য  অব্যাহত রাখায় পূর্বাঞ্চল বিচ্ছিন্ন হয়ে ভারতের সক্রিয় সহায়তায় একটি স্বাধীন দেশ গঠিত হল বটে, কিন্তু তার আধেয়’র গুণগত কোন পরিবর্তন দেখা গেল না, এটা বর্তমানেও অপরিবর্তিত বলে মনে করি।

বর্তমান বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তির প্রগলভ-জনদের আলোচনায় একটি কথা বার-বার উঠে আসে – তাহল, বর্তমান মোদী-সরকার ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র করে ফেলেছে বা করতে চাইছে – ফলে বাংলাদেশে ইসলামি মৌলবাদের এত বাড়-বাড়ন্ত। বাংলাদেশী রাজনীতির অঙ্গনে ভারত বিরোধীতার প্রকাশ সাম্প্রতিককালে আলোচনায় এসেছে। বর্তমানে আওয়ামি লিগ পরিচালিত সরকার থাকা ও নির্বাচনে স্বচ্ছতা ব্যতিরেকে ক্ষমতার মসনদে তাদের আরোহণ এটাও একটা ইস্যু। আলোচনা করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের ইতিহাসে একটিও স্বচ্ছ-নিরপেক্ষ ও সর্বজনগৃহীত নির্বাচনের নজির নেই। অর্থাৎ বলা যায়,  বাংলাদেশে এখনও রাজনৈতিক-সামাজিক ও রাষ্ট্র-পরিচালনার ক্ষেত্রগুলিতে গণতন্ত্রের মৌলিক ধারণার চর্চা ও তার প্রয়োগ পাঁচ দশক অতিক্রান্ত হলেও প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছে। এবিষয়টি আলাদা প্রবন্ধে আলোচিত হতে পারে।  বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তি–রাজনীতি ও সামাজিক অঙ্গনে ভারত তথা হিন্দু বিদ্বেষের ভিত্তি তৈরি মূলতঃ ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ ভিত্তিক। বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বের প্রশ্নে ভারতের ভূমিকা ও হিন্দুদের আত্মত্যাগ ইতিহাস থেকে নিশ্চিহ্ন করা না গেলেও বর্তমান বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর বৃহদংশ সেই পাকিস্তানি ভারত বিদ্বেষী মানসিক বিকারগ্রস্ততা থেকে মোটেই মুক্ত হতে পারেনি। এর পশ্চাতে রয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানের চেয়েও সংগঠিত সামরিক-রাজনৈতিক-সামাজিক প্রয়াস – যার বিকট চেহারা ১৯৭৫ সালের ভয়ঙ্কর যুগান্তকারী নৃশংস ঘটনার মধ্যে বিশ্বব্যাপী উন্মোচিত হয়েছিল। এই অমোঘ পরিবর্তন  প্রতিরোধী কোন বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠী আর পাওয়া গেল না।

রাষ্ট্র এবং সমাজের অত্যধিক সংখ্যাধিক্য জনগোষ্ঠী ইতিহাসের চাকা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে অন্ধকারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে। এমনকি আলোকিত জনগোষ্ঠীও  ইসলামি বাংলাদেশে ধর্মান্ধতা দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। শিক্ষা- সংস্কৃতি-রাজনীতি সমাজে ঘোরতর ইসলামিকরণ ও পশ্চাদাভিমুখে যাত্রা চোখের সামনে ঘটলেও তার প্রতিবাদের প্রয়োজন বোধ করে না —  তাদের মনে উদয় হয়, ভারত হিন্দুরাষ্ট্র হয়ে গেছে – ‘মোদি’ হিন্দুত্বের ঝাণ্ডাবাহী। তারা একথা বুঝতে চায় না, ভারত একটি বহুজাতি- বহুধর্ম- বহুসংস্কৃতি- বহুভাষাভাষী  মানুষের দেশ। ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পঁচাত্তর বছরে কোন মিলিটারি বা সামরিক শাসন জারী করতে হয়নি, কোন একনায়কতন্ত্র গেড়ে বসেনি, নিয়মতান্ত্রিকতা মেনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সংবিধান চালু হওয়ার পর থেকে দলমত নির্বিশেষে নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে গত সাত দশকের অধিক সর্বদল গৃহীত নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সরকার গঠিত বা গণতান্ত্রিক শাসন অব্যাহত রয়েছে।  পঁচাত্তর বছর পেরিয়ে গেলেও অত্যধিক সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু বা সনাতন ধর্মাবলম্বী অধিবাসী ভারতীয়গণ নিজেদের রাষ্ট্রকে হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণা করে নাই। সনাতনী হিন্দুদের গণতান্ত্রিক চর্চার বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি ও সহনশীলতার কারণে ভারতে মুসলমান জনসংখ্যা ১৯৫০ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ৯.৮ শতাংশ থেকে বেড়ে  ১৪.৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বৃদ্ধি ৪৩ শতাংশের অধিক। ঐ সময়ে হিন্দু জনসংখ্যা ৮৪.৭ শতাংশ থেকে কমে গিয়ে ৭৮.১ শতাংশে নেমে এসেছে, অর্থাৎ হিন্দু জনসংখ্যার হ্রাস ৭.৮ শতাংশ। গবেষকগণ ধর্মীয় সংখ্যাগুরু জনসংখ্যা হ্রাস এবং সংখ্যালঘু জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি বিষয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখেছেন, “decrease in the  share of the majority population and a consequent increase in the share of minorities suggests that the net result of all policy actions, political decisions  and societal processess is to provide a conducive environment for increasing diversity in the society”.  অপরদিকে পাকিস্তানের জন্মই ইসলামিক রাষ্ট্র হিসাবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বাঙালি মুসলমানের নব্বই শতাংশের অধিক ইসলামিক রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের জন্য মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। ইতিহাসের পাকেচক্রে বাংলাদেশ নামে একটি ভূখণ্ড পরিচিতি পেল বটে, কিন্তু তার আধেয় চারিত্রিক বৈশিষ্টে বাঙালিত্বে উত্তরণ ঘটাতে ব্যর্থ হল। এই ব্যর্থতার প্রক্রিয়া গত পাঁচ দশকের ইতিহাসে ছত্রে ছত্রে বিধৃত রয়েছে। ফলে পূর্ব-পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ধর্মীয় সংখ্যালঘু অমুসলমান, বিশেষতঃ হিন্দু ১৯৫১ সালে ২২ শতাংশে থাকলেও ২০২১ সালে ৮ শতাংশের নীচে নেমে এসেছে। বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তি বা আলোকিত মহলও এই ইতিহাসকে আর  অস্বীকার করতে পারছেন না। বাংলাদেশ ইতিহাসের কালো গহ্বরের দিকে দ্রুত ধাবিত হচ্ছে। ‘বাংলাদেশ ভূখণ্ডে’ বাঙালির ভবিতব্য হিসাবে এটাই কি মেনে নিতে হবে !  

 

তথ্যসূত্রঃ 

Shamik Ravi, Abraham Jose and Apurv Kumar Misra, “Share of Religious Minorities: A  Cross-Country Analysis (1950-2015)”, A  Report by Economic Advisory Council to the Prime Minister, Government of India.

 

 

 

 

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo.

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *