বাংলাদেশে নারী উন্নয়ন
Dr. Kakoli Sarkar যুগের পর যুগ ধরে বাধা–নিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে সতিত্ব, পতিব্রতা ইত্যাদি বিশেষণের ঘেরাটোপ থেকে বাঙালি নারীর জীবনে প্রথম পরিবর্তনের হাওয়া লাগে ব্রিটিশ শাসনের আমলে, অর্থাৎ উনিশ শতকে । তৎকালীন ব্রাহ্ম সমাজে নারীর এই পরিবর্তনের গতি কিছুটা দ্রুতগামী ছিল, হিন্দু সমাজে এই পরিবর্তনের গতি কিছুটা মন্থর ছিল, আর মুসলিম সমাজে ছিল তার থেকেও ধীর গতি সম্পন্ন। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর পাকিস্তান রাষ্ট্রে নারীর জীবনে উন্নতি বিধানের জন্য বিশেষ কোনো পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায় না; ফলতঃ পূর্ব-পাকিস্তানে নারীর জীবনে পরিবর্তন কিছুটা স্থবির হয়ে পড়ে। তার মধ্যেও দুই একটা ঘটনাতে আমরা পূর্ব-পাকিস্তানে নারীদের সচেতনতা লক্ষ্য করি। ভাষা আন্দোলনে এবং মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ (যদিও সংখ্যাটা খুব হাতে গোনা) প্রমাণ দেয় নারী সচেতনতার বিষয়টি। তবে এই সচেতনতা ছিল শিক্ষিত সমাজের নারীদের মধ্যে, যারা তখন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরতা ছিল, (শিক্ষিত সমাজের নারীর সংখ্যাটি পূর্ব-পাকিস্তানের মোট নারীর শতকরা কুড়ি ভাগও ছিল কিনা সন্দেহ)। এই শিক্ষিত সমাজের বাইরে বেশিরভাগ অংশটাই ছিল অশিক্ষিত সমাজ। তাই হাতে গোনা কিছু শিক্ষিত নারী দ্বারা বাংলাদেশে নারী অগ্রগতি উপলব্ধি হবে না। তবে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে আমরা নারীর জীবনে উন্নতির জন্য বিভিন্ন সরকারি কর্মসূচি লক্ষ্য করি। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ তথা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যে সকল নারী অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদের নিয়ে গঠিত হয় মহিলা সংগ্রাম পরিষদ, যা স্বাধীনতা পরবর্তীকালে মহিলা পরিষদ নামে কাজ করতে থাকেন। তবে এই মহিলা সংগ্রাম পরিষদ নারীর পুনর্বাসন, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, উত্তরাধিকার আইন, রাষ্ট্রের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, ধর্মীয় অনুশাসন, ইত্যাদি বিষয়ে কাজ করলেও তাঁরা খুব বেশিদুর অগ্রসর হতে পারেননি। এর কারণ স্বরূপ বলা যায় ধর্মীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তাঁরা আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নেওয়াটাই শ্রেয় মনে করেছেন। আশির দশকের শেষ দিকে নারীর অধিকার প্রসঙ্গে যিনি ব্যাপক আলোড়ন তুলেছেন, বিতর্কিত হয়েছেন এবং নন্দিত ও নিন্দিত হয়েছেন, তিনি তসলিমা নাসরিন। তিনি সমাজ এবং ধর্মীয় ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে নারীর উপর ঘটা বিভিন্ন বৈষম্যমূলক আচরণ অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেন। তবে তসলিমা নাসরিনের একটি সাহসী পদক্ষেপ হলো নারীর যৌন-জীবন নিয়ে কথা বলা। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন ধর্মীয় অনুশাসনে যেভাবে নারী নির্যাতনের একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে তিনি তার স্পষ্ট চিত্র উপস্থাপন করেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বিভিন্ন ধর্মীয় ভাবনার মূলে আঘাত হানেন। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখান, নারী নির্যাতনের কি কি কৌশল সেখানে অবলম্বন করা হয়েছে। বাংলাদেশের মুসলমানরা তাদের কোরান, হাদিসের সমালোচনা মেনে নিতে পারেনি, তারা তসলিমার বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ আন্দোলন গড়ে তোলে। যার পরিপ্রেক্ষিতে তসলিমাকে বাংলাদেশ ত্যাগ করতে হয়। যদিও তিনি নারী প্রসঙ্গে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মকেও আক্রমণ করেছিলেন, কিন্তু একমাত্র ইসলাম ধর্ম ছাড়া আর কেউই তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন করেনি। এই প্রেক্ষিতে উপলব্ধি হয় যে, বাংলাদেশে মুক্তচিন্তা করা তথা বৈষম্যমূলক ধর্মীয় ভাবনায় আঘাত হানা অত্যন্ত কঠিন কাজ। নারী অগ্রগতির ব্যাপারে বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের সদিচ্ছা এবং প্রচেষ্টা থাকলেও বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ধর্মীয় মৌলবাদ এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব। নারী উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের সদিচ্ছা বিষয়ে একটু আলোকপাত করা যাক। ১৯৭১ সালে দেশটি স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭২ সালে নবগঠিত সংবিধানে নারীর মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়। বিশেষত সংবিধানের ২৮ এর ১, ২, ৩, ৪ নং অনুচ্ছেদে নারী ও পুরুষের সমান মর্যাদা ও সমান সুযোগ সুবিধা প্রদানের অঙ্গীকার করা হয়। ২৮ এর ৪ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, “নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না”। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার সরকারি চাকুরিতে মেয়েদের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে দিয়ে সকল ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ অবারিত করে ১০ ভাগ কোটা সংরক্ষণ করেন। ১৯৭৩ সালে দু’জন নারীকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং ১৯৭৪ সালে একজন নারীকে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক নিয়োগ করা হয়। ৬৫(৩) অনুচ্ছেদে নারীর জন্য জাতীয় সংসদে ৪৫টি আসন সংরক্ষিত করা হয়েছে এবং ৯ অনুচ্ছেদের অধীনে স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান সমূহের উন্নয়নে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে। ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্থানীয় সরকারে তথা ইউনিয়ন পরিষদে তিন জন নির্বাচিত নারী সদস্য হওয়ার বিধান প্রণয়ন করেন। শেখ হাসিনার সরকার কর্তৃক প্রশাসনে সচিব ও জেলা প্রশাসক পদে, পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীতে নারী কর্মকর্তাদের নিয়োগ প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে উপজেলা পর্যায়ে একজন নির্বাচিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদ সৃষ্টি করা হয়। সরকারি কাজে নারীর অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গেজেটেড বা সমপর্যায়ের পদে দশ শতাংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে এবং তৃ্তীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর পদের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ কোটা নির্দিষ্ট রয়েছে। তাছাড়া প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। এমনকি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ নারী সংগঠিত পুলিশ ইউনিট পাঠিয়েছে। নারী উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের আরো বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ আছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত মেয়েদের উপবৃত্তি ও অবৈতনিক শিক্ষা চালু করা। বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা মহিলাদের জন্য ভাতা প্রদান কর্মসূচি, মাতৃত্বকালীন ভাতা, বিত্তহীন নারীর দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি, বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ প্রদান, বিশেষত আয়বর্ধক প্রশিক্ষণ, কৃষি, কম্পিউটার, ইত্যাদির মাধ্যমে নারীকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার চেষ্টা। নারীর মর্যাদা ও অধিকার সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন আইন সংশোধন ও নতুন আইন সন্নিবেশিত হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল যৌতুক নিরোধক আইন, বাল্যবিবাহ রোধ আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০, নাগরিকত্ব আইন (সংশোধিত) ২০০৯ (নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের মাধ্যমে মাতা কর্তৃক সন্তানকে নাগরিকত্ব প্রদানের বিধান সন্নিবেশিত করা হয়েছে)। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি ছাড়াও বিভিন্ন NGO নারী উন্নয়নে বাংলাদেশে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এককথায় বলা যায়, নারী উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপ ইতিবাচক। কিন্তু তা সত্বেও এখনো বাংলাদেশে ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ের হার শতকরা ৫১ ভাগ (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএস ও ইউনিসেফ মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাষ্টার সার্ভে ২০১৯)। তবে এর বেশিরভাগই গ্রামাঞ্চলে। বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হবার কারণে গ্রামাঞ্চলের সব মেয়েরাই প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করে। অনেকে উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। কিছু অংশ অবশ্য উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় না। যারা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তারাও দশম শ্রেণী পাস করতে পারে না, তার আগেই তাদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। গ্রামাঞ্চলে দরিদ্র পরিবারগুলির মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ পরিবারেই ১৩ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। এদের অনেকের বক্তব্য এইরকম,– স্কুলে টাকা দিতে হয় না, কিন্তু টিউশনি পড়তে, বই কিনতে টাকা লাগে। টিউশনি না পড়লে পাশ করতে পারবো না । সেজন্য স্কুলের খাতায় নাম থাকলেও পড়া বন্ধ করে দিয়েছি। আসলে এর পেছনে মূল কারণটি হলো ধর্মান্ধতা এবং সচেতনাতার অভাব তথা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব। গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র পরিবারগুলোর এইসব অপ্রাপ্তবয়স্ক বিবাহিত মেয়েদের মধ্যে তালাকপ্রাপ্তার সংখ্যাও অধিক। বাংলাদেশে তিন তালাকের একটি আইনগত রূপ আছে, কিন্তু কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই সব তালাকপ্রাপ্তা মেয়েরা আইনের সাহায্য নিতে যেত না, তারা কেবল শরীয়তকেই মান্যতা দিত। কিন্তু বর্তমানকালে দেখা যায় তালাকপ্রাপ্তা মেয়েরা আইনের সাহায্য নিতে …